| 28 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

জীবন

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

।। নবনীতা সই ।।

গাঁয়ের বাইরে যেখানে চৌমাথার কাছে বড় বটগাছটা হেলে আছে৷ সেই হেলা বটতলায় বিশুর চায়ের দোকান৷ সারাদিন বাকি খদ্দের আর আড্ডা বেশি৷ পাশাপাশি চার আট দশটা দোকান আছে৷ দুটো মুদিখানা, একটা সিতেশের জামাকাপড়ের দোকান, মোবাইল রিচার্জ করার দোকান৷ বুড়ো হারাণ চক্কোত্তির হোমিওপ্যাথির চেম্বার৷ সবমিলিয়ে বাজার না হলেও বাজার৷ মাছ আনাজপাতি নিয়ে সকালবেলা কিছু লোক প্লাস্টিক পেতে বসে৷

বিশুর তিনটে ছেলে মেয়ে৷ মেয়েটা বড়, ছেলে দুটো জমজ৷ বৌ সারাদিন দুটো গরু, তিনটে বাচ্চা আর বুড়ি মা কে সামলাতে পারতোনা, যদি মেয়েটা হাতে হাতে করে না দিতো৷ ছেলে দুটো গাঁয়ের স্কুলে পড়ে৷ দুপুরে খেতে পায়৷ মেয়েটা এবার নাইনে উঠেছে তাই মি ডে মিল বন্ধ ৷ ঐ বাঁশঝাড়, কলা আমের বাগান দিয়ে চলে যায়৷ বিশুর বৌটা লক্ষী৷ ভোর থাকতে উঠে কাজ সেরে, গরু মাঠে দিয়ে সোজা কাক ডাকার আগেই দোকানে এসে যায়৷দোকান পরিস্কার করে, বাসন মেজে, উনুন ধরিয়ে চলে যায়৷ বিশে কি কম খাটে? ভোর হলেই গরুর জাবনা কেটে, পুরো উঠোন ঝেটিয়ে গোবর ছড়া দিয়ে, গোয়াল পরিস্কার করে তারপর আসে দোকানে৷

বিশের মায়ের কাজ সকাল হলে নাতি দুটোকে স্নান করিয়ে খাওয়ানো৷ টুকুটুক করে ভাঙা মাজা নিয়ে স্কুলের দোর গোড়ায় দিয়ে বুড়ি সারাদিন ঘুটে দেয়৷ ঐ এক নেশা৷ আজকাল গাঁয়ে গ্যাস এসে গেছে তবুও বুড়ির ঘুটে আর মশাল বানানো চাই৷ মেয়েটাও সকালে উঠে বাসন মাজে, জল আনে৷ ভাই দুটোকে পড়িয়ে দুটো নাকে মুখে দিয়ে ছোটে স্কুলে৷ সাইকেলে যায় বলে পেরে যায়৷ হরিমোহন গার্লস তো প্রায় হেঁটে ঘন্টাখানেকের পথ৷ জমিজমা নাই, তবুও দিন কেটে যায়৷ বছর বছর গাঁয়ের চেহারা পাল্টায়৷ বেঞ্চ গুলো মড়মড় করে সব মাতব্বরদের যুক্তি তর্কে৷ কোথায় নেতা কোথায় পুলিস, সবাই সবজান্তা৷ বিশু কোনদিকে নাই৷ সারাদিন চা বানায়, বিস্কুট, লজেন্স, কেক, আর চিপসের প্যাকেট বিক্রি করে৷ বেলা একটা বাজতেই, দোকান পরিস্কার করে সব বাসন পত্তর ধুয়ে দোকান বন্ধ করে গরু নিয়ে হাঁটা দেয় বাড়িতে৷ কিছু ঘাস, কোনদিন খোল হাতে করে নিয়ে যায়৷ নিজের ঘরের পিছনের ডোবায় কিছু মাছ আছে৷ বাড়িতে মুরগী দু চারটে আছে৷ স্বামী স্ত্রী সারাদিন খেঁটে যায়৷ দুপুরে ঘুমবার ও জো নেই৷ বিকালের আগে আবার উনুনে আঁচ দিতে হবে৷ এবেলা শম্পা আসতে পারেনা৷ ছেলে দুটো স্কুল থেকে আসে, মেয়ে আসে, ঘোষ আসে দুধ নিতে৷
সবমিলিয়ে বিকালের আঁচটা বিশুকে দিতে হয়৷ তবে আটটা না বাজতেই বিশুর বৌ হাজির হয় দোকানে৷ সারাদিনের মতন সব গুছিয়ে দুজনে বাড়ি ফেরে৷ সারাদিনের কত কথা, মেয়েটার বই লাগবে, ছোটো দুটোর প্যান্ট, মায়ের কাশির ওষুধ৷

বিশু ও দোকানের সব গল্প করতে করতে আসে৷ ঘরে আসামাত্র ছেলে মেয়ে বই তুলে বাবার কাছে চলে আসে৷ সবাই মিলে ঐ সময় টুকু টিভি দ্যাখে, বাচ্চাদের খুনসুটি, মেয়েটার মাতব্বরি সব চলে৷ দশটা না বাজতেই সব ঘুম৷ পুরো গ্রাম ঢেকে যায় অন্ধকারে৷ এমনি করে জীবনের চাকা চলতে থাকে৷
কিন্তু সেবার ভোটের সময় দলে দলে যখন জনসভায় গেলো৷ ছেলে বৌ সব দলে দলে গাড়িতে ভরিয়ে৷ বিশুকে ও নিয়ে গিয়েছিলো৷ বিশুর কোন বাহানা কেউ শোনেনি৷ তার উপর দোকান রাস্তার পাশে৷ সেটা নাকি সরকারি জমি৷ দোকান চলে যাবার ভয়ে বিশু দোকানের ঝাপ বন্ধ করে গাড়িতে ওঠে৷ মেয়ে শিউলি কে বলে যায় ভাই দুটির খেয়াল রাখতে৷ বৌ কে বলে যায়, গরুর জাবনা কাটা আছে, দিও৷ আর আজ স্কুলে পাঠাতে হবেনা ছেলে মেয়ে কে৷ সাবধানে থেকো৷ আমি ট্রেন ধরে আগেই চলে আসবো৷ ব্যাস সেটাই ছিলো শম্পা আর বিশুর শেষ সংসারের গল্প৷ দিনের শেষে সবাই ফিরলেও বিশু ফেরেনা৷ মিটিং এ যাওয়া অনেক মানুষ, সেখারকার খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো৷ বিশু কোন হাসপাতালে আছে কেউ জানেনা৷ যারা পরে ফিরছিলো, বিশুর খবর কেউ দিতে পারেনি৷ কোলকাতায় কিছু চেনেনা শম্পা তবুও পাশের বাড়ির রঘুনাথ আর ওর বৌয়ের সাথে যায়৷ কোথায় খুঁজবে? কত বড় শহর!

দলের নেতারা আশ্বাস দেয় কিন্তু তাতে শম্পার মন ভরেনা৷ বাড়িতে বাচ্চা গুলোর মুখ শুকনো৷ দোকান বন্ধ৷ শম্পা পাগলের মতন একবার এই অফিস ঐ অফিস শেষে থানায় হত্যে দেয়৷ তাদের গাঁয়ের এলাকার থানা বলে এটা তাদের কেস নয়৷ কোলকাতার কোন থানায় যাবে? গাঁয়ের অনেকে বলে বিশু নাকি মরে গেছে৷ শম্পার মন মানে না৷
কেউ কেউ বলে, কেটে পড়েছে সংসার রেখে৷ কোথায় খুঁজবো? কেউ যদি ইচ্ছা করে চলে যায়৷ সবাই নিজের দায় ঝেড়ে ফেলে৷ সবাই চলে আসলো, বিশু বাদে৷ সবাই না না কথা, গুজবে রটায়৷ শম্পা কানে নেয়না৷তার মনে হয় বিশুর বিপদ হয়েছে, নইলে ছেলে মেয়ে অন্ত প্রাণ লোকটার৷ ভাবলে পেট চলেনা৷ বাধ্য হয়ে শম্পা দোকান খোলে৷
প্রথম প্রথম খুব লজ্জা লাগতো৷ সব তো ব্যাটাছেলে৷ আস্তে আস্তে সয়ে যায়৷ মেয়েটা পুরো সংসার সামলায়৷ ছেলে দুটোও যেন হট করে বড় হয়ে গেছে৷ সব খুনসুটি গুলোর জায়গায় গম্ভীর ভাব চলে এসেছে৷

এত কাজের চাপে ও শিউলি পাশ করে যায়৷ শম্পার মনটা শান্তি পায়৷ গরু গুলো বিক্রি করে দেয় শম্পা ৷ ছোট্ট মেয়েটা পারেনা এত৷ আর দোকানেও কিছু জিনিস দরকার৷ মেয়ের ভরতি, বই সব লাগবে৷ দোকানে দুটো বেঞ্চ বাড়ায় শম্পা৷ টুকটাক খাবার তোলে৷ আজকাল দিন পাল্টাচ্ছে৷ চা টা খুব ভালো করে শম্পা৷ আর টুকটাক বিক্রিতে কোনরকম চলে যায়৷ ছেলে গুলোর পড়াশুনা নিয়ে খুব চিন্তা শম্পার৷ দিন দিন জিনিসের দাম আগুন হয়ে যাচ্ছে৷ গাঁয়ের শাক লতাপাতা ও আজ অমিল৷ সবাই তুলে নিয়ে বাজারে বসে যায়৷ একদিন শীতের রাতে বিশু বিশু ডাকতে ডাকতে বিশুর মা চলে যায়৷ ছেলে থাকতে সবকাজ নাতিরা করে৷ দিন চলে যায়৷ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেই শিউলি মায়ের পাশে দাঁড়ায়৷ দুটো ভাই কে খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে শিউলি দোকানে যায়৷ মা মেয়ে দুপুরে ফেরে৷ আবার বিকালে ভাইদের পড়ায়৷ রাতে সাইকেল নিয়ে মা কে বাড়ি নিয়ে আসে৷ কলেজ বেশ দুর৷ কলেজে আর পড়া হয়না শিউলির৷ রাস্তায় আজকাল ছেলে ছোকরারা টোন টিটকারি করে ৷ কেউ কেউ প্রেম প্রস্তাব দেয়৷ কিন্তু শিউলি বোঝে এসব শুধু মন ভোলানো৷ গরিবের মেয়েকে বিয়ে নয় সুবিধামতন সুযোগ নেবার ছল৷ মাঝে দুটো মাতাল, কুঁড়ে, দোজবরের সমন্ধ যে আসেনি তা নয়৷ অন্য সংসারে গিয়ে সেই তো খেঁটে খেতে হবে তারথেকে ভাই দুটিকে মানুষ করা বেশী ভালো৷ একদিন রাতে চালে ঢিল পরে৷ কে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে৷ শম্পা ঘাস কাটার হেঁসো নিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ায়, ছায়া গুলো সরে যায়৷ আজকাল সবসময় হেঁসো রেখে দেয় কাছে শম্পা৷ ভাই দুটি স্কুল থেকে সাইকেল পেয়েছে৷ শিউলি খুব খুশি৷ আস্তে আস্তে বাবার দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলেছে ভাই বোন৷ শম্পা বুক আগলে বাচ্চা গুলোকে মানুষ করছে৷

একদিন গাঁয়ের প্রাইমারী স্কুলের জিতেন মাষ্টার আসে শম্পার কাছে৷ সাথে একটি অল্প বয়সী ছেলে৷ ছেলেটা গাঁয়ে কি কাজে এসেছে জানেনা শম্পা৷
কদিন ধরে চায়ের দোকানে আসে৷ জিতেন মাষ্টার কে বসতে বলে শিউলিকে বলে চা চাপাতে৷ বলেন স্যার৷
-বৌমা৷ বিশুর তো কোন খবর নেই ৷
-না স্যার, কপূরের মতন উবে গেলো জলজ্যান্ত একটি মানুষ ৷
-কি করবে? ভাগ্য৷ এ হচ্ছে নিতিন৷ খুব ভালো ছেলে৷ গাঁয়ে এসেছে কাজ করতে৷
-গাঁয়ে কি কাজ করবে স্যার?
-এরা সমাজসেবা করে৷ এখানকার অবস্থা লিখবে৷ পরিবেশ দেখবে৷
-ও৷
-বলছি জানো তো আমি থাকি এজমালি বাড়িতে৷ নিজে বিয়ে থা করিনি৷ বড় বৌদি দুটো খেতে দেয় দুবেলা৷ তারও বাতের সমস্যা৷ থাকিও ছোট্ট একটা ঘরে৷ ছেলেটা কমাস থাকবে৷ তোমাদের তো ঘর ফাঁকা আছে, যদি ভাড়া দাও তো আমার সুবিধা হয়৷
স্যার আপনি বলছেন সে তো ঠিক৷ কিন্তু আমিও তো!

-কোন চিন্তা নেই বৌমা৷ নিতিন কে তুমি আমার ভরসায় থাকতে দাও ৷ ওপাশে যে খোপটায় বিশুর মা থাকতো সেইখানে৷ বাইরে দিয়ে একটা দরজা ফুটিয়ে নিলেই হবে৷
-আপনার কথা অমান্যি তো করতে পারিনা৷ ঘরে বয়স্থা মেয়ে আছে৷ তা বাবা তুমি থাকো কিন্তু আমরা খুব গরিব, যা শাক ভাত হয় তাই দিতে পারবো৷
-সে নিয়ে চিন্তা করবেন না কাকিমা ৷ আমার কোন অসুবিধা নেই ৷
-হ্যাঁ ঘরের ভাড়া আর খাই খরচটা তুমি ঠিক করে নিও ৷
-সে আপনি যা দেবেন৷ আমি কি বলবো৷ সব তো আপনার সামনে৷
-আচ্ছা আচ্ছা ৷ নিতিন আপাতত হাজার পাঁচেক টাকা তুমি বৌমা কে দাও ৷ ঘরটা একটু ঠিকঠাক করে চালাক৷
-দুদিন পর নিতিন থাকতে আসে শম্পাদের বাড়িতে৷
আসলে শম্পার ইচ্ছা না থাকলেও জিতেন মাষ্টার কে গাঁয়ে সব খুব মান্য করে৷ আর কটা তো মাস৷ বরঞ্চ শক্ত একটা ছেলে থাকলে অনেক ভয় কম৷
দোকান থেকে ফিরে শম্পা দ্যাখে, নিতিন ছেলে দুটোকে পড়াচ্ছে ৷ শিউলি নিতিন কে এড়িয়ে চললেও তারও ভালো লাগে৷ কদিনেই দুটো ছেলে নিতিনের ন্যাওটা হয়ে ওঠে৷ গাঁয়ে কানাঘুষো হলেও জিতেন স্যারের জন্য কেউ সামনে কিছু বলেনা৷ ছেলেটি কি করে শম্পা বোঝেনা৷ দুবেলা যা রান্না করে হাসি মুখে খায়৷ বাবা মা নেই , দাদা বৌদি সব কোলকাতায় থাকে৷ বিশুর ফটো দিয়ে নিতিন কে বলেছে যদি কোনদিন খোঁজ পায়৷ আস্তে আস্তে সময় কেটে যায়৷ শিউলি এখন পুরো দোকান সামলায়৷ আর স্বপ্ন দ্যাখে৷
নিতিন কে কবে যে শিউলির ভালো লেগে গেছে শিউলি জানেনা৷ খুব সাহসী আবার কত ভিতু৷ যেমন সেদিন হঠাৎ পিছনের ডোবায় মাছ ধরার সময় নিতিনের গায়ে জোঁক বসে৷ কি লাফ নিতিনের৷ শিউলি ধমক দিয়ে, তারপর লবন ডলে দেয়৷ এদিকে ভাইদের কত গল্প করে৷ কত যুদ্ধ, বিপ্লব৷ রুশ বিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব আর জোঁকে ভয় পায়৷

বড় মুরগীটার কুট্টি কুট্টি বাচ্চা গুলোকে ধরতে ভয়৷ বড় ভিতু৷ কিন্তু মুখে শুধু লেকচার ৷ শিউলিও শোনে৷ কোন দেশে কত অবিচার হচ্ছে ৷ কোথায় সিরিয়া কোথায় চিন৷কত আলোচনা৷ ভাইদের গল্প বলে৷ বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে৷ সবাই সমান হবে৷ আর কোন গরিব বড়লোক থাকবে না৷ পাগল আছে সামান্য৷ তারমানে ভোলা ঠাকুর আর আমরা এক হয়ে যাবো? আমাদের ছুঁলে স্নান করে পুরহিত৷ সবাই খুব মানে ভোলা ঠাকুর কে৷ পৃথিবীর সব টাকা, জমি, সবাই কে সমান ভাগ করে দিলেও কি সবাই সমান হয়ে যাবে? সবাই মেনে নেবে? হিন্দু মুসলিম, কত জাত কত কিছু৷ শিউলির মাথা ঘোরায়৷
ধুর সব সাম্য টাম্য বোঝেনা শিউলি, হ্যাঁ অবিচার বোঝে৷ কত অবিচার দ্যাখে৷ কত লোক চা খেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে যায়, চা ভালো হয়নি বলে৷ বাবা যাদের কাছে পয়সা পেতো সেগুলো দিতে চায়না৷ পাড়ার ময়না কে শশুরবাড়ি থেকে দিয়ে গেছে দুটো মেয়ে হবার জন্য৷ কত অবিচার৷ কিন্তু নিতিন কিসের কথা বলে সেটা বোঝেনা শিউলি৷ সবাই সমান কোনদিন হয়? শুধু জানে জীবনে কিছু ছিলোনা এখন যেন সবকিছু আছে৷ আস্তে আস্তে নিতিনের সাথে অল্প অল্প কথা হয় শিউলির৷

নিতিন কি করে বোঝেনা শিউলি মাঝে মাঝে চলে যায়৷ তখন মন খারাপ হয়ে যায়৷ যদি আর না আসে? কিন্তু কিছুদিন বাদে কাঁধে ঝোলা নিয়ে আবার হাজির হয়৷ ঘরভাড়া আর খাওয়া খরচ দেয় নিয়মিত৷ যদিও টাকাটা শম্পা গুছিয়ে রাখে৷ মেয়েটার যে কি গতি হবে ভেবে ভেবে শরীরে অসুখ দানা বাঁধতে থাকে৷ ছেলেদুটো কে পড়াতে হবে৷ কত দায় যে লোকটা দিয়ে গেলো শম্পা কে৷ তবুও এই প্রতীক্ষা আরও কষ্টকর৷ হঠাৎ কেউ আসলে মনে হয় ফিরে আসলো বোধহয়৷ এরমধ্যে বিশুর এক দুর সম্পর্কের দিদি হঠাৎ একদিন পাশের গাঁয়ের থেকে শিউলির জন্য সমন্ধ নিয়ে হাজির৷

ছেলের দোকান আছে৷ দেনা-পাওনা তেমন নেই৷ শুধু বয়েসটা একটু বেশী৷ শম্পা তো এক কথায় রাজি৷ নিজের শরীর ভালো যাচ্ছে না৷ ছেলে দুটো বড় হয়ে উঠছে, খুঁটে খেতে পারবে৷ শম্পা না থাকলে মেয়ের কি হাল হবে ভাইদের সংসারে ভাবতে পারেনা৷ পিসি কথা বলে চলে যায়৷ সামনের রবিবার আসবে ছেলে৷ শিউলি বেঁকে বসে৷ কিছুতেই বিয়ে করবে না৷ ভাইদের কে দেখবে? মায়ের শরীর ভালোনা৷ শম্পা অনেক বোঝায়৷ শেষে নিতিন কে গিয়ে ধরে৷ নিতিন কি বলবে ভেবে পায়না৷ মেয়েটা বড় সরল৷ সন্ধ্যেবেলা দুটি ভাই কে পড়া দিয়ে নিতিন ডাকে, শিউলি…।
শিউলি নোখ খুঁটতে খুঁটতে দাঁড়ায় দেয়াল ঘেষে৷
তোমার মায়ের বয়স হয়েছে৷ পাত্র ভালো হলে বিয়ে করতে আপত্তি কিসের? শিউলি কিছু বোবাকান্না নিয়ে শুধু নিতিনের দিকে৷ নিতিন চমকে ওঠে৷ আবছা আলোয় শিউলির চোখে একরাশ প্রশ্ন দেখে, নিতিন সে রাতেই শম্পার সাথে দোকানে দেখা করে চিরকালের মতন গাঁ ছেড়ে চলে যায়৷ সকালে শম্পা শিউলি কে বলে, ছেলেটা পুরা আলগা পাগলা, কাল দোকানে এসে বললো, কাকিমা চললাম৷ আর হয়ত দেখা হবেনা৷ আপনার পাওনা টাকাটা দিতে আসলাম৷ সবাই ভালো থাকবেন৷ শিউলি কে বলেছি, ও ঠিক বিয়ে করবে৷ আমিও বললাম, বাবা তুমি থাকলে খুব কাজে সুবিধা হতো৷ তা বললো, তার নাকি মস্ত কাজ পড়েছে৷ যাইহোক, ছেলেটা মন্দ না৷ মন খুব ভালো ৷ কিছু টাকা বেশী দিয়ে গেছে তোর বিয়ের উপহার হিসাবে৷

শিউলি মনে মনে বলে, তোমার কোন অধিকার নেই আমার হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার৷ আমি তোমায় বলিনি তোমাকে ভালোবাসি৷ মা কে বলে, তুমি যদি চাও আমিও বাবার মতন হারিয়ে না যাই তো আমার বিয়ের কথা ভেবেনো৷ সবকথা এখানেই চাপা পড়ে যায়৷ শম্পা আর কিছু বলতে সাহস পায়না৷ দিনকাল পাল্টে গেছে৷ আজকাল সেই দাবড় থাবড় দেবার যুগ নেই৷ এই ঘটনার ছমাসের মধ্যে শিউলি নিতিন সম্পর্কে জিতেন মাষ্টারের কাছে কিছু কিছু শুনেছে৷ জিতেন মাষ্টার জানেনা নিতিন কোথায় গেছে৷ তবে শিউলি বোঝে জিতেন স্যার সবটুকু বলেন না৷ শিউলি ঠিক করে সে বিয়ে করবে না৷ একদিন সেও নিতিনের মতন কাজ করবে৷ দেখতে দেখতে সময় বয়ে যায়৷ দুটো ভাই পাশ করে৷ শুধু দোকানের আয়ে চলবে না সংসার, দুটো ভাইয়ের পড়াশুনা৷ এক ভাই দোকানে মায়ের সাথে কাজ শুরু করে৷ আর পনেরো মিনিটের ছোটো ভাই বাসু কলেজে ভরতি হয়৷ শিউলি নিতিনের দেওয়া টাকায় দুটো মেসিন কিনে কাজ শুরু করে বাড়িত৷ ময়না আর শিউলি৷ দুজনে স্বপ্ন দ্যাখে ছোট্ট একটা কারখানা করার৷ ভাই দোকানে বসাতে দোকানে অনেক হাল ফিরে আসে৷ কবছরে বাজারও বড় হয়েছে৷ খদ্দের বেড়েছে৷ নতুন করে দোকানটা সাজিয়ে নিয়েছে রাসু৷

আস্তে আস্তে শম্পা দোকানে আসা কমিয়ে দেয়৷ ক’বছরের লড়াই তে মন শরীর দুটোই ক্লান্ত৷ বরঞ্চ বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে৷ দুটো ভালো মন্দ রান্না করে ছেলে মেয়েকে দিতে পারে৷ ছেলে খুব বড় না হলেও বেশ চালাক চতুর দোকান ঠিক সামলে নিয়েছে৷ আবার গাঁয়ের নেতা মাতব্বরের সাথে খাতির করে দোকানটা যাতে বজায় থাকে৷ শম্পা কিন্তু নিশ্চিত হতে পারেনা৷ যতই সচ্ছলতা আসুক, মায়ের মন সবসময় শিউলির জন্য চিন্তায় ডুবে থাকে৷ মেয়েকে জোর করতে পারেনা কিন্তু বিয়ের জন্য ভাবে৷ শিউলি এখন সাবলম্বী, ছোটো ভাইয়ের পড়াশুনা চালায়৷ আরও দুটো মেসিন তুলে গাঁয়ের আরও দুটো মেয়েকে কাজে নিয়েছে৷ ঠিকাদার ঠকায় কিন্তু তবুও চলে যায়৷ ছোটো ছেলে কলেজ পাশ করলে, শম্পা নিজে দেখে রাসুর বিয়ে দেয়৷ বাসু চলে যায় কোলকাতা৷ শম্পার মনে আজও আশা যদি বাসু খুঁজে পায় বাবাকে৷ সময়ের গতিতে শম্পার বয়স হয়, শরীর ভাঙতে থাকে৷ সবাই বলে শাঁখা সিঁদুর মুছে ফেলতে৷ অনেক বছর তো হলো৷ কিন্তু শম্পা মোছেনা৷ শিউলি নিজে কোলকাতা থেকে মাল আনা শুরু করে৷ ছোটো ভাই সব যোগাযোগ করে দেয়৷ শিউলি নিজের ছোটো কারখানা নিয়ে ব্যস্ত থাকে৷ জীবনের সব সখ আল্হাদ সে আরও কয়েকটা মেয়ের জীবনের ভিত কে মজবুত করতে মুছে দিয়েছে৷ দুই ভাই বোন মিলে বাড়িঘর করেছে৷ শিউলির কারখানার জন্য লম্বা টিনের ঘর বাড়ির পিছনে বানিয়ে নিয়েছে৷

জীবনের অনেক না পাওয়া থেকে নিজের পাওনা গুলো আদায় না করতে পারুক লড়াই করে গেছে৷ জিতেন মাষ্টার কে হঠাৎ একদিন পুলিসে ধরে নিয়ে যায়৷ জানা যায় তিনি নাকি মাওবাদী৷ শিউলি বোঝে কেন নিতিন চলে গিয়েছিলো৷ শুধু বোঝেনা মাঠে ঘাটে ঘুরে কজন নিয়ে কি বিপ্লব সে করবে৷শিউলি বোঝে না, বুঝতেও চায়না৷ হয়ত হয় হয়ত হয়না৷ নিজের স্বল্প বুদ্ধিতে বোঝে জীবন বড় বাস্তব বড় কঠিন৷ নিজে এগিয়ে গিয়ে আর দুজন কে পথ দেখানো কম বিপ্লব না৷ আজ ময়নার মেয়েরা পড়াশুনা করে৷ সতেরো বছরের রানি বাড়িতে বলে দিয়েছে, সে পড়বে বিয়ে করবে না৷ লতা নিজের ছেলের জন্য কাজ করে পয়সা জমায়৷ এটাই জীবন যা চলবে বাকি বিপ্লব হয়ত কোনদিন আসবে৷ হয়ত আসবে না নিতিনের মতন৷ একদিন হঠাৎ করে শম্পা চলে যায়৷ দুই ভাই কাজ করে মা বাবার একসাথে৷ একটা অপেক্ষা চিতায় গিয়ে শেষ হয়৷ আর শিউলির জীবনের অপেক্ষা রয়ে যায় সবার অজান্তে৷

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত