| 28 নভেম্বর 2024
Categories
ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ

মধ্যযুগের ইতালির এক ভয়াবহ যুদ্ধ এবং একটা বালতির গল্প

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

রিজওয়ানুর রহমান প্রিন্স

কাহিনীর শুরু সেই ১১৫৪ খ্রিস্টাব্দে, যখন জার্মান সম্রাট ‘ফ্রেদেরিক বারবারোসা’ নিজেকে ঈশ্বরের দূত দাবী করে ইতালিতে হামলা করে বসলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, খ্রিস্টান সাম্রাজ্য তার অধীনে চলবে। ইতালির পোপের অধীনে নয়। তারা ঈশ্বরের আসল দূত নয়, তিনিই আসল। “ঈশ্বরের নির্দেশপ্রাপ্ত” হয়ে তিনি একে একে দখল করে নিলেন ইতালির মিলান, বোলোনিয়া, তুসকানি সহ বিভিন্ন শহর। পরে রোমে গিয়ে মিটিংয়ে বসলেন তৎকালীন পোপ দ্বাদশ জনের সাথে। কিন্তু পোপের সাথে কোনো বিষয়েই একমত হতে পারলেন না বারবারোসা। ফলে রোম থেকে ফিরেই আবার শুরু করলেন ইতালি দখল। এটা চললো ১১৭৬ সাল পর্যন্ত। ১১৭৬ সালের ২৯শে মে লেনিয়ানোর যুদ্ধে পরাজিত হলেন তিনি। তাকে ইতালি হতে কিকআউট করে ফেরত পাঠানো হলো জার্মানি। জার্মানি ফিরে যাবার আগে অবশ্য ইতালির সর্বনাশ যা করার করে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ইতালিকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গিয়েছিলেন বারবারোসা। এই ভাঙ্গাচোরা ইতালি প্রায় ৪০০ বছরেরও বেশি সময় নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত ছিলো। বিভিন্ন অঞ্চল মিলে একক ইতালি রাষ্ট্র হতে হতে বহু শতাব্দী পার হয়ে গিয়েছিলো তাদের।

ইতালিরই এমন দুই অঞ্চল ছিলো বোলোনিয়া এবং মোদেনা। এই দুই শহরের মাঝে দূরত্ব ৩১ মাইল। বোলোনিয়া ছিলো পোপের সাপোর্টে, কিন্তু মোদেনা ছিলো জার্মান সম্রাটের পক্ষে। এই দুই অঞ্চল প্রায়ই ঠোকাঠুকি লেগে যেতো একে অপরের সাথে। ১২৯৬ সালে বোলোনিয়া আক্রমণ করলো মোদেনাকে। তারা মোদেনার কিছু অঞ্চল দখল করে নিলো। পোপের আনুগত্য প্রকাশকারীরা এসে বসতি স্থাপন করলো মোদেনায়। আর ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’-এর শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসীরা চলে যেতে বাধ্য হলো ঐ অঞ্চল ছেড়ে। ১৩০৯ সালে রাজা ‘রিনালদো’ ক্ষমতায় আসলে তার অধীনে পালটা হামলা চালানো হয় বোলোনিয়াতে মোদেনার পক্ষ হতে। এমতাবস্থায় পোপ ত্রয়োবিংশ জন ঘোষণা করলেন, যেসব মোদেনাবাসী বোলোনিয়াতে এসে পোপের জমিজমায় হামলা চালায়, তারা সবাই ধর্মচ্যুত। বোলোনিয়ার থেকে একটা সুঁই চুরি করলেও সেটার জন্যে ঈশ্বর মোদেনাবাসীকে ক্ষমা করবেন না। ঈশ্বরের গজব পড়বে তাদের উপরে।

এই কথার কিছুদিন পরেই বোলোনিয়া শহরের মাঝখানে অবস্থিত একটা কুয়া থেকে পানি তোলার বালতি চুরি হয়ে গেলো! এই কুয়া হতে শহরবাসী এসে পানি তুলতো নিজেদের গেরস্থালী কাজের জন্যে। মোদেনার সৈন্যরা এসে চুরি করে সেটা নিয়ে গেলো। তারপরে মোদেনার মাঝখানে অবস্থিত কুয়ার সামনে সেটা গর্ব ভরে (সেই সাথে হাই ফাইভ করে নিজেরা নিজেরা খিক খিক হাসাহাসি করছে, এটাও কল্পনা করে নিন) প্রদর্শনীর জন্যে রেখে দিলো। বোলোনিয়া শহর মোদেনার কাছে তাদের বালতি ফেরত চাইলো অপমানে চোখমুখ লাল করে। মোদেনা সরাসরি অস্বীকৃতি জানালো বালতি ফেরত দিতে।

শুরু হয়ে গেলো যুদ্ধ, যা এখন ইতিহাসে ‘বালতির যুদ্ধ (War of Bucket)’ নামে পরিচিত!

১৫ নভেম্বর ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালির রিমিনি শহরের শাসক ‘মালাতেস্তিনো’ বোলোনীয় সৈন্যদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন মন্তেভেলিও নামক স্থানে, যেখানে ঐ বালতিটা প্রদর্শনীর জন্যে রাখা আছে। বোলোনীয়দের পক্ষে ছিলো ফ্লোরেন্স এবং রোমানিয়ার সৈন্যরাও। পরে পোপ ত্রয়োবিংশ জনের অধীনে এসে বোলোনিয়ার পক্ষে যোগ দিয়েছিলো আরো ৩০০০০ পদাতিক সৈন্য এবং ২০০০ নাইট। এদিকে মোদেনার পক্ষে ছিলো মানতুয়া, ফেরারা শহরের সৈন্য এবং জার্মান সৈন্যরা। কিন্তু তারা সংখ্যায় ছিল মোটে ৭০০০। কিন্তু যুদ্ধে জিতেছিলো মোদেনাই। বোলোনীয়দের বিপুল সংখ্যক সৈন্যকে পাশ কাটিয়ে উলটে তারা বোলোনিয়া শহরেই ঢুকে পড়ে সেখানকার দুর্গ ধসিয়ে দিয়ে এসেছিলো। সেইসাথে উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছিলো মোদেনাতে। ধারণা করা হয়, উভয়পক্ষে সব মিলিয়ে ২০০০-২৫০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিলো এই বালতির যুদ্ধে।

মোদেনা এবং বোলোনিয়ার মধ্যে এই ধাওয়া-পালটা ধাওয়া চলেছিলো ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। পরে স্পেনের শাসক প্রথম চার্লস ইতালি আক্রমণ করলে তাদের টনক নড়ে এবং নিজেরা নিজেরা আবার একসাথে মিলে যায়। তবে বোলোনিয়া শহর আর কখনো তাদের সেই বালতিটা ফিরে পায়নি। এটা এখনো আছে মোদেনা শহরে। সেখানকার ঐতিহাসিক জাদুঘরের এক ডিসপ্লেতে।

তথ্যসূত্র:

১। https://www.warhistoryonline.com/featured/bloodiest-medieval-war-fought-bucket.html
২। http://www.geekshistoryoftheworld.net/the-medieval-world/the-war-of-the-bucket/
৩। https://en.wikipedia.org/wiki/War_of_the_Bucket
..
.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত