কমিকস পড়তে আমার কী ভালই যে লাগে। অথচ এখন আর পড়া হয় না। সেদিন গৌতমের কাছ থেকে দুটো টিনটিন এনেছিলাম। বাড়িতে এখনও অরণ্যদেব, ম্যানড্রেক– ইন্দ্রজাল কমিক্সের পুরো সেট গুছিয়ে রাখা আছে। বিয়ে হলেই অনেক কিছুই কীরকম আপনা-আপনি পালটে যায়। নিষেধের ভাইরাস উচ্চারিত বা অনুচ্চারিতভাবে চারপাশে বিজবিজ করে। বাড়িতে চান করতে গিয়ে গলা খুলে গান করেছি। যখন তখন সোফায় পা তুলে বসে তন্ময় হয়ে কমিক্স পড়েছি। আর এখন? আমার চলাফেরা, কথা, হাসি, আচরণ– সবই কেমন ভূতে পাওয়া মতো। বিয়ে হওয়ায় আমি তো আর রাতারাতি পালটে যাইনি। কিন্তু আমার চারপাশ পালটে গেছে। বাড়ির সেই আমিকে আমিই আর খুঁজে পাই না।

বাড়ি। আবার বাড়ি বলে ফেললাম। আমার শাশুড়ি থাকলে বলতেন- “বাড়ি! মানে! বলো বাপের বাড়ি।” বাপের বাড়ি… বাপের বাড়ি … অনেকবার বলা অভ্যাস করতে চেয়েছি। হয়নি। আমি এখনও বলি বাড়ি। তা হলে এটা কী! এই বাড়িটা? এটা শ্বশুরবাড়ি। কী জানি, হয়তো থাকতে থাকতে একদিন এটাই আমার বাড়ি হয়ে যাবে, আর আমি, আমার অজান্তে আমার ছোটবেলা, আমার স্বপ্ন, কল্পনা, স্কুল-কলেজের দিনগুলো ধরে রাখা বাড়িটাকে বলতে শুরু করব- বাপের বাড়ি।

সেদিন গৌতমের বউ বৃষ্টি বলছিল, ফিফটিনথ ওর জন্মদিন। আজ সেই ফিফটিনথ। বৃষ্টিটা এত সুন্দর, এমন আদরকাড়া যে ওকে কিছু দিতে খুব ইচ্ছে করছিল। কী দিই! আমার কাছে তো টাকা নেই। কুণালের কাছে আমি টাকা চাইতে পারি না। কুণালও দেয় না নিজে থেকে। দু’একদিন চেয়েছিলাম। প্রথম প্রথম। টাকা নিয়ে কী করতে চাই তার কৈফিয়ৎ আমাকে দিতে হয়েছিল। ওর মা’র কাছে চাইবার কথা তো ভাবতেই পারি না। আমার যে টাকা ছাড়া চলে না তা নয়। বেশ তো চলেই যাচ্ছে। কিন্তু মাঝে মাঝে লাগে। একান্ত ব্যক্তিগত কিছু খরচ তো থাকেই মানুষের। সব চাহিদাই কি আর মুখ ফুটে বলতে ভাল লাগে?

বৃষ্টিকে কী দেব ভাবতে ভাবতেই কাল রাতে কাগজ আর স্কেচ পেনটা টেনে নিয়েছিলাম। একটা জানলা আঁকলাম আর গ্রিলের ওপারে একটি মেয়ের মুখ। চোখ দু’টো খুব বিষণ্ণ হয়ে গেল, কেন কে জানে! বৃষ্টির জন্মদিনে উপহার দেব বলে এঁকেছি। আনন্দের ছবি হওয়া উচিত ছিল। প্রায় চার বছর পর আঁকা। বেশ লাগছিল। আমি ভেবেছিলাম আঁকতে ভুলে গিয়েছি।  টিনটিন দুটোর সঙ্গে ছবিটা নিয়ে আজ বিকেলে গৌতমের বাড়ি গিয়েছিলাম। বৃষ্টি ছবি পেয়ে খুব খুশি। ঝরঝর করে প্রশংসা করল। গৌতম কিন্তু করল না। ও বরং খুটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ছবিটা দেখল আর নানারকম মন্তব্য করল। ও নিজেও ভাল আঁকে। রবীন্দ্রভারতীর পাশ করা শিল্পী। আমার আঁকার সমালোচনা ও করতেই পারে। কিন্তু মনে মনে বেশ কষ্ট পেলাম আমি। এতদিন পরে আঁকতে পারার আনন্দটাই চলে গেল।

অনেক দিন ধরে গৌতম আমার একটা ছবি তুলতে চেয়েছে। ছবি আঁকার মতো ছবি তোলাও ওর নেশা। আমি বলেছিলাম তুলতে দেব। আজ ও একেবারে নাছোড় হয়ে গেল। বৃষ্টি আর ও এত জোর করতে লাগল যে আমি রাজি হয়ে গেলাম। দিনের আলোয় তুলবে বলে ওদের খোলা ছাদে দাঁড় করিয়ে দিল আমাকে। ওদের ছাদটা দারুণ। ওখানে দাঁড়ালে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। আকাশটাকে খুব বড় লাগে। আর কী যে তুমুল হাওয়া তা কী বলব! ওদের সঙ্গে এই ছাদে আমি কতদিনই তো দাঁড়িয়েছি। কিন্তু আজ গৌতমের ক্যামেরার সামনে আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। ও বলল- “এদিকে মুখটা ফেরাও … একটু নীচে নামাও … ওঃ! চোখটা তোলো …!” কী মুশকিল। এত কিছু করা যায় নাকি! তা ছাড়া খুব ভয়ও করছিল। আমার শাশুড়ি যদি শোনেন গৌতমের ক্যামেরার সামনে আমি পোজ দিয়েছিলাম তাহলে ভীষণ অশান্তি করবেন। আমার অশান্তি ভাল লাগে না। গৌতম যতক্ষণ ফোকাস করছিল, সে হয়তো দু’এক মিনিট- কিন্তু ওটুকুতেই আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন অনন্তকাল অপেক্ষা করে আছি! কিছুতেই ওকে সন্তুষ্ট করার মতো তাকাতে পারলাম না। ও রেগে গেল। বলল – “একটু স্মার্ট হও। এত ক্যাবলামো করছ কেন?” বৃষ্টি বলল- “তুমি তো কুণালদার ক্যামেরার সামনে পোজ দিতে অভ্যস্ত। এখন এত নার্ভাস হয়ে যাচ্ছ কেন?”

আমি কিছুতেই বলতে পারলাম না। কুণালের ছবির সামনে পোজ দেওয়া? হ্যাঁ, দিয়েছিলাম। যে বার বিয়ে হল, সেবার। কুণালও ভাল ছবি তোলে। দুটো ক্যামেরা আছে ওর। অলিম্পাস আর জেনিথ। হানিমুনে গিয়ে দুটো ক্যামেরায় দু’শো রিল ছবি তুলেছিল ও। শুধু আমার ছবি। এখন আর তোলে না। বউ পুরোনো হলে বোধহয় আটপৌরে হয়ে যায়। বৃষ্টি কিন্তু হয়নি। ওর আর আমার প্রায় একই সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। কেন হয়নি? বোধহয় এ কারণেই যে গৌতম ও বৃষ্টির মধ্যে গভীর ভালবাসার জন্ম হয়েছে।

আজ কুণাল আবার বাইরে গেল। কবে ফিরবে ঠিকঠাক বলল না। হয়তো সাতদিন। খুব খাটছে ও। খাটবেই। ওর অনেক টাকা চাই। ওদের সবারই চাই। অনেক আছে, তবু অনেক চাই। আজ বাইরে যাবে বলে কাল ও নিজের জন্য অনেক কিছু কিনে এনেছে। আমার জন্য কতদিন কিছু কেনেনি। আজকাল জিজ্ঞেস করতেও ভুলে যায় আমার কিছু লাগবে কি না। আমার প্রতি সত্যিই ওর কোনও গভীর অনুভূতি নেই। এ বাড়িতে আমার অবস্থা অনেকটা পোষা বেড়ালের মতো। শাশুড়ি সারাদিন খিট খিট করছেন। শ্বশুর নির্বিকার। কুণালের ভাই এত শীতল, এত চুপচাপ যে মাঝে মাঝে ওকে বোবা বলে মনে হয়।

অন্যদের প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই। যার জন্য এ পরিবারে এসেছিলাম, যাকে সবচেয়ে বেশি করে পাওয়ার কথা, তার সঙ্গে দাম্পত্য কোথায়? এ তো শুধুই সহবাস। এই কি আমি চেয়েছিলাম?

এক এক দিন পাগল পাগল লাগে। নিঃসঙ্গতা কী ভয়ানক। যখন বাড়িতে ছিলাম, তখনও যে আমার অনেক বন্ধু ছিল, তা নয়। কিন্তু ওখানে যেন সবাই আমার বন্ধুই। স্টেশনারি দোকানের কমলদা, সিরাজুল টেলারিং-এর সিরাজুলদা, সবাই। ওখানে গরু-ছাগল বেড়ায় চড়ে, যেসব কুকুর মাংসের দোকানের সামনে ধৈর্য ধরে বসে থাকে, যেসব কাক-শালিক-চড়াই আমার মায়ের রান্নাঘরে ঢুকে উৎপাত জুড়ে দেয়- তাদেরও প্রত্যেককে আমি বন্ধু না ভেবে পারিনি। এখানে কেউ তেমন নয়। কিছুই তেমন নয়।

আজকাল রাতে ভাল ঘুম হয় না। সারাদিনের একাকিত্ব একরকম। কিন্তু মাঝরাতের ওই ঘুম না আসার একলাপনার চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছুই নেই। আজকাল যে ডায়াজিপাম কিনতে প্রেসক্রিপশন লাগে না, তাতে খুব সুবিধে হয়েছে।

ছ’মাস আগের কথা মনে পড়ছে। কুণাল টুর থেকে ফিরেছে সেদিনই। আমি ডায়াজিপাম খেয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করছিলাম। রাত প্রায় একটা হবে। ও হঠাৎ আদর করতে শুরু করল। আজকাল এসব আমাদের মধ্যে কমে এসেছে। তবু, ক্ষুধার্ত থাকা স্বাভাবিক সত্ত্বেও, আমি ওকে প্রত্যাখ্যান করলাম। ও অবশ্য জোর করল না। করেওনি কখনও। সত্যি কথা বলতে কি, করতে হয়ওনি। এতদিনের মধ্যে এই প্রথম ওকে বাধা দিয়েছিলাম আমি। ও একটু অবাক গলায় বলল-“কী হল!” ভীষণ ছোট লাগছিল আমার। খুব অপমানিত লাগছিল। টুর থেকে ফিরে এল, একটিবার আমার কাছে বসল না, দুটো কথা বলল না। প্রথম প্রথম রাগ করতাম, এখন ছেড়ে দিয়েছি। এসবের তো কোনও মূল্য নেই ওর কাছে। তবু ছেড়ে দিয়েছি বললেই তো সবটা ছাড়া যায় না। নিজের অজান্তে রাগ-অভিমান ঝাঁপিয়ে পড়ে। বললাম- “কতদিন তুমি এরকম টুর করবে? কতদিন আমাকে এরকম একা একা রাখবে? আমাকে এভাবে অবহেলা করছ কেন? আমাকে যদি ভাল না লাগে তবে স্পষ্ট বলে দিচ্ছ না কেন?” ও বলল- “রাগ কোরো না। আর দু’টো দিন। একটু গুছিয়ে নিই।”

কত গুছোবে ও? কত গুছোতে চায়? আমার বাবা একটা সাধারণ চাকরি করতেন। তাই দিয়েই তো আমাদের জীবন শান্তি স্বচ্ছন্দে কেটে গেছে। ও যদি বুঝত, দু’টো দিন– দু’টো দিন করতে করতে চার-পাঁচ বছর কীরকম অর্থহীনভাবে চলে গেল! একদিন খুব অভিমানী হয়ে গিয়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম- “কেন আমাকে ভালবাস না তুমি? আমি কী করেছি?” কান্না দেখে ওর বোধহয় দয়া হয়েছিল। বলেছিল- “ভালবাসব না কেন? বাসি তো।” এত নিরুত্তাপ গলায় ভালবাসার কথা বলতে কুণালই পারে। আমার তখন অত বিশ্লেষণের ক্ষমতা নেই। অভিমান হলে, রাগ হলে, মানুষের আর স্বাভাবিক বিচারবোধ কাজ করে না। তাই ওর ওই শীতল ভালবাসার পরও বলেছিলাম- “ভালবাস না। কিচ্ছু ভালবাস না। একটু কথা বলো আমার সঙ্গে? একটু সময় দাও? একা একা আমার কীভাবে কাটে খোঁজ রাখো?” ও বলেছিল- “তুমি যে আছ, বাড়িতে ফিরে যে তোমাকে দেখতে পাব- এই তো আমার অনুপ্রেরণা।”

অনুপ্রেরণা! অনুপ্রেরণা! শব্দটা শুনতে চমৎকার। কিন্তু আমি এই শব্দটাকেই ঘেন্না করি। কীসের অনুপ্রেরণা? কী ভাবে অনুপ্রেরণা? এ বাড়িতে একটা কল দেওয়া পুতুলের মতো বা পোষা বেড়ালের মতো হয়ে থাকাটা? চিরকাল শুনে এসেছি নারী পুরুষের অনুপ্রেরণা। চমৎকার কথার আড়ালে চমৎকার গুটিয়ে রাখার প্রক্রিয়া। নারী প্রেরণা। তার মানে নারীর কোনও প্রত্যক্ষ অস্ত রইল না। সে আড়ালে রইল। বন্ধ রইল। সব কাজ রইল পুরুষদের জন্য। আর নারীকে বলা হল-“তুমিই সব। তুমি প্রেরণা। দুটো হাত নুলো করে দিয়ে শক্তিমান বলে প্রচার করার মতো।

এসব কথার পর অবশ্য অনেকদিন কেটে গেছে। আমি অনুপ্রেরণা হয়ে যেমন ছিলাম তেমনি আছি। কুণালের নৌকাটা ক্রমশ সরে যাচ্ছে। এতদিন জোরে ডাকলে শুনতে পেত, এখন আর পাবে না। সন্ধেবেলা রান্নাবান্না সেরে টিভির সামনে বসেছিলাম। শ্বশুর-শাশুড়ি গিয়েছেন আমার পিসশাশুড়ির বাড়ি। শাশুড়ি থাকলে আমি টিভির সামনে বসি না। টিভি দেখতে দেখতে উনি সারাক্ষণ কথা বলেন আর আজকালকার মেয়েদের সম্পর্কে সারাক্ষণ কটুক্তি করেন। একই কথা রোজ শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখনকার মেয়েরা যে কত খারাপ তা আমার শাশুড়ি না থাকলে অনুধাবন করা আমার নিজের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এখনকার মেয়েদের রুচিবোধ নেই, দাঁড়াবার ছাঁদ নেই, কথায় আগল নেই, বুকে লজ্জা নেই, পুরুষদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা– তাই চরিত্র নেই। এখনকার মেয়েরা সিঁদুর পরে না, কারণ পথেঘাটে বিবাহিতা বোঝা গেলে ফ্লার্ট করতে অসুবিধে হবে। এসব শুনে আমার শাশুড়িকে সেকেলে ভাবলে ভুল হবে। তিনি দিব্যি আধুনিক। ঠোঁটে রঙ মাখেন, হাতা কাটা রাউজ পড়েন, ভুরু তোলেন, নিয়মিত পার্লারে গিয়ে ফেসিয়াল করান। তবু তাঁর সঙ্গে আমার মিলল না।

শাশুড়ি নেই বলে যে আমার টিভি দেখতে খুব আনন্দ হল তা নয়। টিভির অবস্থাও তাঁর মতো। সারাক্ষণ একই বিজ্ঞাপন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। বোকা বোকা সিনেমা দেখলাম। কুণালের খুড়তুতো দাদার ছেলেমেয়েরা এল। ওদের সঙ্গে ঘরের আলো নিবিয়ে দিয়ে জি হরর দেখলাম। এসবই সময় কাটানো । এর কোথাও কোনও ভাললাগা নেই। আমার একমাত্র প্রিয় চ্যানেল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। সেটা চালিয়েছি, কুণালের ভাই এসে বদলে দিল। বদলাবে কি না এটুকু জিজ্ঞেস করার ভদ্রতাও নেই। ধুম-ধাড়াকা নাচের প্রোগ্রাম শুরু হল। আমি টিভি ছেড়ে এ ঘরে চলে এলাম।

নিজের একাকিত্ব ও অসহায়তা দেখতে দেখতে নিজের প্রতি করুণা হয়। আজকাল একটা বাচ্চা পেতে খুব ইচ্ছে করে। একটা মেয়ে যদি থাকত আমার। ছোট্ট পুতুলের মতো সারা ঘর ঘুরত। চুলে পনিটেইল করে দিতাম। দারুণ দারুণ ফ্রক আর প্যাঁক প্যাঁক জুতো পরিয়ে দিতাম। কাঁদলে চোখের জল মুছিয়ে দিতাম আর সন্ধেবেলা যে কোনও বই খুলে বর্ণ পরিচয় করাতাম ঠিক আমার মায়ের মতো। আমার বাবা আমাকে গুচ্ছের ছড়ার বই এনে দিতেন। আমি একেকটি ছড়া মুখস্থ করতাম আর মুখস্থ হলেই সেই পাতাটি ছিঁড়ে উনুনে দিয়ে দিতাম। পড়া তো হয়েই গেল। তাহলে আর ওটার বইতে থাকার দরকার কি? তখন আমাদের কাঠের উনুন ছিল। সেই উনুনের গরম লালচে আঙরায় আমি আর রুপু কাঁঠালবিচি পুড়িয়ে খেতাম। এখন তো উনুন নেই, গ্যাস। আমার মেয়ে যদি ছড়া পোড়াতে চায় তাহলে কী করবে?

সবাই আমাকে বলে- “এবার একটা হোক।” যেন আমি ইচ্ছে করেই বাচ্চা নিচ্ছি না। কুণাল আরও গুছিয়ে নিয়ে তারপর বাচ্চা আনতে চায়। বাচ্চা হওয়া তো আমার একার হাতে নেই।

আজ কালীপুজো। আমার অবশ্য উৎসবের দিন বলতে কিছু নেই। বরং কোনও উৎসব-অনুষ্ঠান এলেই আমার ভয় করতে থাকে এই ভেবে যে আমাকেও সাজ-গোজ করতে হবে। মুখে একটা সুখি প্রলেপ বুলোতে হবে। আর কুণাল যখন আমার কথা ভাববেও না, আমি একা পড়ে থাকব এবং সবার তা চোখে পড়ে যাবে, তখন আমাকে দেখাতে হবে আনন্দে উড়ছি আর কুণালের সঙ্গে আমার কত পরিকল্পনা যা দিয়ে একটি অসামান্য ভবিষ্যৎ গড়ে

তোলার জন্য আজ নিজেকে নিবেদন করছি। সবটাই কী আশ্চর্য মিথ্যে। আর সবাইকেই দেখছি মিথ্যেটা বুঝেও কেউ সেটি বজায় রেখে চলেছে দেখলেও স্বস্তি হয়। শুধু স্তোক। শুধু ভণ্ডামি। আজকাল প্রায়ই মনে হয় বেঁচে থেকে কী লাভ!

আজ একজন কাজের লোকও আসেনি। এ বাড়িতে একজন বাসন মেজে মশলা বেটে দিয়ে যায়, একজন ঘর মোছে, কাপড় কাচে। শাশুড়ি আজ শ্বশুরমশাই-এর সঙ্গে তাঁর বন্ধুর বাড়ি গিয়েছেন। পুজো আছে। ফিরতে ফিরতে পরশু। সকাল থেকে যাওয়ার আয়োজন চলছে। গতকাল মাথায় মেহেন্দি লাগিয়ে এসেছেন। সেই সঙ্গে ফেসিয়াল না করে ব্লিচ করে এসেছেন দেখলাম। বয়স হলে মেয়েদের গোঁফের রেখা ঘন হয়ে যায়। উনি সেটি তুলে ফেলেছিলেন। ভীষণ পুরুষালি লাগছে মুখটা। অথচ গোঁফের রেখা তুলে ফেলা তো এ জন্যই যে যাতে মুখটা পুরুষালি না লাগে। সকালে দেখলাম উনি গায়ে কাঁচা হলুদ আর দুধের সর মাখছেন। এখন তো শরীর সুন্দর রাখার কত প্রয়াস। ভাল। জীবনকে ওরা ভালবাসতে পেরেছেন।

সকাল থেকে সমস্ত কাজ মিটিয়ে দুপুরের খাবার খেতে তিনটে বেজে গেল। কুণাল সেই সকালে বেরিয়েছে। এখনও ফেরেনি। আগে ওর জন্য অপেক্ষা করতাম। এখন আর করি না। ওর ভাই খেয়ে গেছে আগেই। এই বেলায় আর শুতে ইচ্ছে করছে না। টিভি খুলে বসে আছি। দেখছি না কিছুই। কুণাল এল পাঁচটায়। এবার এ পাড়ার বারোয়ারি কালীপুজোর রজতজয়ন্তী। সারা দিন নিজের কাজ করে এসে ও এবার পাড়ার কাজে বেরোল। আমি একা একাই চা খেলাম সন্ধ্যায়। রুটি করলাম। পনির রাখা ছিল ফিজে। পালং পনির আর আলুভাজা করেছি। আশেপাশের সব বাড়িতে প্রদীপ জ্বলছে, মোম দিয়ে সাজানো হয়েছে, শুধু এ বাড়িতে কোনও আয়োজন নেই।

বাড়ির কথা মনে পড়ছে। কত মোম এনে দিতেন বাবা। গেটের সামনে দু’খানি কলাগাছ লাগিয়ে তাতে বাঁশের কঞ্চি গুজে দীপাবলি সাজাতাম। আমাদের পাড়ায় সবাই এরকম করত। যেন অলিখিত অনুচ্চারিত মোম ও প্রদীপ সাজানোর প্রতিযোগিতা চলত পরস্পরের মধ্যে। কিন্তু আমার মনে হত আমরাই সেরা। আমার মায়ের মতো অত সুন্দর বাঁশের ডিজাইন আর কেউ করতে পারত না। মা নির্দেশ দিতেন আর আমাদের মালি বুখলাকাকু বাঁশ কাটত। দুপুরের খাওয়া তাড়াতাড়ি সেরে সন্ধে পর্যন্ত এসবই আমরা করতাম। আজ বাড়িতে দীপাবলি সাজাতে সাজাতে বাবা আর মা নিশ্চয়ই আমার কথা বলছেন। আর একা একা ঘরে আমার খুব কান্না পাচ্ছে। একটা মোম কেউ কিনে রাখেনি। একটা বাজিও না। অথচ দুটোই আমার কত প্রিয়। বাবা শব্দবাজি পছন্দ করতেন না বলে চরকি, হাউই, তুবড়ি আর ফুলঝুরি আনতেন। মায়ের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে বুড়িমার চকোলেট বোম কিনে আমি, রুপু, বুয়া, জয়, মুন মাঠে গিয়ে ফাটাতাম। কী যে মজা হত। সেসব এখন স্বপ্নের মতো লাগে।

অন্ধকার বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে আছি। আজ আমার সাজবার দায় নেই। কেউ কোথাও নেই। যে যার মতো বেরিয়ে পড়েছে। আজ আমার ভয়ঙ্কর একা লাগছে। আজ আমি যা কিছুই করতে পারি। আশ্চর্য ! কুণালটা দেখতেও এল না আমি কী করছি! হয়তো এগারোটায় আসবে। খাবে। বলবে– চলো, ঠাকুর প্রণাম করে আসবে। আমি বলব– সারা সন্ধে কেটে গেল, এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না। ও বলবে– কালী প্রণাম করতে তো মাঝরাতেই লোকে যায়। আমার আর মাঝরাত আর সন্ধে কী, আমার অনন্ত আদিগন্ত রাতই শুধু। আচ্ছা! কুণাল এল না তো কি? আমি একাই পারি না সেজেগুজে বেরিয়ে পড়তে? পুজো মণ্ডপে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারি না? পারিই তো। আমার সঙ্গে যদি কেউ না থাকে, যদি না বলে, চলো… তাহলে আমি যাব না? এখানেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকব? কেন? আমি একলা একলা সাজব। একলা একলা আনন্দ করব। যতটুকু পারি ততটুকুই করব।

কতটুকু পারি? বাবা এবারে পুজোয় একটা কাশ্মীরী সিল্ক দিয়েছেন আমাকে। সেটা পরেছি। চুলটা গুটিয়ে ফ্রেঞ্চ রোল করেছি। ঠোটে স্ট্রবেরি রেড রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছি। রঙটা হট। আমার খুড়তুতো ভাই শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট থেকে এনে দিয়েছিল। কানে ড্যাঙ্গলার পরেছি। আয়নায় দেখছি নিজেকে । বেশ লাগছে আমাকে। ফ্রেশ। পরিষ্কার। সুখি ও তৃপ্ত। আমার পেটে একটু মসৃণ মেদ। সহজেই চোখে পড়ার মতো কিন্তু প্রকট নয়, বেশ একটা ভারতীয় ডৌল। একটু আগে কেঁদেছিলাম। চোখ দুটো ফুলো ফুলো লাগছে, যেন অনেক সন্ধে পর্যন্ত ঘুমিয়েছি। দরজায় তালা দিয়ে আমি একা এসেছি মণ্ডপে। কিন্তু সবাই কী আশ্চর্য ভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে। একটা চেনা মুখ নেই। ভাল লাগছে না এখানেও। ওরা ওভাবে দেখছিল কেন আমাকে? আমি অত সেজেছি বলে? আমি একা বলে?

বাড়ি ফিরে এসেছি। দরজার তালা খুলছি। তালায় জং পড়ে গেছে। প্রায় আমার স্ট্রবেরি রেড লিপস্টিকের রঙের মতো মরচে। এত তাড়াতাড়ি মরচে পড়ে নাকি? হয়তো আগেই পড়েছে, আমি খেয়াল করিনি। দরজায় তালা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তো খুব একটা তৈরি হয়নি আমার। আবার সেই শূন্য ঘরে এসেছি। বাইরে কালীপুজো। বাইরে দীপাবলি। ওসব আমার জন্য নয়। তাই বোধহয় লোকে আমাকে দেখছিল। সাজ বদলাব বলে, শাড়ি বদলাব বলে ঘরে এসে আয়নার কাছে দাঁড়িয়েছি আমি। মা গো! কী বিশ্রি লাগছে আমাকে। আমার চুলগুলো পেকে সাদা, গালের চামড়া কুচকানো। পেশিগুলো নরম, ঝুলন্ত। তারই উপরে আমি এত সেজেছি। যখন সাজতে ইচ্ছে করেছিল, আর যখন আমি সেজে বেরিয়েছিলাম তার মধ্যে কতদিন পেরিয়ে গিয়েছিল? আমার অস্তিত্বের মধ্যে এতখানি মরচে পড়ে গেল কখন?

আমি যে কিছুই খেয়াল করিনি।