ঘুমন্ত নগরী আলেকজান্দ্রিয়া, মেমফেজ প্রাসাদে সবাই ঘুমোচ্ছে বাদে নতুন আইসিস, টলেমি আওলিসিসের কন্যা সারপেন্ট অফ নাইল, মিশর ক্রীট সাইপ্রাসের দেবী সবুজ নয়না কন্যা মহারাণী ক্লিওপেট্রা। অস্থির পদচারনা তার নিজস্ব কক্ষে। দেওয়ালের স্তিমিত আলোয় তার ছায়া টুকু ও পান্ডুর–
চতুর্দিকে ছড়ানো ইটালিয়ান আয়না সোনার পাতে মোড়া, হাতির দাঁতের মখমলের গদি আটা কুর্সি, অদুরেই সিংহাসন আন্টনিওর প্রিয় রঙ আকাশনীল সিল্কের আবরণ দিয়ে ঢাকা। সারা কক্ষে নীল রঙের লেসের পর্দায় নীলনদের স্বপ্ন লেগে আছে। সব আছে শুধু নেই বিজয়ী সেনাপতি। বদলে আজ অনিশ্চিত আলেকজান্দ্রিয়ার ভাগ্যাকাশ।
-আবার! আবার! ভাগ্য দেবী আমার সাথে খেলছে। কতবার কতবার এই নাটক করে যেতে হবে আমায়! প্রথমে দুই ভাই, তারপর রোমান অধিপতি জুলিয়াস সিজার, রোমান বীর আন্টোনিও এবার আসবে অক্টোভিয়াস, মূঢ় এক বালক! তার মন জয় করতে হবে পৃথিবীর অধিশ্বরী ক্লিওপেট্রাকে! কেন কেন সেদিন আন্টোনিও কে এমন দুর্বুদ্ধি দিলাম! সে তো নৌযুদ্ধে অপরাজেয় নয় জানতাম! কেন অক্টামে হুকুম দিলাম মিশরের নৌবহর প্রত্যাহার করে নিতে! কি করে আন্টোনিও কে ঠেলে দিলাম এমন পরাজয়ের অতল খাদে!! আর কি পারব নতুন করে!
বুক ঠেলে হাহাকার বেরিয়ে এলো, টলেমি কন্যার-
-হিংসা, ক্লিও হিংসা-
-কে! কে ওখানে! ওহ হার্চিমিয়ন!
মূঢ়! বেরিয়ে যা তুই! এখনো লোভ ছাড়িস নি মিশরের সিংহাসনের! টলেমী আওলিসের বংশধর ক্লিওপেট্রা আর বীর জুলিয়াসের পুত্র টলেমী সিজার বেঁচে আছে!
টলেমী সিজার! লোভী নারী! তুই ওই স্বপ্ন দেখ! রোমের অধিপতি অক্টোবিয়াস নিজেকে ছাড়া কাউকে সিজারের উত্তরাধিকারী ভাবে না! না রোম, না মিশর! কিচ্ছু নেই আর তোর। তুই সিজারের রক্ষিতা! আর বীর আন্টোনিও অবৈধ স্ত্রী মাত্র। রোমান সেনেট তোকে বন্দী করে প্রাণদন্ড দেবে!
– রক্ষী! রক্ষী!!! তোকে প্রাণদণ্ড দিলাম এই মুহূর্তে।
-নিয়তি, ক্লিওপেট্রা নিয়তি। তুই প্রাণদণ্ড দেবার কে! কাল থেকে রোমান রাজ অক্টোবিয়াস মিশরের অধিপতি। অক্টামের যুদ্ধে রানী ক্লিওপেট্রা হেরে গেছে। নির্মম ভাবে হারিয়ে দিয়েছে আন্টোনিও কে! তোর ষড়যন্ত্রের জন্যে আজ মিশর, মিশরীয় রা, টলেমির বংশধর রা সব অসহায়, রোমান দের মুঠিতে! কি দোষ করেছিল আন্টোনিও! তাকে নৌযুদ্ধে প্ররোচিত করেছিলি! কেন শেষ মুহুর্তে হেলাদি কে আদেশ দিয়েছিলি নৌসেনা প্রত্যাহার করতে! কেন! কেন!
– চুপ কর বেয়াদপ মুর্খ! আন্টোনিওর পরাজয় অবশসম্ভাবী ছিল! মিশরকে বাঁচাতে অক্টোবিয়াস কে ক্রুদ্ধ করা যেত না! তাই আন্টোনিও কে সরতে হয়েছিল! নয়ত সেই দন্ডে মিশর ধুলিসাৎ হতো!
– মিশর নয়, মিশর নয়! আসলে তুই রোমের উপর আধিপত্য চেয়েছিলি। রোম চেয়েছিলি বলে সিজারকে পাবার জন্যে, নিজের স্বামী ত্রয়োদশ টলেমিকে, সিজার হত্যার পর এক মুহূর্ত দেরী না করে আন্টোনিও কে নিজের প্রলোভনে ফেলেছিলি! আন্টোনিও ফুরিয়ে যেতেই এখন অক্টোভিয়াসকে! অকৃতজ্ঞ লোভী, নিষ্টুর চিত্ত নারী,তোর জন্যে অক্টিভিয়াকে ত্যাগ করেছিল আন্টোনিও, আর অক্টোভিয়াস তার ই ভাই! তুই ভাবলি মাপ করে দেবে তোকে রোমান সম্রাট! সময় আছে ক্লিয়া, মৃত্যু বরন করে নে। দিয়ে দে মিশর তার উত্তরাধিকারীকে! দিয়ে দে!
কে কোথায় আছ! এত বিলম্ব কেন! নিয়ে যাও এই অর্বাচীনকে, বলতে বলতেই ভারি মিশরীয় ফুলদানি ছুঁড়ে মেরে আঘাত করলেন হার্মিচিয়ন কে! নিঁখুত নিশানা তীরন্দাজ শ্রেষ্ঠার। মাটিতে পড়ে গেল ক্লিওপেট্রার খুল্লতাত ভাই টলেমি হার্চিমিয়ন।
মাত্র আর এক রাত, অক্টোভিয়াস আসছে। রোমান পুরুষ বীর হতে পারে,নারীর আসঙ্গলিপ্সা উপেক্ষা করার মত সন্ন্যাসী পুরুষ না! তা ছাড়া অক্টোভিয়ান ফারসালুসকে কথা দিয়েছেন, তাকে রোমে নিয়ে যাবেন সঙ্গে করে! মনে পড়ে গেল তার সিজারের সাথে প্রথম সাক্ষাতের কথা। টলেমি পার্থের চোখ এড়িয়ে দু : সাহসিক সাক্ষাৎকার! না আর ফিরতে হয়নি তাকে, রোমান সেনাপতি তাকে আমৃত্যু গ্রহন করেছিলেন, বয়স্ক জুলিয়াস সিজার ভেসে গেছিলেন বছর তেইশের ক্লিওপেট্রার প্রেমে। দুটি সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার করেছিলেন রোমান সেনেটে দাঁড়িয়ে। যদিও রোমান সেনেট এই অবৈধ সম্পর্ক গ্রহণ করতে পারেনি! রোমান নারী ছাড়া কোন বিদেশী নারী রোমান পুরুষের উপযুক্ত বলে তারা মানেই না।সিজারের হত্যার পেছনে ক্লিওপেট্রা ও কম দায়ী নয়! মিশরের প্রভুত্ব রোমের উপর! এত বড় দু: সাহস রোমান রা মানবে কেন! ভেনাসের মন্দিরে ক্লিওপেট্রার স্বর্ণ মূর্তি! সিজারের হত্যার পরিকল্পনা হলো, সরিয়ে দেওয়া হলো। চিরতরে। ক্লিওপেট্রা টলে গেছিলেন এত বড় আশ্রয় হারিয়ে ফেলে। লক্ষ্য রাখছিলেন রোমের রাজনীতির উপর। তারপর মার্ক আন্টোনিও রোমান প্রধান হলে, সু্যোগ মত নিজেই দেখা করলেন এশিয়ার টারটাসে—
– আপনি কি চান আমার কাছে! সবুজ নয়নাকে দেখে সেই মুহূর্তেই নিজেকে হারিয়ে ছিলেন আন্টোনিও!
– মিশর কে রোমের অধীনে নয়, সাবভৌম দেখতে চাই বীর সেনাপতি !
– আপনি নিশ্চিন্তে রাজত্ব করুন রাজ্ঞী নিজের মত। কথা দিলাম রোম আপনার আগে নয় পাশে পাশে চলবে!
গভীর প্রেমে সৌন্দর্যে বুদ্ধিমত্তায় ভেসে ছিলেন আন্টোনিও। নাইলের বুকে রাতের পর সেই রাত প্রেমে আকুল দুর্বার পুরুষ ! ঈর্ষাপরায়ণ ক্লিওপেট্রা তাকে দিয়ে বিচ্ছেদ করালেন তার স্ত্রী অক্টিভিয়ার সাথে। রাগে দু:খে ক্ষোভে অধীর হলেন ভাই অক্টোভিয়াস সিজার। সাইপ্রাস, কীট গ্রীস সব রাজ্য জয় করে ক্লিওপেট্রার পায়ে সাজিয়ে দিলেন আন্টোনিও ! রাণী উপাধি নিলেন আইসিস! কি বর্ণময় জীবন। দুই সন্তান এলো জীবনে।
– ক্লিয়া, অক্টোভিয়াস যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। সে দ্রুত অক্টাম পৌছবে! ভুমধ্যসাগরে তার রণতরী অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
– এবার আপনিও জলেই যুদ্ধ করুন প্রিয়তম
-সেকি! সবাই জানে আন্টোনিও স্থল যুদ্ধের বীর সেনাপতি।
– আপনি একা নন! মিশরের রণতরী থাকবে আপনার সাথে..সেনাপতি হেলাদিপাউস নৌ যুদ্ধে অপরাজেয় প্রিয়তম
– বুকে জড়িয়ে ধরলেন আন্টোনিও তার চিরকালীন কাঙ্ক্ষিত নারীটিকে।
সব ঠিক ছিল। অক্টামের প্রথম যুদ্ধে হেরে গেলেন যে রাতে আন্টনিও, সেই রাতেই গোপনে ফারসালুস রোম থেকে এসে দেখা করলো ক্লিওপেট্রার সাথে।
– রানী আমি আপনার পুরোনো অনুগত সেবক। রোমের সেনেটে সেনাপতি আন্টোনিও কোন জায়গা আর নেই। অক্টোভিয়াস এখন রোমের প্রধান। এই যুদ্ধে আন্টোনিওর হার নিশ্চিত! আপনি আপনার সেনা নৌবাহিনী প্রত্যাহার করুন! আত্মসমর্পণ করে নিন। নইলে মিশরে সারাজীবন তার স্বাধীনতা হারাবে! সেনেট আপনাকেও নিষ্কৃতি দেবে না।
– আর আন্টোনিও!
– আমার উপর ছেড়ে দিন আইসিস
তারপর দিন রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল রানী ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেছেন, এ কথা শুনে হতভাগ্য প্রেমিক আন্টোনিও যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিজের বুকে তরোয়াল বসিয়ে মৃত্যু বরণ করে নিলেন! নাহ, এত বে রেহেম ক্লিয়া নন! দেখা করতে গিয়েছিলেন। আন্টোনিও সব বুঝেও তার ই কোলে মাথা রেখেছিলেন শেষ মুহুর্তে। ফিরে গিয়েছিলেন রোমে বিজয়ী অক্টাভিয়াস। একমাস বাদে ফিরে আসছেন মিশরে ক্লিওপেট্রার সাথে সাক্ষাৎ করতে
মহিমাময়ী আপনাকে প্রথম দিনের মতই সুন্দর লাগছে। সেই সবুজাভ চোখ, সেই আবেদন । মিশরের নীলনদের মতই নীল স্বচ্ছ কামাতুরা আপনার বস্ত্র! রোমান অধিপতি অক্টোভিয়াস কি মাথা ঠিক রাখতে পারবেন?
– হিল্লোল তুলে হেসে উঠলেন চিরযৌবনা, নীলনয়না ক্ষীনকটি ক্লিওপেট্রা -তাকে তো জিততে হবেই
মেমফিস প্রাসাদ সাজানো হল মনের মতন করে। আলেকজান্দ্রিয়ার নগর দরজায় সুন্দরী নারীরা স্বল্পবাসে সজ্জিত হলো বিজয়ীর অভ্রর্থনায়। স্বর্ণ রথ সাজানো হলো স্বর্ণ বেদিকা ফুল মালায়। আফ্রিদিতির মত ফুলের টিয়ারা মাথার চুলে বেস্টন করে দিলেন ক্লিওপেট্রা।
রোমান বীর অক্টোভিয়াস খোলা তলোয়ার উঁচিয়ে প্রবেশ করলেন আলেকজান্দ্রিয়ায়। মিশরবাসীদের স্তব্ধ করে জয়ধ্বনি তুললো বিজিত রোমান সৈন্যদল।
— মহামান্য রোমান বিজেতা হেলেন অক্টোভিয়াস সিজার, আপনাকে মিশরের রানী টলেমি আওলিসিস ক্লিওপেট্রা অভিবাদন জানাচ্ছে।
সারা শরীরে হিল্লোল তুললেন রানী। অপরূপ শরীরী বিভঙ্গ তার।
নাহ! অক্টোভিয়ান তাকালো না চোখের দিকে। সে জানে ওই চোখ ঘাতকের। রোমের নেমেসিস লিখেছে বারবার। মনে পড়ে গেল জুলিয়াস সিজারের অন্তর্ঘাত! বীর আন্টোনিওর আত্মহনন! আর না! হাঁটুগেড়ে অভিবাদনের জন্যে ক্লিওপেট্রা নিচু হতেই কাঁটা দেওয়া জুতো দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন বুকের সুডৌল বিভাজিকায়! ছিটকে গেল আন্টোনিওর দেওয়া ব্রাজিলের সবুজ পান্নার হার! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে উঠতে না উঠতেই চুলের মুঠি চলে এলো অক্টোভিয়াসের হাতে। তার চোখে ভাসছে দিদি অক্টোভিয়া আর তার দুই সন্তানের নিষ্পাপ মুখ!
-সাপিনী তুই! বীর প্রসবকারিণী রোম কে তুই নি:স্ব করেছিস! কেড়ে নিয়েছিস সন্তানদের পিতাকে! রোমান সেনেট তোকে ক্ষমা করবে না! কুকুরের মত মারবে! হিংস্র ষাঁড়ের মুখে দেবে! রোমের কলোজিয়মে টাঙ্গিয়ে রাখব তোর সুন্দর চেহারার চামড়া খানা!
সজোরে ঠুকে দিলো আন্টিনিও ক্লিওপেট্রার মাথা সেই হাতির দাঁতের কুর্সির হাতলের উপরে।
পরিস্কার দেখতে পেলেন এবার ক্লিওপেট্রা, আন্টনিও হাসছে। সেই হাসি প্রতিফলিত হচ্ছে কক্ষ জোড়া বিশাল বিশাল ইটালিয়ান কাট গ্লাসের আয়নায়-
অক্টোভিয়ান লোহার জুতো পরা পা উপরে তুলতেই তিনি তরিতে অনামিকার হীরের আঙটির মুখ খুলে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলেন ক্ষুদ্রকায় বিষ প্রকোষ্ঠে।
তথ্যসূত্র – হেনরি হ্যাগার্ডস ক্লিওপেট্রা
শেকসপীয়ার -আন্টোনিও ক্লিওপেট্রা
বাংলাদেশ প্রতিদিন
