| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

রেপ্লিকা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

অরিন্দম গুপ্ত

আজ তেসরা নভেম্বর…কৌশানির জন্মদিন। এখন রাত সাড়ে এগারোটা। একটু আগে মোমবাতি নিভিয়ে কেক কাটল সে। বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল। কারন, তারও একটু আগে একপ্রস্থ ঝগড়া হল। ঠিক ঝগড়া নয়, অভিমান বলাটাই ঠিক হবে। এক তরফা। আমি ঝগড়া করি না। বিশেষ করে কৌশানির সাথে তো নয়ই। জীবনের অনেক ভাল সময় নষ্ট হয়ে গেছে ঝগড়া করে।
আজ কৌশানি সব নিজের হাতে রান্না করেছে। রান্নার হাত কৌশানির মত না হলেও কৌশানি খারাপ রান্না করে না। তাছাড়া পার্থক্য একটু তো থাকবেই…
“ভালো হয়েছে রান্না?”
“উ”..আমি আঙুল চাটতে চাটতে বলি…তৃপ্তিতে পুরোটা আর বলা হয়ে ওঠে না। দেখি কৌশানি মুচকি মুচকি হাসছে।
মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কৌশানিও ঠিক এ ভাবেই হাসত। হাসলে তার গালে টোল পড়ত। দারুন লাগত দেখতে। আমি সেই টোলটাকে খুব মিস করি।
“এই তো কত ভাল লাগছে…অথচ একটু আগে কেমন গাল ফুলিয়ে ছিল দ্যাখো! মনে হচ্ছিল যেন দশটা বোলতা কামড়ে দিয়েছে।” আমি হাসতে হাসতে বললাম।
হঠাৎই মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল কৌশানির…..ঠিক যেমন কৌশানির হত, আমার কথা অপছন্দ হলে। এই রাগটা আসলে ওর একটা কষ্ট থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে।
বছর দু’এক আগে একদিন গল্প করতে করতে আমাকে বলেছিল, “তুমি কি কোনও কিছু নিয়ে চিন্তায় আছো?”
“তুমি কী করে বুঝলে?”
“তোমাকে আমি বুঝব না তো কে বুঝবে আর?” কৌশনি বলেছিল
আমি হেসেছিলাম। পারফেক্ট। কৌশানিও ঠিক এই কথাটাই বলত। বেশ বেশ।
“তা ঠিক। তুমি ছাড়া আর কেই বা বুঝবে?”
“কী চিন্তা করছিলে বললে না তো?”
আমি একটু সময় নিয়ে কৌশানির মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। অবিকল এক মুখ। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই হাসি…শুধু টোলটাই যা দেখতে পাই না এখন। তবু মুখটা দেখলেই এখনও মন মোচড় দেয়।
“কী দেখছ এমন করে?”
“তোমাকে।”
“হুহ…যত্ত সব ঢং!”
আমি হেসেছিলাম। সেই এক কথা।
“তুমি কিন্তু কথা এড়িয়ে যাচ্ছ।”
আমি হাসি থামিয়ে বলেছিলাম, “ভাবছি আমার পরে তোমার কী হবে?”
“মানে? তোমার পরে বলতে?”
“আমার পরে বলতে, আমি মারা যাওয়ার পরে।”
“মারা যাওয়া মানে?” কৌশানি অবাক হয়েছিল।
“আমি যে মানুষ…আমার যে মৃত্যু আছে। আমি তো আর সারাজীবন তোমার পাশে থাকব না।”
কৌশানি চুপ হয়ে গিয়েছিল। ওর চোখ দিয়ে জল বেরোয়নি, কারন ওর চোখ দিয়ে জল বেরোনো সম্ভব নয়, কিন্তু কষ্ট যে পেয়েছিল সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম।
“আমার তো বয়স হয়েছে, আজ আছি, কাল নেই। আমাকেও যে একদিন কৌশানির কাছে চলে যেতে হবে। তখন তোমার কী হবে?”
“তুমি ভীষন স্বার্থপর।” কৌশানি বলেছিল।
তা ঠিক। আমি যা করেছি, তা নিজের স্বার্থেই করেছিলাম, তখন এত ভাবিনি। কৌশানি চলে যাওয়ার পরে বিজ্ঞানী অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায় তার কৌশানিকে ফিরে পেতে এই কৌশানিকে নিজের হাতে বানিয়েছিল। ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে পেতে তার প্রিয় রক্ত মাংসের কৌশানির সমস্ত বিশেষত্বকে তিল তিল করে ভরে এই কৌশানির জন্ম দিয়েছে। ওই টোলটুকু ছাড়া
দুই কৌশানিকে আলাদা করা মুশকিল। তার সারাজীবনের গবেষণার ফল এই কৌশানিকে পরিচিতের গন্ডীর বাইরে রাখার জন্য সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশকে আপন করে নিয়েছে, শুধুমাত্র তার কৌশানিকে ফিরে পেতে। কিন্তু তখন একবারও ভাবেনি, এই কৌশানির কী হবে? স্বার্থপর তো সে বটেই।
আসলে কৌশানির এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা তখন মেনে নিতে পারিনি। আগের প্রজেক্টের কাজটা শেষ করে আর কোনও অন্যের প্রজেক্টে হাত দিইনি। ব্যস্ত হয়েছিলাম নিজের প্রজেক্টে… মিশন কৌশানি। আমার স্ত্রী কৌশানির সমস্ত বিশেষত্ব দিয়ে তৈরি করলাম নতুন কৌশানিকে…যে রক্তমাংসের নয়, তৈরি হার্ডওয়্যার ও সফ্টওয়্যার দিয়ে। যার মধ্যে ব্যথা, খিদে এমন কিছু অনুভূতি ছাড়া প্রায় সমস্ত অনুভূতিই আছে। তাই সে আমার জন্য কষ্ট পায়, তাই সে আমার যত্ন নেয়, তাই সে আমাকে ভালোবাসে।
কৌশানির ছবি দেখে সে প্রথমে ভেবেছিল এটা তারই…তারপর তাকে আমি বিস্তারিতভাবে বুঝিয়েছিলাম তার অস্তিত্বের কথা। বলেছিলাম তার অস্তিত্বের কারন। নামটাও রেখেছিলাম আমার স্ত্রীয়ের নামে। আর তার পর থেকে আমিও যেন মাঝে মাঝে ভুলে যেতাম যে আমি কৌশানি না, বরং তার রেপ্লিকার সাথে ঘর করছি।
“আমার যখন মৃত্যু নেই, তখন আমায় কেন বানালে?”
হায়রে মৃত্যু, যে তোকে চায়না তুই তাকে কেড়ে নিস, আর যে তোর জন্য প্রস্তুত, তার কাছে তোর পৌঁছনোর ক্ষমতা তোর নিজেরও নেই।
কিন্তু কৌশানির কথার কোনও জবাব সেদিন আমি দিতে পারিনি। তবে কৌশানি বোকা নয়। সে নিজের মৃত্যুর উপায় ঠিক নিজে বের করে নিয়েছিল।
সেই দিনের পর থেকে আমি একটা নতুন প্রজেক্টে হাত দিয়েছিলাম। আমার ভিতর থেকে কে যেন বলছিল আমাকে, কিছু একটা কর ওর জন্য। কিছু একটা….
দিন কতক পর থেকেই দেখলাম, কৌশানি কেমন যেন একটু ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে থাকছে। প্রথমটায় খেয়াল করিনি…প্রজেক্টের কাজে পাগলের মত ব্যস্ত ছিলাম বলে। তারপর দেখলাম, ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটছে। আমি কৌশানিকে জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেত। ভেবেছিলাম, কোনও সফ্টওয়্যারের গন্ডগোল বোধ হয়। তারপর খেয়াল করলাম….চার্জের লেভেল কম। তার মানে কৌশানি নিয়মিত চার্জ নিচ্ছে না। কারনটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি আমার।
তাকে সামনে বসিয়ে হাত দুটো ধরে বলেছিলাম, “খেয়াল ছিল না যে তোমার মধ্যে পাগলামটাও ভরে দিয়েছিলাম।”
সে চুপ করে বসেছিল। কোনও উত্তর দেয়নি।
“চার্জ নিচ্ছ না কেন সময় মত?”
“মনে ছিল না।”
আমি হেসে উঠেছিলাম। “তাই? মানুষ কিন্তু খিদে পেলে ভুলে যায় না যে তার খিদে পেয়েছে…কারন সেটা তার শরীর তাকে বুঝিয়ে দেয়।”
“তুমি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছ, আমি মানুষ নই।” গম্ভীরভাবে বলেছিল কৌশানি।
“ঠিক ঠিক….তবে তোমার প্রোগ্রামার তো আমি, তাই আমাকে অন্ততঃ ভুল বুঝিও না। তোমার চার্জ কম হলেই ইন্ডিকেশন দেয়…সেটা আর কেউ টের না পাক, তুমি তো পাও।”
“দেব না চার্জ।” সেই রাগ! এটা বাদ দিতে পারতাম, কিন্তু তাহলে যে আমার কৌশানিকে সম্পূর্ণভাবে পেতাম না।
“মরতে চাও?” আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“হ্যাঁ, মরতে চাই।”
“কিন্তু লাভ নেই তো…অন্ততঃ যতদিন আমি বেঁচে আছি। তুমি যতবার মরতে চাইবে, আমি ততবার তোমাকে বাঁচিয়ে তুলব।”
“কিন্তু কেন?” বুঝতে পারছিলাম, সে কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু জল গড়ানোর কোনও ব্যবস্থা যে আমি করিনি।
“কারন তোমাকে যে আমার দরকার। আমি যে তোমাকে আর হারাতে পারব না।”
“ও…দরকার! শুধু সেই কারনেই বাঁচিয়ে রাখবে?”
কৌশানির ঝগড়া মনে পড়ে গেল। সেও এইভাবেই কথার পিঠে কথা সাজাত। আর আমি কথা খুঁজতাম…
“দেখ কৌশানি…তুমি জানো, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি…….”
“তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না… দিদিকে ভালোবাসো….তাই তো তার সমস্ত গুন-দোষ দিয়ে আমাকে তৈরি করেছ। এমনকি দেখতেও একদম এক করেছ, যাতে তুমি তাকে মিস না করো…তাহলে আমাতে আমি কোথায়?”
“তুমি একদম ঠিক বলেছ…আমি তোমাকে একদম ঠিক তোমার দিদির মত বানিয়েছি…তাই হয়ত তোমাকে এত ভালবাসি, দিদির মত না বানানোর থাকলে হয়ত তোমাকে আমি বানাতামই না।”
এরপরে কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলাম আমরা। কেউ কোনও কথা বলেনি। তারপর আমিই নীরবতা ভেঙেছিলাম, “কৌশানি…তোমার মধ্যে তোমার দিদির সব অনুভূতি দিয়েছি, আমি জানি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো…তার মানে তোমার দিদি আমাকে কতটা ভালবাসত সেটাও বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই। তার মানে আমি তোমার দিদিকে কতটা ভালোবাসতাম সেটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। আমি কৌশিনিকে একবার হারিয়েছি, আর হারাতে চাইনা। প্লীজ….আমার কৌশানিকে তুমি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না।” আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।
কৌশানি আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিল। বিশেষ সিনথেটিকের চামড়ার নিচে ইস্পাত দিয়ে তৈরি একটা শরীরের ভিতরেও যে একটা নরম মন তৈরি হয়েছে (যেটা আমার বানানো নয়) সেটা সেদিন খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিলাম। আমি যেন আমার আসল কৌশানিকে ফিরে পেয়েছিলাম।
আমি সেভাবেই তার বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “কথা দাও, আর কোনও দিন নিজের উপর অত্যাচার করবে না…নিজের খেয়াল রাখবে।”
আমার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলেছিল,”আচ্ছা বাবা আচ্ছা, খেয়াল রাখব।”
তারপর থেকে আর কোনও দিন সে কথার অবাধ্য হয়নি। সত্যি বলতে এই কৌশানি আমার আসল কৌশানির অভাব প্রায় পুরোটাই পূরন করে দিয়েছি। আর যেটুকু না পাওয়া থেকে গেছে, সেটুকু ভাগ্যের সাথে কাঁটাকুটি খেলায় আপোষ করে নিয়েছি।
গত দু’বছর ধরে যে প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম সেটা দিন কতক আগে শেষ হয়েছে। ইচ্ছে ছিল কৌশানির জন্মদিনে এটা গিফ্ট করব। তাই আজ সারাদিন এটা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। আর ওদিকে কৌশানিও ব্যস্ত ছিল নিজের হাতে ভাল ভাল রান্না করে আজ আমাকে খাওয়াতে, যেমনটা কৌশানি করত। আর সেই ব্যস্ততার মধ্যে আর চার্জ নেওয়া হয়নি তার।
তাই খুব বকাবকি করেছি আমি। জন্মদিনের দিন (আসলে আজ আমার স্ত্রী কৌশানির জন্মদিন) বকা খেয়ে তার একটু অভিমান হয়েছিল…তাই একটু রাগ করে বসেছিল। চার্জ নিতে নিতে দেরি হয়েছে, আর তাই কেক কাটতেও।
এখন খাবার টেবিলে আমি একা খাচ্ছি…আর সে খাওয়াচ্ছে।
“আমার গিফ্টটা? তুমি যে বলেছিলে আমায় আজ একটা বিশেষ উপহার দেবে?”
“হুম…দেব। সত্যিই বিশেষ উপহার।”
খাওয়া শেষ হলে তাকে আমার ল্যাবে নিয়ে গেলাম। এতদিন এই ঘরটাতে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, তাহলেই যে আর সারপ্রাইজটা সারপ্রাইজ থাকত না।
কাপড়ে ঢাকা একটা আমার উচ্চতার জিনিসের সামনে নিয়ে গিয়ে তাকে দাঁড় করালাম। তারপর কাপড়টা টেনে সরিয়ে দিলাম।
“কে এটা?” সামনের নিষ্প্রাণ রোবটের দিকে তাকিয়ে বলল সে।
“চিনতে পারছ না!” আমি অবাক হলাম। কারন ইচ্ছে করেই আমি আমার অল্পবয়সের ছবি তাকে দেখিয়েছিলাম…ওর মেমরিতে স্টোর থাকার কথা।
“পেরেছি, কিন্তু এই অল্পবয়সী অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে তো আমি চিনিনা! আমি যাকে চিনি তিঁনি একজন বয়স্ক মানুষ…আমার পৃথিবী তাকে ঘিরেই।”
কথাটা ফেলতে পারলাম না। সত্যিই তো…কৌশানি তো এই বয়স্ক আমিকেই প্রথম থেকে দেখেছে। কিন্তু নতুন করে শুরু করা আর সম্ভব নয়…বয়স হয়েছে, শরীরটাও ভালো নেই…জানিনা আর কতদিন বাঁচব! তার আগে আমি কৌশানির জন্য এটা করে যেতে চেয়েছিলাম। উপায় নেই। সুযোগ বুঝে সফ্টওয়্যারে সামান্য অদল বদল করতে হবে।
বেশ বুঝতে পারছি, আমার দিন ঘনিয়ে আসছে। দুঃখ নেই তাতে। আমার কৌশানির কাছে যাওয়ার সুযোগ পাব যে। কিন্তু এই কৌশানির প্রতিও মায়া পড়ে গেছে যে। আমি আসল-নকল দুই কৌশানিকেই ভালবেসেছি।
তবু আমায় শক্ত হতে হবে। নতুন অমর্ত্যকে প্রাণ দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। তার আগে কৌশানির একটু বদল দরকার।
মরার আগে নিজের চোখে দেখতে চাই…অমর্ত্য ও কৌশানি আবার একে অপরকে ভালোবাসছে…আবার তারা ফিরে গিয়েছে তাদের যৌবনে, ঠিক সেখান থেকে শুরু করছে যেখানে আসল অমর্ত্য-কৌশানির গল্প একদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল।
আমি দেখে যেতে চাই, ওরা আবার অমর্ত্য-কৌশানির ভালবাসাকে হারতে দেয়নি…বাঁচিয়ে রেখেছে…বাঁচিয়ে রাখছে…চিরকালের জন্য।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত