অনুবাদ: ভার্জিলিয়ো পিনেরা’র গল্প । ভাষান্তর নাহার তৃণা
ভার্জিলিও পিনেরা
ভার্জিলিও পিনেরা(Virgilio Piñera) কিউবার কারদেনাসে ৪ আগস্ট ১৯১২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কারদেনাস শিক্ষাবোর্ডের সেক্রেটারি হিসেবে প্রথম জীবনে কাজ করেন। পরে কারদেনাস একোইডাক্ট (aqueduct) বিভাগের প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। ১৯২৩ সালে তাঁরা সপরিবারে হাভানায় বসবাস শুরু করেন। কবিতা দিয়ে তাঁর লেখালিখির সূচনা হয়। প্রথম কবিতা এল গ্রিটোমুডো El GritoMudo (The Mute Scream)১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৭ সালে প্রথম রচিত নাটক ক্ল্যামার এন এল পেনাল(Clamor en el Penal (Noise in the Penitentiary)। এই নাটক রচনার মধ্যে দিয়ে দর্শন শাস্ত্রে ডিগ্রীধারী পিনেরা পুরোদস্তুর লেখক জীবনে প্রবেশ করেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা সৃষ্টি হলো ‘লা ইসলা এন পেসো’ La islaen peso (The Island in Weight) ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর অন্যান্য রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে সাহিত্য সম্পর্কিত প্রবন্ধগুচ্ছ, সাহিত্য সমালোচনা। ছোটো গল্পের সংকলন যা ‘কোল্ডটেলস’ শিরোনামে পরিচিত, এটি ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা লাভ করে। পিনেরা অসংখ্য নাটক রচনা করেন। যার মধ্যে অনেকগুলো দর্শকের সমাদর পেয়েছিল। তাঁর গল্পে উদ্ভট আর অলৌকিক ব্যাপারের কেমন একটা মেলবন্ধন চোখে পড়ে যা কাফকা সুলভ বলে বোদ্ধাদের মতামত। পিনেরার অনুবাদিত সাহিত্য সৃষ্টি বিংশ শতকের স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের খতিয়ান হিসেবে পাঠকের সামনে উপস্হিত হচ্ছে। সমাজ-রাজনীতি সচেতন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ভার্জিলিও পিনেরা ১৯৭৯ সালের ১৪ অক্টোবর হাভানায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অনিদ্রা
লোকটা সেদিন আগে ভাগে শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসে না। ঘুমের আশায় বার বার এপাশ-ওপাশ করে। তাতে বিছানার চাদরের দফারফা হলেও ঘুম নাগালের বাইরেই থেকে যায়। লোকটা উঠে একটা সিগারেট ধরায়। বই নিয়ে খানিক পড়বার চেষ্টা করে। নাহ্ মন বসাতে ব্যর্থ হয়। আবার বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসে না। ঘড়ির কাটা যখন তিনটের ঘর ছুঁইছুঁই তখন সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। পাশের ঘরে ঘুমে ডুবে থাকা বন্ধুকে উঠিয়ে নিজের ঘুমহীনতার কথা বলে। বন্ধুর পরামর্শ চায়। বন্ধু পরামর্শ দেয় সে যেন বাইরে খানিক হাঁটাহাঁটি করে। তাতে শরীর ক্লান্ত হবে। এরপর এককাপ লেবু চা খেয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়তে বলে; ঘুম আসবে। বন্ধুর কথা মতো পইপই করে সব কাজই করে। কিন্তু তাতেও ঘুম বশ মানে না। আবার সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। এবার লোকটা ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার যথারীতি একগাদা উপদেশ ঝাড়েন। কিন্তু সেসবও কাজে দেয় না। ভোর ছটার সময় পিস্তলে গুলি ভরে সে তার কপাল বরাবর চালিয়ে দেয়। লোকটা মারা যায়। মৃত্যু তাকে কোলে টেনে নিলেও ঘুম তার অধরাই থেকে যায়। অনিদ্রা এক ভয়াবহ অবস্হার নাম।
মূল গল্প: INSOMNIA [1956] by Virgilio Piñera Translations by Daniel W. Koon
পাহাড়
পাহাড়টা প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচু। সিদ্ধান্ত নিয়েছি পাহাড়টাকে একটু একটু করে কামড়ে খেয়ে ফেলবো। পাহাড়টা আর দশটা পাহাড়ের মতোই; গাছপালা, পাথর, মাটি, পশুপ্রাণী, এমনকি মানুষও এর ঢাল বেয়ে ওঠা-নামা করে। প্রতিদিন সকালে আমি পাহাড়টার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং আমার চলার পথের সামনে যা পাই তা চিবানো শুরু করি। চর্বণের কাজে কয়েক ঘন্টা কেটে যায়। অবসন্ন শরীর আর ফুলে ওঠা চোয়াল নিয়ে আমি বাড়ি ফিরে আসি। অল্প বিশ্রাম নিয়ে এরপর আমি দরজার কাছে বসে দূরের নীল দিগন্তের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকি। আমার কর্মকাণ্ডের কথা যদি প্রতিবেশীকে বলি তবে নিশ্চিত, আমার নির্বুদ্ধিতা নিয়ে হেসে মরবে এবং আমাকে পাগল ঠাওরাবে। আমি আমার কাজের অগ্রগতি বিষয়ে সচেতন বলেই বুঝতে পারছি, দিন দিন পাহাড়টা কেমন উচ্চতা আর ওজন হারাচ্ছে। অবস্হা এমন দাঁড়িয়েছে যে, খুব শিগগিরই হয়ত পাহাড়ের এই ক্ষয়কে ভূতাত্ত্বিক সমস্যা চিহ্নিত করে প্রকৃতিকে দোষারূপ করা শুরু হবে। সেটা আমার জন্য মর্মান্তিক: কেউই একথা স্বীকার করবে না বা জানবে না যে আমিই ছিলাম তিন হাজার ফুট আজদাহা ওই পাহাড়টার ভক্ষক!
মূল গল্প: THE MOUNTAIN [1957] by Virgilio Piñera Translations by Daniel W. Koon
সাঁতার
আমি সাঁতার শিখেছি ডাঙ্গায়। মনে হয়েছে জলের চেয়ে শুকনো জায়গায় সাঁতার শেখাই শ্রেয়। যেহেতু আপনি ইতিমধ্যে তলদেশে আছেন, ডুবে যাবার কোনো ভয় নেই। একই যুক্তিতে আপনি তো আসলে ইতিমধ্যে ডুবেই গেছেন। কোনোভাবে উজ্জ্বল বাতি কিংবা দিনের আলোর ঝলকানির শিকার হবারও ভয় নেই আপনার। সবচেয়ে বড় কথা শরীরে জল ঢুকে ফুলে যাবার ভয় নেই।
আমি অস্বীকার করছি না যে শুকনো ডাঙ্গায় সাঁতার শেখার দৃশ্যটা মৃত্যু যন্ত্রণার ছটফটানির মতো লাগে। প্রথম দর্শনে কেউ ভাবতে পারে যে আপনি মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন। তবু এটা একেবারেই আলাদা একটা ব্যাপার। একই সাথে আপনি জীবিত আছেন, সতর্ক আছেন, জানালা দিয়ে ভেসে আসা সঙ্গীত সুধা উপভোগ করছেন এবং মাটিতে হামাগুড়ি দেয়া পোকাটিকেও দেখতে পাচ্ছেন।
প্রথম দিকে আমার বন্ধুরা আমার এই কাজটিতে সায় দেয়নি। তারা আমার দৃষ্টি এড়িয়ে থাকতো এবং আমাকে নিয়ে গোপনে দুঃখ পেতো। ভাগ্যক্রমে সেই সংকট কেটে গেছে। এখন তারা জানে আমি ডাঙ্গায় সাঁতার কাটতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। মাঝে মাঝে আমি মার্বেলটাইলসে হাত ডোবাই এবং গভীর তলদেশে আটকে থাকা ছোট ছোট মাছ ধরে বন্ধুদের হাতে তুলে দেই।
মূল গল্প: SWIMMING[1957] by Virgilio Piñera Translations by Daniel W. Koon
নাহার তৃণা। জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে ইলিনয়ে বসবাস। মূলত গল্প লেখায় ঝোঁক। পাশাপাশি অনুবাদ, প্রবন্ধ, সিনেমা, সাহিত্য সমালোচনা লিখে থাকেন। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখছেন। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ ‘পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একই বছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশি গপ্পো’। সম্পাদিত গ্রন্থ: ‘গল্পের পুষ্পিত কুঞ্জ’(২০২১, বইয়ের হাট প্রকাশনী), ‘গল্পপাঠ নির্বাচিত জাপানি গল্প সংকলন’(যৌথ সম্পাদনা, ২০২২, কবি প্রকাশনী)। প্রকাশিতব্য অনুবাদ গল্প সংকলন, ‘দূরদেশের গল্প(২০২২, চৈতন্য প্রকাশনী)’।