| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

নিষিদ্ধ বই

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
।।সালেহা চৌধুরী।।
নির্বাসিত গ্রন্থ বা ব্যান্ড বুকসের কথা আমরা প্রায়শই শুনে থাকি। কোন বই কোন দেশের জন্য নির্বাসিত, কত বছরের জন্য নির্বাসিত, কখন নির্বাসন শেষ হয়ে যায়, কখন শুরু হয়, এমনি নানা খবরাখবর।
ভাবতে গেলে মনে হয়, কেন একটা বইকে নিষিদ্ধ করা হলো? একসময় ড. হুমায়ুন আজাদের বই ‘নারী’ও নিষিদ্ধ হয়েছিল। কারণ বুঝতে পারিনি। কোন ঘটনায় বইটাকে নিষিদ্ধ করা হলো? তিনি কিছু কঠিন সত্যকে বইয়ে ব্যবহার করেছেন, সেটাই কি কারণ? তসলিমার বই ‘লজ্জা’। এখানে নির্বাসিত হয়। সে বই ভারতে ঝাকায়, দোকানে, রাস্তাঘাটে বিক্রি হয়েছে, লাখ লাখ কপি।
এবারে আমি বলব এমন কিছু বইয়ের কথা, যেগুলো আমেরিকায় একসময় নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। কিন্তু সেই নির্বাসিত বইগুলোর কারণে নতুন করে আমেরিকাকে ভাবতে হয়েছিল, আমেরিকার চেহারা বদলে দিয়েছিল এসব নিষিদ্ধ বই। একটা লেখা পড়ছিলাম যেখানে লেখা ছিল দশটি বইয়ের নাম এবং রচনার নাম -‘Some Band Books that Shaped America
এই বইগুলোর নাম_ দি অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন। লেখক মার্ক টোয়াইন। ১৮৮৪ সালে বইটি প্রকাশ করেন। ওখানে নাকি বারবার ‘নিগার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ব্যান্ড বা বর্জন। তবে সেটা এখন আর নেই।
এরপরের বই-‘দি অটোবায়োগ্রাফি অব ম্যালকম এক্স’। বইটি বাজারে আসে ১৯৬৫ সালে এবং তখনই একে নিষিদ্ধ বই করা হয়। কারণ এমন ‘সাম আন্টি হোয়াইট টেস্টমেট’। বইটি লিখেছেন ‘রুট’ নামের বিখ্যাত সেই লেখক আলেক্স হেইলি।
টনি মরিসনের ‘বিলাভেট’ বইটিকেও একসময় ব্যান্ড করা হয়। বইটি লিখেছিলেন টনি মরিসন ১৯৮৭ সালে। প্রথমে বইটিকে স্কুলে পাঠ্যবই হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও পরে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ, এখানে এমন সব ঘটনা যা স্কুলের ছেলেমেয়ের জন্য উপযুক্ত নয়। ভায়োলেস বা সহিংসতা, জনতার হাতে একজন নারী গণধর্ষণের শিকার, এমনি কিছু ঘটনার প্রাঞ্জল বর্ণনা ছিল বইটিতে। বইটি টনি মরিসন লিখেছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান শ্লেভ মার্গারেট গানারের জীবন নিয়ে।
এর পরের বই ‘বেরি মাই হার্ট অ্যাট উনডেড নি’। বইটি লিখেছিলেন ডি ব্রাউন ১৮৭০ সালে। জ্যাক লন্ডন লিখেছেন ‘দি কল অব দ্য ওয়াইল্ড’। সেটাও একসময় নিষিদ্ধ বই হয় জার্মানি ও ইতালিতে।
জে ডি সালিঞ্জারের বই ‘ক্যাচার ইন দ্য রাই’। ১৯৫১ সালে বইটিকে ব্যান্ড করা হয়। কিছু আপত্তিকর কথাবার্তা, কিছু অপছন্দের ঘটনা- এ কারণে বইটিকে ব্যান্ড করা হয়েছিল। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা বই ‘ফর হোম দ্য বেল টোলস’ বইটিও একসময় নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৪০ সালে বইটি প্রকাশ হয়। নিষিদ্ধ করার কারণ কালো মানুষ। পরে নিষিদ্ধকরণ উঠে যায়। মার্গারেট মিচেলের বিখ্যাত বই ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ প্রকাশ হয় ১৯৩৬ সালে। একসময় ব্যান্ড হয়েছিল। নিগার শব্দটি এখানে বারবার এসেছে, তাই এবং নিগারদের জীবন কাটে ক্রীতদাস ও দাসী হয়ে। এ ছাড়া ওরা যে বড় কিছু হতে পারে না সে কথাও আছে। এর সঙ্গে আর যে আপত্তিকর শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন, তার মধ্যে একটি ‘ডার্কিস’।
স্টাইনবেকের বিখ্যাত বই ‘দ্য গ্রেপস অব র‌্যথ’। ১৯২৯ সালে বইটি প্রকাশ হয়। একসময় নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় পড়ে এবং এর সঙ্গে ‘অব মাইস অ্যান্ড ম্যান’। কারণ সেই একই কথা নিগার বা কালো লোকের কথা বারবার আসা। ‘দি গ্রেট গ্যাটসবি’ লিখেছিলেন স্কট ফিজজারোল্ড। ১৯২৫ সালে বইটি প্রকাশ হয় এবং তারপর এটিকে ব্যান্ড করা হয়।
এই কালো মানুষের কথা বলার কারণে ‘টু কিল এ মকিংবার্ড’ বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ বইটিকে পছন্দ করেনি। পরে এই বই থেকে সমস্ত নিষিদ্ধকরণ চলে যায় এবং বইটি আবার ছেলেমেয়েদের জন্য পাঠ্যবই করা হয়। এখন একশ’রও বেশি ভাষায় বইটি অনুবাদ হয়েছে। এখানেও কারণ অনেকটা একই রকম- সাদাদের কর্তৃত্ব। আটিকাস ফিঞ্চ যে কালোর জন্য আইনের সাহায্যে লড়েছিলেন। সবাই বলেন, তিনি আসলে হিপোক্র্যাট। হার্পার লি বইটি প্রকাশ করেন ১৯৬০ সালে। তারপর অনেক দিন পর ‘গো অ্যান্ড সেট এ ওয়াচম্যান’ বইটি প্রকাশ করেন। কিছুদিন পর মারা যান। ‘গো অ্যান্ড সেট এ ওয়াচম্যান’ বইটি ‘টু কিল এ মকিংবার্ডে’র ৫৫ বছর পর বাজারে এসেছে। তিনি মাত্র দুটি বই লিখেছিলেন সারা জীবনে। তার বিখ্যাত কোটেশনের একটি_ ‘একজন কাউকে বুঝতে গেলে, জানতে গেলে, তার পয়েস্টস অব ভিউ থেকে তাকে দেখো।’
এই বইগুলোর কারণে আজ আমেরিকার চেহারা বদলে গেছে। ফলে ওখানে কালো লোকও প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছে। যেদিন রোজা পার্কস (১৯১৩-২০০৫) সাদাদের জন্য রাখা বাসের সিটে বসেছিলেন, উঠতে বললে ওঠেননি, সেদিনই সকলে বুঝতে পেরেছিল কালো মানুষ আর মুখ বুজে সহ্য করবে না। তারা জাগছে।
সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটি তো ব্যান্ড হয়েছিল। তার ওপর তার মুণ্ডু দাবি করেছিল খোমেনির দল।
আরও যেসব বই নিষিদ্ধ হয়েছিল সেসবের ভেতরে আছে ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। ১৯২৯ সালে আন্টি ওয়ার নভেল হিসেবে বইটি বেরিয়েছিল। পরে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। ব্যান্ড করা হয়েছিল ‘অ্যানিমাল ফার্ম’ নামের একটি অসাধারণ বইকে। ১৯৪৫ সালে বইটি প্রকাশ হয়। কমিউনিস্ট দেশগুলোতে বইটি ব্যান্ড হয়ে য়ায়। পরে সেসব ব্যান্ড উঠে যায় এবং এই বই দুইশ’রও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়। অ্যারাব অ্যামিরেটস ব্যান্ড করে; কারণ সেখানে পিগ বা শূকর মানুষের মতো কথা বলে। একজন মানুষ যখন শূকরের সঙ্গে তুলনীয় হয় তাকে মেনে নেওয়া অ্যারাব অ্যামিরেটসের পক্ষে ছিল। তখন স্টালিন বা রাশিয়াকে কেউ খেপাতে চায়নি। টি এস এলিয়ট বলেন, এত বড় একটা বিদ্রোহকে এমন বিদ্রূপ করে দেখাতে হবে তার কোনো মানে নেই। বইটির শেষ এমন- মানুষগুলোকে লাগছে পশুর মতো, আর পশুকে লাগছে মানুষের মতো। স্টালিন, লেনিন, যাজক, বড় লোক, গরিব, কমিউনিজম অপছন্দের গুলাক, সবাইকে বিভিন্ন পশু হিসেবে দেখানো হয়। এখন পর্যন্ত বইটি ব্যান্ড হয়ে আছে উত্তর কোরিয়াতে।
লোলিতা বা লেডি চ্যাটার্লি লাভার বইগুলোকে ব্যান্ডমুক্ত করতে সময় লেগেছিল। অনেক আইন-আদালতে সাঁতার কেটে এক সময় বই দুটি সিদ্ধ হয়। আসলে লেডি চ্যাটার্লি যখন একজন সাধারণ বাগানের মালিকে পছন্দ করে, তার যৌন জীবনের সঙ্গী করে, অবশ শরীর স্বামীকে ফেলে, পুরো আরিসট্রোকাটিক সোসাইটি মুখে একেবারে কাদা ছুড়ে দিয়েছিল বলে সবাই মনে করে। ১৯২৮ সালে বইটি প্রকাশ হয় এবং ১৯২৯ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত নিষিদ্ধ বই হিসেবে ছিল অস্ট্রেলিয়াতে। অন্য দেশে আগে নিষিদ্ধকরণ উঠে যায়। এখন যেসব যৌনতাসর্বস্ব বই প্রকাশ হয় প্রতিদিন তার কাছে লেডি চ্যাটার্লি তো শিশু। কেউ যদি ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’ পাঠ করে থাকেন, আমার এ মন্তব্য বুঝতে পারবেন।
লোলিটা ছিল ছোট মেয়ে, বারো বছর বয়স তার। তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে একজন প্রফেসর, চাইল্ড মলেসটার নয়। আমি বইটি পড়ে মজা পাইনি। ১৯৫৫ সালে ভ্লাদিমির নবোকভ বইটি প্রকাশ করেন।
আরও অসংখ্য বইয়ের নাম করা যেতে পারে, যুগে যুগে যে বইগুলো নিষিদ্ধ হয়েছে নিজ দেশে এবং ভিনদেশে।
ড. জিভাগো লিখে বোরিস প্যাস্টারনেক নোবেল পুরস্কার পেয়েও নিজ দেশে আনতে পারেননি। তিনি পুরস্কার ফেরত দেন, রাশিয়াতে থেকে যান এবং পরে অনেক বই রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেন। বইটি সত্যি্ই চমৎকার একটি বই। ১৯৬৫ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হয় এবং ডেভিট লিনের পরিচালনায় এই বইটি একটি চমৎকার সিনেমা হয়। ১৯৬১ সালে বইটি নোবেল প্রাইজ পায়।
‘জিন্নাহ অব পাকিস্তান’ বইটি নিষিদ্ধ হয়েছে পাকিস্তানে। কারণ সেখানে বলা হয়েছে, জিন্নাহ শূকরের মাংস আর মদ খেতেন। ১৯৮২ সালে স্টানলি ওয়ালপার্ট বইটি প্রকাশ করেন। ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ও ব্যান্ড হয়েছিল এক সময়। সেখানে এমন সব কথা আছে যা শিশুদের জন্য আপত্তিকর।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত