| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ভালোবাসা দিবসের ছোটগল্প: প্রেম প্রকৃতি 

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

  

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,valentine dayধুর, আজ সকাল থেকেই রাধিকার মন ভালো নেই। বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে, ফেসবুকের পাতায় পাতায় লাল হৃদয়ের পতাকা উড়ছে। আর বেছে বেছে ঠিক এই সময়েই দু-বছরের পুরনো দম্পতি সৌম্য আর রাধিকার মধ্যে শুরু হয়েছে মন কষাকষি। কোন মানে হয়! সাত-দিন হয়ে গেল তাদের মান-অভিমান চলছে, দোষ হয়তো রাধিকারই একটু বেশি। তবুও সে আশা করেছিল, চোদ্দই ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সৌম্য নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে, রাধিকার হাত ধরবে, মান ভাঙাবে।   

কিন্তু ও হরি, সে গুড়ে বালি। ঘড়িতে ন-টা বাজতেই সৌম্য বেরিয়ে গেছে অফিসে। অভিমানে রাধিকার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। তবে খালি বাড়িতে একা একা চোখের জল ফেলে আর লাভ কী। রাধিকার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, সে ভারাক্রান্ত মনে কফির কাপ হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ায় লিভিং-রুমের জানলার পাশে।

ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ, প্রকৃতি এখন বড় মনোরম। ঝকঝক করছে নীল আকাশ, বাড়ির সামনের পার্কটা ভরে আছে মরশুমী ফুলে, দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছটায় ফুল এসেছে ঝেঁপে। প্রেম যেন মূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। কিন্তু সৌম্য আর রাধিকার সম্পর্কে প্রেমের অবস্থান কোথায়? প্রিম্যারেজ আট-বছর আর পোস্ট ম্যারেজ দু-বছরেই কি তাদের প্রেম ফুরিয়ে গেল? হারিয়ে গেল? মিলিয়ে গেল শূন্যে? অথচ এই সৌম্যকে পাওয়ার জন্যই রাধিকা কত লড়েছিল বাড়িতে।  

সৌম্যর সঙ্গে রাধিকার চেনা ক্লাস ইলেভেন থেকে, দুজনে একই কোচিং ক্লাসে পড়তে যেত। রাধিকাদের পরিবার ভীষণ গোঁড়া, ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে গার্লস স্কুলের ছাত্রী রাধিকার মুক্ত মেলামেশা একেবারেই পছন্দ করতো না। তবু সাউথ-পয়েন্টের ছাত্র সৌম্যর সঙ্গে রাধিকার খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, তারপর বিয়ে। একমাত্র মেয়ের ইচ্ছেকে বাবা-মা শেষ অবধি মেনেই নিয়েছিলেন।      

ক্লাস-টুয়েলভেই ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে সৌম্য পকেট মানি থেকে পয়সা বাঁচিয়ে এক গুচ্ছ গোলাপ দিয়েছিল রাধিকাকে। তারপর এতগুলো বছর কেটে গেছে, প্রেম দিবসে উপহার দিতে কখনই সৌম্য ভুলে যায়নি। বরং চাকরি হওয়ার পরে, পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে, উপহারের মানও বৃদ্ধি পেয়েছে ধাপে ধাপে।    

রাধিকা ঠোঁট কামড়ায়, যাহ্‌, উপহারের মানের সঙ্গে কি ভালোবাসা সমানুপাতিক?

সে নিজের মনে বলে ওঠে, কখনওই নয়, বরং আগে রাধিকাকে চোখে হারাতো সৌম্য। এখন বিয়ের পরে, ঘরকা মুর্গি ডাল বরাবর। নাহলে আজ সকালেও মুখ হাঁড়ি করে অফিসে চলে গেল! উপহারের প্রসঙ্গ উচ্চবাচ্যই করলো না! রাধিকার কী চাই জিজ্ঞাসা করতেও ভুলে গেল। সাতদিন আগে তাদের ঝগড়া হয়েছিল অন্য কিছু নয়, সোমরস নিয়ে। রাধিকার বাপের বাড়িতে অ্যালকোহল একেবারেই চলে না, ওয়াইনও নয়। তাই বলে সৌম্যর অ্যালকোহল প্রীতি নিয়ে রাধিকা কোনদিনই কোনরকম আপত্তি জানায়নি। কিন্তু সৌম্য হল একটু নার্ড প্রকৃতির, বন্ধুবান্ধব কম,কাজের বাইরে লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা অত পছন্দ নয়। বিয়ের পর থেকে সোমরসের সঙ্গী হিসেবেও সে রাধিকাকে টানার চেষ্টা করে।   

সৌম্যর আব্দারে বিরক্ত রাধিকা সেদিন ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল,“এ বাড়িতে সবই তোর পছন্দ মত হবে,তাই না? তুই সি-ফুড খাস না, তাই বাজারে গেলে সি-ফুড নিই না। আমি বেগুন ভালোবাসি, তোর তাতে গলা চুলকায়। আমার নিরামিষ ভালো লাগে, তোর তিনশো-পঁয়ষট্টি-দিন দু-বেলা মাছ-মাংস চাই-ই চাই।“

সৌম্য ব্যাজার মুখে বলেছিল,“তোর বাপের বাড়ির সবাই ভীষণ মুনি ঋষি টাইপ, একটু সেকেলে মার্কা।“  

উত্তরে রাধিকা কেটে কেটে বলেছিল,“হ্যাঁ, আমিও আমার বাবার মত প্রাচীনপন্থী, অত আধুনিকা নই। তুই যত পারিস রাম-হুইস্কি-ওয়াইন টেনে যা, শুধু আমাকে টানিস না।“    

সৌম্য বলেছিল,“এটা তোর জেদ। আমার সঙ্গে বসে ওয়াইনের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ালে কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। ভালোবাসি বলেই তোর সঙ্গ চাই, নাহলে আর কী। তাছাড়া, মানুষকে তার দোষগুণটুকু নিয়েই ভালবাসতে হয় রাধিকা।“    

রাধিকা চেঁচিয়ে উঠেছিল,“তাই নাকি? ছোট থেকেই আমার নিজের কুকুর থাকে। দেড়-বছর হল টফি নেই। তোর চারপেয়ে পুষ্যি পোষায় না, তাই বাড়িতে কুকুর-বেড়াল ঢোকানো বারণ। তারবেলা?”

নীল আকাশের দিকে চোখ রেখে কফির কাপে একটা দীর্ঘ চুমুক দেয় রাধিকা, ভাবে, সৌম্য অধম তাতে কী! রাধিকা উত্তম হতেই পারে। যেমন ভাবা তেমন কাজ, জানলার পাশ থেকে সে দ্রুত সরে আসে, কিচেনে ঢুকে সিঙ্কে কাপ নামিয়ে রেখে ঢুকে যায় বাথরুমে, শাওয়ার নিয়ে চটপট তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বেরোয়।    

বাড়ির পাশের মলে ঢুকে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন গিফট-শপে ঘোরাঘুরি করে অবশেষে ঢুকেই পড়ে। তবে ওয়াইনের নাম সে তো অত জানে না! গতকাল রাতে সে চোদ্দই ফেব্রুয়ারি রাতের জন্য ফিশ-টিক্কা মেরিনেট করে রেখেছিল। হাল্কা ভাবে মনে পড়লো, ফিশের সঙ্গে হোয়াইট ওয়াইন ভালো যায়। রাধিকা হোয়াইট ওয়াইনের একটা বোতল কিনে হাতের ঝোলা ব্যাগে ভরে বাড়ি ফিরে এলো।   

ওয়াইনের বোতল চিলারে রাখার সময় রাধিকার মন ভরে গেল আত্মপ্রসাদে। ইয়েস, আফটার অল সে তো সৌম্যকে ভালোবাসে। সারাবছর নয়, সৌম্যর খাতিরে শুধু আজ প্রেম দিবসে সে না হয় ওয়াইনের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ালই। তারপর সেই ওয়াইন রাধিকার পেটে গেল না কিচেনের সিঙ্কে গড়াগড়ি খেল, সৌম্য অত খেয়াল করার মানুষ নয়।     

দুপুরে রাধিকা আশা করেছিল, হয়তো সৌম্য অফিস থেকে ফোন করবে, দুজনে একসঙ্গে মার্কেটিং যাওয়ার প্ল্যান হবে। নিদেনপক্ষে সন্ধ্যে সাতটার পরিবর্তে বিকেল বিকেল সৌম্য বাড়ি ফিরে আসবে।    

তবে রাধিকার প্রত্যাশা মত কিছুই হল না। অবশেষে সন্ধ্যে ছ-টা নাগাদ রাধিকা মনের দুঃখ পাশে রেখে ফ্রেশ হয়ে সামান্য প্রসাধন করে নিল, কিচেনে ঢুকে মেরিনেট করা ফিশ-টিক্কাগুলো ঢুকিয়ে দিল ওভেনে।  

পৌনে সাতটা নাগাদ কলিং বেল বেজে উঠতেই রাধিকার মুখের পেশী শক্ত হয়ে উঠেছিল। তবে সে নিজের অভিমান সামলে হাসি মুখে দরজা খুলে দেখে, সৌম্যও হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। সৌম্যর কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ, বাঁ-হাতে একটা বেতের বাস্কেট, আর ডান হাতে রাধিকার প্রিয় এক গুচ্ছ হলুদ গোলাপ।    

গোলাপ আর বেতের বাস্কেটটা রাধিকার হাতে দিয়ে সৌম্য বলল,“হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন’স-ডে বিউটিফুল!”   

খুশিতে মাখনের মত গলে, চোখ ছানাবড়া করে রাধিকা দেখে, আরিব্বাস! বেতের বাস্কেট থেকে উকি দিচ্ছে সাদা উলের বলের মত জ্যান্ত একটা কুকুরছানা। উফ কী মিষ্টি, কী মিষ্টি! 

ঘরে ঢুকে টাইয়ের নট আলগা করতে করতে সৌম্য বলল,“মাসদুয়েক আগে বস বলেছিল, তখনই তোর কথা বলেছিলাম, ভ্যালেন্টাইন-ডে তে উপহার দেব বলে অপেক্ষা করছিলাম। পাঁচটায় অফিস থেকে বেরিয়েছি। বসের বাড়ি থেকে মিসকে নিয়ে আসতে এতটা সময় লেগে গেল। খুব খিদে পেয়েছে, ভালো কিছু আছে নাকি?”

বিগলিত রাধিকা পরম যত্নে বেতের বাস্কেটটা ঘরের কোনে রেখে আহ্লাদী স্বরে বলল,“আছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো।“     

বাথরুম থেকে বেরিয়ে, জামাকাপড় পরে, চুল আঁচড়ে, লিভিং-রুমে এসে সৌম্য তো একেবারে বিস্ময়ে ‘থ’। ওহ বাবা, এসব কী! সে ঠিক দেখছে তো?

ডাইনিং টেবিলের মাঝে ফুলদানিতে গোলাপ ফুল। পাশে বড় এক প্লেট ধোঁয়া ওঠা ফিশ-টিক্কা উইথ স্যালাড, এক বোতল চিলড হোয়াইট ওয়াইন। তার পাশে দুটো ছোট প্লেট, কাঁটা চামচ আর ওয়াইনের গ্লাস। ইয়েস, ওয়াইনের গ্লাস একটা নয়, দুটো।    

দুটো গ্লাসের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে সৌম্য কিছু বলতে যাচ্ছিল, তবে রাধিকার কোলে ছোট্ট তুলতুলে কুকুরছানাটার দিকে চোখ পড়তে সে থেমে যায়।    

রাধিকাও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তবে তারও আর বলা হয় না, তার আগেই সৌম্য জোরে হেসে ওঠে। সৌম্যর সঙ্গে গলা মেলায় রাধিকাও,

হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট ভেসে যায় প্রেমের জোয়ারে।    

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত