Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ভালোবাসা দিবসের ছোটগল্প: দোপাটি ভোর

Reading Time: 5 minutes

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,valentine dayএই সুকোমল ভোরের প্রথম আলোয় মুনিয়াকে দেখে আমি চমকে উঠি। সুগন্ধা বিচের মনোরম আর প্রায় নির্জন ভোরটাও হয়তো চমকে ওঠে আপনমনে। মুনিয়া এখানে! বেলাভূমি ধরে ধীর পায়ে হেঁটে আসতে থাকা মুনিয়াকে হঠাৎ দেখে আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারি না। ও এখন গজ পঞ্চাশেক দূরে। নরম ভেজা বালির ওপর খালি পায়ে হেঁটে মুনিয়া আসছে যেন একটা শিশিরভেজা দোপাটির ঝাড়, সেই পনের বছর আগেকার মতোই। আমাকে দেখেনি এখনও কিংবা দেখলেও চিনতে পারেনি। পনের বছরে কম তো আর বদলাইনি!

দোপাটির ঝাড় হাঁটতে হাঁটতে আরও কাছে, একেবারে কাছে চলে আসছে তার সমস্ত সুগন্ধ আর মুগ্ধকর সৌন্দর্য নিয়ে। আমি কিংকর্তব্যবুমূঢ় হয়ে খাটটা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। আচমকা চোখের সামনে আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে মুনিয়া তাকায় একবার, তারপর আরেকবার, ওর চোখে পলক পড়ে না যেন!

অ-নি-ক!

মুনিয়ার ধীর উচ্চারণের পরও আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়েই থাকি। আমার শত চেষ্টার হাসিটাও ঠোঁট পর্যন্ত আসার গন্তব্য ভুলে যায় বোধহয়। মুনিয়া আমাকে দেখেছে! আমাকে চিনেছে! পৃথিবীর দীর্ঘতম বেলাভূমিতে ও আমার নিকটতম দূরত্বে আছে সেটা ভেবেই আমার সমস্ত অস্তিত্ব অসাড় হয়ে যেতে চায়। এটা সত্যি না এক অলীক স্বপ্ন তা বুঝতে পারি না একদম।

আরে অনিক! এটা সত্যি তুমি তো!
কেবল কণ্ঠেই নয়, মুনিয়ার দু’চোখেও অবিশ্বাসের জোয়ার পাড় ভাঙ্গে। তারপর যেন ওর দোপাটি ঠোঁটে সূর্যের সমস্ত আলো এসে জড়ো হয়। ওর সত্যিকারের খুশি দেখে এতক্ষণে আমি একটু ধাতস্থ হই। আর এই প্রথম আমার মুখে কথা আসে-

আমিই তো, মুনিয়া, চিনতে পারলে তাহলে?

ও আমার কথার জবাব দেয় না। এই নির্মল ভোরবেলায়ও আমার এমন প্রশ্নে ওর ভ্রু কি একটু কুচকায়? আমি ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগেই সামলে নিয়ে মুনিয়া বলে-

বসব? কত্ত বছর পরে আমাদের দেখা হলো, তাই না?

তারপর আমরা পাশাপাশি বসি। সমুদ্রে তখন প্রবল জোয়ার, বড় বড় সব ঢেউ পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে। নভেম্বরের ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা আমাদের গা ভিজিয়ে দেয়। আমরা গল্প করি যেন মাঝখানে পনেরটা বছর কেটে যায়নি নিরুদ্দেশে। যেন সব সময়ই আমাদের দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।

তারপর? বেড়াতে এসেছ?
মুনিয়া প্রশ্ন করে আবার, ওর কথার ধরনও একইরকম রয়ে গেছে। সেই পুলিশ লাইন কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রীটার মতোই, অবিকল।

হ্যাঁ, তাই এসেছি। তুমি?

আমি? হানিমুন।

হানিমুন? সত্যি?- আমি বিস্ময় গোপন না করতে পেরে জিজ্ঞাসা করি আবারও।

সত্যি, অনিক। হানিমুনেই এসেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না?

আমি কোনো জবাব দিই না। তবে সত্যিই আমার অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় মুনিয়ার কথা। ওর কথা অবিশ্বাস করার পক্ষে যুক্তিও সাজিয়ে ফেলি মনে মনে। ধুর! হানিমুনে এসে কি কেউ বরকে ফেলে রেখে একলা ঘুরতে বেড়ায় ভোরবেলায়? ও নিশ্চয়ই আমার সাথে মজা করছে।

মুনিয়া মনে হয় আমার এই দুর্বল যুক্তি খোঁজার বিষয়টা বুঝে ফেলে, যেমন ও সবকিছু বুঝে যেত আজ থেকে দেড় দশক আগের দিনগুলোতে।

আচ্ছা শোনো, রওনক ঘুমাচ্ছে এখন। বেচারা এত সকালে উঠতে পারে না। তাই আমি একলা বেরিয়ে পড়লাম।

আচ্ছা- বলে আমি চুপ করে যাই। যে মুনিয়াকে আমি চিনি, তার পক্ষে এমনটা করা আশ্চর্য কিছু নয়।

সকালটা বড়ো হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ঝকঝকে রোদ সমুদ্রের ফেনিল জল আলতো ছুঁয়ে আছে এখন। সকালের সৈকত দেখতে আসা মানুষের ভিড় বাড়ছে। মুনিয়ার এলোমেলো বারগেন্ডি রংয়ের খোলা চুল বাতাসে উড়ে উড়ে আমাকে ছুঁয়ে যায়। পনের বছর আগেও যেমন আসতো হঠাৎ কখনো। আমি পুরনো দিনে হারিয়ে যেতে যেতে আবার ফিরে আসি। ঢেউয়ের গর্জন, এলো বাতাস আর পাশে বসা কোমল হলদে রংয়ের জামায় একটা নতুন কিংবা সেই দেড় দশক আগের মুনিয়া আমাকে অতীতে ফিরতে দেয় না।

মুনিয়াই নিস্তব্ধতা ভাঙ্গে- বিয়ে করেছ, অনিক?

আমি? না।

আচ্ছা।

ওর ছোট্ট উত্তরের পর আবার আমরা চুপ করে যাই। আমাদের চারপাশে এলোমেলো হেঁটে আসা মানুষজনের হাসি, গল্প, সুখ কিংবা বিষাদময় মুখের গল্প আমাদের তেমনভাবে স্পর্শ করে না। মাঝেমধ্যে পাশে বসা মুনিয়ার চেয়েও পনের বছর আগের মুনিয়া যেন এসে দাঁড়াচ্ছে আমার সামনে। পুলিশ লাইন কলেজের গেটে সমীর মামার দোকানের ঝাল ফুচকা খাওয়ার সময় ঠোঁট গোল করে বারবার ফুঁ দেয়া মুনিয়া, এক দুপুরে ক্লাস পালিয়ে চিকলির বিলে নৌকায় ঘুরতে যাওয়া দুই বেণি ঝোলানো মুনিয়া, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বুকভরা দরদ দিয়ে ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’ গাওয়া মুনিয়া যেন বহুদিন পর আবার খুব জীবন্ত হয়ে পাশে এসে বসেছে আমার। এত এত সব মুনিয়াই এসে এসে কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে এই মুনিয়ার মাঝে।

আমি সেই মুনিয়াকে জিজ্ঞাসা করি-

সুপারমার্কেটের মান্নানের চটপটির কথা মনে আছে তোমার?

সোনারং আলোয় একটা হলদে রংয়ের মুনিয়া পাখি আমার চোখে তাকিয়ে হাসে এবার-

সেখানেই তো তোমাকে চিরকুটটা দিয়েছিলাম, অনিক। মনে থাকবে না?

আমি অবাক হয়ে যাই আবার, মুনিয়া এত বছরেও বদলায়নি এতটুকু! সেই একইরকম চটপটে, অকপট, সরল! ওর কথায় সেই ছোট্ট সাদা চিরকুটটা যেন আমার বুকপকেটে এসে আবার ঠাঁই নেয় আদরে- যে চিরকুটে মুক্তোঝরানো অক্ষরে লেখা ছিল ‘অনিককে মুনিয়া ভালোবাসে’! কত কতদিন সেই চিরকুটটা বুকপকেটে রেখে দিয়েছিলাম আমি! তারপর মুনিয়ার মা-বাবার ট্রান্সফার হলো, সেকেন্ড ইয়ারের প্রথমেই ওরা চলে গেল যশোরে। ঐ সময় ওর বাবার অফিসের ঠিকানায় চিঠি লিখেছিলাম কত, উত্তর পাইনি কোনোটার। কী আশ্চর্য! মুনিয়া আমার সাথে যোগাযোগ রাখেনি কোনো।

অতীত আর বর্তমানের ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে আমি বুঝতে পারি না মুনিয়ার প্রতি আমার সেই পুরনো অভিমানটা ফিরে আসে কি না। তবে গলার কাছে কিছু তো একটা দলা পাকাচ্ছে এখনো। আমার হঠাৎ ওর কাছে অনেক অনেক প্রশ্নের উত্তর জানতে ইচ্ছে করে।

জোয়ারে ভেসে আসা ছোট্ট একটা ঝিনুক কুড়িয়ে নিয়ে মুনিয়া হঠাৎই বলে ওঠে-

অনিক হাঁটবে? চলো হাঁটি।

মুনিয়ার পাশাপাশি ভেজা বালুতট ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি আরও একবার অনুভব করি এই ডাকের আজন্ম কাঙাল আমি। কাল রাতে তানিশার সাথে কাটানো উত্তাল সময় যেন আমাকে ভেংচি কাটে। শুধু তানিশা নয়- রিংকি, পর্ণী নামের অচেনা মেয়েদের সঙ্গে কাটানো সময়গুলোও যেন আমাকে সং সাজিয়ে মজা দেখছে। ওদের সঙ্গে হাজার টাকায় কেনা টুকরো টুকরো মিনিটগুলো বাদে আজ পর্যন্ত আমি আসলে মুনিয়া ছাড়া কাউকে চাইনি এ জীবনে। কিন্তু আচমকাই সেই মিনিটগুলোর জন্য নতুন করে অপরাধবোধে ছেয়ে যায় আমার ভেতরটা। আমি মুনিয়ার দিকে তাকাতে পারি না।

দুটো বাচ্চা চাওয়ালা আমাদের দিকে হাসি ছুড়ে দিয়ে পাশ কাটায়। বেলাভূমিতে দর্শনার্থীর ভিড় আরও বাড়ছে। চা, বাদাম, কলাওয়ালাদের সাথে একজন পেঁয়াজু বেগুনিও বিক্রি করছে এই সাত সকালে। সেদিকে তাকিয়ে মুনিয়া বলে-
এবার পেঁয়াজ কী ঝাঁঝটাই না দেখালো বাবা!

আমি হা হা করে হাসি। পেঁয়াজের দাম নিয়ে সত্যিই কী না হলো এ বছর! বাপের জন্মে কেউ ভেবেছে আড়াইশো টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কিনতে হবে কোনোদিন?

হাঁটতে হাঁটতে এক তরুণীর গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে খাই না। আমার বিব্রত মুখ দেখে মুচকি হাসে মুনিয়া। তারপর আমরা আবার হাঁটি। লাবণী পয়েন্টের শেষ মাথায় পৌঁছানোর আগে আমরা আর কথা খুঁজে পাই না। যেন শুধু পাশাপাশি হাঁটাই আমাদের ভবিতব্য।

সূর্যটা এতক্ষণে সবটুকু রোদ বিছিয়ে দিয়েছে চারপাশে। ফেনিল ঢেউ সে রোদে ঝিকমিক করে। আমি সেদিকে তাকিয়ে মুনিয়াকে জিজ্ঞাসা করি-

আমার একটা চিঠিরও উত্তর দাওনি কেন, মুনিয়া?

চিঠি!

দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় মেখে মুনিয়া আমার চোখে তাকায়। তারপর গত পনেরটা বছরে জীবনের নানা অভিজ্ঞতা মেখে বড় হওয়া আমরা দু’জনেই বুঝে যাই সে চিঠির একমাত্র সম্ভাব্য অতীত। সে চিঠি নিয়ে তাই আর অযথা বাক্য ব্যয় করি না আমরা।

তবে মুনিয়ার চোখের পাতায় যেন নভেম্বরের প্রথম শিশির জমে। সে শিশিরে ধুয়ে যায় ওর দোপাটি জীবনের অতীত অবিশ্বাস। জলধোয়া গভীর কালো চোখ তুলে মুনিয়া বলে-

চিঠি না হয় হাতে আসেনি। তুমি কেন একবারও যশোরে এলে না, অনিক? অন্তত একবার তো আসতে পারতে!

আমি ওকে বলতে পারি না সেকালে একজন আঠারো বছরের কিশোরের কাছে যশোর মানে বিদেশ, সে কিশোর সেই অচেনা বিদেশের গন্ডি পেরিয়ে তার হারানো মুনিয়ার হদিস করতে পারেনি।

আমার বোবা চোখের দিকে তাকিয়ে মুনিয়া হয়তো আমার না পারার ব্যর্থতা ক্ষমা করে দেয়। কে জানে, হয়তো দেয় না। একটা বাড়ন্ত সকালের আলোয় এক সমুদ্র জলের দিকে, গভীরতর সমুদ্রের দিকে ও তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর কেমন আচ্ছন্ন স্বরে বলে-

বেলা হলো, অনিক, চলো ফিরি।

কোথায় ফিরব সে প্রশ্ন করতে গিয়েও আমি শেষ মুহূর্তে থামি। হঠাৎ মুনিয়া ওর ডান হাতে আমার বাম হাতটা ধরে। আমি এবার আপাদমস্তক কেঁপে উঠি। তারপর একটা সর্বনাশা ইচ্ছেকে বুকের ভেতর পাথর চাপা দিতে দিতে ওকে বলি-
চলো ফিরি।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>