জোড়াতালির শিল্প ও অন্যান্য কবিতা । আলো বসু
আগুন
পৃথিবীটা নাকি একদিন বরফ চাপা পড়ে মরবে-
আগুনের লম্ফঝম্প দেখে কেউ বলবে !
লঘুগুরু মানে না , জাতপাত জানে না
লজঝড়ে ঝুপড়ির গায়ে হামলে পড়ে, লকলকে জিভ
চাটে নাক উঁচু বহুতল
কারা যেন গুঁজে দেয় তার মুখে ইন্ধন
অমর দেবতার নামে মরে মানুষ মরণশীল
পেটে আগুন লাগলে জল ঢালে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে
মেরুদন্ড বেঁকে যায়
ফুল দেয় কুকুরের পায়ে, ভুতের কেত্তন করে
বাজারে আগুন লাগলে খবর হয় খুব।
পৃথিবীর ফুসফুস তুলে দেয় তার মুখে মূর্খ মানুষ;
মানুষের মুখে আগুন
চোখ দিয়ে, কথা দিয়ে ঝরতে ঝরতে শেষ পর্যন্ত মাথায় চড়ে যায়
মাথায় আগুন বা হনুমানের লেজে , মানে
সেই লঙ্কা কান্ড
সমস্ত কল ও কারখানার মধ্যে কে আগুন আর কে জ্বালানি, ধোঁয়াচ্ছন্ন সব
এই যেমন তোমাতে আমাতে একটু ঠোকাঠুকি হতেই আগুন জ্বলে ওঠে
তারপর আমরা দুজনেই ছাই মাখামাখি করি
একা জ্বলে যাই, যখন দাহ্যে ঠাসা আমার গুদামঘরে আগুন ধরে।
মন্দ হবে না,পৃথিবী তুষার সমাধিতে গেলে আমরা যে আগুনের অপচয় করেছি,
দেবতা আর আমাদের মধ্যে দেনা পাওনার সাক্ষী পুরোহিত অগ্নি;
তাকে যে ডাক নামে নামিয়ে এনেছি রন্ধনপ্রণালী পথে,
ছিটিয়ে দিয়েছি ঘরে ঘরে শান্তি জলের মতো ,
আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে একদিন নিজেরাই
হয়ে উঠেছি এক একটা আগুনের বল-
সেই ইতিহাস ঠান্ডা ঘরে চলে যাবে।

জলছবি
আকাশের মত নীল আর বাতাসের মত ফুরফুরে স্বপ্ন
দেখেছিলাম প্রথম জীবনে
শিখেছিলাম স্বপ্ন দেখতে হয়, নইলে পথ তৈরি হয় না
পথ নেই তো চলা নেই ভেবে
আমার ছানা কাটা ঘুম আর কেটে কেটে যাওয়া ঘুমের মধ্যে
স্বপ্ন এক ঝুড়ি
একটার ঘাড়ে আরেকটা
কৌটো ভরা কিসমিস শুকিয়ে ছাতা পড়ে যায়
আক্ষেপ আসার আগেই দ্বিতীয় খেপ এসে পড়ে জীবন আর
স্বপ্নের মত স্বপ্ন ঢুকে পড়ে জলের মত হুড়হুড় করে
পায়ের তলার মাটি, ঘটি বাটি সুদ্ধ আমাকে টেনে নিয়ে যায় দিগ্বিদিক
খড়কুটো ধরে কোন রকমে পারে উঠে দেখি অনেকটা বড় হয়ে গেছি এবং
অন্য জলের ধারে আবার জমি , বীজতলা, চাষবাস…
এইভাবে তৃতীয় চতুর্থ, পঞ্চম জীবনে এসে দেখি
এত বড় হয়ে গেছি, স্বপ্নে আর কুলোচ্ছি না
ফ্রেম ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া ছবি হাওয়ার হাত ধরে এ পথে সে পথে
ধুলোবালি বৃষ্টিতে সব রং ধুয়ে গেলে ভালোবাসি জল রং

জোড়াতালির শিল্প
আমার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে গল্পের শেষ নেই
পূর্ণানন্দ নিজেই নিজের স্বাদ নেবেন, নিজেকে খুঁটে খুঁটে
ছড়িয়ে দিয়ে তাই এই জীব জগৎ
বড় টুকরোগুলোতে মানুষ
সে বোঝে পূর্ণ আর সে এক আসনে বসার যোগ্য নয়
ওঁর জন্য উঁচু থাক, নাগাল থেকে দূরে
কিন্তু রক্তের টান যাবে কোথায়!
সেদিকেই মানুষ ছুটতে থাকে আর মুখ থুবড়ে খানখান
টুকরো থেকে শত টুকরো হওয়া মানুষের এই গল্প এখানেই শেষ নয়
এখানেই শেষ নয় সময়ের অজস্র দাগে দগদগে যাত্রাপথ
যদিও জখম ও যন্ত্রনার ফাটল ,যদিও চুর চুর পতন
প্রেম ভালোবাসা, ক্ষমা —সোনার সম্পদ ছাই হয়ে গেলে
শ্মশানের শূন্যতায় মাথা তোলে মানুষ
সোনার ছাই মায়ার আঠায় জড়িয়ে জোড়া দেয় ভাঙা টুকরো
ভরাট কাজে বাঁধিয়ে রাখে প্রতি ফাটল
দাগ বরাবর সোনালি আলপনায় পরব নামে জোড়াতালির জীবন দেউলে
মানুষ জানে জগত সংসার অপূর্ণতার উদযাপন ছাড়া আর কিছুই নয়

উৎসব
গতির হাত ছাড়িয়ে হঠাৎ ছিটকে বেরিয়ে পড়ে কিছু সময়
গ্যাস বেলুন উড়তে থাকে দিগ্বিদিক
অন্ধগলি রাত বিরেতে ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে ‘গান ধরে
দিনের আলোর ছবি থেকে বিভূতি ঝরে পড়ে
অলৌকিক এই ট্রান্সলুসেন্ট পাউডার মেখে
আমাদের বাবা মা ঈশ্বর, আমরা ঈশ্বরের সন্তান
আমাদের নিষ্পাপ মুখে মন্ত্রের পবিত্রতা, অগুরুর গন্ধ
কী আনন্দ আর কত উজ্জ্বলতা!
আবেগের ধাক্কায় খুলে যায় বুজে যাওয়া ফোয়ারার দুটো চারটে ফুটো
ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে রঙিন জল
বুকে পাথর চাপা দিয়ে ঝরনার গান গায় মানুষ
উৎসব বাজনা বাজায়

ফুঁ
অন্ধকার ছানা হাত, হেঁসেলে বিজাতীয় গন্ধ, জড়িও না
দম বন্ধ হয়ে আসে
যতই ধরে বেঁধে বসাও,দুঃসময় বোঝাও ,বোঝাও রথের চাকা
বসে গেছে মাটিতে
যার সময়ই নেই, তার আবার দুঃসময় কী ! সময়কে আমি
ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিয়ে এসেছি
মাছির মতো ভনভনিয়ে যাও ,দগদগে একটা ঘা
চাটতে চাটতে কতদূরে যাবে যাও
এদিকে আমার পিছে পড়ে থাকা সময় শুরু এখন থেকে
আমাকে খুঁজতে হবে কেন পুঁজ রক্ত, কোথায় বাধা পেলো আলো
আধ খাওয়া ফলের মতো আধা-খেঁচড়া ক্রিয়াকলাপ
গড়াগড়ি খাচ্ছে কোথায়
পাট না ভাঙা মন্ত্র ও শ্লোক খুলতে খুলতে এগিয়ে যেতে হবে শুরুর দিকে
কোন ফুলে কী রং প্রজাপতি, কোন পাতায়
কী বাহার তাচ্ছিল্য করেছি
কোথায় আদর পড়েনি,কোন পাপে হারিয়ে গেছে হাত থেকে হাত—-
খুঁজতে খুঁজতে যতদিন না পৌঁছে যাই একটা ফ্রেস স্টার্ট পয়েন্টে
ওসব সময় দুঃসময় সবই আমি নিবিয়ে দেবো ফুঁ দিয়ে

জন্ম ১০ ফেব্রুয়ারি পুরুলিয়ায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, জ্যাঠামশাই চারণ কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যয়ের সাহচর্যে কবিতার প্রতি অনুরাগ। উদ্বোধন, কৃত্তিবাস, কবিতা আশ্রম সহ নানা পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ‘শূন্যের স্বরলিপি’ কবির প্রথম কবিতার বই।
হীরক সেনগুপ্ত says:
আহ ! আলো বসুর সব কটি কবিতা এক স্ত্রোতে পড়লাম।চমৎকার বললে ,খুব কম বলা হবে।জরুরি।অত্যন্ত জরুরি।আপৎকালীন ইন্ধন।