| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ভাইরাস

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

অবস্থা যে এমন জটিল হয়ে উঠবে তা বুঝতে পারলে তারা সিকিম ট্যুরটা করতই না। নানা ঝামেলায় প্রায় তিন বছর প্রণবেন্দু কোথাও বেরোতে পারেনি। স্বাভাবিক ভাবেই পর্ণা আর ছেলেমেয়েরাও ঘরে আটকে থাকতে বাধ্য। অথচ তারা সবাই খুব ভ্রমণপিপাসু। সে না গেলে বাকিরা যাবার কথা ভাবেই না।প্রতিবার বেড়াতে যাবার আগে প্রণবেন্দুর সঙ্গে অন্যদের ঝামেলা একটা বাধবেই। সে একটু চুপচাপ ধরণের মানুষ। কোনো একটা জায়গায় নির্জন প্রকৃতির কোলে ইচ্ছেমতো বিচরণ করে, বসে থেকে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেওয়াই তার পছন্দ। সেই জায়গার শান্ত মহিমাকে সে উপলব্ধি করতে চায় শুধু। হৈচৈ, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা চষে বেড়ানো তার তুমুল অপছন্দের।

কোনো পাহাড়ি নদীর ধারে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত বসে থেকেই সে কাটিয়ে দিতে পারে। তখন যদি পর্ণা ছড়ানো গলায় কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে ওঠে, তার ভালোই লাগে। তা যদি না হয় তবে আরও ভালো। এক আকাশ রোদ কেমন ঘাসে, পাতায়, নদীর জলে, দূরের পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে সব কিছু সঞ্জীবিত রাখে, উদ্দাম হাওয়ায় কত শব্দ আর গন্ধ ভেসে আসে! গভীর এক মগ্নতার আনন্দ-বিভূতি মনের আনাচকানাচ ভরে দেয়। স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে নিজেকে বড় পূর্ণ লাগে তার। কখনও বা বেদনার মতো একটা আকুতি জাগে মন তোলপাড় করে, তার স্বরূপ সে বুঝতে পারে না শুধু অনুভব করতে পারে।

ঝরণার ধারে দাঁড়ালে জল ঝরে পড়ার শব্দ শুধু। ধীরে ধীরে একটা আবেশের ভেতর মনে হবে ঝরণার শব্দ ছাড়া আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। মনে হবে, ‘শব্দই ব্রহ্ম’ কথাটা ভুল নয়। শব্দ আছে বলেই পৃথিবী জ্যান্ত। একটা নিঃশব্দ পৃথিবীর কল্পনা করতে গিয়ে জলে ডোবা মানুষের মতো হাঁসফাঁস করে ওঠে। নৈঃশব্দ-কল্পনা কষ্টকর। সে পৃথিবী মৃত। কিন্তু সভ্যতার যে অবদানগুলো দৈনন্দিন জীবনে শব্দ-যন্ত্রণা নিয়ে আসে তার হাত থেকে কখনও কখনও মুক্তি পেতেই বেরিয়ে পড়ে সে। চারজনের নিরবচ্ছিন্ন সুখী জীবনে তারা খুব কাছাকাছি থাকে। তাই তাদের ভ্রমণে চারজনের টিম।তাদের এবারের ইচ্ছা, পূর্ব সিকিমের কোনো একটা গ্রামে গিয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসা। গত ডিসেম্বরে ভাইরাস সংক্রান্ত একটা অসুখের খবর শোনা গেলো। এটা নাকি ভয়ংকর সংক্রমণ ছড়ায়। চীনের উাহান প্রদেশে এই ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছিলো প্রথম। তারপর যতো দিন যাচ্ছে ততই পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে অতিমারীর আকারে। ইউরোপ নাকি এতে বেশি আক্রান্ত।

ভারতে এই ভাইরাস, কোভিড -১৯, ডাকনামে করোনা এখনও তেমনভাবে আক্রমণ শানায়নি। এদেশের লোক যেন এই মারীকে নিয়ে তত ভীত নয় এখনও পর্যন্ত।জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে লাগেজগুলো একপাশে রেখে প্রণব আড়মোড়া ভাঙলো এমন, তাতেই বোঝা গেলো এই তিন বছরে জমে থাকা শরীর মনের জঙধরা কলকব্জাগুলো ককিয়ে উঠে একেবারে ছিটকে বেরিয়ে গেলো। রকম-সকম দেখে ওর ছেলে রুকু হিহি করে হেসে ওঠে। একটা ঝকঝকে নতুন দিন। এমনিতেই জলপাইগুড়ি বা মালবাজারের মতো দু-একটা স্টেশনে ভ্রমণেচ্ছু বাঙালিবাবুরা নামলেই তাদের মন তাজা হয়ে যায়। ওদেরও একই রকম ভালো লাগায় মন ছেয়ে গেলো। নিজেদের একটু গুছিয়ে নিয়ে স্টেশনের বাইরে স্ট্যান্ডে চলে এলো।

বাস জার্নি রুকু-টুকুর পছন্দের নয় একটাই কারণে। ইচ্ছেমতো থামতে পারে না। কোনো ছবি তোলার ইচ্ছা, কিংবা পথের বাঁকে কোনো এক জায়গার বাড়তি বৈশিষ্ট্য একটু বেশি সময় দাবি করতে পারে। চারচাকা গাড়ি সে দাবি সহজেই মেটায়। চলাথামা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই কারণেই তারা ট্যাক্সি নিলো। প্রতিটা দৃশ্য পুরনো স্মৃতির সঙ্গে মেলাতে মেলাতে যায় ওরা। চেনার সঙ্গে বদলও টের পাওয়া যায়। আগের বার যেখানে একজোড়া আকাশ ছোঁওয়া শালগাছ রাস্তার ধারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কৌতুহলী চোখে দাঁড়িয়ে ছিলো এবার তাদের দেখা পাওয়া গেলো না। শুধু দুটো কাটা গুঁড়ি অনেক নালিশ জানালো। একটা নতুন ঝোড়া কোথা থেকে রাস্তার উপর এসে পড়েছে। রাস্তার তো ভাঙাগড়া চলছেই! রুকু-টুকুর কথার বিরাম নেই। ওরা স্বামী-স্ত্রী মাঝে মাঝে যোগ দিচ্ছে তাতে।

তিস্তাবাজারের পর খানিকটা রাস্তা যেতেই একটা বাঁকের মুখে জায়গাটা খুব ভালো লেগে গেলো প্রণবেন্দুর। ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বললো। রুকু-টুকুর মতো সাধারণত ও এমন হুটপাট কোথাও গাড়ি থামিয়ে দেয় না। চলার পথে কোনো জায়গাকে আলাদা করে দেখে তৃপ্ত হবার কারণ থাকে না তার কাছে। প্রকৃতিকে ও চলমান পথে পর্যায়ক্রমে দেখে যায় কেবল। খন্ড চিত্র নয়, সামগ্রিক একটা রূপ নিয়েই প্রকৃতি তার কাছে আসে। তাই ও গাড়ী থামানোয় বাকিরা একটু অবাক হয়। রুকু ওর দিদির দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসে। প্রণবেন্দু সামনের দিকে কয়েক পা হেঁটে যায়। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। রাস্তা থেকে নীচের দিকে; যেখানে কয়েকটা ছোটো ছোটো কাঠের বাড়ি চোখে পড়ছে, সামনে রঙ্গিত নদী! ওর নজর সেখানে। কিছু বাড়ি সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইটের বা কাঠ,ইট মিলিয়ে তৈরী।

শেষ পর্যন্ত ওরা এখানেই থেকে গেলো। ভ্রমণ পত্রিকাগুলোতে এই জায়গার কোনো উল্লেখ পাওয়া যাবে না। ভ্রমণ বিষয়ক গাইড বুকেও না। গোটা হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলই আসলে ট্যুরিস্ট স্পট। পাহাড়চূড়া, গাছপালা, খাদ-উপত্যকা, মেঘ-কুয়াশা-রোদ শুকনো ঝোড়াটুকু নিয়েও অনাবিল! প্রাচীন সৌন্দর্য মেলে সে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ বলে দিলে তবেই কোনো জায়গা সুন্দর হয় না। কে কাকে কীভাবে কোথায় টানবে কে-ই বা বলতে পারে? ওর সিদ্ধান্তে অন্যদের মুখ গোমড়া হয়ে গেলো। এখানে কেন? তাদের গন্তব্য সিকিম, ওরা সিকিমই যাবে। সে নিজের সিদ্ধান্ত সচরাচর অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয় না, আলোচনার রাস্তা খোলা রাখে। তবে অধিকাংশ সময় যুক্তিজাল বিস্তার করে ওদের নিজের পক্ষে টেনে নিতে তাকে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। ওদের খারাপ লাগা থাকলেও তা ক্ষণস্থায়ী হয়, মনের উপর তার ছাপ পড়ে না।

এবারও একই ঘটনা। অনামা এই জায়গাটাতে থাকা স্থির হলো। প্রণবেন্দু একটা হোম-স্টের ব্যবস্থা করলো। রঙ্গিতের ধারে গাছগাছালি ঘেরা একটা ছেটো সমতল জায়গায় একটা ছোট্ট পার্ক , বাচ্চাদের জন্য। একটা দোলনা, একটা স্লিপার, আর বড়দের বসার জন্য কয়েকটা ইট-পাথরের বেঞ্চ। বড় জোর বারো-চোদ্দোটা পরিবারের বাস।রঙ্গিত যেন এখানে খাপে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার। রবীন্দ্রনাথের দেখা ঝিলমের সঙ্গে প্রণবেন্দু মিল খুঁজে পায় রঙ্গিতের। নীচু পাড়ের গায়ে স্বচ্ছ জলের মৃদু স্রোত আলগা ছুঁয়ে চলে গেছে। কোথাও জলরেখা সংকীর্ণ, কোথাও বা ঘের বেশি। কোথাও জল গভীর। নদীতে পাথর খুব বেশি নেই। নির্মেঘ রোদের ভেতর কোথাও কোথাও চড়ার বালি উজ্জ্বল হয়ে থাকে, স্রোত চিকচিক করে। তলোয়ারের পেটের অংশটুকু গাছপালার আড়ালে। তারপর সে বেঁকে গিয়ে বাঁকের মুখে হারিয়ে গেছে। নদীর ওপার বড়ো রহস্যময়। মানুষের দৈনন্দিন পদপাত যেখানে পড়ে না, সেই জায়গায় অপার্থিব সুন্দর বাস করে। ওদিকে অচেনা ছোট-বড়ো গাছ, ছায়াচ্ছন্ন ঝোপঝাড়, কোনো পাখির উড়তে উড়তে ঢুকে পড়া সব মিলিয়ে তার কেমন যেন মন আনচান করে।

রুকু-টুকু প্রস্তাব দেয়, “বাবা চলো, ওপারটা দেখে আসি।” প্রণবেন্দু সায় দেয় না। নিটোল ওই রহস্যময় সৌন্দর্যকে ভেঙে দিয়ে বাড়তি কিছু পাওয়া যাবে না বলেই তার বিশ্বাস।এখানে জীবনের গতি বড়ই ধীর। লোকজন সহৃদয়। কেউই চেঁচিয়ে কথা বলে না। সড়কে উঠে শীত-শীত আমেজের ভেতর পাহাড় বা নদীর দিকের খাদের ধার ঘেঁষে লোকজন বাঁক পেরিয়ে দোকান-বাজারের জন্য চলে যায়। পর্ণা মিশুকে মানুষ। ছেলেমেয়ে দুটিও নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে ভালোবাসে। তেমন তেমন গপ্পে লোক হলে দু-তরফেই নানান কৌতুহল মেটায়। অল্পবয়সীরা কলকাতা সম্বন্ধে খোঁজখবর নেয়। যে বাড়িতে তারা রয়েছে, মিসেস গুরুং, নেপালী বিধবা মহিলাটি তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন। রাস্তার উপর, বাড়ির সামনের দিকে মুদিখানা-মনোহারী-সবজি সব কিছু মিলিয়ে একটা দোকান। তাঁর ছেলে আনমোল, আর মেয়ে প্রেমিলা। দুজনেই স্কুলের উপরের দিকের ছাত্র-ছাত্রী। মাকে তারা দোকান ও বাড়ির কাজে সাহায্য করে। প্রেমিলা এতটুকু বয়সেই বেশ ভালো রাঁধতে পারে। ওদের আর ওদের বন্ধুদের সঙ্গে মিশে গিয়ে রুকু-টুকু খুশি। আগের দিন ওদের সঙ্গে চিত্রে ওয়াটার ফলস আর পেসক টি-গার্ডেন ঘুরে এলো। কাঠ ও ইট সিমেন্টের মিশেল দেওয়া মোট তিনটে ঘর। বড়ো ঘরটায় ওদের জায়গা হলো। সেখানে দুটো ডবল বেডের খাট কোনোক্রমে ঢোকানো। দেওয়ালে একটা আয়না। তার সামনে একটা টেবিল। গোটা দুয়েক ফাইবারের চেয়ার। একটা ওয়ারড্রোব। অ্যাটাচড বাথরুম। চার-পাঁচটা দিন কাটাতে আর কী লাগে!

এখানে আসার দুদিন পরই মিসেস গুরুং খবরটি জানালেন। খাবার পরিবেশন করতে করতে বলছিলেন, ট্যুরিস্টদের নাকি ফেরত যেতে নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য সরকার। সিকিম থেকেও প্রচুর ট্যুরিস্ট ফিরছে। উল্টোদিক থেকে আসা বন্ধ। চেকপোস্টে ভীষণ কড়াকড়ি। বাইরে থেকে ফিরে আসা স্থানীয় লোকজনদের থার্মাল টেস্ট ও অন্যান্য জিজ্ঞাসাবাদের পর বাড়ি যাবার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। যদি কারও কোভিড-১৯ পজিটিভ হয় তাদের কোয়ারেনটিনে রেখে চিকিৎসা হবে।এসবই নাকি মিসেস গুরুংয়ের শোনা কথা। পর্ণা ও ছেলেমেয়েরা কলকাতা ফিরে যাবার কথা বলছিলো। বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে প্রণবেন্দুও ফিরতে চায়।

রাতে নিশ্ছিদ্র নীরবতার মাঝে ঝিঁঝিদের অবিমিশ্র বৃন্দগান। থেকে থেকে একটা রাতচরা পাখি অকুন্ঠ ডাকে চারপাশ সচকিত করে তুলছে। সবে পৌনে ন’টা। ছোটো জনপদটি নিঝুমপুরীর মতো শান্ত। কোথাও কথার শব্দ নেই , সড়কে গাড়ী চলাচলের শব্দও নেই। ইদানীং রাস্তার চেহারা ভালো হওয়ায় রাতেও সিকিমের গাড়ী যায়। রুটের বাস, চারচাকা সবই যায়। মিসেস গুরুংয়ের কথা বোধহয় ঠিক। ট্যুরিস্ট নট অ্যালাউড হয়ে গেছে। তাই বেশ বিরতিতে একটা-দুটে গাড়ি জলপাইগুড়ির দিকে নেমে গেলেও, পাহাড়ে ওঠার গাড়ি নেই বলেই মনে হচ্ছে।এখানে রাত নেমে আসার খুব তাড়া। ওরা আটটাতেই রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে। পাহাড়ে নিয়ম মেনে লোকজন সন্ধ্যে রাতেই খাওয়া সেরে নেয়। ওরা ডিনারের পর ধীরেসুস্থে ব্রাশ করা, পোষাক বদলানো এসব করছে। হাতে অঢেল সময়। রাত নটা থেকে ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছা তাদের নেই।

পর্ণা আর টুকু মুখের পরিচর্যারত, রুকু মায়ের মোবাইল নিয়ে খবরের চ্যানেল খুললো। এখন তো খবরের বিষয়বস্তু একটাই। জ্বালালো যা হোক এই করোনা ভাইরাস! এই কোভিড১৯ নাকি খুবই ছোঁয়াচে! রাতে খাওয়ার পর প্রণবেন্দু পর্ণাকে একটা হালকা চাদর চাইলো। একটু অবাক হয়েই পর্ণা জিগ্যেস করলো, “তোমার ঠান্ডা লাগছে?” “তেমন নয়! গা-টা একটু শিরশির করছে শুধু। যাই, রঙ্গিতের ধার থেকে হেঁটে আসি একবার।”

এখানে রাতে গা-শিরশির করাটা খুবই স্বাভাবিক। প্রণবেন্দু তাই শাল গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে গেল। নদীর গা ঘেঁষে একটা সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসলো। শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী বা ষষ্ঠী হবে হয়তো। একফালি চাঁদ অন্ধকারের দেহের উপর সাদা ওড়না মেলে দিয়েছে। আকাশের খুব বেশি অংশ দেখা যাচ্ছে না। নদীর দু-পাড়ের গাছপালায় ঢাকা পড়েছে নদীর প্রবাহপথের আকারেই আকাশের আঁকাবাঁকা লম্বা খানিকটা আয়তন চোখে ধরা পড়ছে। গাছপালাগুলো কালো কালো চেহারা নিয়ে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছে কৌতুহলী চোখে। নদী শুধু থেমে থাকে না। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে নিজের আনন্দে কলধ্বনি রেখে বয়ে যায় নিজের পথে। ওপারের রহস্য আরও ঘনীভূত। এই মার্চে নীচু পার্বত্য অঞ্চলে নদীর দুপাশে অনেক পলাশ গাছে ফুল ফুটে থাকতে দেখেছে সে। তবে সমতলে, বা পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরে ফোটা পলাশের মতো এখানে ফুলগুলো ততো বড়ো নয়। ওপারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক জায়গায় খানিকটা কালচে লাল রঙের ছোপ পাওয়া। জমাট বাঁধা কালো রক্তের মতো তার অস্তিত্ব। বাঁদিকে সামান্য পিছু ফিরে তাকালে ছুটন্ত গাড়ির আলো রাতের কালোকে ফালাফালা করে দিচ্ছে। কারও বাড়ি থেকে হঠাৎ টিভির শব্দ ভেসে এলো। অল্প পরে আবার তা থেমেও গেলো।

বসে থাকতে খুবই ভালো লাগছে প্রণবেন্দুর। হিসাবহীন সময় বয়ে চলেছে তার মতো। এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে ওঠে সে। হয়তো এভাবে আরও বহুক্ষণ বসেই কাটিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু বাড়ির লোকের প্রতি তার দায়বদ্ধতা সে ভুলে যায় না। তাছাড়া তার বেশ ঠান্ডা লাগছে এবার। তাই উঠতেই হলো। এসে ঘড়ির দিকে সে তাকায়। নাহ্! মোটে সাড়ে নটা বেজেছে। মা ও মেয়ে ওদিকের খাটে শুয়ে পড়েছে, তবে ঘুমায়নি। অন্য খাটটা বাপ-বেটার জন্য নির্দিষ্ট। রুকু এখনও মোবাইলে। ওর এবার ইলেভেন। মেয়ের সেকেন্ড সেমিস্টার সামনেই। ছেলেমেয়ের পড়াশুনার সঙ্গে অন্য গুনও আছে। রুকু ক্রিকেটে একজন প্রমিসিং খেলোয়াড়। আবার ক্যুইজেও চ্যাম্পিয়ান। ছেলের দিকে তাকালে তার মন উদাস হয়ে যায়। বুকের ভেতরটা আনচান করে। নিজের কৈশোররের দিনগুলো মনে পড়ে। অনেকেই বলে ছেলে নাকি একদম কৈশোরের প্রণবেন্দু। বিছানায় বসে ছেলের মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিলো। রুকু বললো, তোমার “হাতটা এতো গরম কেন গো?”

সে আমল দেয় না। এমনিই হয়তো হবে। সবার উদ্দেশ্যে বললো, “বুঝলে, পরশুদিনই ফিরছি তাহলে। কনফার্ম টিকিটটা নষ্ট করব না।” টুকু উঠে বসলো। বললো, “সেটাই ঠিক হবে, বাবা! যেহেতু প্রচুর ট্যুরিস্ট আগে আগেই ফিরে যাচ্ছে, তাই তৎকালেও টিকিটের ক্রাইসিস হবে। আমাদের যেদিন ফেরার টিকিট, সেদিনই ফিরি।”

পর্ণা সান্ত্বনা দিতে চায়, “তুমি না-হয় পরে আবার কখনও এসো, এখানে কাটিয়ে যেও কটাদিন!” সিদ্ধান্তটা নেওয়ায় সবাই বেশ ফুরফুরে হয়ে গেলো। এক হতচ্ছাড়া ভাইরাস অবাধ আনন্দে এবার যেন কুটিল থাবা বসিয়েছে। ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরে গেলেই শান্তি। পরের দিন কেমন বিস্বাদের ভেতর ঘুম ভাঙলো প্রণবেন্দুর। উঠতেও বেশ বেলা হলো। পর্ণা বা ছেলেমেয়ে কাউকেই আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। হাঁটতে গেছে নিশ্চয়। সকালের শীতল আমেজে যতদূর পারে হেঁটে যাওয়া। এতক্ষণে হয়তো ফিরে আসছে। বেশ খানিকটা হাঁটার শ্রমে অল্প অল্প ঘাম ফুটে উঠেছে তাদের কপালে ও নাকের উপর, সে স্পষ্ট দেখতে পায়। কিন্তু তার এমন শ্বাসকষ্ট লাগছে কেন? মাথাটা ভার হয়ে আছে। শরীরে ব্যথা। গলাটাও টাটিয়ে আছে, ঢোঁক গিলতে পারছে না। নিশ্চয় ঠান্ডা লেগে গেছে। ভালো করে আদা আর মেথি দিয়ে মিসেস গুরুংকে চা বানাতে বলতে হবে। মেথি দিয়ে এই চা-টা ওরা আগে কখনও খায়নি। মিসেস গুরুং সুন্দর বানান।
ব্যাপার দেখে ওদের কপালের ঘামের উপর ভাঁজ ফুটে উঠলো। মিসেস গুরুং তিস্তাবাজারে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সবাই চুপচাপ ব্রেকফাস্ট সারলো। প্রণবেন্দু এর মাঝেও একবার বেরোলেো। ও বেরিয়ে যেতেই পর্ণা ও ছেলেমেয়েরা মিসেস গুরুংএর সঙ্গে জরুরি আলোচনায় বসলেো।
পর্ণা বললো,” বুঝতেই পারছেন, যা শুনছি, যদি পুলিশ জানতে পারে যে আমরা সকলে একই ফ্যামিলির তাহলে আমাদেরও হয়তো আটকে দেবে। চোদ্দো দিন এখানে পড়ে থাকতে হলে আমাদের বাড়ি ফেরাও ভীষণ কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ ট্রেন চলাচল নাকি বন্ধ গয়ে যেতে পারে।” মিসেস গুরুংকে বেশি বলতে হলো না, তিনি বুঝেছেন। বললেন যে, তারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। জলপাইগুড়ি পর্যন্ত গাড়ির ব্যবস্তা তিনিই করে দিলেন। আশ্বস্ত করলেন, তাদের তিনজনের কথা পুলিশ জানবে না, মিস্টার বিশ্বাসের করোনা পজিটিভ হোক বা না হোক।

প্রণবেন্দু ফিরে এসে শুয়ে পড়লো। পর্ণা ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত ওর পাশে বসেই পড়লো। এ ক’দিন একসঙ্গে একঘরে কাটিয়ে এখন দূরত্ব রেখে লাভ কী? ওর কপালে গলায় হাত রেখে গায়ের উত্তাপ বোঝার চেষ্টা করে। প্রণবেন্দু কোনো কথা বললো না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ওরা তিনজন যে ততটা আন্তরিক নয়, কোনো একটা দ্বিধা বিভেদের সূক্ষ্ম ফাটল তৈরী করেছে তা বুঝতে তার অসুবিধা হলো না।পর্ণা অল্প গলা ঝেড়ে স্বাভাবিক স্বরে বলার চেষ্টা করলো, “বুঝলে, তোমার যদি পজিটিভ হয় আমাদেরও নাকি চোদ্দদিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। আমাকে তো স্কুল যেতেই হবে, ছুটি নেই। ওদেরও পড়াশুনার ক্ষতি হবে। তাই আমরা তিনজনে এখনই শিলিগুড়ি বা জলপাইগুড়ি চলে যাচ্ছি।”
প্রণবেন্দুর কোনো উত্তর না পেয়ে আবার ডাকলো, শুনছো…!
“হুঁ, বলো না, আবার কী বলবে!” প্রণবেন্দু চোখ ঢেকে কপালে হাত আড়াআড়ি করে রেখেছে। তাকালো না। সিদ্ধান্ত ওরা তো নিয়েই নিয়েছে, কী বা বলার আছে এখন?

পর্ণা বলে,” কাল ট্রেনে কলকাতা ফিরবো। তুমি তো এখনই ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছো, যদি ডাক্তার ছাড়পত্র দেন তুমিও জলপাইগুড়ি চলে আসবে। তারপর কাল একসাথে বাড়ি ফিরবো!”
ওরা তিনজন পরস্পরের দিকে তাকায়। অপেক্ষা করে প্রণবেন্দু কী বলে তা শোনার জন্য। তার শ্বাসকষ্ট ছাপিয়ে এই মুহূর্তে গলার কাছে একটা ব্যথা দলা পাকিয়ে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত পর চোখ খুলে হাসিমুখে তাকায়। “বাঃ! ঠিকই ভেবেছ! একদম ঠিক আছে। আমি ডাক্তারখানা যাবার আগেই তোমরা বেরিয়ে পড়ো। আমাদের একসঙ্গে তিস্তাবাজার না যাওয়াই ভালো। বলবো, আমি একাই এসেছিলাম।”

ওরা যখন ঘর থেকে ওদের লাগেজ নিয়ে বেরোচ্ছে ও বিছানায় বসে হাসিমুখে হাত নাড়লো। রুকু বললো, “বাবা! তুমি কিন্তু ফোন করবে!” “আমরা খুব চিন্তায় থাকবো, বাবা! আশা করছি তুমি আজ জলপাইগুড়ি চলে আসছো, আমরা একসাথে বাড়ি ফিরছি।” টুকু করুণ মুখে বললো। পর্ণার মুখ মেঘলা। হাত নেড়ে ওরা বারান্দা থেকে নেমে গেলো।

প্রণবেন্দুর বুকটা ফাঁকা হয়ে গেলো হঠাৎ। কী যেন হারিয়ে গেলো তার জীবন থেকে। গলায় আবার সেই কষ্ট। শুয়ে পড়লো দেওয়ালের দিকে মুখ করে। একটু পরে খেয়াল করতে পারলো ওর চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

জলপাইগুড়ি যাবার পথে আর ওখানে পৌঁছে পর্যায়ক্রমে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলো ওরা। একবার ফোন ধরে জানিয়েছিলো, ও ঠিক আছে। তারপর লাইন কেটে দেয়। তিনমাস ধরে ও হিমালয়ের কোলে অখ্যাত এই জায়গাটাতে রয়েছে। অফিসের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হয়েছে। জুন মাসেও এখানে গরম তেমন প্রকট নয়। রাতে গায়ে ঢাকা নিতে হয়। এখানকার রোদবৃষ্টি মেঘ ছায়ার সঙ্গে সে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। লোকজনের সঙ্গে সে মাখোমাখো হতে পারে না কোনোদিনই। তবু সহজ একটা হৃদ্যতা। বাচ্চাদের একটা স্কুলে ঘন্টা চারেক সময় কাটায়। ওদের সঙ্গ খুব উপভোগ করে। মিসেস গুরুংয়ের ঘরে তার আস্তানাটা আছে। বড় ঘরটা ও ছেড়ে দিতে চাইলেও গুরুং পরিবারের তরফে এটাই তার জন্য বরাদ্দ। এই বাড়িতে তাকে সোস্যাল ডিসট্যান্স বজায় রাখতে হয়নি। করোনার প্রভাবে যে পৃথিবী নীল, ঘন নীল হয়ে উঠেছে। এরপর হয়তো তার কালো রঙই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

রঙ্গিতের গা ঘেঁষে বেঞ্চটায় বসেছিলো বিকেলের দিকে। কয়েকজন বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রাইড দুটোয় গুটিকয় বাচ্চা আনন্দ নিচ্ছে। একখন্ড মেঘ এসে ছায়াচ্ছন্ন করে দিলো হঠাৎ। কোথা থেকে বৃষ্টির গন্ধ আসছে। একটু পর ফোঁটা ফোঁটা পড়তে শুরু করে। বাচ্চা ও বয়স্করা দ্রুত ঘরে ফিরে যায়। সে যেমন বসেছিলো, তেমনই। যেন তার তৃষ্ণার্ত শরীর শীতল করছে। চারপাশের পরিবেশ ঝাপসা হয়ে তার পাশে গা লাগিয়ে বসে। তার দিকে তাকিয়ে যেন কিছু জানতে চায়। জায়গাটাকে সে ভালোবেসেছে দ্বিতীয় নারীর মতো। একান্ত প্রিয় কোনো নারীকে না পেলে মানুষ যেমন অন্য নারীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ভালোবাসার স্বাদ নিতে চায়! কলকাতা তাকে উপেক্ষা করেছে। সে তাই এই ছোট্ট পরিমন্ডলে তার নির্জন বাস শান্তভাবে গ্রহণ করেছে। মনের উপর নিরাসক্তির পাতলা সর, ভেতরের খবর জানতেও চায় না। সকাল সন্ধ্যে বসে থেকে থেকেও তার ক্লান্তি নেই। এক একদিন রাস্তার বাঁক পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় অনেক দূর। কোনো আজনবীর মতো সে শুধু চোখের লেন্সে ধরে রাখে এর প্রাকৃতিক দৃশ্যের সবটুকু।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত