ভালোবাসা দিবসের ছোটগল্প: যদি বৃষ্টি আমায় ডাকে
এক
ফেসবুক খুলেই দেবোপম দেখল চারটে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। দোলনচাঁপা সেন,জলপরি, নীলাভ আয়না এবং সুনন্দন সাহা। জলপরি ও নীলাভ আয়না কেমন যেন রহস্যময়। এরকম কি কারও নাম হয়? হয়তো ছদ্মনাম বা সন্দেহজনক কোনো ফেক আইডি। আজকাল এইসব মানুষের ভিড় ফেসবুকে। প্রনত আশমান কিছুদিন আগে তার বন্ধু হয়েছে। নাম নিয়ে প্রথমে দ্বিধা ও সন্দেহ ছিল। এখন বন্ধুত্ব গভীর হওয়ায় বেশ ভাল লাগছে। ছেলেটি অসম্ভব ভদ্র ও বিনয়ী। ফেসবুকে যতদূর মানুষকে বোঝা যায় তা থেকেই দেবোপমের এই ধারণা হয়েছে। এখন সে আর নাম নিয়ে ভাবেনা। প্রথমেই দোলন চাঁপা। ফিমেল , জন্ম তারিখ- ১ ফেব্রুয়ারি, সাল নেই। মেয়েরা বয়স চাপা দিতে ভালবাসে। দোলনও চাপা দিয়েছে। দোষের কিছু নয়। ওয়ার্ক –আপাতত বেকার, কাজকর্ম নেই। রিলেশান- কমপ্লিকেটেড। লাইক- পোয়েট্রি , সং।
জলপরি। ৭৯ মিউচুয়েল ফ্রেন্ড। সেক্স – ফিমেল এর বাইরে কোন তথ্য নেই। সুনন্দন সাহা- এল আই সি এজেন্ট। ইন্টারেস্টেড ইন ওম্যান। এল আই সি দেখেই পিছিয়ে এল দেবোপম, এদের খপ্পরে না পড়াই ভাল। ফলে তার নীলাভ আয়না দেখার ইচ্ছেটাও মরে গেল। জলপরি। কী সুন্দর নাম। দেবোপম তাকে বন্ধুতালিকায় যুক্ত করল। বাকি তিনজন আপাতত অপেক্ষায়। ফেসবুক এক মায়াবী দুনিয়া। তবু একে এড়াতে পারেনা সে। এই পৃথিবীর মাঝে আরেক সুন্দর পৃথিবী যেখানে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে পেলে আনন্দে ভরে ওঠে বুকের কার্নিশ। এ যেন সেই সুড়ঙ্গ যেখানে সে ফিরে পায় নিরুদ্দিষ্ট কৈশোর পলাতক রোদছায়ার দিন।
-শুভ সকাল। কেমন কাটছে দিনকাল?
ইনবক্সে মেসেজ। জলপরি। টুং করে শব্দ হল। জলতরঙ্গ বেজে উঠল।কিন্তু বেশিক্ষন নয় তরঙ্গটা মিলিয়ে গেল সাথে সাথেই
বউ ডাকল – শুনছো
শুনেও শুনল না দেবোপম। সেই এক কথা থোড় বড়ি খাড়া। এর বাইরে কোন সৃজনশীল দুনিয়া নেই।
-পরে কথা বলব জলপরি, বাই। একটা স্মাইলিও দিল দেবোপম। এরপর ফেসবুক লগ আউট করে ল্যাপটপ বন্ধ করল। তার এখন অনেক কাজ। আগামী রবিবার সুনন্দপুরে কবি সম্মেলন। কিছু কবিতা লিখে নিয়ে যেতে বলেছে সৈকত সোম। অলীক নৌকা র সম্পাদক। জানিয়েছে নব্বইএর কবিদের নিয়ে একটা সংকলন করবে। বিকেলে কিছু কবিতা লিখতেই হবে। ভাবনাটা মনের ভেতর জালাতে শুরু করল। কোন নতুন চিন্তা আসছেনা। তবে কি ফুরিয়ে যাচ্ছে সে। না কি মাঝে মাঝে এরকম শীত ও শারদ নেমে আসে।
-সারাদিন অং বং লিখলে হবে? ভাবনাটা ভেঙ্গে গেল বউএর চিৎকারে।
-কি হয়েছে কি?
-তা ও বলে দিতে হবে?
-না বললে বুঝব কি করে?
-আলু। ফুরিয়ে গেছে।থলি নিয়ে বাজারে যাও। সামনেই বাপির দোকান। ওখানেই যাও। কুইক…
-আমি যাব এখন?
– তবে কে যাবে?
-কেন তুমি? আমার এখন কত কাজ, একটা ভাবনা আসব আসব করেও আসছেনা। তাকে আনতে হবে।
-ভাবনাকেই আনো, আমি চললাম আলু কিনতে। ভাত টা দেখো, যেন পুড়ে না যায়। নইলে …।
দেবোপম আর কথা বাড়াল না। বলল- থলি দাও, বাজারেই যাচ্ছি।
বাজারে যেতে যেতে দেবোপম ভাবছিল এভাবে কবিতা হয়না। এই বিরুদ্ধতার ভেতর নির্মাণ সম্ভাবনা কতদূর প্রশস্ত ? কি হয় লিখে? একজন আন্তরিক পাঠকও যদি পাওয়া যেত। দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে গেল তাকে। সময় বদলে যাচ্ছে। এই পরিবর্তিত সময়ের মানচিত্র আঁকা কি সহজ তার পক্ষে? এসব ভাবনার ভেতরেই সে লক্ষ করল বাপির দোকানেও লম্বা লাইন। ভয়ংকর ভিড়।
দুই
কলাপাতার উপর পিছলে পড়ছে রোদ। তার দাহ এসে লাগছে জানলার গায়ে। অজস্র ফল ধরে আছে গাছটায়। দেবোপম দেখতে থাকে একটি মধ্যাহ্নের মৃতদেহ। কিভাবে পুড়তে পুড়তে শেষ হয়ে যায় আতসবাজির মত একটি গনগনে দুপুর। বুকের ভেতর শব্দ হাতড়াতে গিয়ে সে টের পায় অনুভূতির বুদ্বুদগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। কোন স্থায়ী দাগ বা অভিঘাতের চিহ্ন পড়ছে না খাতায়। কি লিখবে সে এখন? কোনো সুচনাবিন্দু দেখতে পাওয়ার মত উদ্দীপনাও তৈরি হচ্ছেনা। তার চিন্তাবিশ্ব এক জটিল সংকটের মুখোমুখি এই মুহূর্তে। নৈঃশব্দের মন্থন থেকে আলোড়িত হচ্ছেনা সৃজন সম্ভাবনার নান্দনিক কৌশল সুত্র। চরম নিরালম্ব এবং সিদ্ধান্ত বিহীন পীড়ায় জারিত দেবোপম খুঁজে পাচ্ছেনা কোন ভাবনা ও মেধাবী বিন্যাস যা দিয়ে অতিক্রম করবে এই পরিস্থিতি। ক্লান্তিতে গভীর ভাতঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগল ক্রমশ এবং এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল- সুন্দর পাখি এসে দোল খাচ্ছে তার কবিতার খাতায়। কেউ দেখেনি এরকম পাখি। শিস দিচ্ছে আর গানের সুরের মত তা ছড়িয়ে পড়ছে সারা আকাশে। মায়াবী উদভ্রান্ত আলোয় এক রূপকথার জগতের মধ্যে আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে। একসময় পাখিটা তার মাথার কাছে এল
-তুমি কোন রঙ পছন্দ কর? দেবপম উত্তর দিল–নীল। পাখিটা অমনি নীল হয়ে গেল। বলল–আমাকে আঁকতে পারবে স্বপ্নের তুলিতে? শব্দের জাদুতে।
-কি করে আঁকব আমার তো সব রঙই ফুরিয়ে গেছে।
-কে বলেছে?
-নিজেই বুঝতে পারি।
পাখিটা তার গা থেকে একটি পালক ফেলে দিয়ে বলল– তুলে নাও। এতেই সব রঙ আছে।
দেবোপম পালকটা হাতে নিতেই অদ্ভুত সুগন্ধে ভরে গেল চারপাশ। এই মৌসুমি পালকে সে লিখতে লাগল মেঘমল্লার। অমনি ঝমঝম শব্দে বেজে উঠল বর্ষার পায়েল। পাখিটা একটার পর একটা পালক উড়িয়ে দিয়ে আকাশের আর্দ্রতায় বৃষ্টির মানচিত্রে মিলিয়ে গেল…
স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতেই দেখল জুন ফিরে এসেছে তার স্কুল ছুটির পর। ওর গায়ে জ্বর। খুব বেশি নয়। দেবোপম জিজ্ঞেস করল– কখন এলি?
-অনেকক্ষণ।
-আমাকে ডাকিস নি যে।
– শরীর ভালো লাগছিল না। তাই বিরক্ত করিনি। তোমার পাশেই শুয়ে পড়েছিলাম।
– চল তোকে ডাক্তার দেখিয়ে আনি,জুন।
-দরকার হবেনা, ও এমনিই সেরে যাবে বাবা।
দেবোপম উঠে পড়ে। আর শুয়ে থাকা ঠিক নয়। একতলার এই বারান্দা থেকে আকাশের খানিকটা দেখা যায়। সেখানে সন্ধ্যার নীরব হাজিরা। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার ফেসবুকে বসল দেবোপম। বেশ কয়েকটি মেসেজ এসেছে ইনবক্সে। জলপরি লিখেছে– আপনি তো অসাধারন লেখেন। কবিতায় এত বৃষ্টি কেন?
– আজকাল তো লিখিই না। অনাবৃষ্টি। উত্তর দিল দেবোপম
– আমি জানি, আপনার মনের তরঙ্গ। ভাবনা নুপুর।
– কি করে জানেন?
– যেভাবে ইথার ভাসিয়ে দেয় শব্দমালা।
এ কি প্রশস্তি না আরোপিত বাক্যবিন্যাস।দেবোপম বুঝতে পারে না।
এক গোলকধাঁধার মাঝে দিশেহারা কিছু প্রশ্ন খেলে বেড়ায়। কে এই নারী? নারীই তো নাকি অন্য কেউ? ইয়ার্কি বা ফাজলামি নয়তো? তাই বা কেন করবে? কতটুকুই বা সম্পর্ক তার সাথে। লিখে যদি মনের শান্তিই না এল। নতুন কোন মাত্রাই না যোগ হল তাহলে কি লাভ লিখে। এসব ভাবতে ভাবতে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দুজন মানুষ।
প্রথমজন বলল- তুমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছ দিন দিন, বুঝতে পারছ না?
দ্বিতীয়জন– না তো। আমি তো স্বাভাবিক আছি। রক্তে মাংসে, মনে।
-আয়নায় দেখেছ নিজের মুখ? চিন্তার বলিরেখা সেখানে।
-আয়না আর কতটুকু প্রতিচ্ছবি দিতে পারে?
-ঘর সংসার, রুগ্ন স্ত্রী, অসুস্থ বাবা মা। মেয়ের বেড়ে ওঠা… এসব টের পাও?
-পাই।
-পাওনা। তাই জলের মত পয়সা ওড়াও অনর্থক। কি হয় লিখে? ট্যুইশন করতে পারো তো অবসরে?
-অর্থ তো আমি কোনোদিন চাইনি। আমার কেবল শব্দের অনুসন্ধান।
-কোন লাভ নেই।
-তা আমিও জানি।
দুটো দেবোপম মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই শেষ সে আর কবিতা লিখবে না। রাত বাড়তে থাকে নীরবতার ভেতর। শুধু পাতা ঝরার শব্দ আর রাত পাখির কিচির মিচির।
আরো পড়ুন: ভালোবাসা দিবসের ছোটগল্প: ভাষা ও ভালোবাসা
তিন
কবিতার আড্ডা শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষন। খুব বেশি কবি সমাগম হয়নি। ট্রেন ও বাসের গোলমাল থাকায় দেবোপমের দেরি হয়েছে খানিক। সৈকত ভীষণ ব্যস্ত। অনুষ্ঠান নিয়ে মেতে রয়েছে। আজকের কবিতার সাথে খুব বেশি পরিচয় নেই দেবোপমের। যারা কবিতা পড়ছেন তাদের মুখ তো দূরের কথা নাম ই শোনেনি সে। সাম্প্রতিক কবিতায় কত রূপবদল ঘটে গেছে।
যারা কবিতা পড়ছেন তারা নিজেদের কবিতা পড়া শেষ হলে ব্যাগ গুছিয়ে বাসের খোঁজ করছেন নয়তো সিগারেটের নেশায় চলে যাচ্ছেন হলের বাইরে। ঘরের মধ্যে যারা আছেন খুশ গল্পে মশগুল।
-আসি সুরঞ্জন , মাঙ্গলিকের অনুষ্ঠানে দেখা হচ্ছে তাহলে
-অবশ্যই যাব। সামনের রোববার তো?
-হ্যাঁ, ১৩ এপ্রিল। ঠিক সকাল ১০ টায়।
-অল্পক্ষন থেকে যা,আর তো কয়েকজন মাত্র বাকি, তাদের কবিতা শুনলে কি খুব দেরি হবে?
পিছন ফিরে দেবোপম দেখল সাগর হাজরা আর সুরঞ্জন মাইতি। এদের ছবি ও সাক্ষাৎকার অনেক বাণিজ্যিক কাগজে দেখা যায়।
-দেরির কিছু নেই, কতগুলো অপোগণ্ড কবির কবিতা শুনে টাইম ওয়েস্ট করা মিনিংলেস। নব্বইএর কবি মানে তো সেই প্যানপ্যানানি আবেগ। শালা কবিতা না প্রেমপত্র কি যে পড়ে বুঝতে পারিনা।
কবি সাগর হাজরার সাথে পরিচয় করার লোভ হয়েছিল। কিন্ত ওর বক্তব্য শুনে ইচ্ছেটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকে গেল।
নিজেকে ভীষণ অপমানিত মনে হল। দেবোপম যখন কবিতা পড়তে উঠল, দেখল চারপাশে প্রায় কেউই নেই। অনেকগুলো কবিতা সে বেছে রেখেছিল। সব ব্যাগের মধ্যে রেখে শুধু একটি কবিতাই পড়ল– যদি বৃষ্টি আমায় ডাকে। বুকের ভেতর কষ্ট চেপে রেখে সংযত আবেগে কবিতাটি পড়তে থাকল। দীর্ঘ কবিতা। কেউ তো শুনছে না তাই মাঝের বেশ কিছু লাইন বাদ দিয়েই ছোট করে নিল কবিতাটি। অনেকদিন আগের লেখা হলেও তার প্রিয় কবিতা।
কবিতা পড়া শেষ হলে সৈকত বলল– নব্বইএর যে সংকলনের জন্য তোর কাছে কবিতা চেয়েছিলাম, তার আর প্রয়োজন নেই, এর মধ্যেই প্রচুর কবিতা এসে গেছে, নতুন করে আর কারও কবিতা নিতে পারছিনা। সরি।
-ও কোন ব্যাপার নয় বন্ধু। তোর ডাকে সাড়া দিতে পেরে খুব ভাল লাগল। আজ আসি।
-এখন তো তোর কোন ট্রেন নেই। আজ রাত টা আমার বাড়িতে থেকে যা না। খুব আড্ডা হবে।
-প্রচুর আড্ডা হল ভাই আর ভাল লাগছেনা। এবার ঘরে ফেরাই উচিত।
বাইরে বেরিয়ে এসে দেবোপম দেখল সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এসেছে। এখন তার কোন ট্রেন নেই। শেষ বাসও চলে গেছে চারটে চল্লিশে। সারারাত স্টেশনে কাটিয়ে ভোরের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতেই হবে। আর সারাজীবনেও এ রাস্তা মাড়াচ্ছি না। যতসব পাগলামি। কে এর মূল্য বোঝে। বউএর বকুনি। বিখ্যাত কবিদের অবজ্ঞা। কবিতা লিখি বলে যেন কোন সম্মান নেই। সৈকতের এরকম আচরণেরও কোন গ্রহণযোগ্য কারণ খুঁজে পেলনা দেবোপম। কবিতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য এই পরিস্থিতির দরকার ছিল।
-এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন বন্ধু? কেউ যেন সুরেলা গলায় ডাকল।
ফিরে তাকাল দেবোপম। নীল শাড়িতে অপূর্ব লাগছে ভদ্রমহিলাকে। কপালেও নীল টিপ। তাকে চেনা চেনা মনে হল কখনো যেন দেখেছে কোথাও। স্মৃতির ভেতর অনেকদূর হেঁটে গেলেও কোন কূলকিনারা করতে পারল না।
-চিনতে পারছেন না, তাই তো। আপনি দেরিতে এসেছেন, তাই আমার কবিতা শোনেন নি। আমি নীলাঞ্জনা সান্যাল। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল দেবোপম।
-আপনাকে আমি সত্যিই চিনিনা। কিন্তু আপনার মুখে ওই বন্ধু ডাক বড় আপন মনে হল।
-আমিও ছিলাম আপনাদের কবিতার আড্ডায়।
-নজরে পড়েনি।
-নজরে পড়ার মত কোয়ালিটি আমার নেই।
-মিথ্যে অভিমান করছেন। আপনিও কি ট্রেন ধরবেন? চলুন গল্প করতে করতে যাওয়া যাক।
-আমি তো এখানেই থাকি।
-এখানে?
কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে আসার পর নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হল। এ তো অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। অবান্তর। সত্যি তো এখানে কি কারো বাড়ি হতে পারেনা। সামনের গাছটার দিকে তাকিয়েছিল দেবোপম। পাখিদের কিচির মিচির শব্দে ঢাকা পড়েছে যাবতীয় শব্দের কারুকাজ। পরিস্কার আকাশের আধখানা জুড়ে সুন্দর চাঁদ উঠছে আজ।
-আপনার তো এখন কোন ট্রেন নেই। কোথায় যাচ্ছেন? চমকে উঠল দেবোপম। আমতা আমতা করে বলল– না, মানে…
বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড ধক ধক করছে। ভেতরে জল নেই। পিপাসায় শুষ্ক কণ্ঠনালী।
-মুখ শুকনো লাগছে কেন? খাওয়া হয়েছে?
-হ্যাঁ বাড়ি থেকে খেয়েই বেরিয়েছি। খিদে নেই আর।
-আচ্ছা মানুষ তো আপনি। গোয়ালগঞ্জ থেকে সুনন্দপুর প্রায় ৭০ কিলোমিটার রাস্তা। কোন সকালে খেয়েছেন, এতক্ষন উপোষ। চলুন আমার বাড়ি। আপনার কোন কথাই শুনব না।
-গোয়ালগঞ্জ? আপনি জানলেন কি করে? সেখানে আমার বাড়ি। বাকরুদ্ধ হয়ে আসে। নীলাঞ্জনা হাসল বিস্ময়াতীত হাসি। যা বহুমাত্রিক অথচ রহস্যময়। প্রিয় কবির কত খবরই তো রাখি। রাখতে হয়।
-সম্ভব নয়।
-কেন? চেনেন না বলে? সৈকতদার মত আমি আপনার কলেজের বন্ধু নই বলে?
-এগুলো ও তো সত্যি। সত্যিই তো আমি আপনাকে চিনি না।
-কবিতার জগতে সবার সাথেই একদিন প্রথম পরিচয় হয়। সেদিন সেই অপরিচিত মানুষটিকে অবজ্ঞা করা সহজ। এড়িয়ে চলাটাই ঘোষিত রীতি।
খোঁচাটা গায়ে লাগল খুব। আসলে তা নয়। বাড়িতে কি পরিচয় দেবেন আমার?
-সে আমি বুঝব। এমন তো হতে পরিচয় দেওয়ার ই দরকার হল না।
সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারছিলনা দেবোপম। তবু এক অদৃশ্য মায়াচুম্বক তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল।
চার
চারপাশে বইএর পাহাড়। স্তূপীকৃত বইয়ের ভেতর নিজের বইগুলোও দেখতে পেল। আলোপাখি সেতো কতদিন আগের। নব্বই একানব্বই হবে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ। অথচ কি সুন্দর ভাবে গুছিয়ে রেখেছে। নীন মানচিত্রের নীচে বেরিয়েছিল তারপর। নিজেরই মনে নেই এর প্রকাশকাল। কবিতার বই সাজিয়ে রাখার সখ থাকে কারও। নীলাঞ্জনা হয়তো সেরকম ই একজন
-বিশেষ কিছু বানাতে পারিনি কিন্তু। সামান্য আলুর দম আর পরোটা।
-কেন এত কষ্ট করতে গেলেন, আমি তো চলেই যাচ্ছিলাম।
ধুয়ো উঠছে খাবারে ।টাটকা গন্ধে ভরে আছে চারপাশ। খুব তৃপ্তি সহ খেল দেবোপম। বুকের ভেতরের জ্বালা যন্ত্রনা সব কেমন স্থির হয়ে গেল। ক্লান্তি উধাও।
-একটা প্রশ্ন করব, কিছু মনে করবেন না তো?
-হাজার প্রশ্ন করতে পারেন, কেন মনে করব?
-যদি বৃষ্টি আমায় ডাকে কবিতার পুরোটা বললেন না কেন?
-পুরোটাই তো বলেছি।
-উ হু পুরোটা বলেন নি। “ বৃষ্টি যদি আমায় ভালোবাসে তবে ভিজিয়ে দিল কই” এ লাইনটা তো বলেননি।
-স্তব্ধ হয়ে গেল দেবোপম। নির্বাক। যেন মাটির ভেতর দৃঢ় হয়ে গেছে তার শেকড়। মাথার উপর আলোময় আকাশ। সে যেন ফিরে আসছে মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে।
-ঐ কবিতার প্রতিটি লাইন আমার মুখস্ত। আপনার যত বই বেরিয়েছে, সব সংগ্রহ করেছি, পড়েছি। এখনও সব কবিতা মুখস্ত বলে দিতে পারি। প্রতিটি লাইন। চিত্রাপিতের মত মনে হল দেবোপম কে। যেন সে স্বপ্ন দেখছে। এ তো সত্যি হতে পারেনা। কবিতার কোন ইকোনোমিক ভ্যালু সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু নেই। কেউই তো আজকাল কবিতা পড়েনা। তাহলে কি করে মাটির দুনিয়ায় এ ঘটনা ঘটবে। অনেক কষ্টে টেনে টেনে বলল- কেউ তো আমার কবিতা পড়েনা।
-আর কেউ না পড়লেও আমি তো পড়ি। এ কি নিছক আমার ই পাগলামি?
কোন উত্তরপত্র তৈরি ছিলনা দেবোপমের হাতে। এক দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে ফিরে আসছিল শব্দের স্টেশন। ট্রেন থেমে ছিল। সবুজ ইশারা ছিলনা। তবু ভাবনাগুলো গতিশীল হয়ে উঠল আজ। দেবোপম ডাকল– নীলাঞ্জনা।
-ও নামে আপনি আমায় ডাকবেন না ।
-কেন ?
-আমি আপনার কাছে বৃষ্টির মানচিত্র হয়েই থাকতে চাই। আপনি আমায় জলপরি নামেই ডাকবেন।
-তুমিই জলপরি? বিস্ময়ে পা দুটো গেঁথে গেছে ভূমিতে। চোখ স্থির। অপলক।
-সবার কাছে নয়। শুধু আপনার কাছে।
দেবোপম দেখল স্বপ্নের সেই নীল পাখিটা আবার নেমে এসেছে তার কবিতার খাতায়।

কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
জন্ম ১৯৭২, পুরুলিয়ায়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ এক ডজন। পেয়েছেন ত্রিবৃত্ত পুরস্কার মালীবুড়ো সন্মান সহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সন্মাননা। কেতকী পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত।