ভূতের গল্প: পটলা
ছেলে পটলাকে নিয়ে খটিক দাসের বড় মুশকিল যাচ্ছে। পটলার মোটে আট বছর বয়স, কিন্তু বাড় নাই, রোগা ডিগডিগে। লেখাপড়া বা খেলাধুলো করবে কী, বারো মাস তার আমাশই সারতে চায় না। ডাক্তার, কবিরাজ দেখিয়ে খটিক হদ্দ। এক সকালে নন্দমেসো এসে বললেন, “বুঝলি খটিক, হাটমদনপুরের রাজবাড়ির পুরনো ইঁদারার জল যদি সাতদিন খাওয়াতে পারিস, তা হলে দেখবি, পটলা ফের ঝাঁকি মেরে উঠবে। ওঃ কী জল রে বাপু, কী জল! পেটে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে গায়ে বল এসে পড়ে। তবে খরচা আছে, সেখানে গিয়ে কয়েকটা দিন থাকতে হবে।”
তা খটিকের টাকার অভাব নেই, চার-পাঁচটা গাঁ জুড়ে তার পাইকারি কারবার। চালকল আছে, তেলতল আছে। তাই দানোমোনো করে খটিক মনস্থির করে ফেলল।
হাটমদনপুর খুব কাছে পিঠে নয়। লোক পাঠিয়ে সেখানে একটা বাসা ভাড়া করে ফেলল সে। তারপর একদিন পটলা আর পটলার মা কুসুমকে নিয়ে হাজির । বাড়িখানা বেশ সাবেক আমলের। চারখানা ঘর, দারদারান, ঠাকুর ঘর, ভাঁড়ারঘর, সামনে বারান্দা, চাতাল, চারিদিকে আগাছায় ভরা বাগান এসব আছে। রাজবাড়িও কাছেই। ভারী দিয়ে সেখানকার জল আনানোরও ব্যবস্থা হল। পটলা বুঝতে পারছে, তার জন্যই এত সব আয়োজন হচ্ছে। তার শরীর ভাল নয়। শরীর খারাপ বলে তার খেলাধুলো বারণ, দৌড়ঝাঁপ বারণ। কাঁচকলা দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল আর দই ছাড়া কিছু খাওয়া বারণ। আর এই জন্যই পটলার মনও ভাল না। যে শুধু চুপচাপ জানালার ধারে বসে বাইরের গাছপালা, কগবগ দেখে। সময় কাটতে চায় না।
দুপুরবেলা একদিন পটলা বাড়ির মধ্যেই ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বিরাট বড় বাড়ি, বড়-বড় সব তালাবদ্ধ ঘর। তালায় মরচে পড়ে গিয়েছে। ঘুরতে-ঘুরতে সে দরদালানের শেষ প্রান্তে এসে ডান দিকে একটা অন্ধকার মতো গলিতে ঢুকে ধমকে দাঁড়াল। ডান দিকে একটা একটেরে ঘর। তার দরজাটা ভেজানো, ভিতর থেকে হামানদিস্তার শব্দ আসছে।
পটলা গিয়ে দরজার ফাঁকে চোখ রেখে দেখতে পেল, একজন বুড়ো মানুষ একটা টেবিলের উপর লোহার ছোট হামানদিস্তায় কী যেন গুঁড়ো করছে। এ বাড়িতে কেউ থাকে বেলে জানা ছিল না তার। সে একটু অবাক হল। বুড়ো লোকটা হঠাৎ দরজার দিকে চেয়ে একগাল হেসে বলে,“বাইরে দাঁড়িয়ে কেন রে পটল? ভিতরে আয়। তোর জন্যই ওষুধ করছি।”
পটল আরও অবাক, বুড়ো তার নামও জানে যে! ভিতরে ঢুকে সে দেখতে পেল চারদিকের তাকে নানারকম শিশির বোতল সাজানো। আর ঘরটার মধ্যে একটা বেশ কবিরাজি ওষুধের মিষ্টি গন্ধ ভাসছে। পটলা বুড়োর মুখোমুখি একটু টুলে জড়সড় হয়ে বসে ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে বলো তো?” সাদা দাড়িগোঁফের ফাঁক ফাঁক দিয়ে ফিক করে একটু হেসে লোকটা বলে, “আমি হলুম গে হেমেন সাধুখাঁ, আয়ুর্বেদাচার্য। কি বুঝলে?”
মাথা নেড়ে পটলা বলল, “না তো! তুমি কি এই ঘরেই থাকো?”
“তা আর কোথায় থাকব বলো?”
“কিন্তু এ বাড়িতে তো আর কেউ থাকে না।”
তা হলে আমি আছি কী করে? নাও তো বাবা, এবার এই খল থেকে ওষুধটা ঢক করে খেয়ে নাও।”
বুড়ো লোকটা হামানদিস্তা থেকে গুঁড়োটা খলে ঢেলে কী একটা পাতার রস মিশিয়ে তাকে দিল।
পটল ভয় পেয়ে বলে, “তেতো নয় তো?”
“আরে না। মধু মেশানো আছে।”
ওষুধটা খেতে বেশ লাগল পটলার।
“আমি কি ভাল হব?”
“খুব হবে।”
“খেলতে পারব?”
“তা না পারবে কেন?”
“পড়াশুনা?”
“তাও হবে। রোজ এ সময়টা এসে ওষুধ খেয়ে যেও। আর শোনো, আমার কথা মা-বাবাকে বলতে যেও না যেন!”
“ঠিক আছে।”
লোকটা বলল,“এবার যাও। কাল আবার এ সময় চলে এসো।”
পটলা টুকটুক করে নিজের ঘরে ফিরে এল। দুপুরে তার খুব খিদে হল। রোজ একমুঠো ভাত খায় সে, আজ ভাত নিয়ে খেল। রাতের বেলা সে রোজ যা খায়, তার ডবল খেয়ে ফেলল।
খটিক কুসুমকে বলল,“জলের তো গুণ আছে দেখছি”
কুসুম ধমক দিয়ে বলল, “ওসব বলতে নেই। নজর লাগবে।”
পরদিন দুপুরে পটলা ফের সেই ঘরে গিয়ে হাজির। বুড়ো মানুষটা তাকে দেখে খুব খুশি। ওষুধ খাইয়ে দিল যত্ন করে। তারপর বলল,“এ বাড়িটা একসময় আমারই ছিল, বুঝলে?”
“এখন নেই?”
“না, এখন আর বাড়িঘরের দরকারও হয় না। দিব্যি আছি।”
“কাল থেকে আমার খুব খিদে পাচ্ছে”
“পাবেই তো। পাওয়ারই কথা।”
বাবা বলছিলেন,“পুরনো ইঁদারার জলেই নাকি গুণ!”
লোকটা খিঁচিয়ে উঠে বলল, “তোমাকে বলেছে!দুর দুর, জলের কোন গুণ নেই। ওষুধের গুণ।”
“বাবাকে বলব?”
“খবরদার না।”
সাতদিনের মধ্যেই পটলার শরীর সেরে উঠল। সে দিব্যি গাঁয়ের ছেলেদের সঙ্গে ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াতে লাগল, এমনকী ফুটবল, হাডুডু খেলতেও মেতে গেল। দেখে খটিক আর কুসুম খুব খুশি।
খটিক কুসুমকে বলল,“ভাবছি, ইঁদারাটা ইজারা নিয়ে ওর জল শিশিতে করে বিক্রি করব। কেমন হবে বলো তো?”
“তা বাপু জলের গুণ আছে, স্বীকার করতেই হবে।”
ঠিক এই সময় আড়াল থেকে একটা গলাখাঁকারির শব্দ পাওয়া গলে, কিন্তু কাউকে দেখা গেল না।
খটিক অবাক হয়ে বলে,“কে কাশল যেন?”
পটলা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছবির বই দেখছিল, বলল,“ও তো হেমেনদাদুর কাশির শব্দ।”
“হেমেনদাদু! সে আবার কে?”
ওই যে বাড়ির পেছন দিককার ঘরটায় থাকে। হেমেনদাদুই তো আমাকে রোজ ওষুধ খাইয়ে ভাল করে দিয়েছে।
খটিক আর কুসুম অবাক হয়ে মুখ তাকাতাকি করে বলে,“বাড়ির পিছনে আবার কে থাকে? আমরা তিনজন ছাড়া এ বাড়িতে তো কেউ নাই!”
“বাঃরে, হেমেনদাদুর ঘরে তো আমি রোজ ওষুধ খেতে যাই!”
“চল তো দেখি কেমন তোর হেমেনদাদু?”
মা-বাবার সঙ্গে গিয়ে পটলাও একটু অবাক। সেখানে হেমেন সাধুখাঁর ঘরটা থাকার কথা সেখানে এখন নিরেট দেওয়াল।
সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,“এখানেই তো ঘরটা ছিল।”
“ছিল তো গেল কোথায়? ঘরতো আর মানুষ নয় যে উড়ে যাবে!”
“বাঃ রে, হেমেনদাদু যে আমাকে ওষুধ দেয়। সেই ওষুধ খেয়েই তো আমার অসুখ সেরেছে।”
খটিক আকাশ থেকে পড়ে বলে “হেমেনদাদু তোকে ওষুধ দেয় কি করে? নিশ্চয় স্বপন দেখেছিল। তোর অসুখ তো সেরেছে ইঁদারার জলে।”
পটলা কী আর করে। চুপ মেরে গেল।
পরদিন দুপুরে গিয়ে সে একা ঠিক ঘর খুঁজে পেল।
“হ্যাঁ দাদু, কাল তোমার ঘরটা খুঁজে পেলাম না কেন বলো তো?”
একগাল হেসে হেমেন সাধুখাঁ বলল,“প্রায় ধরিয়ে দিয়েছিলি আর কী!”
“তোমার ধরা পড়ার ভয় কেন দাদু?”
“সে অনেক কথা, তোর অত শুনে দরকার নেই। তবে তোর বাবাকে বলিস, ইঁদারার জলে আর আগের মতো কাজ হয় না। কেন জানিস? ওই ইঁদারার মধ্যে এক সময় আমিই থাকতাম কিনা। তখন আমার জড়িবুটির গুণে জলে রোগ সারত। কিন্তু এত লোক উৎপাত শুরু করল যে, তিষ্ঠোতে পারলুম না। এসে এই বাড়িতে জুটেছি। তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক, ওর মধ্যে আর লোক ডেকে এনে ভজঘট্ট পাকিয়ে তুলিসনি। তা হলে ফের আমাকে পালাতে হবে।”
একগাল হেসে পটলা বলে,“আচ্ছা তাই হবে। তুমি থাকো দাদু!”
বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর, বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ শিরোনামে ১৯৫৯ সালে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাত বছর পর ওই একই পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে ‘ঘুণ পোকা’ নামক তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়।শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৫ সালে বিদ্যাসাগর পুরস্কার, ১৯৭৩ ও ১৯৯০ সালে দু’বার আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৮ সালে ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০১২ সালে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হন।