পাঠপ্রতিক্রিয়া: তিনকন্যার গল্প তবুও সত্যি । আশিস দাস
‘তফাৎ যাও,সব ঝুট হ্যায়,তফাৎ যাও’, বলেছিল মেহের আলী। হতে পারে মেহের আলী ঠিকই বলেছিল, কারন এ পৃথিবীর অনেক কিছুই তো আমাদের কাছে “ঝুট” বলে মনে হয়। আসলে এই পৃথিবীর সবই তো মায়া; এর মধ্যে সত্যের অবস্থান কতটা আর মিথ্যার উপস্থিতি কতটা এ নিয়ে বিস্ময়ের অন্ত নেই ; সুকন্যা,দেবলীনা ও বর্ণালী, এই তিনকন্যার গল্প পড়ে যেন মনে হলো মেহের আলীর মতো আমরাও বিভ্রান্ত,আমাদের ও অনেক সময়ই মনে হয়, “সব ঝুট হ্যায়”,যদিও বাস্তবে অবাস্তবের উপস্থিতি অস্বীকার করা যায় না ; তিন জনের গল্পেই দেশ বিদেশের রূপকথা,উপকথা ইত্যাদি বিষয়ে অনেক কিছু জানা যায়। সুকন্যার “ভক্তের আকুতি” বিশ্বাস অবিশ্বাসের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকা এক গল্প। মানলে মা গঙ্গা না মানলে ‘বহতা নদী’; অবিশ্বাস্য মনে হলেও এ ধরনের কথা লোকসমাজে শোনা যায়। “তারামতির নাচমহল” গল্পে আছে গোলকোন্ডা ফোর্ট-এর ধূসর অতীত কথা। “মৃত্যুদন্ড” গল্পটি খুবই গা ছমছম করা গল্প, মেনে নিতে কষ্ট হয়,তবে লেখিকাকে অবিশ্বাস করা যায় না কারণ তা অন্য সভ্যতার মিথ ঘিরে গড়ে উঠেছে। দেবলীনার “বেলভেডেয়ার হাউস” এক অনবদ্য গল্প ; ন্যাশনাল লাইব্রেরী সম্পর্কে এক সুন্দর উপস্থাপনা এই গল্প ; দেবলীনা গল্পের শেষে Walter De la Mare এর “Listeners” কবিতার উল্লেখ করেছে ; খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই গল্পে “Listeners” কবিতার কথা মনে পড়বে ; একথা তো ঠিকই যে ইহলোক ও মৃত্যুলোকের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান কিন্তু পরলোকবাসীর মধ্যে কি মর্ত্যলোকের জন্যে কোনো টান থাকেনা! দেহটা বিলীন হয় ঠিক ই কিন্তু “মন” এর কি হয় ?? “মন” এর ও কি মরণ হয় ? আমরা জানি না। “মৃত্যু ডাক উজাগর” ও একটি অনবদ্য গল্প ; ‘নিশির ডাক’ নামে এক আতঙ্কের ‘ডাক্’ এর কথা আমরা শুনেছি, দেবলীনার কাছে জানলাম যে এই ধরনের ‘ডাক’ পৃথিবীর আরো অনেক দেশেই শোনা যায় : আয়ারল্যান্ডে এই ‘ডাক’ ই “ব্যানশির ডাক” বলে পরিচিত। ভয়াবহতা,ত্রাস,মৃত্যু এসবের কোনো দেশ কাল নেই ; পৃথিবীর সর্বত্রই এর রূপ এক ; নিজস্ব অভিজ্ঞতার নিরিখে সুন্দর গল্প লিখেছে বর্ণালী; “বিশ্বাসঘাতক” গল্পটি পশ্চিম মেদিনীপুর আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের জীবনের এক বিশ্বাসযোগ্য প্রতিচ্ছবি। আদিবাসী জীবনে যে mystic intervention বা রহস্যের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় তারই এক সুন্দর উপস্থাপনা এই গল্প ; “পঞ্চমুন্ডির আসন” গল্পটি পড়লে জানা যায় যে কোন্ পাঁচ প্রাণীর মাথা ওই আসনে থাকে,এবং কেন থাকে,যা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। বইটা হাতে পেয়ে বেশ ভালোই লাগলো…একটু আঁধো অন্ধকার প্রচ্ছদপট যা গল্পের সাথে সাযুজ্য রেখেই তৈরী….সহজ সরল ভাষায় লেখা বেশ কিছু জটিল বিষয় ; এই গল্প গুলো কম বয়সী ছেলেমেয়ে, যারা খুব অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় আর সত্য অলৌকিকতার সন্ধান করেন, তাদের বেশ ভালো লাগবে। এছাড়া যারা যে কোনো রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে ভালোবাসে তাদেরও এই বই ভালো লাগবে। আধ্যাত্মিক ঘটনা, মন্দির ও মিথ নিয়ে গড়ে ওঠা গল্পগুলি বিশ্বাসী মনকে স্পর্শ করবে। বইটাকে নিছক ভুতের বই ভাবলে একটু ভুল হবে ; আসলে এই মর্ত্যলোকের বাইরেও হয়তো একটা জগত আছে যে জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের সম্যক জ্ঞান নেই ; এই বই সেই জগতেও কিছুটা আলোকপাত করেছে এটা ঠিক। যাই হোক্ “…তবুও সত্যি”, আপাত ভাবে সব কথা সত্যি বলে মনে না হলেও,…তবুও সত্যি একথা স্বীকার করতে হবে। শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ জানাই তিনকন্যাকে।

জন্ম ভাটপাড়ায়। পড়াশুনা আসানসোল, বর্ধমান ও কল্যানীতে। ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করে বি.টি. করেছেন। শিক্ষকতার সাথে যুক্ত। বর্তমানে মহিশিলা হাই স্কুলের হেডমাস্টার। বিভিন্ন বিষয়ে কবিতা, প্রবন্ধ ও আলোচনা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য। বিভিন্ন পেজে ইনি নিয়মিত লেখেন। বইয়ের প্রতি গভীর ভালবাসা। ওনার লেখা পাঠপ্রতিক্রিয়া অনেক পেজেই সমাদৃত হয়েছে।