| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ভালোবাসা দিবসের ছোটগল্প: জীবনের রোদ্দুরে

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,valentine dayকী রোদ্দুর রে বাবা! চাঁদি ফাটিয়ে ঘিলু-টিলু শুষে নেবে একদম। রাস্তার দু’পাশে সরকারি উদ্যোগে সৌন্দর্যায়ন। সেখানে কংক্রিটের ঘেরাটোপে ছোট-ছোট গুল্ম। ওতে পিঁপড়েরা ছায়া পায়। মানুষের ছায়া দিত যে-সব মহিরুহ, তারা কালে-কালে এই সৌন্দর্যবর্ধনকারী নেতাদের বেডরুমের এসির দাম চুকিয়ে সিরাজুলের মতো মানুষের স্মৃতি হয়ে রয়ে গিয়েছে শুধু। ‘এত তাপে মাথা ঘুরে পড়ে না-যাই!’ ভাবতে-ভাবতে জোর পায়ে হাঁটছে সিরাজুল। বারোটা সাঁইত্রিশ হয়ে গিয়েছে, লেট হয়ে গিয়েছে তার। মান্যতার ক্ষেত্রে এই ‘দেরি’ সিরাজুলের আবাল্য সঙ্গী। যদিও এই দেরি হওয়াতে সিরাজুলের কোনও দোষ থাকে না। পরিস্থিতি তাঁকে দেরি করিয়ে দেয়। আজ যেমন শারমিন। অহেতুক কতকগুলো কটুকথা শুনিয়ে মাথাটা গরম করে দিল মেয়েটা। সেগুলোর জবাব দিতেই যত সময় নষ্ট।
প্রথম যেদিন মান্যতার সঙ্গে আলাদা করে দেখা করেছিল, সেদিনও দেরির নিয়তি পিছন ছাড়েনি। বাবার বিয়েতে যৌতুক পাওয়া সাইকেলটার তখন লাস্ট ল্যাপ চলছে। প্যাডেল চাপলেই ক্যাঁচরক্যাঁচর। সিরাজুল সেই বুড়ো হাড়ের প্যাডেলে একটু জোরেই চাপ দিচ্ছিল। যন্ত্র বৃদ্ধ আর বিকল হলে তার সঙ্গে গায়ের জোর খাটে না। মাঝ রাস্তায় এসে ঘ্যাটাং! চেন পড়ে গেল। শুধু পড়ে গেল না, পেছনের ফ্রিহুইলের সঙ্গে বিশ্রীভাবে জড়িয়ে গেল। ঘেমে-নেয়ে আর হাতে-মুখে চেনের কালি মেখে আধাঘণ্টা পরে হাঁপাতে-হাঁপাতে মান্যতার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সিরাজুল।
বুড়ো সাইকেলটার কথা ভাবতেই হাসি পেয়ে গেল। সিরাজুলও তো এখন বুড়ো ভাম। এই যে গা-ঝলসানো রোদে সে জোরে-জোরে পা চালিয়ে হাঁটছে, কখন যে জীবন-চাকার চেন পড়ে যাবে, কে বলতে পারে! এই বয়সে এসে আর কি এসব ছেলেমানুষী মানায়? ভাবল সিরাজুল। তারপরেই নিজেকে নিজে ধিক্কার দিল। এই দ্বিধাই সিরাজুলের সর্বনাশের মূল। মান্যতার দিক থেকে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। দোনামনা করেছিল সিরাজুল, “একটু অপেক্ষা করো, আব্বা ঠিক মেনে নেবে। আব্বাকে বলেই আমি বিয়ের ব্যবস্থা করব। তাঁর অমতে এই কাজ করলে বুড়ো বয়সে মানুষটা বড্ড আঘাত পাবে। তাও যদি আম্মা বেঁচে থাকত, তাহলে একটা রিস্ক নেওয়া যেত।”
বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন সিরাজুলের বাবা। তবে হঠাৎ করে। এক আত্মীয়বাড়ির অনুষ্ঠানমঞ্চেই সিরাজুলকে নিকা করিয়ে দিয়েছিলেন রাবেয়ার সঙ্গে। সিরাজুল রা’ কাটার আগেই রাবেয়া বলে দিয়েছিল, “কবুল, কবুল, কবুল!”
সেই দিনটা এখন থেকে চল্লিশ বছর দূরের। এই চল্লিশ বছরের অতিক্রান্ত সময়ের রাস্তায় মান্যতা আর সিরাজুলের বাক্যালাপ হয়েছে মাত্র দু’বার। যেদিন সিরাজুল আর রাবেয়ার প্রথম এবং একমাত্র সন্তান রাকিবুল জন্মাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের লেবাররুমের বাইরে এসে সিরাজুলের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে মান্যতা শুধু বলেছিল, “ছেলে।”
আর বছর-তিনেক আগের এমনই এক কাঠফাটা দুপুরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ইমার্জেন্সিতে ট্রলির উপর শোয়ানো রাবেয়ার পালস্ পরীক্ষা করে আশঙ্কিত সিরাজুলকে মান্যতা নির্বিকার বলেছিল, “নেই।”
আর কোনওদিন মান্যতার সঙ্গে সিরাজুলের কথা হয়নি। কিন্তু দেখা হয়েছে প্রায় রোজ। সিরাজুল সকালে খেয়ে উঠেই দৌড়তে পারে না। তাই বরাবর তার প্রাইমারি স্কুল খোলার এক ঘণ্টা আগে সে খেয়ে নেয়। খেয়ে আধাঘণ্টা বিছানায় গড়াগড়ি। তারপর ঠিক পঁচিশ মিনিট হাতে থাকতে মুখে একটা পান ফেলে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পাড়ার গলি ধরে বড় রাস্তায় উঠতেই সিরাজুল দেখতে পায় একটা সবুজ ছাতা মাথায় দিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চাকরিতে যাচ্ছে মান্যতা।
পাঁচ বছর হল সিরাজুল আর ওর প্রাইমারি স্কুলের চাকরিতে যায় না। বয়সের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবু সকালের নিয়ম সে পরিবর্তন করেনি। সেই নিয়ম আজও রক্ষা করেছিল। বড় রাস্তায় উঠে এসে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয়নি। দু’মিনিটের মধ্যেই সবুজ ছাতা দেড়শো মিটার দূরের বাঁকটা কাটিয়ে উঁকি দিয়েছিল। সেই প্রথম দিনের মতোই বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল সিরাজুলের। মান্যতা কাছে আসতেই কোনওভাবে বলতে পারল, “তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে। সামাদের চায়ের দোকান দুপুরবেলায় একদম ফাঁকা থাকে। বারোটার দিকে ফিল্ড থেকে একটু ওখানে আসতে পারবে?”
মান্যতা মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়েই, “পারব,” বলে আবার যেমন যাচ্ছিল তেমন চলে গিয়েছে।
আর কোনও দ্বিধা নেই সিরাজুলের। এবার এসপার নয় ওসপার। কার জন্যে লোকলজ্জার কথা ভাববে সে? রাকিবুল? সে তো একটা অমানুষ। সে নিজের বাপকে বুড়ো বয়েসে কথায়-কথায় অপমান করে, আর বউকে লেলিয়ে দেয়। তার জন্যে কীসের ভাবনা? রাকিবুলের বউ মানে শারমিন। ও-ই তো বেরোনোর মুখে অশান্তি বাঁধাল। সিরাজুল কেন পেনশানের টাকাগুলো ওদেরকে দিচ্ছে না? এই তার অভিযোগ। এই বুড়ো বয়সে এসে ওদের লাটসাহেবির জন্যে সিরাজুল কেন টাকা দেবে? কত বড় অপবাদ দিয়ে দিল শারমিন! সিরাজুল নাকি তলে-তলে আর-একটা সংসার পোষে, তাই এই সংসারে সে টাকা দেয় না!
সিরাজুলের পেনশানের মাসকাবারি টাকাটা হাতাতে পারছে না বলেই রাকিবুলের যত রাগ। দুধ-কলা দিয়ে পোষা এই সব কালসাপের জন্যে নিজের শেষ জীবনটা ভেস্তে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। কুলাঙ্গার!
ভাদ্দুরে রোদে এসব ভাবতে-ভাবতে সিরাজুল ঘেমে উঠল। মান্যতা হয়তো অনেকক্ষণ এসে বসে আছে। মান্যতার কথা ভাবলেই সিরাজুলের বুকের মধ্যে হুহু করে ওঠে। অদ্ভুত এই মেয়ে। যদিও এখন সে আর মেয়ে নয়, বিগতযৌবনা মহিলা। যখন ও দেখল যে সিরাজুলের বিয়ে হয়ে গেল, তারপরেও কীসের আশায় ও বসে থাকল? তখনও মান্যতার বাবা বেঁচে ছিলেন। দিব্যি একটা ভাল পাত্রে ওর গতি হয়ে যেত। না, সে-পথ মান্যতা মাড়াল না। বাড়িতে ওর না-আছে কোনও দাদা, না ভাই। ফলে বাবা মরতেই সংসারে নেমে এল অভাব। ও আর ওর মা। এই দু’টি মাত্র পেট। তাই-ই চালানো কঠিন হয়ে পড়ল। শেষে চাকরি নিয়ে ঢুকল স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। দিন কেটে যাচ্ছিল মান্যতার। কিন্তু সিরাজুল জানে, এখন প্রতিটি দিন মান্যতার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়েই থাকে। কেটে যেতে চায় না। কারণ তিন মাস হল মান্যতার মা মারা গিয়েছেন। মান্যতা এখন একেবারে একা। ও যেন এত বছর পার করে এসে জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় ভিতর থেকে ধসে যাচ্ছে। ওর চোখ-মুখ দেখলে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। সিরাজুল বুঝতে পারে।
ফতুয়ার পকেট থেকে রুমাল বের করল সিরাজুল। সাদা রুমাল। চারধারে চারটি লাল সুতোর গোলাপ। রাবেয়ার হাতের কাজ। মুখ মোছার আগে গোলাপগুলো একবার তাকাল সিরাজুলের দিকে। রাবেয়া তাকিয়ে আছে। হাসছে। নিশ্চয়ই হাসছে। অন্তত রাগ করছে না, সে-কথা সিরাজুল জানে। রাবেয়া কখনও রাগ করত না। শুধু হাসত। এমনকি যেদিন মান্যতার কথা ওকে সিরাজুল বলেছিল, সেদিনও হেসেছিল। কোনও দুঃখ বা দুশ্চিন্তার ভাঁজ তার কপালে ফুটে ওঠেনি। রাবেয়া সিরাজুলকে বুঝত। এই গোলাপগুলোও নিশ্চয়ই আজ তাকে ভুল বুঝবে না।
দরদর করে ঘামতে-ঘামতে লাল হয়ে ওঠা সিরাজুল সামাদের দোকানের সামনে এসে পড়েছে। সামাদ দোকানের বারান্দায় উনুনে কয়লা ঠাঁসছে। ভিতরে লম্বা বেঞ্চিতে চুপটি করে বসে আছে মান্যতা। একা। আর কোনও চা-পিপাসু খরিদ্দার এখন নেই।
কীভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না সিরাজুল। উলটোদিকে ভাবলেশহীন মান্যতার মুখ। সে-মুখে কোনও জিজ্ঞাসা নেই, হাসি-দুঃখ নেই, উদ্বেগও নেই।
“জানো তো নিশ্চয়ই ছেলেটা অমানুষ হয়েছে,” দুম করে এই কথাটাই সিরাজুলের মুখ থেকে প্রথমে বেরিয়ে এল। বলেই ভাবল, মান্যতা এত কথা জানবে কী করে?
“জানো… মানে… খবর পাও নিশ্চয়ই… ওর বউ, শারমিন, সে-ও অসভ্য…” আবার কথা আটকে গেল সিরাজুলের। এবার কী বলবে? ঠিক কী কথা বলার জন্যে ও মান্যতাকে ডেকেছে? গুলিয়ে যাচ্ছে। ভুলে যাচ্ছে সিরাজুল। এর মধ্যে সামাদ দু’কাপ চা দিয়েছে। নিজের কাপে চুমুক দিয়ে, মাথার মধ্যে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি করা কথাগুলোর মধ্যে থেকে একটা কথাকে খপ করে ধরে বলে দিল সিরাজুল, “মা চলে যাওয়ার পর খুব একা হয়ে গিয়েছ, তাই না মান্যতা?”
মান্যতা উঠে দাঁড়াল। তার মুখ দেখে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে সে যারপরনাই বিরক্ত, “এসব বলার জন্যে তুমি এখানে ডেকেছ?”
“না… মানে, তা ঠিক নয়…” আমতা-আমতা করে সিরাজুল।
“তাহলে যেটা বলবে তাড়াতাড়ি বলো, আমাকে আবার অফিসে ঢুকতে হবে। অনেকগুলো রিপোর্ট সাবমিট করার আছে।”
‘এবার এসপার, নয় ওসপার,’ সিরাজুলের মন বলল সিরাজুলকে, ‘বলে ফেলো, এর পরে আর সুযোগ পাবে না।’
“চলো মান্যতা শেষ জীবনটা আমরা একসঙ্গে কাটাই! বিয়ে করে নিই আমরা!” এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলে ঘর্মাক্ত উৎকণ্ঠিত মুখে সিরাজুল চেয়ে রইল মান্যতার প্রতিক্রিয়ার দিকে।
পলকের মধ্যে মান্যতার মুখের ছায়া উধাও হয়ে গেল। বিরক্তির আভাস কেটে গিয়ে সে-মুখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত মায়াবী হাসি। সিরাজুলের দাবি কি তবে মেনে নেবে মান্যতা? আশান্বিত হয়ে সিরাজুল আবার বলল, “তুমি তো এখন একা। দুনিয়ার কারোর কাছে তোমার জবাবদিহি করার নেই। আমিও কাউকে তোয়াক্কা করি না। রিটায়ার করে গেছি। আমার পেনশান আর তোমার মাইনের টাকায় খুব ভালভাবে কেটে যাবে আমাদের দিন। আর আমরা দু’জনে যদি ঠিক থাকি, সমাজে কে কী বলল তাতে কী এসে যায়? চলো মান্যতা…”
মান্যতার হাসিটা কেমন করুণ হয়ে উঠল। এগিয়ে দিল ওর ডান হাত। যেন কিছু চাইছে ও। সিরাজুলও ডান হাতটা এগিয়ে ধরল মান্যতার দিকে। সিরাজুলের হাতের পাতার উপরে গোটানো সবুজ ছাতাটা রাখল মান্যতা। দু’হাত দিয়ে ছাতাটা সিরাজুলের হাতের মধ্যে শক্ত করে গুঁজে দিয়ে ধীরে-ধীরে বেরিয়ে গেল সামাদের চায়ের দোকান থেকে। সিরাজুল দেখল, কাঠফাটা ভাদ্দুরে রোদের জ্বলন্ত কুণ্ডের মধ্যে ক্রমশ পুড়তে-পুড়তে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে মান্যতার অবয়ব।

2 thoughts on “ভালোবাসা দিবসের ছোটগল্প: জীবনের রোদ্দুরে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত