মুখোমুখি প্রকাশনা জগতের চেনা দম্পতি
সাক্ষাৎকার ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় ও চুমকি চট্টোপাধ্যায়-এর সঙ্গে। কথোপকথনে মৌমিতা তারণ।

বটানির প্রফেসর হবেন এমন ভাবনা নিয়েই পড়াশোনা এগোচ্ছিল। বাড়ির বড়রাও সেরকম চেয়েছিলেন। এদিকে বাড়ির আনাচ – কানাচ থেকে সাহিত্য উঁকি মারছে। সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনও রেষারেষি নেই। ছেলেটি তাই মনের আনন্দে সবরকম বই পড়ে। নিজেও মাঝেমধ্যে লেখে। বাবা দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে গড়া ম্যাগাজিন “কিশোর ভারতী” ততদিনে বাংলার ঘরে ঘরে কিশোর মন ছুঁয়ে ফেলেছে। বাড়ির ছেলেটিও পড়াশোনার ফাঁকে ক্রমশঃ আকৃষ্ট হচ্ছে সাহিত্য, প্রকাশনা ইত্যাদিতে। বদলাচ্ছে পারিবারিক কাঠামোও।
যৌথ পরিবারের ভাঙন আর সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা শেষ পর্যন্ত ছেলেটিকে টেনে নিয়ে এল পারিবারিক ব্যবসায়। আমরা পেলাম বিখ্যাত প্রকাশক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়কে। পত্রভারতী পাবলিকেশন হাউসের কর্ণধার এই মানুষটি বেশ কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলার পাবলিশার্স অ্যাণ্ড বুকসেলার্স এর সাধারণ সম্পাদকের পদটিও কৃতিত্বের সঙ্গে সামলাচ্ছেন। এসবের সঙ্গে চলছে তাঁর কলমও। কিশোর ভারতী পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের কলম আমাদের একের পর এক উপহার দিয়ে চলেছে ‘ছায়ামূর্তি’, ‘জগুমামা রহস্য সমগ্র’, ‘মৃত্যুকে আমি দেখেছি’, ‘ভৌতিক অলৌকিক’, ‘গোপন প্রেমের গল্প’ ইত্যাদি। কুড়িটি গল্প নিয়ে তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘এখনও গায়ে কাঁটা দেয়’ বইটিতে পাঠক আপ্লুত।
পত্রভারতীর অফিসে কথা হচ্ছিল ত্রিদিবদার সঙ্গে। সদা হাস্যময় ত্রিদিবদার মুখটি সকলেরই চেনা। কিন্তু বাইরের এই হাসিটুকু পেরিয়ে অন্তরেও ত্রিদিবদা কতখানি রসিক সেদিনের কথোপকথনে বারে বারে উঠে এসেছে সেটি। রসিক এবং অকপট। সেইসঙ্গে একজন স্পষ্ট বক্তা। স্পষ্ট কথা বলতে গিয়ে এতটুকু গলা কাঁপে না মানুষটির। বাঙালিকে পুরোপুরি কাঁকড়ার জাত বলতেও যেমন দ্বিধা করেন না তেমনই আবার আসাম, ত্রিপুরায় বাংলা ভাষাকে সরিয়ে হিন্দি প্রবেশের রাজনৈতিক উদ্দেশের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতেও পিছুপা হন না। মুগ্ধ হয়েছি সেদিন ত্রিদিবদার এই বলিষ্ঠ দিকটির সন্ধান পেয়ে। এবার মুগ্ধ হওয়ার পালা মউলের পাঠকদের।
প্রকাশনা, সাহিত্য, লেখক, পাঠক, বর্তমান প্রজন্ম ইত্যাদি বিষয়ে কথোপকথনে ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়।
(১). কিশোর ভারতী মূলত কিশোর মনকে সামনে রেখে কাজ করে। জীবনের সব থেকে ভাইটাল সময় কৈশোর। কিশোর মনকে সাহিত্যের খোরাক দেওয়ার জন্য কোন কোন বিষয়ের ওপর সজাগ থাকতে হয় ?
উঃ. ১২ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সটা দোলাচলের বয়স। শারিরীক এবং মানসিক পরিবর্তন এ সময় থেকে শুরু হয়। কী ছেলে কী মেয়ে — এই সময়টাতে পৌঁছে ঠিক করতে পারে না অন্ধকারে যাব না কি আলোতে থাকব। ১৯৬৮ র আগে কিশোর পত্রিকা বলে কিছু ছিল না। ছোটদের বই ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র কৈশোর মাথায় রেখে কোনও পত্রিকা ছিল না। আমার বাবা দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই জায়গা থেকে কিশোর ভারতী শুরু করেন। এই পত্রিকার লক্ষ্য তাই শিশুসুলভ খোকা খুকু নয়। আমাদের পত্রিকার লেখায় নারী পুরুষের সম্পর্কও থাকে। তারুণ্যের পথে পা রাখতে যাওয়া কিশোর কিশোরী সেসব বুঝতে পারে৷ এই সমস্ত বিষয়গুলো মাথায় রেখেই কিশোর ভারতী এগিয়ে চলেছে।
(২). একজন ভাল প্রকাশকের মধ্যে কোন গুণগুলি অবশ্যই থাকা প্রয়োজন।
উঃ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেটা হয় কেউ আমরা পড়ি না। বই পড়াটা কাজের মধ্যে ধরতে হবে। যে বইটি আমরা প্রকাশ করতে চলেছি সেটি পড়তে হবে ভাল করে৷ প্রোডাক্ট ঠিক না রেখে শুধু নির্মাণের দিকটিকে গুরুত্ব দিলে ভাল প্রকাশক হওয়া যাবে না। লেখাটি ভাল করে পড়তেই হবে। বই প্রকাশের বিজ্ঞানসম্মত ট্রেনিং নিতে হবে একজন প্রকাশককে। বইয়ের সাইজ, ইলাস্ট্রেশন, হেডিং অর্থাৎ নির্মাণের দিকগুলো অবশ্যই দেখতে হবে। তবে প্রোডাক্ট যেন কোনমতেই উপেক্ষিত না হয়। আশার কথা নতুন প্রকাশকরা লেখাটি পড়ছেন। এছাড়াও কোনটা আমি করব বা কোনটা আমি করব না — এ বিষয়ে একজন প্রকাশকের স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত।
(৩). এত বছরের প্রকাশনা আপনাদের — যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছেন কীভাবে ?
উঃ বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে আমরা মিশি। ওদের চাওয়ার জগতটা বুঝতে চেষ্টা করি। পাশাপাশি আমাদের চাওয়াটাও ঢুকিয়ে দিই ওদের মধ্যে। আমাদের মূল্যবোধ, জাতীয়তাবাদ, মানবিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলো ওদের ভেতর যাতে গড়ে ওঠে সেই চেষ্টা করি।
(৪). এই যে এত চিৎকার পাঠক কমে গেছে বলে — কতটা মানেন ?
উঃ পাঠক আছে, লেখক নেই। পাঠক আগেও ছিল, এখনও আছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, সমরেশ মজুমদার এখনও লিখছেন। তবে এটা তো মানতেই হবে লেখার ধার এখন কিছুটা হলেও কমে গেছে। রিপিটেশন এসে যাচ্ছে। আর বর্তমান লেখকদের মধ্যে দু’তিনজন ছাড়া আর কেউ পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতে পারছেন না। পাঠকের হতাশা বাড়ছে। পাঠক তৈরী আছে। একমাত্র ভাল লেখাই পারবে পাঠকের এই হতাশা দূর করতে।
(৫). বর্তমান পাঠক কোনধরনের বইয়ে বেশি আগ্রহী?
উঃ প্রেমকাহিনী অনেক হয়েছে। পাঠক এখন আর এসব অতটা পড়তে চায় না। সাহিত্য থেকে মানুষ মুক্তির স্বাদ খোঁজে। নারী – পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসা বিষয় পাঠককে টানে। এই মুহূর্তে থ্রিলার অর্থাৎ রহস্য, রোমাঞ্চ ইত্যাদি পাঠকের পছন্দ। এছাড়া ক্লাসিক তো আছেই।
(৬) বাংলা সাহিত্যের জগতে ফেসবুক সাহিত্যকে কতখানি জায়গা ছেড়ে দেবেন ?
উঃ নতুন জিনিসকে সবসময় স্বাগত জানাই। দু দুটো প্রকাশ শ্রীজাত-র করেছি ‘ফেসবুক’, ‘লিমেরিক’। তন্ময় মুখার্জির ফেসবুকের লেখা আমরা প্রকাশ করেছি। স্বর্ভানু সান্যালের ‘যজাতির ঝুলি’ বলে একটা লেখা ফেসবুকে পড়ে আমরা প্রকাশ করেছি। তবে ফেসবুকের সব গল্প ‘সাহিত্য পদবাচ্য’ নয়। লেখা স্ক্রুটিনীর কোনও সুযোগ নেই এখানে। যেমন ধরুন ‘সঙ্গে’ শব্দটিকে ফেসবুকে বহু লেখক ‘সাথে’ লেখেন। স্ক্রুটিনীর অভাবেই এটা হয়।
(৭). একজন প্রকাশক হিসেবে কোথাও কি মনে হচ্ছে সুনীল, শীর্ষেন্দু -র পর বাংলা সাহিত্য থমকে গেছে ?
উঃ. থমকে গেছিল। একটা দীর্ঘ সময় ধরে আমরা ভাল বাংলা সাহিত্য পাই নি। তবে সেই খরা কাটানো গেছে। একুশ শতকে নতুন প্রবাহ তৈরী হয়েছে। বিনায়ক, শ্রীজাত, স্মরণজিৎ, জয়ন্ত, হিমাদ্রিকিশোর এরা জায়গাটাকে ধরেছে।
(৮). বিশ্ব দরবারে বাংলা ও বাঙালি আজও কতখানি প্রাসঙ্গিক ?
উঃ. যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। এ ব্যাপারে বেশি কৃতিত্ব দেব বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে। আমাদের শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। চার লাখের ওপর বিক্রি। তবে আমি কোনও রাজনৈতিক দলের নাম না করেই বলব আসামে, ত্রিপুরায় বাংলাভাষার ওপর আঘাত আসছে। সুক্ষভাবে সেখানে হিন্দি ভাষা ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে কী হবে জানি না।
চুমকি চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি প্রেম – ভালবাসা, ভাললাগা ইত্যাদি নিয়ে কথোপকথনে ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়।

(১). স্ত্রী চুমকি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হল কীভাবে ?
একটা বিয়েবাড়িতে। ওরা আমার মাসীর দিকের আত্মীয়। তবে আমার বাবার এ বিয়েতে মত ছিল না প্রথমে। তার কারণ চুমকির বাবা মানে আমার শ্বশুরমশাই ছিলেন পুলিশ৷ বাবার ধারণা ছিল পুলিশ ঘুষ খায়। পুলিশ মানেই ত্রাস।
(২). তারপর বাবা রাজি হলেন কখন ?
চুমকি প্রথম থেকেই আমার বাবার লেখার ভক্ত ছিল। বইমেলায় এসে ও বাবার বই ‘দুরন্ত ঈগল’, ‘নন্টে ফন্টে’ কিনল। বাবাও বুঝতে পারলেন মেয়েটা ভাল। মেয়ের বাবাও ভাল।
(৩). চুমকিদির বাবা প্রথম থেকেই মেনে নিয়েছিলেন ?
উনিও আমায় পরখ করতে এসেছিলেন। পুলিশ তো। তাই প্রথম যখন আমার দিকে তাকালেন আমার মনে হল আমার ভেতরটা উনি দেখতে পাচ্ছেন।
(৪) তারপরেই বিয়ে হয়ে গেল ?
না। পঁচাশি সালে আমাদের প্রথম দেখা হলেও বিয়েটা হয় ছিয়াশির জানুয়ারিতে। মাঝের সময়টা একটু ঘোরাঘুরি হয়েছে দুজনের। দুজনেই সায়েন্স কলেজের স্টুডেন্ট আমরা। ও জ্যুলজি আমি বটানি। তবে চুমকি যখন কলেজে পড়ছে আমি তখন পাস আউট করে গেছি। ও ছ’বছরের ছোট আমার থেকে। আমি মাঝে মাঝে গাড়ি চালিয়ে সায়েন্স কলেজে চলে যেতাম। ওকে তুলে নিয়ে দুজনে কোনও রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করে ফিরতাম৷ তারপর বিয়ে হয়। বিয়ের সময় রেজিস্ট্রেশন হয় নি। বাচ্চা হওয়ার পর বিদেশ যাওয়ার সময় রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়। অর্থাৎ আমাদের বিয়েটা অ্যারেঞ্জড কাম লাভ।
(৫). বউয়ের ভালবাসা টের পান কীভাবে ?
এতগুলো বছর আমায় সহ্য করছে। এতেই বুঝতে পারি।
(৬) দুজনের মধ্যে রাগ বেশি কার ?
আমার।
(৭) ঝগড়ার সময় কে আগে থামে ?
আমি।
(৮) কেমন সাজে চুমকি চট্টোপাধ্যায়কে দেখতে ভাল লাগে ?
সবরকম সাজেই ভাল লাগে। সাজগোজ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না।
নিজের সম্বন্ধে অকপট ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়
(১) বন্ধু বেশি না শত্রু ?
শত্রু।
(২) জীবনে অপমানিত হয়েছেন কতবার ?
অসংখ্যবার।
(৩) মেজাজটি কেমন — ফুরফুরে নাকি খিটখিটে ?
আগে শর্ট টেম্পার্ড ছিলাম। এখন অনেক শান্ত।
( ৪) মন খারাপ হলে মন ভাল করেন কীভাবে ?
বই পড়ে।
(৫) সমস্যা দেখলে পালিয়ে যান নাকি সমাধানে এগিয়ে আসেন ?
সমস্যা দু’রকম। শর্ট টার্ম এবং লং টার্ম। শর্ট টার্ম প্রবলেম সঙ্গে সঙ্গে সমাধান করতে হয়। আর প্রবলেম যদি লং টার্ম হয় চুপ করে থাকি। অপেক্ষা করতে হয়। দেখা যায় এক সময় প্রবলেম নিজেই থেমে গেছে।
(৬) পুরুষ নাকি মহিলা — কোন সাহিত্যিকের সঙ্গে কাজ করতে সুবিধে হয় ?
এ বিষয়ে ভেদাভেদ নেই কোনও।
(৭) প্রথম প্রেম কবে ?
সে অনেক আগে। এতবছর পর মনে হয় ওটা প্রেম নয়, ইনফ্যাচুয়েশন ছিল।
(৮) নিজের মধ্যে হিংসা, লোভ এই আবেগগুলো কতটা আছে ?
লোভ নেই। ছিলও না কখনও। হিংসা ছিল। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে।
(৯) কতখানি স্বাস্থ্যসচেতন ?
একেবারেই না। মর্নিং ওয়াক, এক্সারসাইজ কিছুই করি না।
(১০) সংসারের কাজ করেন ?
একদম না।
(১১) মেয়েরা যখন খুব ছোট ছিল তখন তাদের জন্য রাত জাগা, ন্যাপি পালটানো, দুধের বোতল মুখে ধরা এসব কাজগুলো করেছেন ?
কিচ্ছু করি নি। সব চুমকি করেছে। সেজন্য গিলটি ফিলিং হয়।
(১২) খেতে ভালবাসেন ? প্রিয় খাবার ?
হ্যাঁ আমি খাদ্যরসিক। বাড়িতে তৈরী নন ভেজ খাবার বেশি পছন্দের।
(১৩) প্রিয় বাঙালি লেখক কে ?
রবীন্দ্রনাথ।
(১৪) মানুষ গড়ার দায়িত্ব পেলে কেমন মানুষ বানাবেন ?
মানুষের মধ্যে ভালবাসা প্রবেশ করাব।
(১৫) কলকাতার কোন জিনিসটি প্রিয় ?
উষ্ণতা। পারস্পরিক সম্পর্কের উষ্ণতা।
(১৬) রাজনীতিতে আসতে চান ?
বহুবার অফার পেয়েছি। কিন্তু নিজের ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করি নি। মনে হয়েছে রাজনীতি আমার জায়গা নয়। তবে ভবিষ্যতে কী হবে এখনই তা বলতে পারি না।
(১৭) দুই কন্যার বাবা হতে পেরে কতখানি গর্বিত ?
আগে ঠিক বুঝতে পারি নি। ওরা ছোট ছিল। এখন ওরা প্রতিষ্ঠিত। তাই গর্বিত তো বটেই।
ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপচারিতার পর এবার মুখোমুখি হলাম আর এক প্রিয় মানুষের। বাংলা সাহিত্য তথা প্রকাশনা জগতকে উঁচুতে — আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার ব্রত গ্রহণ করেছেন যিনি সেই মানুষটির সামনে এখন আমি।
কলকাতার আকাশ বাতাস গায়ে মেখে বড় হচ্ছিলেন তিনি। ক্লাস থ্রি-র পর সেটি আর সম্ভব হল না। পা রাখতে হল কলকাতার বাইরে। বাবার কর্মস্থল মহিষাদলের স্থানীয় স্কুলে গিয়ে ভর্তি হল ছোট্ট মেয়েটি। কিন্তু সেও বা ক’দিন। বদলীর চাকরি বাবার। বাবার যতবার বদলি মেয়েরও ততবার স্কুল বদল। সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত চারটে স্কুলে পড়াশোনা। শুধু কি স্কুল বদল ? একই সঙ্গে চলছে বন্ধু বদলও। নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু। গাঢ বন্ধুত্ব কারও সঙ্গেই গড়ে উঠছে না। একাকী মেয়ে সময় কাটায় পুতুল খেলে, রান্নাবাটি খেলে, রেডিয়োতে গান শুনে আর অবশ্যই গল্পের বই পড়ে। ‘মিতুল নামে পুতুলটি’, ‘সোনার পুতুল হীরের চোখ’, ‘আনন্দ’-র পূজাবার্ষিকী, স্কুলের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসা বই তখন পরম বন্ধু। বাংলার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে এভাবেই ক্রমশ বালিকা থেকে কিশোরী হয়ে ওঠা। মাধ্যমিক দেওয়ার সময় আবার শহর কলকাতায় ফিরে আসা। কলেজপর্ব কলকাতায়। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে বিয়ে। এমন পরিবারে বিয়ে হল যেখানে শুধু বই আর বই। এতদিন যে গল্প বইয়ে পড়ত এখন জানতে পারল সে গল্প কীভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। তবে লেখাপড়ায় ফাঁকি দেওয়ার উপায় ছিল না। খোদ শাশুড়ি মা বাচ্চা কোলে নিয়ে যে সংসারে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন সেখানে বউমার লেখাপড়ায় সবাই উৎসাহ দেবেন এ আর আশ্চর্য কী। খুব সহজেই স্নাতকোত্তর হলেন তিনি। বিষয় জ্যুলজি। কলেজ, বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ।
হ্যাঁ এতক্ষণ যে মেয়ের গল্প শোনাচ্ছিলাম তিনি আর কেউ নন, এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্য বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম কাণ্ডারী চুমকি চট্টোপাধ্যায়। “কিশোর ভারতী” পত্রিকার সহ সম্পাদক।
সেদিন সকালের দু’ঘন্টা সময় কেটেছিল প্রিয় মানুষ চুমকি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপচারিতায়। অহংকারী হওয়ার হাজারো সরঞ্জাম হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে নিরহংকারী থাকা যায় সেটি এই মানুষটির সঙ্গে আলাপ না হলে জানতে পারতাম না। সেই সুন্দর সকালের সঙ্গী হোক এবার মউলের পাঠকবৃন্দ।
প্রকাশনা, সাহিত্য, লেখক, পাঠক, বর্তমান প্রজন্ম ইত্যাদি বিষয়ে কথোপকথনে চুমকি চট্টোপাধ্যায়।
(১). সাহিত্যের সঙ্গে নিত্যদিন যে বাড়ির ওঠাবসা তেমন বাড়িতে বউ হয়ে এসে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হয়েছিল ?
স্বীকার করছি সেই অর্থে আমি সাহিত্যপ্রেমী ছিলাম না। বরং বরাবরই আমি বিজ্ঞানমনষ্ক। তাই বলে গল্প, উপন্যাস পড়তাম না তা নয়, যথেষ্টই পড়তাম। তবে শ্বশুরবাড়িতে আমার ওপর সাহিত্যপ্রেম কেউ জোর করে চাপিয়ে দেয় নি। শ্বশুরমশাই কট্টর কমিউনিস্ট ছিলেন। সেইসঙ্গে ছিলেন উদারমনা। তিনি বলতেন, ‘যা ভাল লাগে কর।’ আসলে তিনি জানতেন যে পরিবেশে আমি এসেছি সেই পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে যাব একদিন৷ আলটিমেটলি সেটাই হল। ১৯৯৪ সালে আমি কিশোর ভারতীতে কাজ শুরু করলাম।
(২). লেখার জগতে কবে এলেন ?
আমি নিজেকে লেখক হিসেবে কখনোই ভাবি না। চিন্তাতেও ছিল না কোনদিন আমি এক লাইন লিখব। বাবা বা ত্রিদিব কেউই কখনও বলেন নি আমায় লিখতে। প্রকাশনা জগতে আসার পর সেই কাজেই নিজেকে জড়িয়েছি। প্রচুর কাজ তখন। হাতে কলমে কাজ শিখছি। শুধু কিশোর ভারতীতে “এটাই ঘটনা” শিরোনামে একটা লেখা লিখতাম৷ তাও সেটা নিজের ভাবনা সম্বলিত কোনও লেখা নয়। পৃথিবীতে কোথায় কী আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে সে সব। এরপর কিছুটা হঠাৎ করেই লেখালেখি শুরু করা। ২০১৩ তে “সুরজিত ও বন্ধুরা, কবিতা ক্লাব ” ওদের সংকলন বের করে। সেখানে কমলীনি আমাকে লিখতে বলে। আমি একটি অণুগল্প লিখি। সেটি সংকলনে প্রকাশ পায়। এরপর থেকেই একটু আধটু লেখালেখি শুরু। ২০১৫ তে ত্রিদিব লিখতে বলল। কিশোর ভারতীর জন্য অণুগল্প লিখলাম৷ ২০১৭ তে ছোট গল্পের সংকলন বেরিয়েছে। লেখক প্রচেত গুপ্ত সংকলনটির নাম দেন ” সুন্দর আর ভালো”।
(৩). উপন্যাস লিখতে ইচ্ছে হয় ?
সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায় খুব উৎসাহ দেন উপন্যাস লেখার জন্য৷ প্রচেতও বলে আমার নিজের গ্রামে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে। কিন্তু সাহস করে শুরু করতে পারি নি। নিজের লেখার প্রতি ভালবাসা এখনও জন্মায় নি। কেউ বললেই মূলত লিখি। নিজের ভেতর লেখার ইচ্ছে সেভাবে অনুভব করি না। লেখার থেকে আমি বেশি পড়ি।
(৪). লিটিল ম্যাগাজিনের পাশে আপনাকে সবসময় দেখা যায়। নিজের ভেতরের কোন তাগিদ থেকে আপনার এই ভূমিকা ?
লিটিল ম্যাগাজিনের অনেক ছেলেমেয়ে আমাদের স্টলে আসে। ওদের খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়। নিজের কানের দুল বিক্রি করে পর্যন্ত ওরা অনেকে বই প্রকাশ করে। সাহিত্যের প্রতি ওদের এই ভালবাসাটা আমায় অবাক করে। একটা মায়া অনুভব করি। এই মায়াটাই হয়ত তাগিদ লিটিল ম্যাগাজিনের পাশে থাকার। সৌজন্য সংখ্যা পাই। কিন্তু সুযোগ পেলেই আমি লিটিল ম্যাগাজিন কিনে পড়ি।
(৫). আধুনিক মানুষ কাকে বলবেন ?
আধুনিকতা বিষয়টা মনের সঙ্গে রিলেটেড। ভাল এবং খারাপ সবকিছুকে যে মানিয়ে নিতে পারবে তাকেই আধুনিক বলব। যিনি আধুনিক তিনি একসঙ্গে যুক্তিবাদীও আবার উদারও। আমার শাশুড়ি মা একটা সময় পুরোহিত দিয়ে পুজোআচ্চা করতেন। আমি যখন বোঝাই আমরা নিজেরাই সরাসরি পুজো করব তিনি মেনে নেন। বিয়ের পর দেখেছি সিঙ্গারা, মিষ্টি, কাসুন্দি সব বাড়িতেই তৈরী করেন উনি। প্রচণ্ড খাটুনি সেসবে। পরবর্তীতে বাইরে থেকে কিনে আনা এসব জিনিস তিনি মেনে নিয়েছেন। এটাই তো আধুনিকতা।
(৬). আপনি কি নাস্তিক ?
সে অর্থে আমি আস্তিক বা নাস্তিক কোনটিই নই। বিরাট করে পুজো আচ্চা করি না। বাড়ির লক্ষ্মী পুজো, সরস্বতী পুজো নিজের মতো করে নিজেই করি। তবে একটা সুপার পাওয়ারে বিশ্বাস রাখি। বিপদে কারও কাছে সাহায্য পাব এরকম ভাবতে ভাল লাগে। বাস্তবে সবসময় হয়ত সাহায্য পাই না। তবুও কেউ একজন অলক্ষ্যে আছেন ভাবনাটা জোর দেয়।
(৭). একজন বাঙালি হিসেবে কতখানি গর্বিত ?
অনেক বাঙালিয়ানা পছন্দ হয় না। আবার অনেককিছু ভাল লাগে। বাঙালিদের মধ্যে একটা বন্ডিং আছে। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া -আসা, বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা এগুলো খুব ভাল লাগে। অন্যদিকে এই বাঙালিকেই যখন দেখি পরিবারের কেউ মারা গেলে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে ঘটা করে, বিরাট খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রাখে তখন একদম ভাল লাগে না। তবে বাংলা ভাষা নিয়ে আমি গর্ব করি। জানি প্রত্যেকেরই তার মাতৃভাষা নিয়ে গর্ব আছে।
(৮). আপনি নিজে একজন মেয়ে, পাশাপাশি দুই কন্যার মা আপনি। কখনও কি মনে হয় মেয়েদের প্রধান শত্রু পুরুষ ? এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কীভাবে একজন মেয়ে নিজেকে সুন্দর রাখতে পারবে ?
না, মেয়েরাই মেয়েদের প্রধান শত্রু। অনেক সংসারে দেখা যায় শাশুড়ি নিজের মেয়ে আর ছেলের বউয়ের মধ্যে পার্থক্য করেন। শাশুড়ি বউকে ভালবাসলে বউয়ের ওপর অত্যাচার কমে।
পাশাপাশি বলব প্রতিটি মেয়েকে খুব সচেতন থাকতে হবে নিজের প্রতি। বিশেষ করে প্রতিদিন যাদের কর্মসূত্রে রাস্তায় বেরোতে হয়। মাথায় রাখতে হবে আমি ঠিক থাকলেও যারা রাস্তায় ঘুরছে তারা প্রত্যেকেই ঠিক না। ছেলেরাও নিরাপদ নয়। আর পোশাক একটা বিরাট ভূমিকা নেয় অনেকসময়।আমি বলব অশালীন পোশাক না পরতে। শুধু বিপদ ডেকে আনা নয়, অশালীন পোশাক সৌন্দর্যহানিও ঘটায়।
(৯). আগামী দিন কি অণুগল্প, অণুকবিতার দিন ?
পাঠকের সময়ের অভাব তাকে অণু-র দিকে টেনে নিয়ে গেছে। আমি নিজেও ধারাবাহিক পড়তে ভালবাসি না। তবে সবটাই অণু হয়ে যাবে এমন ভাবি না। আগামীদিনে অণুগল্পও থাকবে, উপন্যাসও থাকবে।
(১০). এই প্রজন্মের পাঠক ও লেখকের উদ্দেশে কী বলবেন ?
পাঠককে বলব, ভাল বই পড়। যে বই থেকে তুমি কিছু নিতে পারবে তেমন বই পড়।
এই প্রজন্মের যারা লিখছে তারা প্রত্যেকেই চেষ্টা করছে। ফেসবুকেও অনেক লেখা আসছে। তবে সব লেখাকেই সাহিত্য পদবাচ্য বলা যাবে না। যারা লিখছে তারা মন সমৃদ্ধ হবে এমন লেখা লিখুক। সহজ ভাষায় লিখুক। আর সবথেকে যেটা জরুরি প্রচুর পড়তে হবে। আগের প্রজন্মের লিখে যাওয়া ভাল বই পড়তে হবে। সোজা কথা পড়তে হবে আগে, লিখতে হবে পরে।
ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি প্রেম, ভালবাসা, ভাললাগা ইত্যাদি নিয়ে কথোপকথনে চুমকি চট্টোপাধ্যায়।
(১). ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় আগে স্বামী না আগে বন্ধু ?
এখন বন্ধু৷ যতদিন দুজনকে ভালভাবে না চিনছি ততদিন বন্ধু হওয়া যায় না। প্রথম প্রথম দেখতাম ছুটির দিনগুলোতে, পুজোর সময় বাড়িতে বসে বই পড়ত। আমার আবার তখন হয়ত বেরতে ইচ্ছে করত। ঠাকুর দেখা নয়। এই একটু ঘুরে বেড়ানো কোথাও গিয়ে খাওয়া দাওয়া এইসব৷ পরবর্তীতে এসব কোনও ম্যাটার করে নি। কারণ ততদিনে পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা এসে গেছে। এই নির্ভরতাই সম্পর্ককে বন্ধুত্বে উত্তীর্ণ করেছে।
(২). হনিমুনে কোথায় গেছিলেন ?
খুব দূরে কোথাও যাই নি। কারণ বাবার তখন চোখের অপারেশন হয়েছিল। তাই কাছাকাছি দার্জিলিং গেছিলাম।
(৩). বরের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার কী ?
যখন প্রথম বাংলাদেশ গেল তখন একটা অফ হোয়াইট কালারের ঢাকাই এনেছিল। তাও সবাই কিনছিল তাই। ওর ধারণা আমার পছন্দমতো জিনিস ও কিনতে পারবে না। বিভিন্ন অকেশনে তাই টাকা ধরে দেওয়াটা ওর কাছে অনেক সেফ মনে হয়।
(৪). ত্রিদিবদার পোশাক কে পছন্দ করে দেন ?
ওর নিজের জিনিস ও কেনে না। আমি আর মেয়েরা কিনে দিই। পোশাক নিয়ে এতটুকু সচেতন নয়। সব পোশাক যে সব জায়গায় চলে না বুঝতে চাইতেন না। এখন আমি আর মেয়েরা বলাতে কিছুটা বুঝেছে। নিজের জুতো কেনার সময় কেবল দোকানে যায়। বাদবাকি সব আমি কিনি।
(৩). এত যে দিবস সারা বছর — সেসব দুজনে পালন করেন ?
একেবারেই না। একমাত্র ভাষা দিবস আর জন্মদিন ছাড়া অন্য দিবসগুলো অর্থহীন মনে হয়।
(৪). বরের কোন স্বভাবটি মোটেই পছন্দ নয় ?
চিৎকার। ভীষণ চেঁচায়।
(৫). স্বামী – স্ত্রীর সম্পর্ক ভাল থাকার রেসিপি কী ?
পরস্পরের ব্যাপারে নাক না গলানো। বাইরে গেলে কোথায় যাচ্ছ বলে যাও ব্যস। কিন্তু ফিরতে এত দেরী হল কেন, আর কে কে ছিল সেখানে এইসব প্রশ্ন সম্পর্ক গুমোট করে তোলে। পরস্পরকে স্পেস দিতে হবে। আমার সৌভাগ্য আমাদের সম্পর্কে এই স্পেস আছে।
নিজের সম্বন্ধে অকপট চুমকি চট্টোপাধ্যায়।
(১). কেমনভাবে সাজতে পছন্দ করেন ?
সাজতে ভালবাসি। অন্যান্য পোশাক বাইরে গেলে পরি। এখানে শাড়িটাই বেশি পরি। জুয়েলারি ভালবাসি না। বেশিরভাগ সময় গলায় কিছু পরি না। কীরকম অস্বস্তি হয়। কানে দুল পরতে অবশ্য ভাল লাগে, বিশেষ করে ঝুমকো, কানবালা। প্রসাধনের মধ্যে কাজল আর লিপস্টিক খুব ভালবাসি। সেইসঙ্গে অবশ্যই কপালে বড় একটা টিপ।
(২). রান্নাবান্না করতে ভাল লাগে ?
না, একেবারেই ভাল লাগে না। আমি নিজে খুব একটা খাদ্যরসিক নই। খাওয়া নিয়ে বেশি মাথা ঘামাই না। বাড়ির পুরনো কুক উপেন খুব ভাল রান্না করে। শাশুড়ির হাতে সে তৈরী। তবে বাড়ির বাকী তিনজন খেতে ভালবাসে। উপেন বাড়ি গেলে আমি রান্না করি। খুব রিচ কিছু বানাই না। হালকা খাবার করি। তবে তখন উপায় নেই বলে রাঁধি। ভালবেসে রান্না করি না।
(৩). ঘেন্না পান কীসে ?
সাপ৷ সাপের অ্যাক্টিভিটি আমার ভাল লাগে না। এছাড়া খাবারে চুল থাকলে আমার খুব ঘেন্না লাগে।
(৪). ভয় পান কখন ?
মৃত্যুকে খুব ভয় পাই। অন্য সমস্যা খুব একটা ভয় পাই না। মনে হয় সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কাছের লোকের মৃত্যু খুব নাড়া দেয়।
(৫). রাগ না অভিমান — কোন আবেগটি বেশি ?
নিঃসন্দেহে অভিমানী আমি। তবে রাগও আছে। যদিও মুখরা বা মুখচোরা কোনটিই নই। প্রকাশনা জগতে আসার পর ধৈর্য অনেক বেড়েছে। রাগ হলেও সেটা কন্ট্রোল করতে পারি এখন।
(৬). সবসময় হাসিখুশি থাকেন কীভাবে ?
আমি খুব প্র্যাক্টিক্যাল৷ চাঁদ আমার কাছে চাঁদই। তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি না। এই বাস্তব অনুভূতির জন্য আমি কোনকিছু নিয়ে বিশেষ ঘাঁটাই না। তাই হয়ত হাসিখুশি থাকতে পারি।
(৭). প্রকাশনা নাকি লেখা — কোন কাজটি বেশি মনের মতো ?
অবশ্যই প্রকাশনা। আমি নিজেকে লেখক ভাবতে পারি না।
তিনি নিজেকে লেখক না ভাবলেও বাংলা সাহিত্যজগত কিন্তু ক্রমশঃ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে তাঁর লেখা গল্পে, অণুগল্পে। পাঠক ভালবাসছে তাঁর কলমকে। পাশাপাশি প্রকাশনা জগতে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ তাঁর প্রতি পাঠকের ভরসা বাড়াচ্ছে আরও বেশি।
পাঠক নেই, লেখক নেই, বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ অন্ধকার ইত্যাদি কথায় যখন ভীত হই, হতাশ হই তখন এগিয়ে আসেন এই দুজন মানুষ — ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় এবং চুমকি চট্টোপাধ্যায়। ক্লাস টেন-এ পড়ার সময় একবার বাড়ির সাধারণ ফ্রক গায়ে চাপিয়ে হাতে টর্চ নিয়ে মায়ের সঙ্গে এভারেস্টে উঠে পড়েছিলেন চুমকি চট্টোপাধ্যায়। সেখানে গিয়ে ভারতীয় পতাকা উড়িয়ে এসেছিলেন। হ্যাঁ ঘুমের মধ্যে এরকম একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি কিশোরীবেলায়। আমি স্বপ্নবিশারদ নই, তবুও ভাবতে ভাল লাগে, ওটা আসলে ছিল বাংলা সাহিত্যকে এভারেস্টের উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন। ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিয়ে চলেছেন চুমকি চট্টোপাধ্যায়।
নিজেদের প্রকাশনা জগত নিয়ে আগামীদিনে বেশকিছু প্রকল্প গড়ে তুলতে চলেছেন এই দম্পতি। পুরোটাই বাংলাভাষা তথা বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নকে মাথায় রেখে। ইন্দো-বাংলাদেশ যৌথ প্রকাশনার উদ্যোগ “বইসাঁকো” ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এই ব্যানারে ভারত ও বাংলাদেশের দুই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘পত্রভারতী’ ও ‘অন্যপ্রকাশ’-র বই দুই দেশে প্রকাশিত হবে। পত্রভারতী-র আরও একটি উদ্যোগ ‘সাধনা’। আধ্যাত্মিক বই প্রকাশ পাবে ‘সাধনা’ ব্যানারে। এছাড়া ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়ার বিভিন্ন বেস্ট সেলারের বাংলা অনুবাদ পত্রভারতী থেকে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকাশনার এই কাজে বাবা, মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দুই কন্যা — এষা এবং অন্বেষা। নিঃসন্দেহে সাহিত্য জগতে এটি একটি আনন্দ সংবাদ।
কৃতজ্ঞতা : লালমাটি সংবাদ
