| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

মহামারী সংখ্যা: ভাইরাস রহস্য,চিনা রহস্য । দিলীপ মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

শুরু হয়েছিল চিনে। তারপরে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ, আমেরিকায়। প্রচণ্ড গতিতে। এশিয়া, আফ্রিকাও তার কব্জায় চলে আাসে  দ্রুত। তখন একটা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দানা বেঁধে উঠতে  থাকে। প্রথম থেকেই এতে ইন্ধন সঞ্চার করতে থাকেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড  ট্রাম্প। ভাইরাসটিকে তিনি ‘চিনা ভাইরাস‘, ‘উহান ভাইরাস‘ বলে অভিহিত করতে থাকেন। প্রতিবাদ করে চিন। ‘ল্যানসেট’ পত্রিকায় এক বিবৃতি দিয়ে চার্লস ক্যালিসার, ডেনিস ক্যারল, রোনাল্ড বি কোর্লে, লুই এনজুনেস, উইলিয়াম বি কারেস, ল্যারি ম্যাডফ, বার্নাড রোজিমান  প্রমুখ বিজ্ঞানীরা জানিয়ে দেন যে  ভাইরাসটি মনুষ্যসৃষ্ট নয়। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাও বলেন যে ভাইরাসটিকে গবেষণাগারে তৈরি করা  হয় নি।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আপৎকালীন ডিরেক্টর ড.মাইকেল রায়ানও বলেন যে ভাইরাসটি প্রাকৃতিক।

কিন্তু সেখানেই রহস্যময় ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে শেষ হয়নি বিতর্ক। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ফরাসি বিজ্ঞানী লুক মন্তাজিনিয়র  ভাইরাসটিকে মনুষ্যসৃষ্ট বলে রায় দেন; কারণ তিনি এতে এইচ আই ভি-র পাশাপাশি ম্যালেরিয়ার জীবাণু দেখতে পান। ব্রিটিশ সিক্রেট ইনটেলিজেন্সের সাবেক প্রধান স্যার রিচার্ড ডিয়ারল্যান্ডও ‘দ্য টেলিগ্রাফ’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে করোনাভাইরাস প্রাকৃতিক নয়;  অসতর্কতাবশত এক দুর্ঘটনার ফলে ভাইরাসটি ছড়িয়ে গেছে বাইরে।  বিজ্ঞানী স্টিভেন মশার, ডিমিট্রিয়স পরাশকেভিসও অনভিপ্রেত দুর্ঘটনার কথা বলেছেন। আবার লণ্ডনের সেন্ট জর্জ হাসপাতালের  অধ্যাপক আঙ্গাল ডালগ্লেইস এবং নরওয়ের বি সোরেনসন দাবি করেছেন সার্স-কোভ-২ ভাইরাসে কৃত্রিমভাবে স্পাইক প্রোটিন প্রবেশ করানো হয়েছে বলে ভাইরাসটি এমন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

করোনার চরিত্র যেমন রহস্যময়, তেমনি রহস্যময় তার উৎপত্তিকাল। প্রথম দিককার সংবাদে ধারণা হয়েছিল ২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে উহানে তার আবির্ভাব; প্রথম রোগী উহান আ্যনিমাল মার্কেটের সি-ফুড বিভাগের ৫৭ বছর বয়েসী উয়ে গুয়িক্সিয়ান। তারপরে হার্ভাড মেডিকেল স্কুলের  গবেষকরা উহানের হাসপাতালগুলির পার্কিং লটের উচ্চমানের উপগ্রহ চিত্রের উপর গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ২০১৯ সালের আগস্ট মাস থেকেই হাসপাতালগুলিতে কাশি ও ডায়ারিয়ার রোগীর ভিড় ছিল। গবেষকদলের প্রধান জন  রাউনস্টেইন বলেন ‘এখন এটা পরিষ্কার যে অনেক আগে থেকেই চিনে সামাজিক বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যায়।’এর কারণ সম্ভবত সংক্রমণ।

সংক্রমণ বিষয়ে চিনের প্রতিক্রিয়া ও কার্যক্রমও রহস্যজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চিনা অফিসকে ২০১৯ সালের  ৩১ ডিসেম্বর চিনা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে উহানে এক নতুন ধরনের নিউমোনিয়ার প্রার্দুভাব হয়েছে। যদি ধরে নেওয়া যায় যে নভেম্বরে উহানে সংক্রমণ শুরু হয়েছে, তাহলে দেড় মাস বাদে তার খবর কেন জানানো হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে? ২০২০ সালের ১ জানু্য়ারি চিনা সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন  ডাঃ লি ওয়েনলিয়াংসহ  ৮জন ডাক্তার। তাঁরা বলেছিলেন এই নতুন ভাইরাস ঘটাতে পারে মহামারি। কিন্তু সরকার তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেন। চিনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন সমস্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেন যে নতুন ভাইরাস সম্পর্কে কোন তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। চিনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও রহস্যময়। যেখানে অন্যান্য দেশে ভাইরাসটি দ্রুত নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেখানে চিনে তা সীমাবদ্ধ ছিল হুবেই প্রদেশ, বিশেষত উহান অঞ্চলে। বেইজিং, সাংহাই, নানচিং, ছেতুং, থিয়েনচিন প্রভৃতি অঞ্চলে করোনার পদসঞ্চার আটকে গেল কোন জাদুতে? চিন সরকারের মতে উহানের কঠোর লকডাউনের ফলে ভাইরাসটিকে লক্ষণরেখার মধ্যে আটকে রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু লকডাউনের অনতিকাল আগে সেখান থেকে যে ১ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা কি কেউ সংক্রমণ ছড়ান নি? ১৮ জানুয়ারি উহানের যে ভোজসভায় ৫০ হাজার মানুষ সমবেত হন, তাঁদের মধ্যে তো অন্য প্রদেশের মানুষ ছিলেন। তাঁরা কি কেউ সংক্রমণ ছড়াননি?

ইউরোপ- আমেরিকায় সংক্রমণের ব্যাপকতার জন্য অনেকে সে সব দেশের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও উদারনীতিকে দায়ী করেন। কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল না বলে সে সব দেশে সংক্রমণ এত ব্যাপক হয়েছে। এ কথার মধ্যে সত্য আছে। তবে ব্যক্তিস্বাধীনতা যেখানে থাকে সেখানে বিরোধী মতেরও প্রধান্য থাকে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের বিরুদ্ধতা করেন বিজ্ঞানী অ্যান্টনি ফাউসি অথবা সেখানকার গোয়েন্দা সংস্থা। চিনে ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই বলে সেখানকার প্রকৃত চিত্র আমরা পাই না। চিনে ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য ডাঃ লি ওয়েনলিয়াং, সাংবাদিক চেন কুইশি  ও ফ্যাং বিন, তরুণ বিজ্ঞানী বোটাও জিয়াও ও লি  জিয়াওকে সেন্সারড হতে হয়। প্রতিবাদীরা রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যান চিন থেকে। এই রহস্যময় চিনকে সমর্থন দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেটার মধ্যেও রহস্য আছে। চিন কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ভারতের চেয়ে কম অনুদান দিত। আমেরিকা অনুদান বন্ধ করার হুমকি দিতে চিন অনুদান বাড়িয়ে দেয়।  উহানে নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তরিক উদ্যোগের ঘাটতিও আমাদের নজরে আসে। মৃতের সংখ্যা নিয়ে চিন ভুল তথ্য দিয়েছিল; হু-র মহাপরিচালক ট্রেডাস আধানম গেব্রেইয়েসুস সেই ভুলকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেছেন। ৭৩তম ওয়ার্ল্ড হেল্থ অ্যাসেম্বলির প্রথম দিনের অধিবেশনে ১২০টি দেশ করোনা সম্বন্ধে চিনের কাছ থেকে সঠিক তথ্য প্রকাশ ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করেছিল। আজ পর্যন্ত সে দাবি পূর্ণ হয়নি, পূর্ণাঙ্গ তদন্তও হয়নি। একা কুম্ভ হয়েই চিন তার বুঁদিগড় রক্ষা করে গেছে। রহস্যনয় চিনের রহস্যময় চিনের রহস্যময় প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং অদৃশ্য মায়াজাল বিস্তার করে রেখেছেন পৃথিবীময়। মুখে তাঁর মৃদু হাসি। মোনালিসার রহস্যময় হাসির মতো।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত