| 24 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: গির্জায় যাবার পথে । ভিকি গ্রাট » অনুবাদক লুনা রাহনুমা

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

গের দিন ওরা লন্ডন থেকে এসেছে অনেক রাত করে। গাড়িতে উঠে বসার আগেই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো দুইজন। বেশ কয়েকদিনের জন্য বাড়ি বন্ধ করে কোথাও যাওয়া মানে শত কাজ- জানালা বন্ধ করা, লাইটের সুইচ অফ করা, ব্যাগগুলো টেনে গাড়িতে তোলা, চিৎকার করে কাঁদতে থাকা শিশুটিকে গাড়ি থেকে বের করে আনা… এইসবের ভেতরেও ওরা দুইজন গলা ফাটিয়ে তর্ক করে যাচ্ছিলো সমান তালে। বিদ্বেষপূর্ণ, তিক্ত, ঝাঁজালো, বিক্ষুব্ধভাবে চলেছে ওদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের মৌখিক আক্রমন। আক্রমণাত্মক বাক্যবাণ চলছিল সেই পর্যন্ত, যতক্ষণ না তারা এই তর্কযুদ্ধ শুরু হয়েছিল কী কারণে, সেই কথাটিই আর মনে করতে না পারে। অবশেষে পড়ে রইলো শুধু কিছু দুঃখদায়ক, আহত, ক্লান্ত, পীড়িত ও সংক্ষিপ্ত অভিযোগ। এরপর পাঁচটি ঘন্টার রাস্তায় ড্রাইভের বেশীরভাগটুকুই ওদের কেটেছে গভীর নিঃশব্দে।

গতকাল রাতে প্রকৃতির আবহাওয়া মনে হয় নিজেকে সাজিয়েছিল ওদের মেজাজের সাথে মিল করে। সারারাত তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে খারাপ ছিল। ঝড়, বৃষ্টি আর বাতাসের তুলকালাম কান্ড ঘটেছে পুরো দেশে। বাড়াবাড়ি বৃষ্টি গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে আঘাত করেছে দুর্দান্ত মেজাজে । প্রচন্ড দাপটে বইতে থাকা ঝড়ো হাওয়ায় গাড়িটা কেঁপে উঠছিলো বারবার। সারাহ ভয় পাচ্ছিল, ওদের গাড়িটি বোধহয় উল্টে যাবে। ঝড়োরাতের ঘূর্ণায়মান, গভীর অন্ধকারের ভেতর তলিয়ে যাবে ওরা এক নিমিষেই। মোটরওয়েতে যথারীতি জায়গার নাম দেখাচ্ছিল: হাঙ্গারফোর্ড, মেইডেনহেড, ব্রিস্টল, কার্ডিফ। ঘুটঘুটে এমন অন্ধকারের মাঝে গাড়িতে বসে এই জায়গাগুলোর অস্তিত্ব আছে সেখানে, বিশ্বাস করতে কঠিন হচ্ছিলো। দীর্ঘসময় ধরে মোটরওয়ের রাস্তায় কোন আলো ছিল না এবং তারপর মনে হচ্ছিল যেন রাস্তাটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ওরা ধরে নিতে পারতো যে সমুদ্রের নিচ দিয়ে গাড়ি চলছে। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো সারারাত। তবুও গভীর অন্ধকারে কেবলমাত্র এক জোড়া হেডলাইট সেই বিস্মৃতির সাগরে আলো ফেলে এগিয়ে গিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতোকিছুর মধ্যেও, বেচারা শিশুটি, পিছনের সিটে নিজের কটে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। শিশুটি একটুও টের পায়নি যে তার চেনাজানা পৃথিবী পুরোপুরি বদলে যাবার উপক্রম হয়েছিল আরেকটু হলেই।

বিয়ের পনের বছর পর তারা বাচ্চা নিয়েছে দেখে লোকে খুব আশ্চর্য হয়েছিল। “এতদিন দেরি করেছো কেন?” প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটি কি কারণ হিসেবে কিছু বলবে, নাকি, আসলে কোনই কারণ ছিলনা? “এটা একটা দুর্ঘটনা ছিল,” মেয়েটি বলেছে, “আমরা ভেবেছিলাম আমাদের আর বাচ্চা-কাচ্চা হবেনা।” বেশিরভাগ মানুষ তার এই কথাটি নিয়ে হাসাহাসি করেছিল। আবার অনেকের চোখে হতাশাও ফুটে উঠেছিল। যেন তারা আরো মুখরোচক একটি গল্প শোনার আশা করেছিল। তবুও, এটাই সত্যি কারণ ছিল।

ঝড়ের রাতে গাড়িটা রাস্তায় মাঝেমাঝে গলি বদলাচ্ছিলো। সারাহ অনুভব করতে পারছিলো প্রচন্ড বাতাসের ভেতর গাড়িটিকে টিকিয়ে রাখতে জনের খুব পরিশ্রম হচ্ছে। বুঝতে পারছিলো যে গাড়ির তিনজনকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে নিতে, জনকে অনেক কসরত করতে হচ্ছে। জনের এই আপ্রাণ চেষ্টা করে যাওয়াটি সারাহকে একটি বিশেষ সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেইসময়, যখন সে তার গর্ভের সন্তানটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় আকুল হয়ে থাকতো। তখন সারাহর বয়স ছিল ৪৩ আর জনের বয়স ৫০। বাচ্চা হওয়ার জন্য দুটো বয়সই অনেক বেশি।

ওরা যখন জনের মায়ের বাড়িতে এসে পৌঁছাল, তখন রাত একটা বাজে। পুরো শহরে রাতজাগা অল্পকিছু মানুষ ছাড়া বাকিরা সবাই তাদের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে ঘুমুবে বলে। গাড়ির আওয়াজ শোনার সাথে সাথে অ্যান দরজা খুলে দিয়েছে। দরোজার ভেতর থেকেই খুব লোভীর মতো সে নিজের হাত দুইটি বাড়িয়ে দেয়।

সারাহ এবং জন একের পর এক কথা বলার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। কিন্তু অ্যান কোন আগ্রহ দেখায় না। “ওকে আমার কাছে দাও,” সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাচ্চাটা, সোনা। আমার কোলে দাও। আমার কাছে আসো বাবু, আমার সোনা জাদু।”

পরের দিনটি হিমশীতল হলেও রোদ ঝলমলে ছিল। আগের রাতের ঝড় পরিষ্কার করে ধুয়ে দিয়ে গেছে বাতাস ও চারপাশ। সারাহর মনে স্বস্তি লাগছিলো কারণ তার শাশুড়ি অনেকক্ষণ আগেই প্রতিবেশীদের সাথে চার্চে চলে গিয়েছে। ওদের সবার জন্য চার্চের ভেতর সামনের দিকে একটি ভালো বসার জায়গা দখল করে রাখবেন তিনি। সারাহ আর জন চুপচাপ তৈরী হলো। বেরুনোর সময় জন বাড়িটির দিকে একবারও পিছন না ফিরে হনহন করে হেঁটে সামনে চলে গেলো। রাস্তায় একটিও গাড়ি না থাকায় জন রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে থাকে। প্রাম নিয়ে সারাহ পেছন পেছন তাকে অনুসরণ করতে থাকে। পনের বছর। এখন সারাহর কাছে জনের মুখ এতটাই পরিচিত যে জনের মুখস্ত মুখটি খুব কমই তাকিয়ে দেখতে হয় তার। কিন্তু তবুও, ইদানীং, জন ওর কাছে কেমন অপরিচিত মানুষ হয়ে ঠেকছে।

সন্তানের জন্মের পর প্রথম একটি বছর, বাচ্চার সাথে সময় কাটানোর জন্য সারাহ নিজের চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু পরে একসময় তার মনে হয়েছে, চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে সে ভয়ানক ভুল করেছে। সে এমন একটি সময় জনের উপর নির্ভর করতে চেয়েছে যখন জন আসলে ওর ভার নেয়ার জন্য উপযুক্ত ছিল না। চাকরিহীন দিনগুলোতে আনন্দের অনেক মুহূর্তও ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে সারাহ যা করছিলো তা হচ্ছে, জন আর বাচ্চার ডাকে ছুটে উপস্থিত হওয়া। বিরামহীনভাবে ছোট্ট শিশুটির প্রয়োজন বা জনের মুডের মেশিনগান ট্যাটু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিলো সারাহর প্রতিটি মুহূর্ত। তাদের যখন যা প্রয়োজন হতো সারাহ তৎক্ষণাৎ সেসব হাজির করতো। এখন। এখন। এখন। কিছুদিন পর সারাহর মনে হতে থাকে যে তার জীবনে যা যা ঘটে গিয়েছে, তার সর্বোৎকৃষ্ট নাম “দুর্ঘটনা” বলতে হবে। এতদিন সারাহ যা কিছু জেনেছে, শিখেছে, জীবনে মূল্যবান ভেবেছে, তার সমস্ত কিছুই ধ্বংসস্তূপে আবর্জনার মতো নিষ্প্রয়োজনীয় হিসেবে আবিষ্কার করছে বর্তমান সংসার-জীবনে।

মাথার উপর দিয়ে একটি কবুতর উড়ে গেলো। কবুতরের উড়ে যাওয়া দেখে, প্রামের ভেতর শুয়ে থাকা নিষ্পাপ শিশুটির মুখে একটি অপার্থিব অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো। শিশুর মুখের এই অভিব্যাক্তিটি সম্পূর্ণ নতুন। সারাহ শিশুপুত্রের দিকে তাকিয়ে হাসলো, শিশুর বাঁকানো মাথাটিতে হাত বুলিয়ে দেয়। শিশুর বাদামি ভ্রূ জোড়াতে আঙ্গুল বুলিয়ে দেয়। বাচ্চাটি নিজের নাদুস নুদুস দুই হাত, আর চিকন আঙ্গুলগুলো দিয়ে তার কম্বলের ঝালর টেনে টেনে খেলতে থাকে। সারাহ গাউনের ভেতরে ছেলের নরম ঘাড় সোজা করার জন্য ঝুঁকে পড়ল। মায়ের চুলের একটি গোছা নিজের হাতে নিয়ে বেল টানার মতো করে টানতে থাকে ছেলেটি। সারাহ হেসে ফেলে। সারাহর বুকের ভেতর আতঙ্কের অনুভূতিটি জেগে উঠতে চায় আবার। সকাল ৯.৪৫ বাজে। চার্চে সার্ভিস শুরু হতে আর পনেরো মিনিট বাকি।

সারাহ দ্রুত হাঁটতে লাগলো।

প্রতিটি রাস্তা দেখতে একই রকম। দুইটি করে উঁচু ও দুইটি নিচু বাড়ি প্রতিসারিতে। বেশিরভাগ বাড়ির জানালা নুড়ি-কাটা এবং ডাবল-গ্লাসযুক্ত। মিটজি’র হেয়ার সেলুনের সামনে জন দাঁড়িয়ে আছে, সারাহর জন্য অপেক্ষা করছে। এখনও সে সারাহর দিকে পিছন ফিরে আছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তির সাথে কথা বলছিলো। সারাহ তার হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়েছে কিছুটা, আশা করছে পৌঁছানোর আগে লোকটি চলে যাক। সারাহ এখন সৌজন্যমূলক আলাপের মেজাজে নেই।

এইবার জন ঘুরে দাঁড়াল, সারাহকে দেখে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো, যেন ওদের মাঝে কোন বিশ্রী কথা কাটাকাটি হয়নি গতরাতে। “এই সারাহ, এখানে আসো, হ্যালো বলো। ও হচ্ছে রিডিয়ান। রিডিয়ান, এই হচ্ছে সারাহ, এই আমার স্ত্রী। এবং এটি হ’ল —- ” হালকা আশ্চর্যের দৃষ্টিতে জন প্রামের দিকে তাকিয়ে থাকে “— এটি আমার ছেলে।”

ওরা সবাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে রইল। এমন দুটি জীর্ণ শীর্ণ ক্লান্ত শরীরের নর-নারীর কাছ থেকে কীভাবে এমন অপূর্ব সুন্দর উজ্জ্বল শিশু জন্মাতে পারে, আশ্চর্য হয়ে ভাবছে হয়তো!

“আমি জন্মের পর থেকেই রিডিয়ানকে চিনি,” জন বলে, “খনি শ্রমিকদের ধর্মঘটের কথা মনে পড়ছে এখন। আমরা উলওয়ার্থের সামনে দাঁড়িয়ে চাঁদা তুলেছিলাম শ্রমিকদের জন্য, তাইনা, রিডিয়ান?
“ঠিক,” বুড়োটি মাথা ঝাঁকালো।
“বিশ বছর আগের কথা, তাইনা?”
“তিরিশ, হবে মনে হয়,” রিডিয়ান বলে, সাঁসাঁ করে নিঃশ্বাস ফেললো লোকটা একবার, “তোমার কানের পেছনটা তখনো অনেকটা তাজা ছিল জন।”

জন মাথা নাড়ে। “ভয়ানক একটি সময় ছিল তখন। শেষপর্যন্ত সবরকম অন্ধ ফোকড় বন্ধ হয়েছিল, যেমনটি আমরা চেয়েছিলাম।”
“হুম,” রিদিয়ান বলল। আর “সেই সাথে উলওয়ার্থসও।”
বাচ্চাটি কম্বলের নীচে শব্দ করতে শুরু করেছে। ছোট্ট শরীরটি বাঁকাচ্ছে।
“জন আমাদের এখন যেতে হবে,” সারাহ ফিসফিস করে বললো। রিদিয়ানকে উদ্দেশ্য করে সারাহ বলে যে অ্যান তাদের জন্য গির্জার ভেতর অপেক্ষা করছে। তারপর নিজেদের সন্তানের দিকে মাথা উঁচু করে বলল, “আজ তাকে খ্রীষ্টধর্মে অভিষেক করা হবে।”

“তোমাদেরকে তাহলে আর আটকে রাখা ঠিক হচ্ছেনা,” রিদিয়ান বলল, জনের কাঁধে একটি চাপড় মেরে বলে, “তোমার মাকে আমার কথা বলো।”

ওরা হাঁটতে আরম্ভ করে। কিছুক্ষণের ভেতর বড় রাস্তা দেখা গেলো। রাস্তায় বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষের দল, তাদের সেরা কাপড়টি পরে গির্জার দিকে পাহাড়ের উপরে উঠছে। কিন্তু জন রাস্তার উল্টো দিকে তাকিয়ে থাকে, নিচের দিকে নেমে যাওয়া একটি সরু পথের দিকে তার চোখ।

“আমার বয়স যখন দশ বছর, তখন আমি বাইক নিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম, ঐযে, ওখানে,” জন আঙ্গুল তুলে দেখায়। “পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটু পর্যন্ত পুরোটা ছিলে গিয়েছিলো একেবারে। তারপর আমি বড় হবার পর আরেকবার। আমার বয়স যখন ষোল বা সতেরো হবে। আমার মনে আছে, আমি ছেলেটিকে একরকম বাধ্য করেছিলাম আমাকে তার মোটরবাইকটি একা চালাতে দিতে। মোটরবাইক কীভাবে থামাতে হয়, সেটা আমাকে বলেনি ছেলেটি। আমি চলন্ত মোটরবাইকটি নিয়ে পাথরের দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম।”

রিদিয়ানের সাথে দেখা হয়ে মনে হচ্ছে জনের মনে ওর শৈশবকাল জেগে উঠেছে আজ। “আমি যখন গ্রামার স্কুলে পড়তাম, তখন আমি প্রতিদিন একটি ছেলের সাথে স্কুলে যেতাম। ছেলেটি ঐ, বা দিকে থাকতো। ঐযে ওখানে, গ্যারেথ ম্যাসন।”

সারাহ বুড়ো আঙুলের নখ কামড়াতে থাকে। জনকে এখন যেভাবেই হউক জলদি করে হাঁটাতে হবে। অ্যান নিশ্চয়ই এখন চার্চের পিছনের দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রতিটি সেকেন্ড গুনছে।

“গ্যারেথ মাসন, না?” জোর করে একটি হাসি ফুটালো মুখে।

“হ্যাঁ, ঐ রাস্তায় বারো নাম্বার বাড়িটিতে থাকতো। সে অনেক বছর বিদেশে ছিল, একটি বড় তেল কোম্পানিতে চাকরি করতো, কিন্তু তারপর তার শরীর খারাপ হয়ে যায়। মা বলেছে, সুস্থ হয়ে সে এখন বাড়ি ফিরে এসেছে।

সারাহর মনে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। তবুও মিষ্টি এক টুকরো হাসি ঠোঁটের উপর ফুটিয়ে রাখে: যেন স্বামীর সাথে তার বিমানবালার মতো হাসিমুখে ব্যবহার করার চুক্তি আছে। আর সবচেয়ে খারাপ কথা হলো যে, জন সারাহর সত্যিকার চরিত্রের চেয়েও এই নকল, হাসিখুশি মুখটিকেই বেশি পছন্দ করে।

“শোন,” জন বলে, “আমি একবার শুধু দরজাতে কড়া নাড়ব, গ্যারেথ বাড়ি আছে কিনা দেখবো। হাঁটার উপর একবার হ্যালো বলা আরকি। আমাদের হাতে এখনো অনেকটা সময় আছে।” জন সারাহর হাত থেকে প্রামটি টেনে নিয়ে পাশের নিচু রাস্তা ধরে নেমে যেতে শুরু করে। সারাহ তাড়াহুড়ো করে সাথে ছুটলো। আজকের পর আমাদের সম্পর্কটির কী হবে, সারাহ আশ্চর্য হয়ে ভাবে? রাস্তাটি সামনে বালির ভেতর গিয়ে মিশেছে।

একজন সৌম্যদর্শন লোক দরজা খুললো। দরোজায় শোনা যায় দুইজনের প্রাণখোলা হাসির শব্দ, একে অন্যের পিঠ চাপড়ানোর শব্দ, তারপরে সারাহকে হতাশ করে দিয়ে তারা দুজনেই প্রামটি ঘরের ভেতরে ঠেলতে শুরু করলো। জনের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? চার্চে সার্ভিস শুরু হবে আরেকটু পরেই। ওদের হাতে মাত্র সাত মিনিট সময় আছে।

“বাচ্চা, না?” গ্যারেথ ম্যাসন বলে, বাচ্চার মুখ ছাড়া অন্য সবদিকে তাকিয়ে কথা বলছে। লোকটি ওদেরকে একটি উষ্ণ, খুব অগোছালো বসার ঘরের দিকে নিয়ে গেলো, যেখানে টিভিতে ফুটবল খেলা চলছে নিঃশব্দে। “আমি একটু চা করছি।” বসার ঘর ছেড়ে চলে গেল গ্যারেথ।

“আমাদের হাতে সময় নেই!” সারাহ গর্জে উঠে। প্রামটির হাতল ধরে একটা ঝাঁকুনি মারলো জোরে, বাচ্চাটি প্রতিবাদ করে একটু মিনমিন শব্দ করলো শুধু।

জন যেন কিছুই শুনতে পেলোনা। সে ঘরের ভেতর অস্থির হয়ে পায়চারি করছে, গ্যারেথ ম্যাসনের ভিনাইল সংগ্রহ দেখছে আর কয়েকটি অ্যালবাম হাতে নিয়ে আনন্দের সাথে চিৎকার করে উঠছে।

কেটলিতে পানি গরম দিয়ে গ্যারেথ দরজার কাছে এসে ঝুঁকে দাঁড়ালো। “এগুলো অনেকবছর ধরে লফ্টে পড়েছিল,” মেঝেতে গাদা করে ফেলে রাখা গানের অ্যালবাম স্তুপের দিকে তাকিয়ে বললো সে, “পুরুষ মানুষ আসলে কখনই কিছু ফেলে দেয়না।”

জন ডেভিড বোয়ির একটি অ্যালবাম হাতে নিলো, “অবিশ্বাস্য, তাই না? ভাবাই যায়না মানুষটি আর নেই?”

“মর্মান্তিক,” গ্যারেথ বলে।

“লোকটা সবসময় এতো উচ্ছল ছিল। এতটাই জীবন্ত। এতই অবিনাশী। তোমার হয়তো মনে আছে, তবুও বলি, নব্বইয়ের দশকে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, তাই না? তিনি প্রায় মঞ্চেই মারা যাচ্ছিলেন।”


আরো পড়ুন: অনুবাদ গল্প আংটি

জন ভারীস্বরে গানের শিরোনামগুলি পড়তে শুরু করেছে। “বৈচিত্রময় জীবন। তাই না? তার সম্পর্কে সংক্ষেপে এই-ই বলা যায়। তিনি নিজেকে বারবার নতুন করে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। এক জীবনে সে অনেকগুলো জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে পেরেছিলো।”

গ্যারেথ কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছে, কিন্তু রান্নাঘরে কেটলির শিস বেজে উঠায় গ্যারেথ রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো।

এইমুহূর্তে সারাহ একই সাথে আতঙ্ক আর ভয়ঙ্কর একটি ক্রোধের মধ্যে দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। বাচ্চার প্রামের মুখ বাইরের দরজার দিকে ঘুরিয়ে দিলো। “জন, তোমার মা গির্জায় সবার সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাদের এখনই যেতে হবে, না হলে আমরা অনুষ্ঠানের শুরুটা মিস করব আর মা তাহলে আমাদের কখনই ক্ষমা করবেন না —-“

জন স্তুপের ভেতর থেকে আরেকটি রেকর্ড টেনে বের করলো, রেকর্ডের রিমের চারপাশে হালকাভাবে নিজের একটি আঙুল বুলাতে থাকে।

“তুমি কি আমার কথা শুনতে পারছো, জন?”

“তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই,” জন বিড়বিড় করে বলে, “প্রথমত এটা খুব সাধারণ একটি চার্চ সার্ভিস। আর বাচ্চার ধর্ম-অভিষেকের কাজ শুরু হবে সবার শেষে, তাইনা?” জন কণ্ঠস্বর নিচু করে প্রায় অস্ফুটে বললো, “তোমাকে আমার কিছু জরুরি কথা বলার আছে।”

“ওহ,” সারাহ প্রাম থেকে তার হাত সরিয়ে নিলো। “এখনই? এখানে?”

“সঠিক সময়, সঠিক স্থান বলে কিছু নেই সারাহ, আছে কি?”

একটি শীতল স্রোত হিম করে দিলো সারাহর সমস্ত শরীর। আমি জানতাম, আমি জানতাম, আমি ঠিক জানতাম। জন চলে যাচ্ছে। জন এমন কারো সাথে মেলামেশা শুরু করেছে, যার গায়ে সারাক্ষণ বাচ্চার ময়লা, বমি, নোংরা খাবার লেগে থাকে না। এমন কেউ, যে কথা বলা শুরু করলে নিজের বাক্যটি সমাপ্ত করে। এমন একটি মেয়ে, যে যৌন সম্পর্কের কথা উঠলেই ক্লান্তিবোধ করে না। সারাহ ঘরের ভেতর এলোমেলো কয়েকটি বিভ্রান্ত পা ফেলে সোফার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো, যাতে জনের কথা শেষ হলে, ওর যদি মাথা ঘুরে পড়ে যাবার উপক্রম হয়, তাহলে ওকে বেশি পথ ছুটতে হবে না।

“বলো।”

রান্নাঘর থেকে কাঁচের কাপে চামচের টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। ধাতব কিছু একটা ঝনঝন শব্দ করে মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে গেলো।

জন হাতের রেকর্ডটি সরিয়ে রাখে। “আচ্ছা,” কথা বলতে শুরু করে সে। হাতের পেছন পাতায় নিজের মুখটি মুছে নিলো আলগোছে। “তোমার মনে আছে সারাহ, গতবছর আমার একটা স্ক্যানের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল হাসপাতালে, আমি ডান কানে শুনতে পাচ্ছিলাম না বলে? মনে আছে তোমার? সেই অ্যাপয়েন্টমেন্টের পর কিন্তু হাসপাতাল থেকে কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। তাই আমি ধরে নিয়েছিলাম যে আমার কানে কোন সমস্যা নেই। নিয়ম অনুযায়ী, খারাপ কিছু পেলে ওরাই যোগাযোগ করতো আমার সাথে।”

এখন এই ধরণের কোন কথা শুনবে বলে একদম আশা করেনি সারাহ।

জন কথা বলতে থাকে। সে “স্ক্যান” এবং “টিউমার” এর মতো কয়েকটি পুরো শব্দ উচ্চারণ করেছে। সারাহ কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু মনে হলো সারাহর কণ্ঠনালীতে ভাষা উৎপাদন ও প্রকাশকারী সকল প্রচেষ্টাগুলোকে কেউ গলার ভেতর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে।

“— হয়তো হাসপাতালে নার্স আমার স্ক্যানের রেজাল্টটি ভুল ফাইলে রেখে দিয়েছিলো। অথবা ডাক্তার রেজাল্টটি ভালোমতো পরীক্ষা করেনি। কিংবা তারা আমার রেজাল্টটি হারিয়ে ফেলেছিলো। কিছু একটা হবে। আমাকে ওদের অনেক আগেই ডাকা উচিত ছিল,” জন কথা বলতে থাকে। “তবে যাই হোক, এখন তারা আমার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখছে। আর, বলা যায়, খুব বেশি দেরি হয়নি। ডাক্তার বলেছে, এই ধরণের টিউমার খুব ধীরে বাড়ে। সার্জন আমার মাথা কাটবে, এই যে এইখানে,” জন কানের পিছনে একটি দিকে ইঙ্গিত করে। “আর জিনিসটাকে ভেতর থেকে চেঁছে তুলে ফেলবে।”

সারাহ সোফায় পিছনের দিকে ডুবে গেল। সোফার পিছনে জানালা দিয়ে আসা শীতের রোদের স্রোতে একরাশ ধুলো উড়ে উড়ে ভেঙে পড়তে থাকে। সারাহর মনে হচ্ছিলো, সে আর কখনই উঠে দাঁড়াতে পারবে না।

জন সোফায় ওর পাশে বসলো। “তুমি চিন্তা করো না, সারাহ” জন ওর একটি হাত ধরে, “সার্জন অহরহ এই অপারেশন করছে। আমি গুগল করে দেখেছি। তিনি বিশ্বমানের সার্জন।” জন খুব হাসে, ” ব্যাপারটি কেমন মজার, তাই না? সেইসময় তুমি গর্ভবতী ছিলে। যখন তুমি তোমার পেটের ভেতরে প্রতিদিন একটু একটু করে বড় করছিলে আমাদের সন্তানকে, তখন আমিও আমার শরীরের ভেতর লালন করছিলাম কাউকে। একটি টিউমারকে বড় করছিলাম আমার খুলির ভেতরে। আমাদের দুইজনের ভেতর যেন একটা কঠিন প্রতিযোগিতা চলছিল তখন, তাই না?”

সারাহ আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে জনের দিকে। একটা প্রবল ঝাঁকুনি এসে আঘাত করে সারাহর মনে। ভাবে, কবে, শেষ কবে আমি ওকে এভাবে হাসতে শুনেছি?

গ্যারেথ ম্যাসন তার কংকালসার হাতদুটিতে তিন মগ চা নিয়ে উপস্থিত হলো। “সবগুলোতে দুধ দিয়েছি, আসলে জানি না তো তোমরা কে কেমন চা পছন্দ করো!”

“তুমি খুব বুদ্ধিমান একটা মানুষ,” জনের মুখ কথা বলার জন্য তৈরী হয়েই ছিল। ওকে দেখতে সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত লাগছে। সারাহর মনে হচ্ছিলো, জনের আসল মুখ, রূপ, চরিত্র এটাই। নিজের চোখের সামনে সে গ্যারেথ ম্যাসন ও জনের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বপূর্ণ দিনগুলোকে পরিষ্কার কল্পনা করতে পারছে যেন।

গ্যারেথ নিজের চায়ের মগে চুমুক দেয়, তারপরে স্তুপ থেকে একটি সিনামন-কালারড অ্যালবাম টেনে বের করে আনলো। “এটির কথা মনে আছে, জন? ১৯৭৭, কমপক্ষে। তোমাকে আমার প্রিয় ট্র্যাকটি শোনাই দাঁড়াও।” লোকটি স্টেরিওর দিকে ঝুঁকে পড়ে রেকর্ডটি চালানোর চেষ্টা করে।

“সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, সারাহ,” জন ফিসফিস করে বলে। “আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।” কিছুক্ষন থেমে জন আবার বলে, “গতরাতে তোমাকে আমি যা যা খারাপ কথা বলেছি তার জন্য আমি দু:খিত I আমি ওসব কিছুই তোমাকে সত্যি করে বলিনি।”

“এটা আমার প্রিয়,” গ্যারেথ বলে, ডিস্কের উপরে রেকর্ডারের সুঁইটি ফেললো সে ।

প্রথম কিচ্ছুক্ষণ ক্যেরক্যের শব্দ হলো যেন পাতিলে গরম তেলে কিছু ভাজা হচ্ছে। তারপরে ডেভিড বোয়ি সুর করে গাইতে লাগলো, “……বারবার আমি একই গাড়িতে ধাক্কা খাচ্ছি।” গ্যারেথ ম্যাসনও গুনগুন করে গাইছে সাথে। জন তার চা পান করছে। বাচ্চাটি নিজের কান ডললো কিছুক্ষণ, তারপর ঘেমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে প্রামের উষ্ণতায়। আর সারাহ চোখ বন্ধ করে আছে। তার মনের ভেতর ভবিষ্যতের অজানা আতঙ্করা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে জয়ী হবার সম্ভাবনার সাথে। সারাহ আশা করছে, জনের কথাই ঠিক হবে। ভাগ্য ওদের সহায় হবে – খনির শ্রমিকদের চেয়ে ওরা বেশি ভাগ্যবান হবে। উলওয়ার্থের চেয়ে বেশি ভাগ্যবান হবে। এমনকি ওরা একটিমাত্র জীবনে বৈচিত্রময় শত জীবন পেয়ে ধন্য হওয়া ডেভিস বোয়ির চেয়েও বেশি ভাগ্যবান হবে।

ভিকি গ্রাট 

তার লেখা বেশ কিছু কল্পকাহিনী যুক্তরাজ্যের পিকোডোর, গ্রান্টা, ডকওয়ার্থস, সার্পেন্টস টেইল এবং ব্লুমসবারি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখা নন-ফিকশন প্রবন্ধ “ইনটু দ্যা ভ্যালি” বেস্ট আমেরিকান এসে, ২০১৩, ঘোষিত হয়েছে। তার একটি গল্প চীনে দ্বৈত ভাষা নৃবিজ্ঞানের জন্য ম্যান্ডারিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। ভিকি গ্রাটের উপন্যাস হিউম্যান জিওগ্রাফিকে ২০১৭ ক্যালেডোনিয়া নভেল অ্যাওয়ার্ডের জন্য শর্টলিস্ট করা হয়েছিল। তিনি কমিউনিটি আর্টস, ফ্রিল্যান্স বইয়ের সম্পাদক হিসাবে এবং ওপেন বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন সাউথ ব্যাংক বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃজনশীল লেখার প্রভাষক হিসাবে কাজ করেছেন। হল্যান্ড পার্ক প্রেস (২০১৮সালে) তার গল্পগুলির সংকলন প্রকাশ করেছে। বর্তমানে তিনি সৃজনশীল ননফিকশন বইয়ের উপর কাজ করছেন।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত