| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ভালোবাসা দিবসের ছোটগল্প: ভাষা ও ভালোবাসা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,valobasa dibos

১.

‘‘তই আঁই হক্সবাজার সাত বছর থাইক্কে, ছকরী গজ্জি, তাই এক্কান এক্কান ‍বুঝিত পারি।’’

কথা বলতে বলতে শ্যামল দেখতে পায় ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে তাশমিম। কেউ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলে এত বেশী সুন্দর দেখায় শ্যামলের জানা ছিল না। ওর চোখেমুখে মুগ্ধতা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফুটে উঠে সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়। সেখানে স্বভাবসুলভ আমুদে ভাবটা ফুটে উঠে।

চকরিয়া থানা স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে চাকরী নিয়ে এসেছে তাশমিম দিন বিশেক হল। বিসিএস দেয়ার পরে ও জানতো ঢাকার বাইরে কোথাও পোস্টিং হবে। সেটা গাজীপুর, রূপগঞ্জ, ঘোড়াশাল, নরসিংদীর মতো ঢাকার আশেপাশে শহরে হবে ভেবেছিল। সেখান কোথায় কক্সবাজারের চকরিয়া! তাশমিমের মনে হয় বনবাসে এসেছে সে এখানে।

‘আপনি কি বললেন বুঝতে পারলাম না!’ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে তাশমিম।

‘ বলেছি যে, আমি এই কক্সবাজারে সাত বছর ধরে  চাকরী করছি। তা একটু একটু করে কথা বুঝতে পারি।’

কথা বলতে বলতে শ্যামল চোখের কোনা দিয়ে মোবাইলে সময় দেখে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে নিজের কোয়ার্টারে। এখানে একজন অবিবাহিত নারী ডাক্তারের সঙ্গে সন্ধ্যার পরে বসে আড্ডা দেয়া শোভন নয়।

‘প্রথম যখন এখানে এসেছিলেন তখন কেমন লেগেছিল? এখানকার ভাষা বুঝতে বুঝতে অসুবিধা হয়নি?’ তাশমিম সত্যিই কৌতুহলী। এই শ্যামল নামের লোকটার মধ্যে কোথায় যেন চুম্বকের মত আকর্ষণ আছে। তাশমিম ঠিকঠাক ধরতে পারছে না। তবে ভদ্রলোকের উপস্থিতি চারপাশকে কেমন জোৎস্নাময় করে রাখে।

‘জি না আফামনি।’ কথা বলার সময় ইচ্ছে করে  আফামনি শব্দটার ওপরে চাপ দেয় শ্যামল। ‘আমি সব সময় নির্জনতা পছন্দ করি। তাই জায়গাটা প্রথম দিনে মনে ধরে যায়। আর নতুন ভাষা শেখা আমার জন্য কুইজের মত। ভেরি মাচ ইন্টারেস্টিং।’   

কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা সহজাত আইকিউ নিয়ে জন্মায়। সবকিছু দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলতে পারে। তাশমিম বুঝতে পারে শ্যামল তাদেরই একজন। সেও বিসিএস পাশ করে এখানে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের চাকরী নিয়ে এসেছে। একদিন হয়ত জেলা প্রশাসক হয়ে যাবে।

তাশমিমের চিন্তামগ্ন চেহারার দিকে তাকিয়ে শ্যামল মৃদুস্বরে বলে ওঠে,‘আমাদের যে কাল ডুলাহাজারাতে মালুমঘাট খৃষ্টান হাসপাতালে যাবার কথা, মনে আছে তো?

তাশমিম মাথা সামান্য ওপর নীচ করে বোঝায় তার মনে আছে।

কথা শেষ করে উঠে পড়ে শ্যামল। তার আগে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দেয়।

‘কি চলে যাবেন এখন?’ তাশমিম হঠাৎ প্রশ্ন করে। ‘এত তাড়া কিসের! কেউ তো অপেক্ষা করে নেই আপনার জন্য!’

‘কেউ তো আটকাতেও চাইছে না! হাহাহা!’ নিজের কথায় নিজেই হোহো করে হাসে শ্যামল। বারান্দা থেকে দুই সিঁড়ি টপকে উঠানে নামে। বুঝতে পারে ওর কথায় তাশমিম সামান্য লজ্জা পেয়েছে।  সেটাকে প্রলম্বিত করার জন্য গলা ছেড়ে দিয়ে শ্যামল গেয়ে ওঠে- ‘আজ চলে না গেলেই কি নয়! সন্ধ্যা ঘনাক না… লা লা লা.লা. কথা ভুলে গেছি।’

‘ভাগেন তো ভাগেন…’ বারান্দার খিলানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাশমিম কপট রাগ দেখায়!

২.

বেডরুমে এসে ঢুকতেই তাশমিমের মোবাইলে ইমরানের ফোন আসে।

আমেরিকার মিশিগান থেকে ফোন করেছে ইমরান। এখন সেখানে ভোর পাঁচটা বাজে জানে তাশমিম।  সাধারণত এত ভোরে ওঠার পরে গলা থেকে স্বর বের হতে চায় না ওর। কিন্তু ইমরান এই সাত সকালে নিরাবেগ কণ্ঠে একের পর এক কথা বলে যায়। যেমন আজকের শুরুটা হল এভাবে-

‘বাবার যে বন্ধু ঢাকায় হেলথ ডিপার্টমেন্টে আছেন তার সঙ্গে আমি কথা বলেছি। বাবা তো আগেই বলেছিলেন। সিলেট শহরে তোমার বদলির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

কেমন আছ, কি করছ- কোন ধরনের  আন্তরিক সম্বোধন ছাড়াই শুরুতে দরকারী কথা বলে ইমরান। এটাই ওর বৈশিষ্ট্য। দরকারী না হলে কোন কাজ সে করেনা। বলা যায় না তাশমিমকে সে বিয়ে করতে চাইছে সেটাও নিশ্চয়ই কোন না কোন দরকারে।

‘মাত্র তো চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জয়েন করলাম। এখনই চলে গেলে কেমন দেখাবে! আমার ক্যারিয়ারে একটা স্পট পড়তে পারে।’ তাশমিম আসলে খুব বিরক্ত ওর সব কিছুতে ইমরানের এত খবরদারি দেখে। সে মিশিগানে কোথায় কাজ করে, সেখানকার পরিবেশ কি- কই এসব নিয়ে তো তাশমিম কোন প্রশ্ন তোলে না।

ইমরান হয়ত বুঝতে পারে ওর কথায় খানিকটা বিরক্ত তাশমিম। তাই পরের কথাগুলোতে কিছুটা নম্র স্বরে বলে, ‘আমি তোমার অবস্থা আঁচ করতে পারছি। কিন্তু জায়গাটা তো ভালো না। টেররিস্টদের অভয়ারান্য। সেখানে সিলেট শহরে আমাদের নিজেদের বাড়ি আছে। আত্নীয়স্বজন, পরিচিতের অভাব নেই। তুমি সেখানে নিরাপদে থাকবে।’ একটু থেমে ইমরান বলে, ‘ক্যামেরাটা অন করতো তোমাকে দেখি..’।

মুখ দেখছিল না, সেটাই বরং ভালো ছিল। তাশমিম ভাবে মনে মনে। চেহারায় বিরক্তি লুকানো অসম্ভব একটা কঠিন কাজ মনে হয় ওর।

ক্যামেরা অন করার পরে ইমরানকে দেখে তাশমিমের মনে হল- মাত্র বাথরুম থেকে বের হয়েছে সে। এতক্ষণ তাহলে বাথরুমে বসে এত কথা বলছিল! তাশমিমকে দেখে মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করে। ছোটবেলা থেকে তাশমিম জানে, ইমরান হল গভীর জলের মাছ। আপন খালাতো ভাই বলে কথা! স্কুলজীবন থেকে সে তাশমিমকে অন্য চোখে দেখতো। কারণ সব কাজিনদের মধ্যে তাশমিম ছিল সবচেয়ে সুন্দর ও মেধাবী। তাশমিম যেন অন্য কোন ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে না পারে এই ব্যাপারে তাঁর নজর ছিল তীক্ষ্ম।

‘কি তাশা, তোকে তো খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। সেজে গুজে কোথাও গিয়েছিস নাকি!’ ইমরান বলে হাসিমুখে। মাঝেমাঝে তাশমিমকে তুই করে বলে ইমরান। এটা ওর কাছে মনে হয় রোমান্টিকতা বহি:প্রকাশ।

‘কোথাও যাইনি বাসাতে ছিলাম। তুমি যে বাসা ভাড়া করে দিয়েছ তোমার কোন আত্নীয়ের মাধ্যমে, সেই বাসাতেই আছি।’ তাশমিম উত্তর দেয়।

‘বাসাটা অত ভালো না শুনেছি। সিলেটে গেলে তুই না তাশা.. একদম রানীর হালে থাকবি…।’ ইমরান বলে টোপ ফেলার মত করে।

ইমরানের মধুর কথার আড়ালে আসল সত্যিটা বুঝতে তাশমিমের দেরী হয় না। ওখানে গেলে সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখা যাবে হবু স্ত্রীকে। এখানে সেটা করা যাচ্ছে না।

৩.

‘আপনার হবু স্বামী তাহলে আপন খালাতো ভাই! নিজেদের মধ্যেই সব।’ শ্যামল মন্তব্য করে তাশমিমের ‘রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস’ শোনার পরে। তাশমিমের অনামিকায় হিরের আঙটির দিকে শুরু থেকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকাতো ও।

তাশমিমের গাড়িতে মালুমঘাট খৃষ্টান হাসপাতালে যাচ্ছে দুজন। গাড়ি তাশমিম চালাচ্ছে। পথের দিক থেকে চোখ সরিয়ে এক ঝলক দেখে নেয় শ্যামলের মুখের অভিব্যাক্তি।

‘জানেন, হিন্দুদের মধ্যে একটা জিনিষ আমার খুব পছন্দ- আপন কাজিনদের মধ্যে ওরা বিয়ে করে না। ছোটবেলা থেকে যাকে ভাই ভেবে আসলাম, আচমকা বলা হল- তাকে বিয়ে করতে হবে। এটা কি যে অস্বস্তিকর ভাবতেই পারবেন না!’

‘সব ধর্মের নিয়মকানুনের মধ্যে কিছু অপ্রীতিকর দিক থাকে। যদিও আমি ধর্ম মানিনা।’ শ্যামল উত্তর দেয়।

‘হিন্দুদের মধ্যে পণপ্রথা খুব নিন্দনীয়। মুসলমানরাও এখন সেটা অনুসরণ করে। যৌতুক ছাড়া তো গ্রাম দেশে কোন বিয়েই হয়না।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে শ্যামল। তারপর আস্তে আস্তে বলে, ‘আমার নিজেরই চার বোন। আমার বড় বোনের শুধু বিয়ে হয়েছে। আমার ছোট তিন বোন বিয়ের বাকী। তাদের জন্য পণের অর্থ জমাচ্ছে বাবা-মা সেই বহু বছর ধরে। আমার বেতন থেকেও জমাই। তারপর যেহেতু আমরা ব্রাক্ষ্মণ, নিজেদের কাস্ট খুঁজে বিয়ে দিতে হবে।’

ত্রিশোর্ধ একজন সরকারী অফিসারের অবিবাহিত থাকার কারণটা এবার অনুমান করতে পারে তাশমিম।

ডুলাহাজারা মালুমঘাট খৃষ্টান হাসপাতালে চমৎকার একটা দিন কাটে দুজনের। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী হয়েও এই হাসপাতালটির কথা জানা ছিল না তাশমিমের। বেশীরভাগ আমেরিকান ডাক্তাদের দ্বারা হাসপাতালটি পরিচালিত। দেশের প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার বিপরীতে এই হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারির জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়।

একটা খবর জেনে তাশমিমের বেশী ভালো লাগল, ওখান তৈরী নবজাতকদের পোষাক স্থানীয় মহিলারা তৈরী করে। যার নাম মনের বাড়ি।

‘এই হাসপাতালটি অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।’ শ্যামল জানায়।

‘তাই তো দেখছি। সুদেষ্ণা আমাকে এই মনের বাড়ির কথা বলেছিল। এখানে কি যে কোন রোগী ভর্তি হতে পারে?’ তাশমিম জানতে চায়।

‘না না, এই হাসপাতালে চিকিৎসা অনেক সস্তা হলেও ধারণ ক্ষমতার বাইরে কোন রোগীকে তারা ভর্তি নেয় না। আর রোগীর সঙ্গে একজনের বেশী কেউ থাকতে পারেনা। তবে হাসপাতালের ভিতরে অল্প খরচে গেস্ট হাউজ আছে সেখানে যে কেউ থাকতে পারে।’

গাড়ীতে আসতে আসতে শ্যামল বলে, ‘এখানে অনেক হরিন আছে। শিকার করা নিষেধ। তবে অনেকে সেটা করে।’

‘ইশ্ এত সুন্দর একটা প্রাণীকে কিভাবে যে মানুষ হত্যা করে খায় আমার মাথায় আসে না।’ তাশমিম উত্তর দেয়।

‘আপনাকে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে নিয়ে যাব দেখাতে। সেখানে বন্য প্রাণীরা স্বাধীন। দর্শনার্থীদের একটা বাসে করে ঘুরতে হয়……….।’ শ্যামল আরো  কি যেন বলতে যাচ্ছিল।

তাকে থাময়ে দিয়ে তাশমিম বলে ওঠে, ‘আচ্ছা, আপনি আমাকে এত জায়গায় ঘোরাতে নিয়ে যেতে চাইছেন কেন, আজকে হাসপাতাল, আবার সাফারি পার্ক… কি ব্যাপার বলুন তো?’ চোখ ঘুরিয়ে নাটকীয়ভাবে জানতে চায়!

তাশমিমের কণ্ঠের মাধুরয্য ও মৃদু রসবোধ শ্যামলের মনে কেমন যেন ভালো লাগার ফল্গুধারা বইয়ে দেয়। ওর যেন মনে হয় সারাদিন ধরে এই কণ্ঠ শুনলেও ক্লান্তি আসবে না।

‘কারণ আমি চাই, আপনার এই জায়গাটা ভালো লাগুক। যেন আপনি এখানে থেকে যান। ’

৪.

এখানকার মানুষদের কথা বুঝতে সমস্যা হয় তাশমিমের। হাসপাতালে যখন গ্রাম থেকে রোগীরা আসে কাতর কণ্ঠে কি যে বলে যায়, রীতিমত হিব্রু ভাষার মত মনে হয় ওর। স্থানীয় একজন নার্স আছে সুদেষ্ণা বড়ুয়া ও অবশ্য খুব সাহায্য করে। অনেকটা দোভাষীর মত কাজ করে ও। তাশমিমের মাঝেমাঝে হাসি পায়। ভাষাগত সমস্যার কথা বলছিল শ্যামলকে।

‘অনে ইবা কি হন আফা?…আপনাকে একটা সহজ ফর্মুলা দিই…’ কথা বলতে বলতে থেমে যায় শ্যামল। ছাত্রীর চেয়ে শিক্ষকের আগ্রহ প্রবল। ছাত্রী কি জন্য যেন আজ খানিকটা আনমনা।

‘কি ফর্মুলা বলেন?’ কণ্ঠে জোর করে আগ্রহ এনে বলল তাশমিম।

দুজনের কথা হচ্ছিল হাসপাতালে যাবার চারদিন পরে। আজ সপ্তাহান্তের ছুটির দিন সকালবেলা। ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে যাবার আগে তাশমিমের বাড়ির বারান্দায় চা খেতে খেতে কথা বলছিল দুজন।

‘আপনাকে একটা সহজ ফর্মুলা দিই। চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে হলে আপনাকে মাঝের অক্ষর বাদ দিতে হবে, যেমন পাগল-পল, আপনে- অনে. কুকুর- কুর, কাপড়চোপড়- করচর, কেমন-কেন।’ লম্বা কথা বলে একটু দম নেয় শ্যামল। তারপর আবার শুরু করে,‘একটা উদহারণ দিলে আপনার জন্য আরো সহজ হবে। যেমন কেউ যদি বলতে চায়- আপনি কেমন আছেন বড় দা- তাহলে সে বলবে- অনে কেন আছুইন বদ্দা..।’

শ্যামল প্রবল উৎসাহের সঙ্গে কথা বলে যায়। ছাত্রীর নিস্প্রভ চেহারা চোখে পড়েনা।

গাড়িতে উঠে তাশমিম বলে, ‘শ্রদ্ধেয় ভাষা শিক্ষক, আমার হবু স্বামী তো উঠে পড়ে লেগেছে আমাকে সিলেটে বদলি করার জন্য। সুন্দর সব জায়গা দেখে চকরিয়া আমার ভালো লেগে গেলেও কোন লাভ নেই।‘

শ্যামল এই কথায় প্রভাবিত হতে চায় না। মন খারাপ করা কোন চিন্তা ঝেটিয়ে বিদায় করে দিতে চায় মাথা থেকে। এই সাফারি পার্কের সবুজ নিবিড় প্রকৃতিতে এই সময়টুকুর স্বাদ সে অনুভব করতে চায় শরীরের প্রত্যেকটি রক্তকনিকা দিয়ে।

‘আপনি তাহলে সিলেটে চলে যাবেন? আমি কিন্তু সিলোটি ভাষাও জানি। হবিগঞ্জে দুই বছর ব্যাঙ্কে চাকরী করেছিলাম। ওরা কথাকে বলে মাতে।’ শ্যামল বলে হাসতে হাসতে।

তাশমিম বুঝতে পারে শ্যামল হাহুতাশ করে সুন্দর সময়টুকু ম্লান করে দিতে চাইছে না। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলে, ‘আর কি শিখলেন সেখানে?’

‘তারা সাধারণত ভাববাচ্যে কথা বলে। যেমন আসসালামু আলাইকুম বউক্কা। মানে বসেন। বাসে উঠানামার সময় বলবে উডোগ্গা, নামার সময়ে- নামুগকা…। আপনি অবশ্য কখনও বাসে কিংবা রিক্সায় চড়েন না। তাহলে আরেকটা তথ্য দিতাম।’

‘কে বলেছে! আমার তো মাঝে মাঝ রিক্সায় চড়া হয়।’ তাশমিম উত্তর দেয়।

‘সিলেটে গিয়ে যদি কোন রিক্সাওয়ালাকে বলা হয়- ‘এই রিক্সা যাবে? সে আপনার দিকে ফিরেও তাকাবে না। বলতে হবে ড্রাইভার। ওবা ড্রাইভার যাইতানি বা?’

‘শেষেরটা অনেক মজার ছিল’ হাসতে হাসতে বলে তাশমিম।‘আপনি কি সৈয়দ মুজতবা আলীর ওই উক্তিটা শুনেছেন? বাংলা ভাষা সিলেটে গিয়ে আহত হয়েছে আর চট্টগ্রামে গিয়ে নিহত হয়েছে।’

‘না শুনিনি। তবে আমি কথাটার সঙ্গে একমত না। আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে এক ধরনের মাধুরয আছে, যেটা বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রাণ।’

সাফারি পার্কে ঘোরের মত একটা সময় কাটে তাশমিমের। এত চমৎকার চারপাশ। সবুজ আর সবুজ। কোথাও কোন কৃত্রিমতা নেই। বণ্যপ্রাণীকে এখানে খাঁচায় বন্দী করা হয়নি। তারা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষই এখানে বন্দী বাসের মধ্যে। সাফারি পার্কের সবুজ গাছগাছালির মধ্যে ঘুরে ঘুরে পশু পাখী দেখার মত আনন্দময় অনুভূতি আর হয় না।

তাশমিমের মনে অজানা অচেনা এক ভালো লাগার অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সবকিছুই তো অচেনা- চারপাশের বৃক্ষরাজি, পশু বা পাখীর ডাক। ও কি কখনও জানতো জীবনের পাতায় এত গভীর অনুভবময় ভালো লাগা লুকিয়ে ছিল! গতকাল এখান বৃষ্টি ছিল বলে অনেক জায়গায় ভেজা আছে এখনও। একটা সোঁদা গন্ধ এসে নাকে লাগে। তাশমিম গভীরভাবে নি:শ্বাস নিয়ে গন্ধের অনুভূতিগুলো মস্তিস্কের নিউরনে জমা করে। যাতে বহু বছর পরে একটা সুখস্মৃতির কথা ভাবলে মনে পড়তে পারে আজকের দিনটি।

রোদে ঘুরতে ঘুরতে শ্যামলের শ্যামল রঙ কালো হয়ে যায়। তাশমিম দেখল, বার বার চোখের চশমা খুলে মুখের ঘাম মুছে নিচ্ছে সে। শ্যামলা বর্ণের খাড়া চেহারায় কালো ফ্রেমের চশমা-বুদ্ধিদীপ্ততার প্রকাশ ঘটায়।

আসার পথে তাশমিম হঠাৎ বলে, ‘ভাষা শিক্ষকের সম্মানী কিভাবে দেব?  বুঝতে পারছি না।’

‘বিনা ভিজিটে রোগীর চিকিৎসা করে দেন তাহলেই হবে।’

‘রোগীর সমস্যা কি আজকে?

‘প্রচন্ড মাথা ধরেছে।’

বাড়ির সামনে গাড়ির থামার পরে তাশমিম ব্যাগ থেকে কাগজ-কলম বের করে ওষুধ লিখে দেয়।

‘ওষুধের নামের নীচে একটা অটোগ্রাফ চাইছে আপনার ভক্ত।’ শ্যামল তার স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় এমনভাবে কথাটা বলে যে অপরপক্ষ হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে। গোটা গোটা অক্ষরে সে লেখে- ‘তাশমিম খান’।

হাসি থামিয়ে তাশমিম এরপরে বলে, ‘ভাষা শিক্ষক- আপনি যে এত ভাষা জানেন, মানুষের মনের ভাষা কি বুঝতে পারেন?’’

৫.

‘এই যে ডক্টর তাশমিম খান..কোথায় চলেছেন?’

আবার তাদের দেখা একুশ বছর বাদে। তাও বাংলাদেশের কোথাও নয়। নিউইয়র্ক শহরের এক সাবওয়ে স্টেশনে। গত পাঁচ বছর যাবত শ্যামল এই শহরের বাসিন্দা। তবে তাশমিম ডেট্রয়েটে আছে, তাও প্রায় বিশ বছর। ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক থেকে ফেরার পরের অভিজ্ঞতা মধুর হয়নি। হবু স্ত্রীর এভাবে ঘোরাঘুরির খবর ইমরানের কানে পৌছে যায়। তারপর তাশমিমের মা আর খালার ওপর চাপ সৃষ্টি করে ওখান থেকে চলে আসতে বাধ্য করে। তবে সিলেটে বদলি নয়, বিয়ে আর কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মিশিগানে নিয়ে আসে তাশমিমকে।

‘আরে আপনি, কি সৌভাগ্য!’ তাশমিম যতটা না অবাক শ্যামলকে দেখে, তারচেয়ে বেশী খুশী হয়।

‘আজকাল লোকজন ডেট্রয়েট থেকে নিউইয়র্কে বেড়াতে আসে, কিন্তু আমাদেরকে বলার দরকার মনে করেনা।’

শ্যামলের কথায় হাসে তাশমিম, ‘ভাবলাম যদি ব্যস্ত থাকেন।’

দুজনের আর দেখা না হলেও ফেসবুকে যোগাযোগ আছে। যে কারণে কারো মনে হয়না মাঝখানে কেটে গেছে এত বছর! বছর গড়ালেও দুজনের চেহারায় তেমন বয়সের ছাপ পড়েনি। বরং দুজনে যেন আগের চেয়ে বেশী সুন্দর আর পরিপাটি হয়েছে আগের চেয়ে।

তাশমিম যাবে আপটাউন ম্যানহাটনে এক হাসপাতালে সেমিনারে যোগ দেবার জন্য। শ্যামলের গন্তব্য ব্রুকলীন কোর্ট স্ট্রিটে এক অফিস,সে নেবে ডাউনটাউন ম্যানহাটানের ট্রেন।

লেক্সিংটন ফিফটি থ্রি সাবওয়ে স্টেশন গিজগিজ করছে মানুষে, তারা কত ভাষায় কথা বলছে। হঠাৎ পকেটে রাখা মানিব্যাগ বের করে শ্যামল। সেখান থেকে দ্রুত হাতে বহুদিন আগের মলিন হয়ে যাওয়া একটা কাগজ তাশমিমকে দেখায়। একটা ওষুধের নাম। নীচে লেখা তাশমিম খান।

বিস্মিত তাশমিমের দিকে তাকিয়ে শ্যামল বলে, ‘আমি যে মনের ভাষা বুঝতে পারিনা, আপনার এই ধারনাটা সঠিক না।’

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত