| 24 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সঙ্গীত

সঙ্গীত: তিন পাগলের হলো মেলা । আবু ইসহাক হোসেন

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

লালনের গান বাঙালির প্রাণ। অন্যভাবে যদি বলি, লালনের গান বাঙালির সত্তা। তাই বাঙালি হিসেবে লালনের গানের ভাষ্যকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা আমাদের কর্তব্য। কিন্তু এটা সত্য যে, লালনের গানের ভাষ্য বেশিরভাগ মানুষই বোঝেন না। লালনকে জানলে, লালন দর্শনকে বুঝলে আমরা আমাদের সঠিক পরিচয় এবং প্রাচুর্যকে বুঝতে পারব। লালনের অনেক জনপ্রিয় গানের মধ্যে একটি হল ‘তিন পাগলের হল মেলা নদে এসে/তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।’ এই গানটির ভেতর দিয়ে লালন একটা মিথ, ইতিহাস ও বাঙালির সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে যুগধর্ম প্রণেতা শ্রী চৈতন্য এবং তার সঙ্গী সাথিদের ইতিহাস ও জীবনযাপন প্রণালী তুলে ধরেছেন। লালন এই তিন পাগল এবং তাদের কীর্তিকলাপ দেখে সমাজের যারা কুলীন, কুলের গৌরবে অন্ধ তাদের সতর্ক করে পাগলের কাছে যেতে নিষেধ করেছেন। গানের ভাষ্যে যাওয়ার আগে গানের সম্পূর্ণ পাঠ তুলে ধরতে চাই।

তিন পাগলের হল মেলা নদে এসে

তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।।

একটা পাগলামী করে

কোল

দেয় জাত অজাতেরে

দৌড়ে এসে

আবার হরি বলে

পড়ছে ঢলে ধুলার মাঝে।।

একটা নারকেলের মালা

তাইতে জল তোলা ফেলা করঙ্গ সে।

পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে।।

পাগলের নামটি এমন

বলিতে ফকির লালন হয় তরাসে

আবার ওদে, নিতে, চৈতে পাগল নাম ধরেছে।

এই গানের ভেতর দিয়ে লালন ভারতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের পথে হেঁটেছেন। সেই ইতিহাসটা কি? এটি সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস। ভারতীয় ধর্ম সংস্কারের ইতিহাস। লালনের উদ্ধৃত গানে যে ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা আমরা বলছি এখন সেটির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। লালন ফকির উপর্যুক্ত গানে শ্রী চৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সমাজে এর প্রভাবের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এই বৈষ্ণব ধর্মের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য কি। বৈষ্ণব মতবাদ হিন্দুধর্মেরই একটি সংস্করিত শাখা। অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের একটি যুগসংস্করণ।

বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ অত্যন্ত গোঁড়া ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল জাতিভেদ প্রথার কবলে পড়ে বিভক্ত হিন্দু সমাজ নানারকম অনৈক্যের মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলেছে, সমাজের কাঠামো পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের কাঠামোতেও এসেছে পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তনের ফলই হচ্ছে হিন্দু ধর্মের অবতারবাদÑ ধর্মের অস্তিত্ব সংকট উত্তরণের একটি সামাজিক উপযোজন। এমনি সামাজিক পরিবর্তনের ফল হিসেবেই হিন্দু ধর্মমতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে বিভিন্ন উপযোজন সাধিত হয়েছে। এই উপযোজনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল বৈষ্ণব ধর্মমত ও রাজা রামোহন রায়ের ব্রাহ্মসমাজ। সমাজের শ্রেণীদ্বন্দ্বের হাত ধরে যখন সমাজে কোনো পরিবর্তন এসেছে যা সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে ধর্মের ওপরেও প্রভাব ফেলেছে, তখন সমাজ কাঠামোর মতো ধর্মীয় চিন্তা-চেতনাতেও একটা সমন্বয়মুখিতা লক্ষ্য করা গেছে। এরই ফলস্বরূপ বৈষ্ণব মতবাদের আবির্ভাব।

লালন ফকির বৈষ্ণব মতবাদ পুরোপুরি গ্রহণ না করলেও এর দার্শনিক দিকটাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছেন, মানতে চেষ্টা করেছেন। বাউল দর্শন দশটি তত্ত্বকে ঘিরে বিকাশ লাভ করেছে। তার মধ্যে গৌরতত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। বাউল দর্শনে গৌরতত্ত্বের এই যে গুরুত্ব তা তার দার্শনিক মূল্যের জন্য এবং জাতপাতকে অগ্রাহ্য করে সব মানুষকে মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস তার কারণে। সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণিকে মানুষ হিসেবে পূর্ণ অধিকারে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার মূল লক্ষ্যটি সামনে রেখেই বাউল দর্শনের উদ্ভব। বাউল দর্শনের মাধ্যমে সমাজের নিগৃহীত, নিপীড়িত মানুষ সমাজে যাদের ন্যূনতম অধিকার ছিল না, না ধর্মে, না সামাজিক কর্মেÑ সেই সব অবহেলিত মানুষগণকে প্রকৃত অর্থেই জীবনের স্বাদ দেয়ার জন্য, তাদের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির স্বাদ এনে দেয়াই বাউল দর্শন উদ্ভবের পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে বলে পণ্ডিতগণের মত। আর সে কারণেই বাউল দর্শন সব দর্শন যা সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির হয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছে তা অকুণ্ঠ চিত্তে গ্রহণ করেছে। তবে এখানে এ কথাটিও মনে রাখতে হবে, তার মানে এই নয় যেÑ বাউল দর্শন সেই সব দর্শনের ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। বাউল দর্শন নানা দর্শন থেকে নির্যাস নিয়ে স্বতন্ত্র দর্শন হিসেবেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বাউল দর্শন তন্ত্র দর্শন, সাংখ্য দর্শন, নাথ দর্শন, বৌদ্ধ সহজিয়া দর্শন, সুফি দর্শন এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন থেকে নির্যাস নিয়েছে বিনা দ্বিধায়। গৌড়িয় বৈষ্ণব দর্শনের সব উপাদান কিন্তু লালন ফকির বা বাউলরা গ্রহণ করেননি। বৈষ্ণব ধর্মের দার্শনিক তত্ত্বের মূল ভিত্তি হচ্ছে রাধা-কৃষ্ণের লীলাতত্ত্ব। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমতত্ত্বের আড়ালে তারা জীব-পরমের দর্শনকে তুলে এনেছেন। তারা রাধাকে জীবাত্মা এবং কৃষ্ণ সত্ত্বাকে পরম আত্মা বা পরম সত্ত্বা কল্পনা করে জীব পরমের অনন্ত লীলার মাধ্যমে এই পৃথিবীকে প্রেমময় রূপে দেখতে চেয়েছেন। আর এই খানটায় বাউলদের ও সুফিদের সঙ্গে বৈষ্ণব তত্ত্বের দারুণ মিল। বাউলেরা সাংখ্য দর্শনের পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্ব গ্রহণ করে নিজেকে প্রকৃতি বা রাধা হিসেবে গণ্য করে আর পরম সত্তাকে তারা কৃষ্ণ হিসেবে গণ্য করে এই দেহে জীব-পরমের অনন্ত লীলার আস্বাদ গ্রহণ করে। বাউলেরা বলে থাকেন, ‘একা কৃষ্ণ পুরুষ আর সবাই প্রকৃতি।’ বৈষ্ণব তত্ত্বে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের ধারাবাহিকতায় গোরা বা শ্রী চৈতণ্যের নদীয়াতে অবতাররূপে আবির্ভাবের কথা স্বীকার করে থাকেন। তাদের বিশ্বাস রাধার প্রেমের দায় শুধতে কৃষ্ণ গৌর বা গোরারূপে আবার নদীয়াতে এসেছিলেন। লালন ফকিরের গানেও এ ইশারা আছে :

রাধা রানীর প্রেমের দায়

গৌর এলো নদীয়ায়

বৃন্দাবনের বলাই কানাই

নদের গৌর নিতাই।”

অর্থাৎ শ্রী চৈতন্যই সেই কৃষ্ণের অবতার । গোরার আবির্ভাবের পরিপ্রেক্ষিত ধর্ম রক্ষা হলেও সেই সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি কাজও হয়েছে- সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর সামাজিক মুক্তি এবং এটার মূল কারণ সময়ের দাবি। কারণ আচার ঘেরা সনাতন হিন্দুকালে এতটাই পচে-গলে গিয়েছিল যে, এর আদলটা আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। তাই তাৎক্ষণিকভাবে গোরা পুরানো সব আইন কানুন ভেঙে দিয়ে নতুন আইনের প্রবর্তন করলেন। যে আইনে পুরানো বেদবিধি আর টিকে রইল না। লালন ফকির তার গানে যথার্থই বলেছেন,

এনেছে এক নবীন গোরা নতুন আইন নদীয়াতে

বেদ বিধি সব দিচ্ছে দূষে সেই আইনের বিধান মতে।।

সাময়িকভাবে বেদ, আচার, বিচার সব পাল্টে গেল। রক্ষা পেল সনাতন ধর্ম তার সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে। গোরা মানে শ্রী চৈতন্য এসে আচার-বিচারের বেড়া ভেঙে দিলেন ভক্তির প্রবল ধাক্কায়। তিনি প্রচার করলে কূল নয়, আচার নয়, বিচার নয়, গ্রন্থ কিতাব নয়Ñ মানুষের মনের পরম ভক্তিই তার মুক্তির একমাত্র পথ। শুধু নামÑ হরিনামেই জীবের পরম মুক্তি। আচারের প্রাচীর ঘেরা যে ধর্মের চৌহদ্দির মধ্যে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না- শ্রী চৈতন্য সেই অচলায়তনের পাঁচিল ভেঙে দিয়ে সবার জন্য হরি নামের আলো নিয়ে এলেন সবাইকে মুক্তি দেয়ার জন্য। সমাজের সাধারণ মানুষ, প্রান্তজন তারা তাদের জীবনের একটা অবলম্বন খুঁজে ফেল এই মুক্তির ভক্তি আন্দোলনের মধ্যে। পণ্ডিতগণ অন্য একটি কারণের কথাও বলে থাকেন- যার ইংগিত এর আগে করেছি। সেটি হল ‘রাধা রানীর প্রেমের দায়’। ব্রজে কৃষ্ণ প্রেমলীলায় রাধাকে যে কষ্টের সাগরে ভাসিয়েছিলেন সেই কষ্ঠকে অনুভব করার জন্য ‘তনে কৃষ্ণ এবং মনে রাধা’ এই নদে আসেন। অর্থাৎ তার দেহটি ছিল কৃষ্ণের আর মনটি ছিল রাধার। কৃষ্ণ দেহে রাধার প্রেমের ভাব অনুভবরে মাধ্যমে ব্রজের সেই প্রেমের ঋণের দায় শোধ করেছেন গোরা। অর্থাৎ গোরা একই দেহে রাধা-কৃষ্ণের দুই দেহের বিহার। একই অঙ্গে জীব পরমের লীলাসঙ্গ। সুতরাং লালন ফকিরের সেই যে নিষেধ ওটা অবতাররূপী আবির্ভূত গোরার সংকীর্তনে মত্ত হওয়ার ব্যাপারে। আবার এই নিষেধের ছলনায় তিনি গৌড়িয় বৈষ্ণধর্মের নানা আচার বিচারের কথা বলে গেছেন যেটা বাউলদের আচার বিচার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বাউলেরা মানুষ ভজনে বিশ্বাসী। মানুষের বাইরে তারা আর অন্য কোন জপাজপির ধার ধারেন না।

আলোচ্য গানের প্রথম স্তবকে বলা হয়েছে :

একটা পাগলামী করে

কোল

দেয় জাত অজাতেরে

দৌড়ে এসে

আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে ধুলার মঝে।।

লালন ফকির এই স্তবকে হরিনামে উš§ত্ত গোরা এবং তার সহচরদের কথা বলেছেন। তারা হরি নামে পাগল হয়ে জাতপাতের বাছবিচার না করে তারা নামের নেশায় মত্ত হয়ে ধুলায় গড়াগড়ি যায়। এই মত্ততায় পূর্বধর্মের আর কোনো সংস্কার থাকে না। এখানে সংস্কারবিহীন যুগধর্মে ভক্ত এবং ঈশ্বরের মধ্যে যে প্রেমের বন্ধন সৃষ্টি হয় তাতে জাতপাতের আর কোনো বিভেদ থাকে না। ঈশ্বর জাতপাতের ধার না ধেরে ভক্তের ভক্তির কাছে নতি স্বীকার করে তাকে প্রেমালিঙ্গণে পরম আদরে বুকে টেনে নেন। ভক্ত আর স্রষ্টার মধ্যকার সকল বিভেদ দূর হয়ে যায় জাত-ধর্মের পুরনো প্রাচীর ভেঙে। ভক্তের ভক্তি ডোরে দ্বারে সাঁই বাঁধা পড়ে যান- জাত ধর্মের শৃংখল ভেঙে। লালন সাঁইজি তাই বলেছেন :

ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই

হিন্দু কি যবন জাতের বিচার নাই।’

লালনের মতে, জাত-ধর্ম নয়, কূলের গৌরব নয়, আচার-বিচার, পূজা-পার্বণের আয়োজন নয় শুধু শুদ্ধ ভক্তি মাতোয়ালা হলেই সেই সাঁইকে আপন মনের বেড়ি পরিয়ে পোষ মানানো যায়। ভক্তি গুণে রামদাস মুচি, জোলা কবির এরা সকলেই সেই পরম সত্তার আলিঙ্গন প্রাপ্ত হয়ে ধন্য হয়-স্বর্গ এসে তাদের পায়ের তলায় গড়াগড়ি যায়। এই ভক্তদের মনে কোনো শিরনি খাওয়ার লোভ নেই, স্বর্গ প্রাপ্তির বাসনা নেই, নেই পূর্ণতার অহংকার। ভক্তি স্রোতের প্রেম কল্লোলে পূর্ণ হৃদয় শুধু সেই সাঁইকে পাবার সাধনাতেই মগ্ন- সাঁইয়ের নামে মাতোয়ারা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের এই যে ভক্তিস্রোত তা বলাই বাহুল্য সুফি দর্শনে প্রভাবিত। আমরা সুফি দর্শনের সাধন মার্গের সেই ফানা ফিল্লা বাকাবিল্লাহ’র মার্গদর্শনের প্রভাবেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের এই ভক্তিমার্গ। সুফিদের একটা ধারা প্রথাগত কোনো আচার-বিচার বা পূজা প্রার্থনায় নয়, প্রেম দিয়ে সেই পরম সত্তাকে নিজের সত্তার দোসর হিসেবে পাওয়া।

মানুষের মধ্যে যখন প্রেমের মার্গ- ভক্তি মার্গের বিকাশ ঘটে, তখন জাগতিক সংকীর্ণতার পরাজয় ঘটে। গোত্র, জাতি, ধর্ম নয় তখন মানুষই তার কাছে সবার বড় হয়ে দেখা দেয়। তখন অনায়াসে বলে উঠতে পারে ‘আনাল হক’ বা ‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই।’ সুফিদের প্রেম বা বৈষ্ণবদের ভক্তি সব মানুষকে যথার্থভাবেই মানুষরূপে দেখার শিক্ষা দেয়। প্রেম সাধনে ব্রজের জরদ কালার নদে এসে গৌর হতে আর বাধা থাকে না। ভক্তি রসে গৌরের আর জাতি-ধর্মের অচলায়তনের বদ্ধ প্রাচীর থাকে না। যবন জামাল বা হরিদাস অনায়াসেই বৈরাগ্য লাভ করে গোরার হাতে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের এই ভক্তিমার্গ, এই ভক্তি মার্গের ফুটো ছাদ দিয়ে ঠিকই কিঞ্চিৎ হলেও আচার-বিচারের অন্ধকার ঢুকে পড়ে। গৌরবাদীরাও নির্দিষ্ট প্রথা মেনে চলতে থাকে। সাধারণ হতে ভিন্ন হয়ে যায় তাদেরও জীবনযাপন প্রণালী। তারাও বিশেষ পাত্র, বিশেষ বসন ধারণ করেন।

‘একটা নারকেলের মালা

তাইতে জল তোলা ফেলা করঙ্গ সে।

পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে।।’

গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদীরা ভক্তির মধ্যে জীবনের মুক্তি খুঁজলেও ব্যবহারিক জীবনে তারা প্রচলিত সামাজিক নানা বেশ-ভূষণের পাশাপাশি নানা ব্যবহার্য দ্রব্যাদি তারা নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতেন। তারই একটা হল ‘করঙ্গ’। এটি নারিকেলের খোল দিয়ে তৈরি হয়। এই পাত্রেই তারা পানাহার্য করে থাকেন। লালন তাদের সেই পানাহার্য পাত্রের কথাই বলেছেন এই স্তবকে। তবে লক্ষ্য করবার বিষয় যে, লালন গানের সঠিক তরজমা ও পাঠের অভাবে অনেক বিখ্যাত গায়ক এই স্তবক গাইতে গিয়ে ভুলবশত ‘করঙ্গ সে’-এর স্থলে ‘করণদোষে’ গেয়ে থাকেন। কিন্তু আসলে বিষয়টি ‘করঙ্গ’ যা গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের পানপাত্র। আশা করি গায়ক এবং শ্রোতাদের ভেতরকার বিভ্রান্তি দূর হবে।

গানের অস্থায়ী’র প্রথম কলিতেই বলা হয়েছে তিন পাগলের কথা। এখন আমরা এই তিন পাগলের কথা বলব। এই তিন পাগল কে বা কারা? লালন তার গানের অস্থায়ী’র প্রথম কলিতে তিন পাগলের কথা তুললেও তাদের পরিচয় দিয়েছেন শেষ অন্তরার শেষ কলিতে। তিনি বলেছেন,

পাগলের নামটি এমন

বলিতে ফকির লালন হয় তরাসে

আবার ওদে, নিতে, চৈতে পাগল নাম ধরেছে।।’

ওদে, নিতে, চৈতে এই তিন পাগলের একটু খানি পরিচয় এখানে দেয়া প্রয়োজন। কারণ এই তিনজনের হাত ধরেই নদীয়াতে কৃষ্ণ নামের জোয়ার বয়ে যায়। আমরা চৈতে পাগল দিয়েই পরিচয়ের পর্ব শুরু করব। চৈতে হল শ্রী চৈতন্য- যাকে বাংলার রেনেসাঁসের নিয়ামক গণ্য করা হয়। যিনি ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার প্রান্তজনের সামাজিক মুক্তি এনে দেন। ওদে হল বৃদ্ধ অদ্বৈতাচার্য যিনি বলা চলে শ্রীচৈতন্যের জন্মের পূর্ব থেকে নদীয়াতে হরি নাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে নিমাই পণ্ডিত তথা শ্রী চৈতন্যের নিকট দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে পুরোদমে হরি নাম প্রচার করতে থাকেন। নিতে হল নিত্যানন্দ যিনি শ্রী চৈতন্যের যোগ্য সহচর ছিলেন যার হাতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম পূর্ণতা পায়। শ্রী চৈতন্যও এক সময় এই বাংলা ছেড়ে জগন্নাথে জলে যান। কিন্তু নিত্যানন্দ এখানে থেকেই বাংলার প্রান্তিক মানুষের নেতা হয়ে তাদের মুক্তির জন্য ভক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। লালন তার এই গানের ভেতর দিয়ে নদীয়ার এই যুগধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন সাবলীলভাবে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত