কল্যাণ কুন্ডু
ডিসেম্বরের রাত। আমরা তখন দানেশ সেখ লেনের সরকারী আবাসনে থাকি। ঘুমটা সবে ধরেছে কি ধরে নি, তীব্র একটা ধাতব শব্দ। ধড়পড়িয়ে উঠে বসলাম বিছানায় । লেপ কম্বল সরিয়ে উঠতে যাবো। এমন সময় আবার। কিসের আওয়াজ বোঝার চেষ্টা করলাম। ধাতব অনুরণন থামাতেই মনে হলো বাইরের ল্যাম্প পোষ্টে কেউ রডের বাড়ি মারছে। শব্দের তীব্রতায় আমাদের দেড় বছরের গোগোল ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছে। তানিয়াও ঘুম থেকে উঠে বসেছে। হতচকিত। দ্রুত খাট থেকে নেমে ব্যালকনির দরজা খুললাম।
-কে? কড়া গলায় হাঁক দিলাম।
-ম্যায় সাব। উত্তর এলো।
দেখি একটা শীতের জ্যাকেট আর মাঙ্কিক্যাপ পরা, পাঁচ সেলের টর্চ গলায় ঝোলানো পাঁচ ফুটিয়া লোক। হাতে একটা চার ফুটের টেন এম এম লোহার রড। গলার আওয়াজটা চেনা চেনা। তাও আবার জিঞ্জাসা করলাম,
-কৌন?
-ম্যায় রাম বাহাদুর, সাব।
নাম আর দন্তস্যর উচ্চারণের বিশেষত্বে বুঝতে অসুবিধা হলো না লোকটি আমাদের আবাসনের নেপালি পাহারাদার। ভীষন রাগ হলো। আরো কড়া গলায় বললাম,
-পাগল হো গ্যায়া ক্যা? ইতনা রাত মে পোষ্ট মে কিউ ডান্ডা পিট রহে হো?
ততোধিক পোলাইট সুরে বাহাদুর বললো,
-আপ নে তো আওয়াজ দেনে কে লিয়ে বোলা, সাব।
চড়াম করে মাথায় রক্ত উঠে যাওয়ার জোগাড়।
নিজেকে যতটা পারা যায় সংযত করে বললাম
-ফাজলামি হচ্ছে? আমি রাত একটায় তোমাকে ইলেকট্রিক পোলে ডান্ডা পেটাতে বলেছি?
কুঁইকাঁই করে আধা হিন্দী আধা নেপালি তে কি যে বললো সবটা বুঝলাম না। মনে পড়লো, আজ সকালেরই কথা। সকালে যখন মাসের টাকা কালেকশন করতে এসেছিল রাম বাহাদুর। প্রশ্ন করে ছিলাম, কি রকম পাহারা দাও। কোন সাড়া শব্দ পাই না। আওয়াজ করবে তো।
নিজের কথায় শীতের রাতে এরকম গুতো খেতে হবে স্বপ্নেও ভাবি নি। পাহারার সময় বাহাদুরের আওয়াজ দেওয়ার বুদ্ধি দেখে রাগ গলে জল হয়ে গেলো। হাসিও পেলো। কোন রকমে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম,
-ম্যায় নে এইস্যা কর কে আওয়াজ দেনে কো কাহা থা? হুইস্যাল নেহী হ্যায় তুমহারা পাস?
-নেহী সাব, হুইস্যাল নেহী রাখতা সাব।
-কাল দুকান সে খরিদ লে না। আউর শুনো, ফির কভী এইস্যা পোল ঠোক না নেহী।
-জী সাব।
-চলো, রাউন্ড মে যাও।
-জী সাব। হাতের রডটা রাস্তায় ঠুকতে ঠুকতে পাশের কোয়াটার্সের দিকে চলে গেল রাম বাহাদুর।
ঘুম চটকে আলুর দম। একফালি ব্যালকনিতে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলাম। সামনের লাইট পোষ্টে হ্যালোজেন-টা বেশ কিছুদিন ধরে জ্বলছে না। দূরের পোষ্টে, টিউবের আলোটাও ম্যাজমেজে। একটু একটু কুয়াশা জমেছে বাতাসে। সামনের তেঁতুলগাছটায় বকের ডানা ঝাপটানো আর থেকে থেকেই কর্কশ ডাক শীতের নিরবতা বিঘ্নিত করছে।রোজিদের সুপারি গাছগুলোর ফাঁকে জেগে রয়েছে আধখানা চাঁদ। পূর্ণিমা থেকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে এগোচ্ছে অমাবস্যার দিকে। আলো আধাঁরের আবছায়ায় কোয়াটার্সের মাঠ যেন প্রেতপুরী। শীতের চোটে কুকুর গুলোও সিঁড়ির তলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। শুনশান আবাসনে কেউ হয়তো জেগে নেই। নিঃঝুম প্রকৃতি, ছমছমে পরিবেশ।বেশ রোমাঞ্চকর একটা অনুভূতি হচ্ছে। দিনের বেলাতেই আমাদের আবাসন নীরবতায় মোড়া থাকে। আর রাত্রে তো কথায় নেই। একমাত্র পীচের রাস্তায় বাহাদুর লোহার রডে ঠন্ ঠন্ শব্দ করে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে পায়চারি করে ফেরে।
-কি হলো শোবে না? বউয়ের ঘুম জড়ানো গলায় ডাকাডাকিতে হুস ফিরলো। বিছানায় এসে সটান লেপের তলায়। সারা শরীর ঠান্ডায় কেমন একটা কাঁপুনি ধরলো।
চাকরীর এক-দেড় বছরের মাথায় কোয়াটার্স পেলাম। ২০০৪ সাল। বনান্ত সরকারি আবাসনে বছর খানেক হলো এসেছি। ইতিমধ্যে পরিচিতি বেশ ভালোই হয়েছে। আবাসিকরা সবাই সরকারি কর্মচারী। আবাসনের আবাসিক সমিতিতে যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেন মহানন্দ বাবু।
-ইয়াংম্যান। তোমরাই তো হাল ধরবে। আমাদের বি, এস ব্লকেই থাকতেন। ওনার কথা ফেলতে পারলাম না।
আবাসিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক হওয়ায় বেশ কিছু বিষয়ে দেখাশোনার কাজ আমার উপর বর্তালো। রাম বাহাদুরদের যাতায়াত বেড়ে গেল আমার কাছে। মোট দুজন পাহারাদার। আমার কথা মতো রাত্রে এখন হুইস্যাল বাজিয়ে পাহারা দেয়। আবাসিক সমিতির সিদ্ধান্তে প্রতিমাসে ফ্লাট পিছু পনের টাকা করে কালেকশন করে পাহারা দেওয়ার জন্য। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচশো-ছয়শো ফ্লাট। মোট সাত- আট হাজার টাকা মাসিক আয় হতো দুই বাহাদুরের। বছর পাঁচ ছয় ধরে এই কাজ করে আসছে।
সমিতিতে আলোচনা করে পাহারার ব্যাপারে বেশ কয়েকটি নিয়ম চালু হলো। এলাকা ভাগ করে দিলাম দুই জনের। তেগ বাহাদুরের জন্য বনান্তের পুজোর মাঠ থেকে উত্তরে এ-টাইপ এবং সি-টাইপ কোয়াটার্স এবং রাম বাহাদুরের জন্য দক্ষিণে র বি ও ডি-টাইপ কোয়াটার্স।আর একটা মেজর সিদ্ধান্ত পাশ করালাম। বাহাদুরের জন্য কোয়াটার্স পিছু মাসে কুড়ি টাকা। জিনিস পত্রের অগ্নিমূল্যের বাজারে এটাও যৎ সামান্য। এই সিদ্ধান্তে দারুণ খুশী হলো রাম বাহাদুর। রাস্তায়, বা বাজারে যেখানেই দেখা হোক, সেলামের ঘন-ঘটাতেই বুঝতাম।
আমি থাকতাম গ্রাউন্ড ফ্লোরে। একতলায়।মাঝে মধ্যে আবার রাতের বেলা ব্লকের সামনে এসে আমাকে ডাকাডাকি করতো রাম বাহাদুর। কোন অপরিচিত সন্দেহজনক কাউকে দেখলে এসে রিপোর্ট করতো। এমনও হয়েছে যে পুলিশী ইন্টারভেনশনের প্রয়োজন পড়েছে। ছিচকে চোরের দল মাঝে মাঝে হানা দিত আবাসনে। বাহাদুরের দাপটে খুব একটা সুবিধা করতে পারতো না। দলগত ভাবে দু’এক বার শারীরিক আক্রমণ করেনি, এমন নয়। কোন ভাবেই হারাতে পারেনি রাম বাহাদুরকে। নির্ভীক মানুষটা নিজের ডিউটি পালনে হুইস্যাল দিতে দিতে টহল দিতো রাস্তা বরাবর। প্রতিদিন রাত এগারোটা থেকে ভোর ছ’টা পর্যন্ত। সারারাত যদি কোন দিন ঘুম আসতো না, রাম বাহাদুরের বাঁশীর শব্দ কানে আসবেই আসবে।
শীত পার হয়ে গ্রীষ্ম, গ্রীষ্ম পার হয়ে বর্ষা, রাম বাহাদুরের হুইস্যাল খুবই নিয়মিত। রাত্রের আবাসনে নির্ভরতার প্রতীক। মাসিক অনুদান কালেকশন করার সময় অনুযোগ জানাতো রাম বাহাদুর। অনেক ফ্লাট থেকে নিয়মিত কুড়ি টাকাও দেয় না। দেশে বুড়া মা বুখার আছে। টাকা না পাঠালে দাওয়াই জুটবে না। সরকারী কর্মচারীদের মাস পার হলেই তনখা মিলে। আর বাহাদুরের সামান্য কুড়িটাকা দিতে দশ বার ঘোরায়। এসব শুনে খারাপ লাগতো। কিছু কিছু আবাসিকের এরকম আচরণের কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সমিতির মিটিং-এ ব্যাপারটা আলোচনা করার কথা বলে রাম বাহাদুরের অনুযোগ লাঘবের চেষ্টা করতাম। সেবার জুলাই মাস। ঘোরতর বর্ষা। রাম বাহাদুরের হুইস্যাল রাত্রিতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর শুনতে পেতাম। তবে, লক্ষ্য করতাম আর আগের মতো রিপোর্টং করতে আসে না রাম বাহাদুর। আরও অবাক হলাম আগষ্টের প্রথম দু সপ্তাহে। মাসের টাকাটাও কালেকশনে আসেনি রাম বাহাদুর। আগষ্ট গেল, সেপ্টেম্বর গেল রাম বাহাদুরের টাকা দুমাস দেওয়া বকেয়া। নিতেই আসে না।
ঠিক করলাম আজ রাতে পাহারার সময় ডেকে জিজ্ঞেস করবো। সামনে পুজো। পুজোর মাসে অতিরিক্ত কুড়িটাকা দিই। প্রায় ষাট টাকা বাকী পড়ে আছে। অভিমান হলো নাকি লোকটার? পাহার দেয় অথচ টাকা নিয়ে যাচ্ছে না। রাত্রে ব্যালকনিতে অনেক্ষন অপেক্ষায় থাকলাম। রাত গভীর হয়ে আসছে। বর্ষার রেশ তখনো রয়েছে। আকাশে টুকরো টুকরো বাদুলে মেঘ। হঠাৎ রিমঝিমিয়ে বৃষ্টি নামলো। সামনের মাঠে ব্যাঙেদের কর্নসাট। ঝিল্লির সঙ্গত। শুনশান আবাসনের রাস্তায় রাম বাহাদুরের দেখা পেলাম না। দূর থেকে শুধু হুইস্যালের শব্দ ভেসে আসছে। কিছুতেই রাম বাহাদুরের দেখা পেলাম না। খানিকটা রাগই হলো। জহন্নামে যাক। যেদিন পেটে টান পড়বে, আসবে। ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে বিছানায় গেলাম।
দুর্গা পুজো এসে গেল প্রায়। বাহাদুরের সাথে যোগাযোগ করতেই হবে। রাতে পুজোর প্যান্ডেলে পাহারায় থাকে ওরা-ই। সমিতির লোকজনও জানালো তেগ বাহাদুরের দেখা পেলেও রাম বাহাদুরকে দেখতে পাওয়া যায় না। বুধবার থেকে পুজো শুরু । আগের রবিবারে সমিতি অফিসে বসে আছি। হাজারো কাজ।প্যান্ডেল লাইট ডেকোরেশন এর কাজ চলছে পুজোর মাঠে। ষষ্ঠীর সকালে ঠাকুর আনা হবে। পুজো কমিটির লোকজন ভীষন ব্যস্ত। এমন সময় তেগ বাহাদুর এলো সমিতির অফিসে। সাথে এক অচেনা নেপালী লোক।
-সাব, মেরে কো বুলায়া?
-আরে হা, রাতমে প্যান্ডাল মে রহনা হোগা। রাম বাহাদুর কিধার হ্যায়? উসে আজ দো তিন মাস দেখাই নেহী দেতা? আমার প্রশ্নে তেগ বাহাদুর খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো।
-সাব, উসকি মা কা ইন্তেকাল হো গয়ী জুন মহিনা মে।
-তো, ফির! দেশ সে লওটা নেহী আজতক?
-ক্যায়সে লটেগা সাব, বো ভী…। চুপ করে যায় তেগ বাহাদুর।
-মতলব? ক্যা হুয়া রাম বাহাদুর কো?
অনেকক্ষণ চুপকরে থাকার পর তেগ বাহাদুর জানালো মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে রাম বাহাদুর রওনা হয় নেপালের উদ্দেশ্যে। দার্জিলিং থেকে নেপাল বাজার যাওয়ার পথে খাদে পড়ে যায় ওদের ট্রেকার। ষোলজন যাত্রী, কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। শ্মশানের নীরবতা সমিতি অফিসের ঘরে। কি বলছে বাহাদুর। গতকাল রাত্রেও বি-টাইপে হুইস্যালের শব্দ শুনেছি আমরা।
-সাব, এ ক্যায়সে সম্ভব? তেগ বাহাদুরের গলায় অপার বিষ্ময়। বিষ্মিত আমরা সবাই।
-তবে কি…! রাম বাহাদুর? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। বিগত দুই আড়াই মাস জল-ঝড়ের রাত্রে প্রতিদিন নিয়মিত হুইস্যাল বাজানোর শব্দ শুনেছি। কর্তব্যে কোন ঘাটতি নাই। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।
“স্রীফ বিশ রুপয়াকে লিয়ে” কে হুইস্যাল বাজায়?”
