| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

ইংরেজি অনুবাদে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ । আবদুস সেলিম

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

সামগ্রিকভাবে বিদেশি ভাষায় বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ আলোচনায় সবার আগে যে নামটি উঠে আসে সেটি হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অন্ততপক্ষে বত্রিশটি ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে যার মধ্যে ভারতীয় ভাষা ছাড়া উনিশটি বিদেশি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, গল্প, কবিতা এবং প্রবন্ধের অনুবাদ আছে। এর মধ্যে আমার জানামতে জর্মন, রুশ ও চীনা ভাষায় রবীন্দ্র-রচনাবলীর সবটাই অনূদিত হয়েছে।

নিশ্চিত করে বলা যায় বাঙালি আর কোনো সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম এতগুলো ভাষায় অনুবাদ হয়নি। যার সূচনা হয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়েই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া যে বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের রচনাবলী বিদেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তারা হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাস, কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, মহাশ্বেতা দেবী, নিরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, জয় গোস্বামী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, আবুল বাসার এবং আরও অনেকে।

ভারতে পরবাস ডটকম কর্তৃক সম্প্রতি বেশ কিছু অনুবাদকর্ম হচ্ছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ ও ‘বাক্স বলদ’, কেতকী কুশারী ডাইসনের রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খঘোষ, জয় গোস্বামী, সুকুমার রায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মুহম্মদ রফিক, খালেদ হোসেন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা এবং সেলিনা হোসেনের অরণ্যকুসুম।

লক্ষ্য এই প্রতিষ্ঠানটি একাধারে অবিভক্ত ভারত, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের লেখকদের সাহিত্যকর্মের অনুবাদ প্রকাশ করেছে ও করছে।

তালিকাটি সমন্বিত নয় এবং আমি এই তালিকায় শুধু ইংরেজ যুগ ও পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের অন্তর্গত করেছি এই উদ্দেশ্যে যে বাংলাদেশের লেখকদের অনূদিত সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলাদা আলোচনা করতে চাই।

এ কথা তো অনস্বীকার্য যে, বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস অন্যান্য সমৃদ্ধ ভাষার সাহিত্যের তুলনায় কম প্রাচীন নয়, যদিও ‘জন্রা’-র বিচারে বাংলাসাহিত্য কিছুটা হলেও পিছিয়ে আছে। যেমন- আমাদের উপন্যাস, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ রচনার ইতিহাস তেমন পুরনো নয়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এর কারণ বাংলা ভাষাভাষীরা মূলত প্রাকৃতিক প্রভাবে যতটা কাব্যপ্রেমী, ঠিক ততটা গদ্যপ্রেমী নয়। কিন্তু তবুও, বিলম্বিত হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক ও প্রবন্ধ কিংবা বঙ্কিম ও শরৎচন্দ্রের উপন্যাস, মাইকেলের নাটক ও মহাকাব্য এবং বিভূতিভূষণ ও মানিকের উপন্যাস ও ছোটগল্প বিশ্বের যে কোনো ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মের সমপর্যায়ের।

বিভূতিভূষণের আত্মজৈবনিক উপন্যাস, যার সত্যজিৎ রায় কর্তৃক চলচ্চিত্রায়ণ সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র জগতকে আলোড়িত করেছে, সেই ‘পথের পাঁচালি’ ও ‘অপরাজিত’ এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ বা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র মতো মনোবীক্ষণিক উপন্যাসের সঠিক মান নির্ণয় হয়েছে বলে মনে হয় না।

কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও অনস্বীকার্য বাংলাসাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ বিদেশি ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে মর্মস্পর্শী মনে হয় না আমাদের ইংরেজি শব্দ ও বাক্যের অপ্রচলিত ব্যবহারের জন্য।

বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদ প্রসঙ্গে নীরোদ চন্দ্র চৌধুরীর নৈরাশ্যবাদী উক্তি : ইংরেজি পাঠকরা আমাদের সাহিত্যকর্মের অনুবাদ পাঠ করে শুধু ‘How interesting’ মন্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন- এ মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেও আমি সঠিক যুক্তি খুঁজে পাই না রবীন্দ্র-উত্তর যুগের লেখক জীবনানন্দ দাস, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা বিভূতিভূষণের মতো লেখকদের সাহিত্যকর্মের অনুবাদ বোদলেয়ার, সেরভেনতেস, নেরুদা, বোরহেস, মারকেস, ফুয়েনতেস, কাজান জাকিস এবং অপরাপর A-ইংরেজ লেখকদের মতো সাড়া জাগাতে পারল না কেন!

ভেবে দেখার দরকার আছে আমাদের অনুবাদে কোনো ত্রুটি আছে কিনা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, এ পর্যন্ত কোনো বিদেশি ভাষায় লেখককে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি যার সাহিত্যকর্ম ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়নি।

আধুনিক যুগে ভারতে কিছু পেশাদার অনুবাদক বাংলা সাহিত্যকর্ম ভাষান্তর করছেন যাদের মাধ্যমে সমকালীন লেখকসহ শরৎচন্দ্র, সুনীল, মানিক এবং অন্যান্য সমসাময়িক লেখকদের কবিতা, উপন্যাস, গল্প, দক্ষতার সঙ্গে অনুবাদ হচ্ছে। সময়ে বোঝা যাবে এসব অনুবাদের অভিঘাত কী হবে।

ভারতে বর্তমানে যারা বাংলা থেকে ইংরেজি বা অপরাপর বিদেশি ভাষায় অনুবাদে নিয়োজিত আছেন তাদের অগ্রগণ্য হলেন অরুণা চক্রবর্তী, কেতকী কুশারী ডাইসন, অরুণাভ সিনহা, চন্দন চট্টোপাধ্যায়, শৈলী পাল, ভাস্বতী ঘোষ, ফ্রান্স ভট্টাচার্য, হৈমন্তি দোরাল, গৌরীদত্ত, জীনিয়া মিত্র, ক্যারলিন ব্রাউন, চিন্ময় গুহ এবং আরও অনেকে। এদের অনুবাদকর্মের মধ্যে কয়েকটি ভরতচন্দ্র রায়ের অন্নদামঙ্গল, সেলিনা হোসেনের অরণ্যকুসুম, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের দেখা হবে এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময় এবং প্রথম আলো।

২.

স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদের প্রকাশনায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে বাংলা একাডেমি।

এ পর্যন্ত বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদের তালিকায় উল্লেখযোগ্য হল : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর The Breakers (‘তরঙ্গ ভঙ্গ’) এবং Night of No Moon (‘চাঁদের আমাবস্যা’), শওকত ওসমানের The King and the Serpents এবং Selected Stories (রাজা উপাখ্যান), রাজিয়া খানের Droupadi, আহমদ ছফার The Om (ওঙ্কার), সেলিনা হোসেনের The PointerÕs Pallet (পূর্ণ ছবির মগ্নতা) এবং The Shirk, The River and The grenades, জিয়া হায়দারের Two Plays: Four Passangers and Mumbo-jumbo, জহির রায়হানের Different Spring (আর এক ফাল্গুন), হাসান আজিজুল হকের Selected Stories, শহীদুল্লাহ কায়সারের Sangshaptak, মমতাজ উদ্দীনের Wedding and the Wild Kite, সাঈদ আহমেদের Three Plays, আসাদ চৌধুরীর Selected Poems, আবু রুশদের Selected Short Stories, আব্দুল্লাহ আল মামুনের Mother of Meraj Fakir, সুফিয়া কামালের Mother Pearls and Other Poems, আনোয়ার পাশার Rifles Bread Women (রাইফেল রুটি আওরাত), Four Poets From Bangladesh, Selected Poems of Nirmalendu goon, আলাউদ্দিন আল-আজাদের Portrait Number Twenty-three, মীর মশাররফ হোসেনের Ocean of Sorrwo (বিষাদ-সিন্ধু), নীলিমা ইব্রাহিমের A War Heroine I Speak (আমি বীরাঙ্গনা বলছি) এবং আবু ইসহাকের Ill-omened House (সূর্যদীঘল বাড়ি) প্রভৃতি। উল্লেখ্য, এদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহয়ের সাহিত্যকর্ম ফরাসি ভাষায় এবং আবু ইসহাকের উপন্যাস ইংরেজি ছাড়াও একাধিক ভাষায় ভাষান্তরিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, সানাউল হক, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, আবুল হাসান, কামাল চৌধুরী- এদের কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ ছাড়াও 14 Young Poets of Bangladesh, Four Poets from Bangladesh, A choice of Contemporary Verses from Bangladesh প্রকাশ করেছে। বাংলা একাডেমির ছোটগল্প অনুবাদ প্রকাশনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- An Anthology of Contemporary Short Stories of Bangladesh এবং The Human Hole by Mainul Ahsan Saber। বাংলা একাডেমি ছাড়া অন্যান্য প্রকাশনার মুদ্রিত অনুবাদকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- হুমায়ূন আহমেদের In bliss hell, Love you all, A few youngs in the moon, To the woods dark, ইমদাদুল হক মিলনের The Chain, Dwelling, Parabas; সৈয়দ শামসুল হকের Keep it up, Kilroy এবং মুহাম্মদ জাফর ইকবালের Rashed, my friend। বক্ষমাণ প্রবন্ধ লেখক ষাটের দশকের কবিদের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ প্রকাশ করেছে Selected Poems from Bangladesh শিরোনামে। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার অনুবাদে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বিশেষ উদ্যোগ ছিল। ১৯৬১ সালে রাইটার্স গিল্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় নজরুল ইসলামের চারটি ইংরেজি অনুবাদ কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়, যার অনুবাদক ছিলেন ইউসুফ জামাল হোসেন এবং জি আল্লামা। ১৯৬৩-তে বাংলা একাডেমি কবির চৌধুরী অনূদিত Selected Poems of Nayrul প্রকাশ করে। অন্যান্য বিশিষ্ট অনুবাদকর্মের মধ্যে রয়েছে- নজরুল ইন্সটিটিউট প্রকাশিত আবদুল হাকিম অনূদিত The Lyrics of Nayrul Islam; কবির চৌধুরী অনূদিত The Moring Shanai; আবু রুশদ অনূদিত Selected Songs of Kayi Nayrul Islam এবং সাজ্জাদ কামালের অনুবাদ। ইংরেজি ভাষাভাষী যারা নজরুল অনুবাদ করেছেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন- এজি স্টক এবং জন থ্রপ। নজরুলের সাহিত্যকর্ম রুশ, উর্দু ও জার্মান ভাষাতেও অনূদিত হয়ে বিদগ্ধ সমাজে আদৃত হয়েছে।

বাংলাদেশে অনুবাদকর্ম প্রকাশনার প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাদি অপ্রতুল যার মধ্যে সিংহভাগ অবদান রয়েছে বাংলা একাডেমির।

এ ছাড়া বেশ কিছু বাণিজ্যিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাংলা কবিতা, নাটক, ছোটগল্প ও উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ করে থাকে যা মূলত অনুবাদকদের ব্যক্তিগত পছন্দ ও আবেগের ফসল। ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনায় বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদকর্ম যা হয়েছে তার অধিকাংশই কবিতা, গল্প, নাটক ও উপন্যাসের অনুবাদ। প্রবন্ধের অনুবাদ নেই বললেই চলে।

এর সম্ভাব্য কারণ বাংলাসাহিত্যে মৌলিকভাবেই প্রবন্ধ শাখাটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল অথবা অনুবাদকরা প্রবন্ধ অনুবাদে আগ্রহী নন। বাংলা একাডেমি ছাড়া অনুবাদকর্ম প্রণোদনাদানকারী অন্যতম প্রতিষ্ঠান হল রাইটার্স ইঙ্ক। যাদের মাধ্যমে আবুল হোসেন, খন্দকার আশরাফের কবিতা, সালেহা চৌধুরী, আনিস চৌধুরীর ছোটগল্পের সংকলনসহ আরও কিছু ভাল অনুবাদ-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মাসুদুজ্জমানের অনলাইন পোর্টাল ‘তীরন্দাজ’-এর অনুবাদ-প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। বর্তমান প্রবন্ধের লেখকের Translation পত্রিকায় এ পর্যন্ত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, রাজু আলাউদ্দিন, সাইমন জাকারিয়া, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, ওবায়েদ আকাশ এবং আরও অনেকের কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ এবং ছোটগল্পের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে।

৩.

বাংলাদেশে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদকর্মে যাদের অবদান অনস্বীকার্য তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- সৈয়দ শামসুল হক, আলী আহমেদ, খান সারোয়ার মোর্শেদ, কবীর চৌধুরী, খালেকুজ্জামান ইলিয়াস, ফকরুল আলম, আফিয়া দীল, পারভীন ইলিয়াস, নিয়াজ জামান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত কুমার দাস, কায়সার হক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, মফিদুল হক, আজফার হোসেন, শওকত হুসাইন, মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, সোনিয়া নিশাত আমিন, দ্বিতীয় সৈয়দ হক, অদিতি ফাল্গুনী, কাজী, জ্যাকি কবীর, মোস্তাইন বিল্লাহ, আফসান চৌধুরী, নাশিদ কামাল এবং আরও কিছু তরুণ অনুবাদক।

বর্তমান প্রবন্ধটি শুধু মাত্রিক (quantitative) বিল্লেষণে আক্রান্ত- অর্থাৎ কেবল অনুবাদ গ্রন্থ, গ্রন্থের রচয়িতা এবং অনুবাদকের তালিকায় পূর্ণ (যদিও কোনোক্রমেই দাবি করতে পারি না তালিকাটি সম্পূর্ণ) অনুবাদকের গুণগত মানের কোনো বিল্লেষণ নেই। এর কারণ- সহজবোধ্য, এত সংখ্যক অনুবাদ পাঠ করে তার গুণাগুণ বিচার ও বিল্লেষণ সহজ নয়।

তবে সাহিত্যকর্মের অনুবাদ প্রসঙ্গে কিছু বলা এই প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক হবে নিশ্চয়। সাহিত্যকর্মের অনুবাদ নিয়ে দেরিদা, বেনজামিন, পামার, গ্রসম্যান, গায়ত্রী চ্যাটার্জি স্পিভাক এবং এমন আরও অনেক গবেষক একাধিক তত্ত্বকথা বলেছেন। তবে সহজ ভাষায় যে বক্তব্যটি আমার দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদন করে সেটি হলো: ভালো বা সফল অনুবাদক তারা যারা মূল ও অনূদিত উভয় ভাষাতেই রচনাশৈলীর তীক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে ধারণ করতে সক্ষম। বক্তব্যটি অবশ্যই আপেক্ষিক কারণ এ ব্যাপারে অনেক বিদগ্ধজনই আরও অনেক-অনেক ভিন্ন-ভিন্ন শর্ত আরোপ করতে পারেন। তবে রচনাশৈলীর নান্দনিকতা অবশ্যই একটি পূর্বশর্ত।

অনুবাদের ব্যাপারে অনেক রক্ষণশীল পাঠক lost in the translation বিষয়ের বিতর্কটি উত্থাপন করতে পারেন। অনুবাদে মূলের বিনষ্টিকে মেনে নিলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি একজন সফল অনুবাদক তিনিই যিনি মৌলিকভাবে লেখক।

একজন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার বা প্রাবন্ধিক সৃজনশীল রচনার মাধ্যমে তার ভিন্ন-ভিন্ন পাঠককে ভিন্ন-ভিন্ন পর্যায়ে যেভাবে আলোড়িত করেন ঠিক তেমনি একজন সফল অনুবাদক তার অনুবাদকর্ম দিয়ে, তা সাহিত্যের যে শাখাতেই হোক, সমপর্যায়ে তার পাঠকদের আলোড়িত করতে সক্ষম। এখন এই প্রসঙ্গে নিরীক্ষণীয়, বাংলা সাহিত্যের বিদেশি ভাষায় অনুবাদে ওই lost in the translation-এর কারণে মূলের বিনষ্টি কতটা হচ্ছে। সত্যি অর্থে এর পরিমাপ বাংলা ভাষার পাঠকদের পক্ষে সুকঠিন।

এ পর্যায়ে আমি মিখাইল বাখতিনের কার্নিভালেক্স তত্ত্বের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চাই। বাখতিন বলছেন, বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীভেদ, পদমর্যাদা, শিক্ষা, চরিত্র, মেধা এবং আবেগ উপন্যাস বা কথাসাহিত্যে উদঘাটিত হয় যা কোনো নির্দিষ্ট ভাষাভাষীর অন্তর্গত সংস্কৃতি।

ফলে ওই ভাষায় রচিত কথাসাহিত্য সম্যক উপলব্ধি করতে ওই ভাষাভাষীদের জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা, আবেগ, চালচলন, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, ভাষিক অভ্যাস এবং এমন অনেক সাংস্কৃতিক বিষয়াদিতে সংবেদনশীল হতে হয়।

যদিও বলা হয়ে থাকে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের বৈদ্যুতিক যোগাযোগ বা তথ্যপ্রযুক্তি মাধ্যমের অভাবনীয় বিস্ফোরণের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানব জীবনযাত্রা পরস্পরের অনেক কাছাকাছি এসেছে (ফলে বাখতিনের কার্নিভাল বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে) তবুও মানুষের জীবনযাপনের সদা পরিবর্তমান ধারা অনুবাদকর্মকে সহজ করেছে বলে মনে হয় না। বাংলাসাহিত্যের বিদেশি ভাষায় অনুবাদে এ বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে আমার মনে হয়। কারণ চলচ্চিত্র যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই এ বাধাকে অতিক্রম করেছে আমাদের অনুবাদ সাহিত্য এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও পিছিয়ে আছে।

৪.

পূর্ব ও পশ্চিম উভয় বঙ্গের সৃষ্টিধর্মী সাহিত্য বিশ্বের উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যকর্মের বিচারে পিছিয়ে আছে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে কাব্য-রচনায়। যদিও আগের তুলনায় দুই বাংলাতেই অনুবাদকর্মে অনেকেই উদ্যোগী হয়েছেন – অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট অনুবাদকর্ম হচ্ছে- গুণগত মানে সেসব অনুবাদকর্ম সব শর্ত পূরণ করতে পারছে কিনা তা সম্যক অনুমান করতে হবে।

বাংলাদেশে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলা ছাড়া বিদেশি ভাষার অনুবাদকর্মে অর্থলগ্নি করতে আগ্রহী নয় হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া। পশ্চিমবঙ্গে ঠিক এমন সমস্যা নেই। প্রধানত এ কারণে যে সেখানে বহুভাষিক পাঠক বর্তমান। তা ছাড়া ভারতে পেঙ্গুইন প্রকাশনা অত্যন্ত সক্রিয়।

রুপার মতো ভারতীয় প্রকাশনা সংস্থাও আছে। এমন পরিস্থিতিতে অনুবাদকর্মের এক মাত্রিক আধিক্য আছে এবং যার কারণে গুণগত মানও ঊর্ধ্বগামী। অপরপক্ষে বাংলাদেশে একমাত্র বাংলা একাডেমি ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠান সেভাবে বাংলাসাহিত্যের অনুবাদ বিষয়ে তেমন উদ্যোগী নয়। উপরন্তু, বাংলাদেশের প্রায় সব অনুবাদকর্মই ইংরেজি ভাষায় সীমাবদ্ধ। এ বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

মানতেই হবে বাংলা ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষান্তরের সবচেয়ে সফল ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু তাই নয় তিনিই একমাত্র বাংলাভাষী সাহিত্যিক যার রচনা অসংখ্য বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ফলে, দুঃখজনক হলেও সত্য এতদিন পরও বাংলাসাহিত্যের বিশ্ব প্রতিনিধিত্ব এখনও একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপরই বর্তায়।

 

 

 

লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত