| 18 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ভালোবাসা দিবসের ছোটগল্প: ভালোবাসা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

      

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,valentine day‘ওকে কি গোলাপই দিতে হবে?’

  ‘তার মানে কী? তুই কাঁটা দিবি বলে ভাবছিস?’

 ‘আঃহা! তা হবে কেন? আমি তো আর দিতে যাচ্ছি না। কিন্তু গোলাপ ব্যাপারটা খুব আননেসেসারি… খুব ক্লিশে… ভেবে দেখ, ঐশিককে গোলাপ দিয়ে খুব লাভ হবে? ও কী করবে?’

       ‘কী আর করবে? কচমচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে!’

       ‘ইস! তুই না এত আনরোম্যান্টিক’।

       ‘আমি কোথায়? তুইই তো… আরে বাবা বয়ফ্রেন্ডের প্রথম জন্মদিনে গোলাপ দরকার নেই?’

       অর্ণব অনেকক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়ে। কানে এল। সিগারেট ধরানোর জন্য একটু দাঁড়ানোর দরকার ছিল। ফাল্গুন শেষের এলোমেলো হাওয়ায় দেশলাইকাঠি নিভে যায় বারবার। বহুদিনের অভ্যস্ত হাত। তবুও। সব স্নায়ু সব সময় কথা শোনে না। অবাধ্য হয়।

দুটি কিশোরী। পনেরো থেকে উনিশের মধ্যেই। সদ্য কলেজ। আবার সদ্য স্কুলপেরোনোও হতে পারে। বেঞ্চে বসে কলকল করে বকে চলেছে। প্রয়োজনীয়। অপ্রয়োজনীয়। বোঝাই যায় তাদের কাছে ভালোবাসা বা প্রেম অর্থহীন শব্দ। বেঁচে থাকার নয়। বাঁচিয়ে রাখার নয়। শুধু দেওয়া-নেওয়া। গোলাপ বয়ফ্রেণ্ড এগুলো নিয়ে খানিক সময় কাটানো। মনে মনে হাসেন অর্ণব। এই ভালো। প্রত্যাশার দায় মিটে গেলে ছেঁড়ার দাগ বা ভাঙা টুকরোর এক্সট্রা ব্যাগেজ নেই।

শেষ বিকেলের আলো মরে আসছে। সূর্যের আলো গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে নেয় কিশোরীর কানের দুলে কাঠের কারুকাজ। চিকন কালো কাঠের টুকরোতে গাঁথা নীল পুঁতি। এইদিক থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। ওর চুলের প্রথম অবাধ্য স্তবক চিবুকের যে প্রান্ত ছুঁয়েছে ঠিক সেইখানে কালো জড়ুল আছে স্নিতার। স্নিতা গোলাপ ভালবাসে। কারণে বা অকারণে। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাসের বাষ্প হাওয়ায় মিলিয়ে দেন অর্ণব।     

সকালে সময় হয় না। তাই বিকেলে। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি। শরীরচর্চার অজুহাত যদিও। কিন্তু ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শ। রিটায়ারমেন্টের পরে এটুকু শরীরচর্চা বাধ্যতামূলক। বয়সোচিত রোগের স্বাভাবিক আভাস অর্ণব মৈত্রর সুঠাম স্বাস্থ্যে সামান্যতম আঁচ ফেলেনি। তবু। সাবধানের মার নেই। ডাক্তার যখন বন্ধু, এবং ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু, তখন তার কোনও কথা অত সহজে ওড়ানো যায় না। ঝগড়া বেধে যায়। তার কথা মতোই শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনে বিকেলে হাঁটাহাঁটির নিয়মিত রুটিন মেনে নিয়েছেন অর্ণব মৈত্র। যান্ত্রিক প্রযুক্তিবিদের এখন চাকরি থেকে অবসর। পিছুটান নেই। স্ত্রী শিঞ্জিনী বিচ্ছিন্ন। অর্ণবের বৃত্ত ছেড়ে বহুদিন হল তার জীবন অন্য খাতে বইছে। অন্য এক ব্যস্ত সংসারে।

মোবাইলের নোটিফিকেশন এল।

‘চা খেতে এসো সন্ধেয়। বন্ধুর আবদার’।

স্নিতার মেসেজ। মাঝেসাঝেই ডাকে স্নিতা। চা, লাঞ্চ, ডিনার। কোনও না কোনও ছুতোয়। মেসেজ করলেই ‘বন্ধুর আবদার’ জাতীয় কোনও বাক্য জুড়ে দেয়। অর্ণব স্পষ্ট বোঝেন সূর্য পশ্চিমে ঝুঁকে পড়েছে অনেকটাই। স্নিতা এখনও প্রথম যৌবনের আবেশ আঁকড়ে বাঁচতে চায়। আবেগটুকু লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। অথচ…         

কিশোরী দুটিকে পিছনে ফেলে অর্ণব এগিয়ে গেলেন। ডাচ গোলাপ কিনবেন একগুচ্ছ।  

আকাশে ছেঁড়া মেঘ।         

 

লবণাক্ত সমুদ্র শৈবাল আঁকড়ে ধরে রেখেছে প্রাসাদের ভিত। মর্মরস্তরে লেপটে থাকে। জলের তলায় গভীরতা মাপা যায় না। রিয়ালটো ব্রিজের নিচ দিয়ে খুব ধীরে যায় গন্ডোলা। অর্ণবের দামি ক্যামেরার লেন্স দিশেহারা। কোন দিক, কীভাবে, কতক্ষণ…

অর্ণব আর শিখর দুজনেরই পরিকল্পনা ছিল একটা সন্ধ্যা পুরো থাকবেন সেন্ট মার্ক স্কোয়্যারে। অন্তত একটা জিলাটোর নির্ভেজাল স্বাদ পরখ করা। শাস্ত্রীয় অর্কেস্ট্রায় ডুবে থাকা। গোধূলির সূর্যাস্ত। ক্যাথিড্রালের ব্যাকড্রপে আকাশ। চোখ জুড়নো রঙ, নকশা, স্থাপত্য সব মিলিয়ে ভেনিসের বিকেলের কাছে। একটাই তো জীবন।  

একের পর এক দ্বীপ। ছোট বড় মাঝারি। আড্রিয়াটিকের রানী ভেনিস। মাকড়সার জালের মতো অসংখ্য খাল। চারিদিক জলে ঘেরা। ভেনিস। সব ট্যুরিস্টের স্বপ্ন। কাজেই শিঞ্জিনী আর স্নিতাও এই যৌথ ট্যুরের পরিকল্পনায় লাফিয়ে উঠেছিল।   

অর্ণব-শিখর বাল্যবন্ধু। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র যুগলবন্দী। অভিন্নহৃদয়। সেই হাফপ্যান্ট থেকে শুরু। সাধারণত ছেলেবেলার এত টান বেশিদিন থাকে না। মাঝপথে কোথাও ছিঁড়ে যায়। অথবা ফিকে। কিন্তু অর্ণব-শিখর ব্যতিক্রম। পাশাপাশি পাড়া। একই স্কুল। মিডল বেঞ্চ এবং মাঝারি হওয়া সত্ত্বেও দুজনেই একসঙ্গে টপকে যায় জয়েন্টের ধাপ। অঙ্কে মজে থাকা অর্ণব ইঞ্জিনিয়ারিঙে যাদবপুর। জীবনের তত্ত্বে মশগুল শিখর জীবন বাঁচানোর দুরুহ চ্যালেঞ্জে মেডিক্যাল কলেজ। পড়ার ব্যস্ততায় তাদের রাস্তা আলাদা হতেই পারত। কিন্তু একইরকম রুচি-পছন্দ-মেজাজ তাঁদের দুজনকেই বেঁধে রেখেছিল। সাধারণত সহোদরের মধ্যেও এই আকর্ষণ দেখা যায় না।

নিজেদের পছন্দেই বিয়ের সিদ্ধান্ত। অর্ণব বেছে নেয় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের জুনিয়র শিঞ্জিনীকে। শিখর অবশ্য স্নিতাকে খুঁজে পেয়েছিল মেডিক্যাল কলেজের পাশের ফুটপাথে। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের পাশের রাস্তায় ধুলো ভর্তি পুরনো বই উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে যার পার্স ফুটপাথে পড়ে গিয়েছিল অসাবধানে। বিধাতা নামক ভদ্রলোক সম্ভবত এই সময় শিখরকেই ওই রাস্তায় পাঠিয়েছিলেন। ওই প্রথমদিনেই তাদের প্রাথমিক পরিচয় একটু বেশিক্ষণ ধরে চলে। পার্স ফেরত, পালটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ প্যারামাউন্টে এক গ্লাস সরবতের আমন্ত্রণ, পরদিন মেডিক্যাল কলেজের সামনের রাস্তাতেই দুজনের বই বিনিময়… ইত্যাদি। সেই চিরাচরিত প্লট। সিনেমায় যেমন হয়। তবে স্নিতার সঙ্গে শিখর বা অর্ণবের সঙ্গে শিঞ্জিনীর বিয়ের আসরে বোঝা গিয়েছিল বাস্তবে অর্ণব-শিখরের যুগলবন্দীতে আরও দুই যোগ্য সঙ্গতকার হাজির। শিঞ্জিনী এবং স্নিতা। যাদের বন্ধুত্ব তৈরি হয় চটপট। এমনকি শিঞ্জিনী অর্ণবকে ছেড়ে চলে গেলেও এখনও অনাবিল মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে স্নিতা আর শিখরকে। সংসার আলাদা হতেই পারে, সম্পর্কে এত দ্রুত মরচের দাগ পড়েনি।  

ভেনিস যাত্রা অবশ্য বিবাহবিচ্ছেদের ঠিক আগেই। নিজেদের কাছে নিজেরা আরও স্বচ্ছ থাকার আশায় এবার আর একা নয়, সঙ্গে নেয় শিখর আর স্নিতাকেও। যারা তখনও বিশ্বাস করতে চায় না অন্যদিকে সরু চুলের মতো ফাটল দিয়ে হু হু করে ঢুকে পড়ছে অস্থির সম্পর্কের নোনাজল।

গণ্ডোলাতে ওরা চারজন।

মুখোমুখি দুই দম্পতি। স্নিতার মুখে সূর্যের শেষ রশ্মি। অর্ণবের ক্যামেরা অন্যদিকে থাকলেও মাঝেমধ্যে চোখ অবাধ্য হয়। লেন্সে ধরা পড়ে বহু অসতর্ক কারুকাজ। শিঞ্জিনী হয়ত লক্ষ্য করেনি। বা করেছিল। তবে বিরক্তি প্রকাশ করেনি মুহূর্তের জন্যও। যে সম্পর্কের বোঝা আর বইবে না, সেই সম্পর্কের প্রত্যাশাও তো থাকে না।

   

 “এই ছবিগুলো মনে আছে?”

স্নিতা চায়ের টেবিলে বড় দুটো অ্যালবাম রেখেছে। আজকাল ছবি প্রিন্ট করে না কেউ। কম্পিউটারে বা পেন ড্রাইভেই রাখে।

“হ্যাঁ… মনে না থাকার কারণ নেই কোনও। দিব্যি মনে আছে। আজ হঠাৎ বের করেছ এগুলো?”  

“আজকের তারিখটাই অদ্ভূত…”

স্নিতার কথায় আশ্চর্য চোখে তাকান অর্ণব।

“তুমি সেই আদ্যিকালের রয়ে গেলে…। চতুর্দিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আজ রোজ ডে। গোলাপ ফুল দেবার দিন।”

সেন্টার টেবিলের ফ্লাওয়ার ভাসে একগুচ্ছ ডাচ গোলাপ। উজ্জ্বল হলুদ।

অর্ণবের চোখের দিকে তাকিয়ে স্নিতা বলে, “জানি, তুমি এসব জানো না।”

সামনের অ্যালবামে স্নিতার ছবি। একার। অনেকগুলো ছবি।

ভেনিসের সন্ধ্যা। আর একটু পরেই একের পর এক আলো জ্বলে উঠবে চতুর্দিকে। প্রাচীন স্থাপত্যের আড়ালে বাঁকা চাঁদের পাশেই থাকবে অস্থির হৃদয়। গন্ডোলার প্রান্ত ছুঁয়ে যাবে নীলচে সবুজ জল। ভেনিস যেরকম। সেই সময় স্নিতার অনেকগুলো ছবি তুলেছিল অর্ণব। হঠাৎই। নিজের ক্যামেরায়। শিঞ্জিনী দূরে। সে তার নিজের যন্ত্রের স্মৃতিতে ভরে রাখছে ব্যক্তিগত অর্জন। শিখর পানীয় নিয়ে বসেছে অর্কেস্ট্রা শুনতে। একা। সুর ভেসে আসছে। স্নিতার চোখে কিশোরীর বিস্ময়। এই স্নিতা অচেনা। রোজকার ডাল-ভাতের জীবনের মধ্যে এই উচ্ছ্বাস থাকে না। ব্যস্ত ডাক্তারের সংসারের মধ্যে একজন সাহায্যকারিণী হিসেবেই যেন নিজেকে মেলে ধরেছিল স্নিতা। বাকি অনেক কিছু লুকনো ছিল কোন গহনে। একসঙ্গে দুটি পরিবারের বেড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা প্রায় নেই বললেই চলে। সেইজন্যেই হয়ত অধরা ছিল গোপন প্রস্রবণ।    

স্নিতার ছবি তুলছে অর্ণব।  

স্নিতারও ছবি তুলতে নেশা ধরে যাচ্ছে যেন। একের পর এক। নানান ব্যাকগ্রাউণ্ড। হাসিমুখে। উদাসমুখে। সাইড ভিউ কোনওটা। ক্লোজ শট একটা। আলো পড়ছে চোখে, হেসে উঠছে ঠোঁট। যেন ফোটোশ্যুট হচ্ছে। স্নিতা কী সত্যিই এত লাবণ্যময়ী ছিল? সৌন্দর্য আর লাবণ্য তো এক নয়। সেই অর্থে শিঞ্জিনী অপূর্ব সুন্দরী। অর্ণব নিজেই বোঝেন, শিঞ্জিনীর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ ঝলসে যায়। স্নিতা বিপরীত মেরুর। সে স্নিগ্ধ।  

ছবি তুলতে তুলতেই হাঁটছিল ওরা। দূরে শিখর একা মগ্ন। শিঞ্জিনী উদাস হয়ে নিজের জগতে…।

“শিঞ্জিনী সত্যিই চলে যাবে অর্ণবদা? ধরে রাখতে পারবে না?”

“জানি না। যে চলে যায় তাকে জোর করে ধরে রাখা যায়?”

“চেষ্টা করাই যায়। তুমি বাঁধতে জানো না… তোমরা সব একরকম…”

“জানি। আমি কাউকে বেঁধে রাখি না।”

স্নিতা চুপ করে যায়।

“কখনও কখনও বাঁধন প্রয়োজন। খুব দরকারি।”

অস্ফুটে বলা কথাও কানে আসে স্পষ্ট। কাছাকাছি দাঁড়ালে জোরে উচ্চারণের প্রয়োজন হয় না।

“হ্যাঁ। কিন্তু সবার জন্য নয়। শিঞ্জিনী উড়তে চায়। ওর বাঁধনে হাঁফ ধরে…”

“উল্টোটাও হতে পারে অর্ণবদা। তোমার বাঁধনের টাইপটা আলাদা। ওটা ফাঁসের মতো। তাই ওর হাঁফ ধরছে।”

“মানে?”

অর্ণব ক্যামেরা বন্ধ করে দিয়েছে ততক্ষণে। সব লেন্স খাপে ভরা। নিজের চোখ দিয়েই পরিপূর্ণ তাকায় বন্ধুপত্নীর দিকে।

“শিঞ্জিনীকে আমি চিনি অর্ণবদা। জানি। ও আমার খুব ভালো বন্ধু। এবং জেনে রেখো তোমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও শিঞ্জিনী আর আমি নিজেদের মধ্যে সেই একইরকম থাকব। কিন্তু ও যে কারণে তোমায় ছেড়ে চলে যেতে চায়, সেই একই কারণে আমিও ছেড়ে যেতে চাই শিখরকে। কিন্তু ও পারে, আমি পারি না।”

“এসব কী বলছ স্নিতা?”

অর্ণব অবাক হয়ে তাকান।

“ঠিকই বলছি অর্ণবদা। আপাতদৃষ্টিতে আমরা হ্যাপি কাপল। ভীষণ সুখী। একদম টিপিক্যাল আইডিয়াল দম্পতি যেমন হয়, ঠিক তেমন। সকলেই বলে, মেড ফর ইচ আদার। আমাকে ছাড়া শিখর এত উন্নতি করতে পারত না। আমি না থাকলে শিখর নিজের প্রফেশনে এত সময়, এত ডেডিকেশন দিতে পারত না। কিন্তু আমি নিজে খুব ভালো করে ভেবে দেখেছি অর্ণবদা, শিখর না থাকলে আমার কিন্তু তেমন কোনও অসুবিধে হয় না। ওর থাকা বা না থাকাটা আমার জীবনে সেই কবে থেকে একটা অর্থহীন একতরফা সংলাপের মতো হয়ে গেছে। ওর ডাক্তারি, ওর চেম্বার, ওর নার্সিং হোম, ওর প্র্যাকটিস, ওর স্নান-খাওয়া-ঘুম-রুটিনের মধ্যে আমি কে? আমি কোথায়?”

“এসব কেন বলছ স্নিতা? তুমি তো বিয়ের আগে থেকেই জানতে শিখর কী করতে চায়, কী করবে…”

অর্ণবকে কথা শেষ করতে দেয় না স্নিতা।

“কিন্তু শিখর জানত না। আমি কী করব, আমি কী চাই… জিগ্যেসও করেনি কখনও। বরং ধরে নিয়েছে বাড়ি-গাড়ি-শাড়ি-গয়না… প্রচুর স্বাচ্ছন্দ্য মানেই সুখ। অনেক সুবিধে দেওয়া মানেই শান্তি। এ কেবল সেই চিরাচরিত অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের পাতি গল্প… আমি কি তাই চেয়েছিলাম? সব মেয়েরাই কী তাই চায়?”

“তাহলে তুমি তোমার চাওয়া শিখরকে খোলাখুলি বলোনি কেন?”

অর্ণবের প্রশ্নের মধ্যে একটা অধৈর্য ভাব। কেমন যেন অসহিষ্ণু।

“সব কথা আমাকে মুখ ফুটে বলতে হবে? তাহলে তুমি আমার কেমন সঙ্গী? তোমাকেও তো আমার প্রথম আলাপের দিন থেকেই ভালো লাগে। বলেছি কখনও?”

বাজ পড়লে হয়ত এতটা অবাক হতেন না অর্ণব। চমকে গিয়েও প্রচণ্ড জোরে হেসে ফেলেন।

“নাঃ। তা’ বলোনি। তবে সেই ভালোলাগাটাকে ভালোবাসা বলে না স্নিতা। আমি নিশ্চিত।”

“ভালোবাসা কাকে বলে অর্ণবদা?”

স্নিতার প্রশ্নের জন্য প্রস্তুতি ছিল না। অর্ণব গম্ভীর হয়ে যান। এই মধ্যবয়সে প্রগলভতা মানায় না।   

“স্নিতা, আমার কাছে ভালোবাসা মানে ভালোতে বাস করা।”

স্নিতা হাসে। মেঘলা রাতের ফাঁকে একটুকরো জ্যোৎস্নার আভাস যেন।

“বড় কঠিন কথা… কত সহজে বললে।”

“কঠিন ভাবলেই কঠিন স্নিতা। শিঞ্জিনীর কাছে কঠিন। তুমিও কঠিন বলছ?”  

“বলব না? আমি শিখরের ভালোতে বাস করি। ওর যা কিছু ভালো, যা কিছু সাফল্য, সবেতেই আমার আনন্দ। আমার তৃপ্তি। কিন্তু দিনের শেষে সব হিসেব মেলে? তুমিই কি মেলাতে পারলে?”

অর্ণব তাকিয়ে দেখেন দূরে শিঞ্জিনী দাঁড়িয়ে। ফোনে কথা বলছে। এখন এই সময়ে কার সঙ্গে কথা বলছে ও? খটকা লাগল। কিন্তু সংযত করলেন নিজেকে। আর জিগ্যেস করা যায় না। চোখ সরিয়ে নেন। কিন্তু লক্ষ্য করেননি স্নিতা তাকিয়ে আছে ওর দিকেই।

“শিঞ্জিনীকে ডেকে জিগ্যেস করবেন না অর্ণবদা, ভেনিসের এই সুন্দর সন্ধ্যায় ও কাকে ফোন করছে? ওর উচ্ছ্বাস দেখুন… ওই দেখুন ও ঘুরে ঘুরে ফোনে কথা বলছে, ও কথা বলতে বলতে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে, জলের দিকে, ওইসব আর্কিটেকচারগুলোতে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে ওর চোখ… ও যেন কাউকে ধারাবিবরণী দিচ্ছে অর্ণবদা… অনর্গল কথা বলছে। ও বলতে চাইছে, ও ভাগ করে নিচ্ছে ওর আজকের এই সন্ধে… ওর ভালোতে বাস করতে চান না আপনি? নাঃ। আপনি চান না অর্ণবদা। ওর ওই ভালোতে আপনার আসলে ভাগ নেই কোনও। ওই ভাগে আপনি ছিলেনই না কোনওদিন। কখনও জিগ্যেস করেননি। ও বলতে চেয়েছে হয়ত, আপনি শুনতে চাননি… ও একদিন একদম চুপ করে গেছে। একটা পাঁচিল উঠে গেছে মাঝখনে। ও হয়ত অন্য কোথাও খুঁজে নেয় ওর ভালোবাসা, ওর ভালোলাগা। সে হতে পারে পুরুষ, নারীও হতে পারে। যে’ই হোক, সে সবসময় ওর ভালোতে বাস করে অর্ণবদা।”  

একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে একটু দম নেয় স্নিতা।

অর্ণব তাকিয়ে দেখেন দূরে শিখর আরেকটা ড্রিঙ্ক অর্ডার করছে। তার সব ইন্দ্রিয় অর্কেস্ট্রার মোহময়ী সুরের দিকে। সুর আর সুরায় আচ্ছন্ন একটি মানুষ নিজের ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে বসে আছে। একা এবং অবশ্যই একা।

সেদিনের কথাগুলো প্রতিটি ছবির তলায় জলের অক্ষরে লেখা। আবছা হয়ে এসেছে সময়ের ভারে। তবু সম্পদ। প্রগলভতা সংযত করে দুটি মানুষ নিজেদের বৃত্তে ফিরে যায়। শিঞ্জিনী খুঁজে নেয় নিজের ভালো থাকার আবাস। অর্ণবের একার জীবনে আলগা হয়ে জুড়ে থাকে শিখর আর স্নিতা দুজনেই। শিখর বাল্যবন্ধু। সে এক স্বস্তির বাঁধন বইকি।  

আর স্নিতা?

এখন অর্ণব আর স্নিতা নিজেদের ভালোটুকু বিনিময় করে। অবসরে। 

               

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত