হলদে পাখির পালক
০১. কত দেরি হয়ে গেল
কত দেরি হয়ে গেল ভুলো তবু বাড়ি এল না, সন্ধ্যে হয়ে গেল, রাত হয়ে গেল। দাদু তাস খেলতে যাবার আগে বললেন, খুঁজতে যাবার কিছু দরকার নেই, কেউ তোদের নেড়িকুত্তো চুরি করবে না, খিদে পেলে সুড়সুড় করে নিজেই বাড়ি ফিরবে দেখিস।
রুমুর গলার কাছটা কীরকম ব্যথা ব্যথা করছিল; কখন ভুলোর খাবার সময় হয়ে গেছে, বারান্দার কোনায় ভুলোর থালায় দুধরুটিগুলোকে নীলমতো দেখাচ্ছে, পিঁপড়েরা এসেছে।
জানলার শিকের সঙ্গে ভুলোর চেনের আগায় কলারটা আটকানো ছিল। খুব মজার দেখাচ্ছিল। ভারি দুষ্টু ভুলো। কলার আঁটবার সময় কান খাড়া করে গলা ফুলিয়ে রাখে; তারপরে যেই-না সবাই চলে যায়, কান চ্যাপটা করে, গলা সরু করে, কলারের মধ্যে থেকে সুড়ুত করে বেরিয়ে পড়ে দে ছুট।
কেন ভুলো পালিয়ে যায়?
দাদা চেন কলার আর একটা বেঁটে লাঠি হাতে নিয়ে গেটের কাছে দূরে রেলের লাইনের ওপারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রুমুকে দেখেই রেগে গেল।
যা, ঘরে যা, এখানে কেন এসেছিস? যা ভাগ।
দাদা, বোধ হয় সে সাঁওতাল গ্রামে গেছে। ওরা যদি মারে?
বেশ হবে, ঠিক হবে, আমি খুব খুশি হব, পালানো বেরুবে, আসুক-না বাড়ি, পিটিয়ে মজা বের কচ্ছি। যা, পালা, ছিঁচকাঁদুনে!
রুমু আবার পিছনের বারান্দায় গেল।
এমনি সময় ভুলো বাড়ি এল। অন্যদিনের মতো সামনের গেট দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে নয়। রান্নাঘরের পেছন দিয়ে, দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে ল্যাজ নামিয়ে, কান ঝুলিয়ে, আড়চোখে তাকাতে তাকাতে, স্রেফ একটা চোরের মতো এসেই রুমুর পায়ে মুখ রেখে ল্যাজ নাড়তে লাগল। রুমুর মুখে কথাটি নেই, গা শিরশির করতে লাগল। জানলা দিয়ে খাবার ঘর থেকে আলো এসে ভুলোর গায়ে পড়েছে, সেই আলোতে রুমু দেখতে পেল ভুলোর ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা হলদে পালক গুঁজে রয়েছে। সোনার মতো জ্বলজ্বল করছে।
রুমুর বুকটা ধড়াস করে উঠল, এক দৌড়ে দাদার কাছে গেল।
দাদা, ভুলোর ঠোঁটের কোনায় সেইরকম হলদে পালক।
যাঃ, দূর, হলদে পাখি ঝগড়ুর বানানো।
না, দাদা, তুমি দেখবে এসো।
কারো মুখে কথা সরে না। কোথাও একটু আওয়াজ নেই, শুধু মাথার উপর একটা রাতের পাখির ডানা নাড়ার ঝটপটি, আর দূরে কুসিদিদিদের পোড়ো জমির ঝাউ গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে শোঁ শোঁ করে বাতাস বইছে, আর রুমু বোগির বুকের ধুকপুকি। এবার তবে তো ঝগডু মিথ্যা কথা বলেনি। দারুণ গাঁজাখুরি গল্প বলে ঝগড়ু। দুমকায় ওদের গাঁয়ে নাকি হয় না এমন আশ্চর্য জিনিস নেই। সেখানে সীতাহার গাছের পিছনে সূর্য ডুবে গিয়ে যেই তার লাল আলোগুলোকে গুটিয়ে নেয়, অমনি নাকি আকাশ থেকে সোনালি রঙের অবাক পাখিরা বটফল খেতে নেমে আসে। তারা ডাকে না, কারণ তাদের গলায় স্বর নেই। তারা মাটিতে বা গাছের ডালে বসতে পারে না, কারণ তাদের পা নেই। এমনি উড়ে ফল খেয়ে আবার আকাশে চলে যায়। কিন্তু দৈবাৎ যদি একটা পাখির ডানা জখম হয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়, আর ঠিক সেই সময় যদি তাকে শেয়ালে কি কুকুরে খেয়ে ফেলে, তাহলে সেই শেয়াল কি কুকুর মানুষ হয়ে যায়। তাই শুনে বোগি বলেছিল, যাঃ, ঝগড়ু যত রাজ্যের বাজে কথা! জানোয়ার কখনো মানুষ হয়?
পণ্ডিতমশাইয়ের গিন্নি রোজ সন্ধে বেলায় দাদুর বাড়ির পাঁচিলের তলা থেকে আমরুল পাতা তুলতে আসেন। মাঝে মাঝে আমরুল তুলতে তুলতে চোখ উঠিয়ে রুমুকে বলেন, আয় তুলে দে, আমার গেঁটে বাত, এসব তোদের কচি হাড়ের কাজ। ততক্ষণে সূর্য তাল গাছের গুঁড়ির কাছে নেমে গেছে, ছায়াগুলো লম্বা হয়ে গেছে। পণ্ডিতমশাইয়ের গিন্নির চোখে আলো পড়ে, চকমকি পাথরের মতো ঝকঝক করে; পাটকিলে রঙের চোখের মণি, তার মধ্যে সোনালি রঙের সবুজ রঙের ডুরি ডুরি কাটা মনে হয়; মাথার কাপড় খসে যায়, ঝিনুকের মতো পাতলা কান, উপর-দিকটা গোল না হয়ে খোঁচামতন।
ও-রকম লোক এখানেও আছে।
দিদিমা এসে বলেন, ওঃ, চাঁদের তাহলে বাড়ি ফেরার মর্জি হয়েছে! কে জানে হয়তো এবার এ বাড়ির অন্য লোকদেরও পড়াশুনো খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি হবে। মেজো মামা সরভাজা এনেছে, জানিস তোরা?
ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ সরভাজা। রুমু তখুনি চলে গেল। বোগি অনেকক্ষণ ভুলোর নাক, মুখ, চোখ পরীক্ষা করে দেখল। কই, কিছু তো হয়নি। তারপর খুব আঁটো করে কলার লাগিয়ে সরভাজা দেখতে গেল।
রাতে শোবার সময় মশারি টানাতে টানাতে ঝগড়ু বলল, বোগিদাদা, ভুলো কিছু খেল না, চটের উপর শুয়ে খালি ঘুমুচ্ছে।
ঝগড়ু বলল, কে জানে, যা পাজি কুকুর, ঘরের ভাত মুখে রোচে না, কোত্থেকে কী খেয়ে এসেছে কে জানে!
বোগি শুধু বলল, থাক চেনে বাঁধা। আজ রাত্রে ছাড়িস না ওকে।
রুমু বলল, কিন্তু রাতে যদি ক্যাঁওম্যাঁও লাগায়? দাদু যদি রাগ করে?
ঝগড়ু, মশারির দড়িটাকে দাঁত দিয়ে কামড়ে টান করে ধরে, দু-হাতে গিঁট বাঁধতে বাঁধতে বলল, কম বদমাশ ওই কুত্তো! সব বাড়ির কুকুর সারাক্ষণ বাঁধা থাকে, আর এনাকে একটু বাঁধলেই পাড়া মাত করবেন! ইদিকে ছাড়লে আবার একে কামড়ে, ওকে কামড়ে একাকার করবেন!
রুমু বলল, আহা, রুটিওলা যে ওর ল্যাজ মাড়িয়ে দিয়েছিল।
তোমাদের দাদুর বন্ধু অনিমেষবাবুও ল্যাজ মাড়িয়েছিল?
বোগির বিরক্ত লাগছিল।দেখো ঝগড়ু, বাজে বোকো না। অনিমেষবাবু কালো জোব্বা গায়ে দিয়ে এসেছিলেন। জানোই তো কালো জোব্বা দেখলে ভুলো রেগে যায়।
বেশ, বোগিদাদা, বেশ! তোমাদের কুকুরের জন্য তোমাদের হাতে হাতকড়া পড়লে আমার আর কী হবে, বলো!
ঝগড়ু চলে গেলে, বোগি অনেকক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল। তারপর একবার উঠে, টেবিল থেকে টর্চটা নিয়ে, গুটিগুটি গিয়ে ভুলোকে দেখে এল। ভুলো নাক ডাকাচ্ছে!
আবার এসে শুতেই রুমু চাপা গলায় ডাকল, দাদা!
চুপ কর। ঘুমো। ঠিক আছে।
পরদিন সকালে দাঁত মাজতে মাজতে পিছনের বারান্দায় গিয়ে রুমু বোগি দেখে, জানলার শিকের সঙ্গে ভুলোর চেন বাঁধা, তার আগায় কলার আটকানো, কিন্তু ভুলো নেই।
নেই তো নেই। চা খেতেও এল না। বোগি সে-বিষয় কোনো কথা না বলে বাড়ির চারপাশটা একবার খুঁজে এল। রুমু রান্নাঘরের পিছনে ঝগড়ুকে একটু বলতে গিয়েছিল। ঝগড়ু চেঁচিয়ে মেচিয়ে এক কাণ্ড করে বসল। আমি যেতে পারি নেড়িকুত্তো খুঁজতে এই সাত সকালে, যদি তোমরা দুজন কুয়ো থেকে জল তুলে স্নানের ঘরের চৌবাচ্চা ভরে, রান্নাঘরের ট্যাঙ্কি ভরে, চারাগাছে জল দিয়ে–দিদিমাও রান্নাঘর থেকে ডেকে বললেন, আচ্ছা, নেড়িকুত্তো কখনো পোষ মানে শুনেছিস? হাজার চান করিয়ে, পাউডার মাখিয়ে, কানা-তোলা থালায় করে খেতে দিস, সেই এর বাড়ি ওর বাড়ি আঁস্তাকুড়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াবে–যা দিকিনি এখন, সকাল বেলাটা হল গিয়ে সংসারের চাকায় তেল দেবার সময়।
রুমু ঘরে ফিরে এল। বোগি কোলের উপর বই নিয়ে বসে আছে।
দাদা, হলদে পালকটা দেখি।
অদ্ভুত পালকটা। অন্য পালকের রোঁয়াগুলো একসঙ্গে সেঁটে মোলায়েম হয়ে থাকে। হলদে পালকটার রোঁয়াগুলো কোঁকড়া, রোদ লেগে ঝকমক করছে, হাওয়ায় ফুরফুর করছে। গোড়াটা সাদা কাচের একটা ফুলের মতো।
রুমুর একটু ভয় ভয় করতে লাগল। এমনি সময় ওরা হাসিটা শুনতে পেল। ঝগড়ুর ঘরের ওদিক থেকে খিলখিল করে কে হাসছে। বোগি রুমু তখুনি এক দৌড়ে সেইখানে।
ঝগড়ুর বউ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেটাকে টপ করে কোলে তুলে নিয়ে বলল, আমার ভাইয়ের ছেলে, এখেনে কয়েক দিন থাকবে। তোমাদের এখন পড়ার সময় না?
রুমু জিজ্ঞেস করল, কখন এল? কাল তো ছিল না। কোত্থেকে এল?
বউ বলল, আজ ভোরে এসেছে দুমকা থেকে। তোমরা যাও, তোমাদের দিদিমা রাগ করবে। চাকর-বাকরদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা ভালো নয়।
বোগি দাওয়ার উপর বসে পড়ল। কেন ভালো নয়?
বউ একটু রেগে গেল। দেখ, বোগিদাদা, এখন আমার রাঁধাবাড়ার সময়। অন্য সময় এসো।
ছেলেটাকে দাও, এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।
অ মা! ছেলে নিয়ে তুমি কী করবে?
না দিলে কিছুতেই যাব না।
ঝগড়ুর বউ রেগেমেগে দুম করে ছেলেটাকে মাটিতে বসিয়ে দিয়ে ঘরে চলে গেল।
বোগিও অমনি তাকে তুলে নিয়ে দে দৌড়।
বারান্দায় তাকে ছেড়ে দিতেই সে হামাগুড়ি দিয়ে সটান ভুলোর থালার কাছে গেল। তারপর খালি থালা দেখে তার রাগ দেখে কে!
রুমু একটু রুটি এনে দিতে তবে থামল। বোগি আস্তে আস্তে ডাকল, ভুলো, ভুলো, ভুলো!
ছেলেটা খিলখিল করে হেসে, হামা দিয়ে কাছে এসে, ভিজে ভিজে জিব দিয়ে বোগিকে চেটে দিল।
রুমু কাঁদতে লাগল। গোলমালের মধ্যে ঝগড়ু এসে ছেলেটাকে বারান্দা থেকে নামিয়ে মোমলতার তলায় ছেড়ে দিল।
তোমরা এইখেনে খেলা করো দিদি। বারান্দার উপরে দিদিমা দেখলে রাগ করবে।
অমনি যেন নিশানা পেয়ে হাঁসের ঝাঁক একসঙ্গে আকাশে উড়ে পড়ে। আকাশের দিকে দুই হাত তুলে ছেলেটা কাঁদতে থাকে।
রুমু বলল, দাদা, আগেই তো ভালো ছিল।
বোগি ছেলেটাকে খুব আস্তে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলে, কেন খেইছিলি হলদে পাখি? কে বলেছিল খেতে?
ছেলেটার কান্না থেমে যায়, এই বড়ো বড়ো ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে।
রুমু হঠাৎ উঠে পড়ে, ওকে বুকে জাপটে ধরে একেবারে ঝগড়ুর ঘরে বউয়ের কাছে দিয়ে আসে।
বউয়ের হাঁড়িতে টগবগ করে ভাত ফুটছে, বুদবুদ উঠছে, ফেটে যাচ্ছে, ফুটন্ত জল ছিটুচ্ছে, বউ ভারি খুশি!
কী, এরই মধ্যে শখ মিটে গেল? আগেই জানি।
ওখানে আর দাঁড়ানো নয়। ঘরে এসে দেখে বোগি পালকটাকে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলেছে। বোগি বলল, ধেত। নেড়িকুকুর পুষতে হয় না। ওদের জাত খারাপ, পোষ মানে না, যা-তা খায়। তার চেয়ে বিলিতি কুকুর ঢের ভালো। সেজো মামা একটা দেবে, চাইলেই দেবে। তার জন্য নতুন লাল কলার কিনব। এটাকে ফেলে দে।
রুমু অমনি জানলা গলিয়ে কলারটা বাইরে ফেলে দিল। নেড়িকুত্তোর কলার আবার কে পরবে?
বোগি উঠে দাঁড়াল।
দেখ রুমু, তারপর যদি কখনো ভুলোটা ফিরে আসে, খবরদার ঢুকতে দিবিনা কিন্তু। ঠেলে বের করে দিবি।
দাদা, ভুলোকে ঠেলে দিলে যে আবার দৌড়ে দৌড়ে ফিরে আসে! মনে হয় ঠেলে দিলে খুশি হয়।
তা হলে বেঁটে লাঠি দিয়ে মেরে তাড়াবি।
ওকে মারলে ও নিশ্চয় আমাকে কামড়ে দেবে। কক্ষনো যাবে না। দেখ, কলারটা বরং আবার তুলে নিয়ে আয়। ছেলেটার গলায়ও মন্দ দেখাবে না। ও কী, এ-সময়ে শুয়ে পড়লি যে? সর, আমিও সোব, আমার শরীর খারাপ লাগছে।
০২. নেই তো নেই
নেই তো নেই। চা খেতেও এল না। বোগি সে-বিষয় কোনো কথা না বলে বাড়ির চারপাশটা একবার খুঁজে এল। রুমু রান্নাঘরের পিছনে ঝগড়ুকে একটু বলতে গিয়েছিল। ঝগড়ু চেঁচিয়ে মেচিয়ে এক কাণ্ড করে বসল। আমি যেতে পারি নেড়িকুত্তো খুঁজতে এই সাত সকালে, যদি তোমরা দুজন কুয়ো থেকে জল তুলে স্নানের ঘরের চৌবাচ্চা ভরে, রান্নাঘরের ট্যাঙ্কি ভরে, চারাগাছে জল দিয়ে–দিদিমাও রান্নাঘর থেকে ডেকে বললেন, আচ্ছা, নেড়িকুত্তো কখনো পোষ মানে শুনেছিস? হাজার চান করিয়ে, পাউডার মাখিয়ে, কানা-তোলা থালায় করে খেতে দিস, সেই এর বাড়ি ওর বাড়ি আঁস্তাকুড়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াবে–যা দিকিনি এখন, সকাল বেলাটা হল গিয়ে সংসারের চাকায় তেল দেবার সময়।
রুমু ঘরে ফিরে এল। বোগি কোলের উপর বই নিয়ে বসে আছে।
দাদা, হলদে পালকটা দেখি।
অদ্ভুত পালকটা। অন্য পালকের রোঁয়াগুলো একসঙ্গে সেঁটে মোলায়েম হয়ে থাকে। হলদে পালকটার রোঁয়াগুলো কোঁকড়া, রোদ লেগে ঝকমক করছে, হাওয়ায় ফুরফুর করছে। গোড়াটা সাদা কাচের একটা ফুলের মতো।
রুমুর একটু ভয় ভয় করতে লাগল। এমনি সময় ওরা হাসিটা শুনতে পেল। ঝগড়ুর ঘরের ওদিক থেকে খিলখিল করে কে হাসছে। বোগি রুমু তখুনি এক দৌড়ে সেইখানে।
ঝগড়ুর বউ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেটাকে টপ করে কোলে তুলে নিয়ে বলল, আমার ভাইয়ের ছেলে, এখেনে কয়েক দিন থাকবে। তোমাদের এখন পড়ার সময় না?
রুমু জিজ্ঞেস করল, কখন এল? কাল তো ছিল না। কোত্থেকে এল?
বউ বলল, আজ ভোরে এসেছে দুমকা থেকে। তোমরা যাও, তোমাদের দিদিমা রাগ করবে। চাকর-বাকরদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা ভালো নয়।
বোগি দাওয়ার উপর বসে পড়ল। কেন ভালো নয়?
বউ একটু রেগে গেল। দেখ, বোগিদাদা, এখন আমার রাঁধাবাড়ার সময়। অন্য সময় এসো।
ছেলেটাকে দাও, এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।
অ মা! ছেলে নিয়ে তুমি কী করবে?
না দিলে কিছুতেই যাব না।
ঝগড়ুর বউ রেগেমেগে দুম করে ছেলেটাকে মাটিতে বসিয়ে দিয়ে ঘরে চলে গেল।
বোগিও অমনি তাকে তুলে নিয়ে দে দৌড়।
বারান্দায় তাকে ছেড়ে দিতেই সে হামাগুড়ি দিয়ে সটান ভুলোর থালার কাছে গেল। তারপর খালি থালা দেখে তার রাগ দেখে কে!
রুমু একটু রুটি এনে দিতে তবে থামল। বোগি আস্তে আস্তে ডাকল, ভুলো, ভুলো, ভুলো!
ছেলেটা খিলখিল করে হেসে, হামা দিয়ে কাছে এসে, ভিজে ভিজে জিব দিয়ে বোগিকে চেটে দিল।
রুমু কাঁদতে লাগল। গোলমালের মধ্যে ঝগড়ু এসে ছেলেটাকে বারান্দা থেকে নামিয়ে মোমলতার তলায় ছেড়ে দিল।
তোমরা এইখেনে খেলা করো দিদি। বারান্দার উপরে দিদিমা দেখলে রাগ করবে।
ঝুরঝুর করে মোমলতার ফুল ঝরে পড়ছে, তাই দেখে ছেলেটা আহ্লাদে আটখানা। মুঠো মুঠো তুলে মুখে পুরতে চায়! শিশু গাছে দলে দলে বুনো হাঁস এসে বসেছে, দেখে মনে হয় বুঝি বড়ো বড়ো সাদা ফুলে গাছ ভরে গেছে। তাই দেখে খিলখিল করে ছেলেটা হেসে ওঠে।
অমনি যেন নিশানা পেয়ে হাঁসের ঝাঁক একসঙ্গে আকাশে উড়ে পড়ে। আকাশের দিকে দুই হাত তুলে ছেলেটা কাঁদতে থাকে।
রুমু বলল, দাদা, আগেই তো ভালো ছিল।
বোগি ছেলেটাকে খুব আস্তে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলে, কেন খেইছিলি হলদে পাখি? কে বলেছিল খেতে?
ছেলেটার কান্না থেমে যায়, এই বড়ো বড়ো ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে।
রুমু হঠাৎ উঠে পড়ে, ওকে বুকে জাপটে ধরে একেবারে ঝগড়ুর ঘরে বউয়ের কাছে দিয়ে আসে।
বউয়ের হাঁড়িতে টগবগ করে ভাত ফুটছে, বুদবুদ উঠছে, ফেটে যাচ্ছে, ফুটন্ত জল ছিটুচ্ছে, বউ ভারি খুশি!
কী, এরই মধ্যে শখ মিটে গেল? আগেই জানি।
ওখানে আর দাঁড়ানো নয়। ঘরে এসে দেখে বোগি পালকটাকে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলেছে। বোগি বলল, ধেত। নেড়িকুকুর পুষতে হয় না। ওদের জাত খারাপ, পোষ মানে না, যা-তা খায়। তার চেয়ে বিলিতি কুকুর ঢের ভালো। সেজো মামা একটা দেবে, চাইলেই দেবে। তার জন্য নতুন লাল কলার কিনব। এটাকে ফেলে দে।
রুমু অমনি জানলা গলিয়ে কলারটা বাইরে ফেলে দিল। নেড়িকুত্তোর কলার আবার কে পরবে?
বোগি উঠে দাঁড়াল।
দেখ রুমু, তারপর যদি কখনো ভুলোটা ফিরে আসে, খবরদার ঢুকতে দিবিনা কিন্তু। ঠেলে বের করে দিবি।
দাদা, ভুলোকে ঠেলে দিলে যে আবার দৌড়ে দৌড়ে ফিরে আসে! মনে হয় ঠেলে দিলে খুশি হয়।
তা হলে বেঁটে লাঠি দিয়ে মেরে তাড়াবি।
ওকে মারলে ও নিশ্চয় আমাকে কামড়ে দেবে। কক্ষনো যাবে না।
দেখ, কলারটা বরং আবার তুলে নিয়ে আয়। ছেলেটার গলায়ও মন্দ দেখাবে না। ও কী, এ-সময়ে শুয়ে পড়লি যে? সর, আমিও সোব, আমার শরীর খারাপ লাগছে।
০৩. একটা ভাঙা মাটির ভাঁড়ে
বিকেলে ঝগড়ু, একটা ভাঙা মাটির ভাঁড়ে করে কী যেন নিয়ে এল।
কী রে ঝগড়ু? কী এনেছিস?
উঠেই দেখো-না, এ সেই আমাদের দুমকার জাদুকরি মাঞ্জা, ঘুড়ির সুতোয় লাগিয়েছ কী দেখো কী কাণ্ড হয়।
কোথায় পেলি রে?
আরে দুমকা থেকে কত কষ্ট করে আমার শালা এনে দিয়েছে। আহা, হাত দিয়ো না দিদি, মাঞ্জায় কাচের গুঁড়ো দেয়া থাকে জান না?
তুমিই তো বলেছ দুমকায় কাচ পাওয়া যায় না বলে জানলায় তোমরা চাটাই বুনে দাও, কাচ কোথায় পেল তোমার শালা? রোজ রোজ উলটোরকম কথা বল!
বেশ, বিশ্বাস না হয় আমি কুসিদিদিদের বাড়িতে দিয়ে আসছি, জগুরাও সুতোলাটাই কিনেছে দেখে এলাম। তা ছাড়া দুমকায় কাচ নেই বলে থাকতে পারি, কাচ হয় না তা তো বলিনি। জাদুকরি মাঞ্জায় দুমকার সেই কাচের গুঁড়ো না দিলে অন্য মাঞ্জা থেকে কোনো তফাতই থাকে না।
রুমু বোগি বিছানা থেকে উঠে এসে বলল, কীরকম কাচ, ঝগডু?
তোমরা তা হলে হাত-মুখ ধুয়ে, জলখাবার খেয়ে, জামাকাপড় পরে আমার সঙ্গে চলো, শালবনে ফুল ফুটেছে দেখবে চলো। তাহলে জাদুকরি মাঞ্জার কথা বলব।
সত্যি গল্প তো ঝগড়ু? তুমি কিন্তু ভীষণ গুল মার।
ইচ্ছে না হয় বিশ্বাস কোরো না, আমি আর কী করতে পারি। তবে এই কথা মনে রেখো, দরকার না হলে আমি কখনো মিছে কথা বলি না।
শালবন থেকে রেলের লাইন দেখা যায় না, কিন্তু ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় কত দূর থেকে আসছে, আবার তারপরেই মনে হয় একেবারে কানের গোড়ায়, কিন্তু যেই না মুখ ফিরিয়ে দেখতে গেছ, অমনি আবার মনে হবে কত দূরে সরে গেছে।
শাল বনে থেকে থেকে দমকা দমকা হাওয়া দেয়, সাদা গুঁড়োর মতো রেণু ওড়ে, শাল ফুলের সোঁদা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে।
ভুলো এলে বেশ হত, না দাদা? গাছের গোড়ায় ঢিপি ঢিপি ফুল জমেছে, ভুলো থাকলে ওর মধ্যে নাক ঢুকিয়ে নেচে-কুঁদে একাকার করত।
বোগি বলল, ঝগড়ু, আর চালাকি নয়। বলো শিগগির দুমকার কাচের কথা। না, চুপ করে থাকলে চলবে না ঝগড়ু।
চুপ করি কি সাধে! দুমকার কাচের কথা ভাবলেও আমার মনটা উদাস হয়ে যায়। দুমকা কীরকম জায়গা জান তোমরা? শুকনো খরখর করে চারদিক, আর যেই শীত পড়ো-পড়ো হয়ে আসে, অমনি শিরশির করে একরকম বাতাস বইতে থাকে। আর গাছে গাছে পাতাগুলো সব আলাদা আলাদা হয়ে বাতাসে গা মেলে দেয়! রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ওই বাতাসের শব্দ আর পাতা খসার আর দূরে কাঁদের বাড়িতে শীত-লাগা কুকুরের ডাক শোনা যায়। দুমকার লোকেরা কুকুর ভালোবাসে, বোগিদাদা–
এই অবধি বলে টুক করে একবার রুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে ঝগড়ু তাড়াতাড়ি বলতে লাগল, আর শুধু কুকুর কেন–কুকুরদের পেজোমির কথা তো তোমরা জানই–দুমকার লোকরা মুরগি ভালোবাসে, শুয়োর ভালোবাসে বেড়াল বাদে সব জন্তুজানোয়ার ভালোবাসে
কেন, বেড়াল বাদে কেন?
খোলা শত্তুর ভালো, রুমুদিদি, যাদের নখ ঢাকা থাকে আর আলো লাগলে যাদের চোখ ছোটো হয়ে যায়, তাদের ভালোবাসতে নেই। দুমকার লোকেরা তাই বেড়াল ভালোবাসে না।
বোগি বলল, আঃ, কী বেড়াল বেড়াল করছ, কাচের কথাটা বলো না।
এই বলি শোনো। চাটাই দিয়ে জানলা বন্ধ করে ঝাপিকুঁপি হয়ে শুয়ে থাকি, শরীরটা গরমের মধ্যে আরামে শুয়ে থাকে কিন্তু মনটা ওই বাইরে বাইরে শীতের মধ্যে পাতা খসার শুকনো গন্ধের মধ্যে, ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে হু হু করে বেড়ায়।
কেন?
আরে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেলে শরীরের চোখ তো বন্ধ হবেই, আর শরীরের চোখ বন্ধ হলে মনের চোখ খুলবেনা? যাই হোক, আমার বুড়ো ঠাকুরদা ভাবলেন ঘরে আলো আনতে হবে। জানলায় কাচ দিয়ে দিনে আলো আনতে হবে, প্রদীপের চারদিকে কাচ দিয়ে রাতে আলো আনতে হবে। কিন্তু দুমকায় কাচ কোথায়, কাচের বড়ো দাম। তখন আমার বুড়ো ঠাকুরদা শাল গাছ, মহুয়া গাছ আর হাজার হাজার মৌচাকসুষ্ঠু একটা গোটা বন বেচে দিয়ে, শহর থেকে এক বাবু ভাড়া করে আনলেন, সাহেবদের লেখা কেতাব দেখে কাচ তৈরি করে দেবে। তাকে নিজের ঘর ছেড়ে দিলেন, বিরাট চুল্লি তৈরি করে দিলেন, মালমশলার পাহাড় বানিয়ে ফেললেন, মুরগি আর গাওয়া ঘি খেয়ে খেয়ে রোগা বাবু মোটা হয়ে গেল, কিন্তু কাচ আর হল না।
কেন হল না ঝগড়ু?
আরে আজ নয় কাল নয় করে করে বছর ঘুরে গেল, শেষটা বুড়ো ঠাকুরদা একদিন রেগেমেগে তাকে যা নয় তাই বলে বকাবকি করলেন। তারপর সে ঘোর রাত্রে পায়ে হেঁটেই দুমকা থেকে চলে গেল। সারা দিন তাকে খোঁজাখুঁজির পর গভীর রাতে ঠাকুরদা বড়ো চুল্লিটা জ্বেলে, তার মধ্যে ওই পাহাড় পাহাড় মালমশলা আর রাশি রাশি সাহেবদের বই সব ঢেলে দিয়ে, রাগে-দুঃখে সারা রাত বনে বনে ঘুরে বেড়ালেন।
ওরে বাবা! বাঘে খেল না?
আরে তোমরা যে কিছুই জান না দেখছি। রাগী মানুষদের আর পাগলদের কেউ কিছু বলে না, তাও জান না?
যাই হোক, সকালে উসকোখুসকো চুল আর লাল ভাঁটার মতো চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন, চুল্লির সেই গনগনে আগুনে সব জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে, আর তার জায়গায় চুল্লিতে ঠেসে রয়েছে পরত পরত কাচ, আর সবার নীচে উনুনের ছাঁচে ঢালাই হয়ে আছে এই বিশাল এক দলা সবুজ কাচ। কাচ কাটে যারা তারা এল, জানলা হল, প্রদীপের ঢাকনি হল, সব হল, দুমকার দুঃখ তখনকার মতো ঘুচল, আর ফালতু কাচ গুঁড়িয়ে জাদুকরি মাঞ্জায় দেওয়া হল।
দুমকার দুঃখ ঘুচল তো তুমি কেন দুমকা ছেড়ে এখানে এলে চাকরি করতে?
বললাম-না, তখনকার মতো ঘুচল। দুঃখ কি আর চিরকালের মতো ঘোচে, বোগিদাদা? সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বারে বারে ফিরে আসে। তবে হ্যাঁ, এই জাদুকরি মাঞ্জাটাও কিছু কম যায় না!
কেন কী হয় ওতে?
সেই কথাই তো বলছি, তা তোমাদের কিছুতেই তর সয় না।
আচ্ছা ঝগডু, সব জানলায় কাচ হল, তবে তোমরা চাটাই লাগাও কেন?
সেও এক কাহিনী, রুমুদিদি। ষাট বছর আগে যে বড়ো ভূমিকম্প হয়েছিল, তাতে দুমকার একটি বাড়িও দাঁড়িয়ে ছিল না, কাচটাচ সব গুঁড়ো। এই মাঞ্জা তো সেই গুঁড়ো দিয়েই তৈরি। আমাদের দুমকায় ঘরে ঘরে কৌটো করে সেই কাচের গুঁড়ো তুলে রাখে। মাঞ্জার সঙ্গে একটু করে দেয়া হয়, ফুরিয়ে গেলে আর তো পাওয়া যাবে না, দিদি! চলো, এখন না ফিরলে আঁধার হয়ে যাবে, সূর্য ডোবার পর এ জায়গাটাও অন্যরকম হয়ে যায়, চলো এখন ফেরা যাক।
তাহলে রাত্রে শোবার সময় মাঞ্জার কথা বলবে তো ঠিক?
ঝগড়ু দু-জনার কনুই ধরে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলল, হ্যাঁ, হা, সে হবেখন!
রাত্রে মাংস রান্না হয়েছিল। মোটা হাড়গুলো কে খাবে? তার উপর রমুর খুব পা কামড়াচ্ছিল। দিদিমা ঝগড়ুকে বকলেন, কী দরকার ছিল ওদের শাল বন অবধি হাঁটাবার, ঝগড়ু? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার দেখি বুদ্ধি বাড়ছে।
ঝগড়ু কিছু বলল না। ঝগড়ু বোধ হয় খুব বুড়ো, কানের চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে, হাতের অনেকগুলো নখ ভাঙা, শিরাগুলো উঁচু উঁচু হয়ে রয়েছে। রুমু একটা আঙুল দিয়ে ঝগড়ুর শিরায় হাত বুলিয়ে দিল। বোগি বলল, ঝগড়ু, তুমিও চলো, আমরা শোব, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো৷
হাত ধুতে গিয়ে রুমু একবার কানা-তোলা থালাটার কাছে গেল। বোগির রাগ ধরল, কী করে আসবে সে? তুই এত বোকা কেন রুমু? হাড়গুলো তুলে এনে থালায় ফেললি?
রুমু পা দিয়ে থালাটাকে একটু সরিয়ে বলল, ঝগড়ুর বউ সন্ধে বেলা ছেলেটাকে কলা চটকে খাওয়াচ্ছিল। আমার বড্ড পা কামড়াচ্ছে, দাদা। রুমু মহা কান্নাকাটি লাগিয়ে দিল।
০৪. ঝগড়ু রুমুর পা টিপে দিল
ঝগড়ু অনেকক্ষণ ধরে রুমুর পা টিপে দিল। পা টিপতে টিপতে মাঞ্জার কথাটা বলল, আমরা যখন ছোটো ছিলাম বোগিদাদা, ওই মাঞ্জা সুতোয় লাগিয়ে একদিন ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম। সারা দিন লেগেছিল সুতোয় মাঞ্জা দিতে। লম্বা করে দুটো শিশু গাছে বেড় দিয়ে সুতো শুকোনো হল। ঘুড়ি উড়োতে সেই বিকেল হয়ে গেল।
আমি আর আমার ভাই ঝমরু, না খেয়ে না দেয়ে সুতো তৈরি করে আকাশে তো ঘুড়ি ছেড়ে দিলাম। ছাড়তেই মনে হল জ্যান্ত পাখি ছেড়ে দিলাম। ঘুড়ি কাত হল না, গোত্তা খেল না, শোঁ শো করে একেবারে সটান মাঝ আকাশে উড়ে গেল।
যতই সুতো ছাড়ি ততই ঘুড়ি উপরে উঠে যায়। ঝমরু বলল, দাদা ঘুড়ির কেন ওজন নেই, টান নেই? বাস্তবিকই তাই, এদিকে লাটাইয়ের সুতোও প্রায় শেষ। আমি বললুম, সারাদিন মাঞ্জা দিলাম, সব কটি সুতো যাবে শেষে, থাক, তুই টেনে নামা।
কী বলব, বোগিদাদা, সে ঘুড়ি নামতে চায় না, জোর করে। ততক্ষণে সূয্যি ডুবেছে, গাঁয়ের লোক আর যারা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল সবাই চলে গেছে, তখন ঘুড়ি এসে চোখের সামনে দেখা দিল। দেখা দিল কিন্তু মাটিতে পড়ল না। ঝমরু আর আমি দেখলাম, ঘুড়ির কলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আশ্চর্য একটা হলদে পাখি! তার পা নেই, মাটি থেকে এক হাত উপরে খালি খালি ফড়ফড় করে উড়ে বেড়াচ্ছে। গলায় স্বর নেই, ডাকছে না, কিন্তু লাল চুনির মতো দুটি চোখ দিয়ে পাগলের মতো ইদিকে-উদিকে তাকাচ্ছে।
বোগি জিজ্ঞেস করল, তবে-না বলেছিলে কেউ ও পাখি চোখে দেখেনি?
মিথ্যা কথা বলেছিলাম, বোগিদাদা। আর কেউ কখনো দেখেনি, শুধু ঝমরু আর আমি দেখেছিলাম। ঝমরু তাকে খপ করে ধরে ফেলল, অমনি সে চোখ বুজে নিঝুম হয়ে গেল, খালি ওর বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। কিন্তু যেই-না আমি তাকে ধরেছি আর ঝমরু তার গলা থেকে সুতোর ফঁস খুলে দিল, অমনি সে ডানা ঝাঁপটা দিয়ে আমার হাত থেকে ফসকে গিয়ে, তিরের মতো আকাশে উড়ে দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল।
তারপর কী হল, ঝগড়ু?
তারপর আর কী হবে? ঝমরু আর আমার আর দেশে থাকা হল না। ওই পাখির ডানার ঝাঁপটা যার গায়ে লেগেছে সে কি আর ঘরে তিধুতে পারে, বোগিদাদা? আজ তুমি ঘুমোও বোগিদাদা, দেখো রুমুর চোখ কখন বুজে গেছে।
তার পরদিনও ভুলো এল না, তার পরদিনও না, তার পরদিনও না।
তার পরদিন রুমু বলল, ঝগড়ু, যে শেয়ালরা কুকুররা হলদে পাখি খেয়ে মানুষ হয়ে যায়, তারা আর জানোয়ার হয় না?
ঝগডু বলল, একবার মানুষ হলে তারা আর কি জানোয়ার হতে চাইবে, দিদি? তবে শুনেছি নিদুলি মন্ত্র দিয়ে সব হয়।
তুমি জান সেই নিদুলি মন্ত্র?
জানি আমি সবই। আমাদের দুমকায় ছেলেছোকরারাও নিদুলি মন্ত্রের কথা শুনেছে। কিন্তু করা বড়ো শক্ত!
কেন শক্ত, ঝগড়ু?
তার জিনিসই পাওয়া যায় না, দিদি; পাঁচ-ঠেঙো মাকড়সা চাই, সোনা-রুপোর মাদুলি চাই– এখন আমি বাজারে যাচ্ছি, দিদি, পরে সব বলব।
বাজারে যাচ্ছ, ভালোই হল, ঝগড়ু, একটু দেখো তো।
কী দেখব, দিদি?
সেই– সেই সোনা রুপোর মাদুলি যদি পাও।
সে কি অত সহজে মেলে, দিদি?
তাহলে সেদিন সেই একচোখো লোকটাকে তাড়িয়ে দিলে কেন? ওর কাছে হয়তো ছিল। বলল, রক্ত বন্ধকরা মাদুলি আছে, স্বপ্ন দেখা মাদুলি আছে। দেখলে না কেন, ঝগড়ু?
আচ্ছা, এবার দেখলে তাকে ডেকে আনবখন। কিন্তু কী করবে তুমি ওই মাদুলি দিয়ে? বিকেলে হিরে খুঁজতে যাবে তো?
হ্যাঁ, যাব। হিরে খুঁজব, আর সেই যে তুমি বলেছিলে সাপের মাথার ফুল, যে ফুল কখনো শুকোয়, সেই খুঁজব। খোয়াইয়ের মধ্যেই সব পাওয়া যাবে তো?
পাওয়া যাবে কি না জানি না, দিদি। তবে খোয়াইয়ের মধ্যেই ওসব খুঁজতে হয়। পেলেই তো মজা ফুরিয়ে গেল।
বিকেলে যেতে হয় খোয়াইয়ে। বর্ষার জলে মাটি খেয়ে খেয়ে লাল কাঁকরের পাঁজরা বেরিয়ে থাকে। ধারে ধারে মনসা গাছ মাথা উঁচিয়ে কাঁটা বের করে দাঁড়িয়ে আছে। আলো কমে এলেই রুমুর কেমন মনে হয় মনসারা আগের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে নেই, মাথা ঘুরিয়ে ইদিক-উদিক দেখছে। খোয়াইয়ের মধ্যে কতরকম আশ্চর্য সাদা লাল পাথর পড়ে থাকে।
ঝগড়ু বলল, কিছুই বিশ্বাস কর না বোগিদাদা, বইয়ে না লেখা থাকলে কিছুই মানতে চাও না। আরে বইয়ে কতটুকুরই-বা জায়গা হয়, বলো? আমাদের দুমকাতে একরকম গাছ আছে তারা চলে বেড়ায়।
ফের বাজে বকছু, ঝগড়ু?
আরে না না, নিজের চোখে দেখা। ছোটোবেলায় ঝমরু আর আমি পাহাড়ে যেতাম ছাগল চরাতে। আমাদের দেশের জন্তুজানোয়ারদের বড়ো কষ্ট, রমুদিদি, এমনি খরা যে ঘাসগুলো সব জ্বলে-পুড়ে যায়। তবে পাহাড়ের উপরে বড়ো বড়ো পাথরের ছায়ায় লম্বা লম্বা ঘাস থাকে, ছাগলরা তাই খেতে বড়ো ভালোবাসে।
ছাগলরা চরে বেড়ায়, আর ঝমরু আর আমি সারাটা দিনমান এ পাথর থেকেও পাথরে লাফিয়ে বেড়াই, বাঁশি বাজাই, আর পাথরের আড়ালে ঘুমুই। ঝমরু একটু রাগী ছিল, দিদি, একটুতেই মেরে ধরে একাকার করত।
কোথায় সে এখন?
বোগি একটু কাছে এসে বলল, মরে গেছে নিশ্চয়।
ঝগড়ু রাগ করল। মরবে কেন বোগিদাদা, তোমার যেমন কথা!ঝমরু এখন বদ্যিনাথে পুলিশে চাকরি করে, তার পাঁচটা ছেলে পাঁচটা মেয়ে; কেউ মরেনি।
আচ্ছা, আচ্ছা, তারপর বলল, ঝমরু ভারি রাগী ছিল, তারপর?
একদিন একটা ছাগল কিছুতেই পাহাড়ে উঠবে না। আমি যতই তাকে ফুসলোই, সে উলটে গুঁতোতে আসে।তখন ঝমরু রেগেমেগে দিয়েছেতাকে এক লাথি কষিয়ে। ছাগলটা অমনি তরতর করে পাহাড়ে উঠে গেল বটে, কিন্তু পাশেই একটা মস্ত মস্ত শাঁসালো পাতাওয়ালা কাঁটাগাছ ছিল, ঝমরুর পায়ে তার একটা এই বড়ো কাটা গেল বিধে। অমনি চুনির মতো গোল গোল রক্তের ফোঁটা টপটপ করে পড়তে লাগল, আর ঝমরুর সে কী চেঁচামেচি! রেগে গাছটার গোটা ডালটাই ছিঁড়ে ফেলে দিল, আর তার গা থেকেও একরকম সাদা রস পড়তে লাগল।
তারপর ব্যথা কমলে আমরাও পাহাড়ে চড়লাম। ঝমরু কী করে, পায়ে ব্যথা, সেদিন আর দৌড়ঝাঁপ করতে পারে না। তখন সে করল কী, মাঝারি পাথরগুলোকে উলটে উলটে ফেলতে লাগল। কখনো পাথর উলটেছ, রমুদিদি?
না তো। কেন, কী হয়?
পাথরের তলাকার ছোটো-বড়ো পোকারা ঊর্ধ্বশ্বাসে যে যেদিকে পারে পালায়। সে ভারি মজা লাগে দেখতে, কিন্তু ওদের ভারি কষ্ট হয়।
কেন কষ্ট হয়?
আরে, ওরা অন্ধকারের পোকা, আলো সইতে পারে না। তা ছাড়া পাথরের তলাটাই ওদের বাড়ি, বাচ্চাটাচ্চা ডিম-টিম নিয়ে সেখানে ওরা থাকে। পাথর উলটে ফেলে দিলে বাচ্চারা মরে যায়, ডিমগুলো ভেঙে যায়।
ইস। ঝমরু তো ভারি দুষ্টু ছেলে।
না, দুষ্টু মোটেই নয়, রমুদিদি, আমাদের দুমকার ছেলেরা আর যাই হোক, কখনো দুষ্টু হয় না। তবে অতটা ভেবে দেখিনি।
আচ্ছা, তারপর বলো।
তারপর আট-দশটা পাথর ওইরকম উলটে ফেলবার পর, ঝমরুর সে কী চিৎকার! আমি ভাবলাম নিশ্চয় পোকায় কামড়েছে! ছুটে গিয়ে দেখি, ওর পায়ে আবার সেইরকম একটা কাঁটা ফুটে রয়েছে।
তাকিয়ে দেখি পাশে ঠিক সেইরকম একটা গাছও রয়েছে। শুধু তাই নয়, গাছটার একটা ডালও ভাঙা, আর সেখানে ফেঁটা ফেঁটা সাদা রস জমে রয়েছে।
কী করে হতে পারে ঝগড়ু? তুমি কি বলতে চাও সেই গাছটাই পাহাড়ে চড়েছিল?
দেখ, বোগিদাদা, তোমাদের সঙ্গে আমাদের এই তফাত যে আমরা যা দেখি তাই মেনে নিই, অত কী করে হল জানতে চাই না। কিছুই মানতে চাও না, এই হল মুশকিল। আমি একবার খোয়াইয়ের মধ্যে ঘোড়ার কঙ্কাল পেয়েছিলাম, তাও বোধ হয় বিশ্বাস করবে না?
বোগি বলল, তা কেন বিশ্বাস করব না? একটা সত্যি ঘোড়াই হয়তো বুড়ো হয়ে খোয়াইয়ের মধ্যে মরে গেছিল, কিংবা হয়তো কিছুতে মেরে ফেলেছিল, কিংবা পথ হারিয়ে না খেতে পেয়ে মরে গেছিল–ও কী, ফের কাঁদছিস, রুমু?
রুমু ফ্রকের কোনা তুলে চোখ মুছে বলল, ঘোড়া মরে গেলেও কাঁদতে পাবনা? না খেতে পেয়ে একলা একলা অন্ধকারে খোয়াইয়ের মধ্যে ঘুরে বেড়ালেও কাঁদতে পাব না?
বোগি বিরক্ত হয়ে বলল, ফ্রক নামাও রুমু, তোমার পেট দেখা যাচ্ছে!
ঝগড়ু ব্যস্ত হয়ে উঠল। আহা, কান্নাটা থামিয়ে আসল কথাটাই শোনোনা, দিদি। ঘোড়াটার ওরকম কিছুই হয়নি।
কী করে জানলে?
শোনোই না, বলি।
০৫. ঝগড়ু খোয়াইয়ের মধ্যে
ঝগড়ু খোয়াইয়ের মধ্যে একটা ভালো জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়ল।
ওরকম কিছুই হয়নি বুঝলাম, কারণ কঙ্কালটার কাছে গিয়ে দেখলাম মেলা ইগল পাখির পালক ছড়ানো।
ও, তা হলে হয়তো ওকে ইগল পাখিতে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, পাহাড়ের উপরে ইগল পাখির বাসাতে বাচ্চারা খাবে বলে। তারপর নখ থেকে কী করে খুলে ঘোড়াটা খোয়াইয়ে পড়ে মরে গেছিল।
আচ্ছা, রুমু, আবার কী হল?
ইগল পাখিতে ধরবে কেন? আস্তাবলে রাখে না কেন?
কী মুশকিল! আমাকে গল্পটা বলতে দেবে কি না?
ও, গল্প? তা হলে সত্যি নয়?
সত্যি নয় মানে? আমার সব গল্পই সত্যি গল্প।
বলো, তারপর ইগল পাখির পালক দেখে কী করলে?
ভালো করে দেখে বুঝলাম ইগল পাখিরই পালক নয়। ইগল পাখির পালক অত বড়োও হয় না–ওরকম নীল নীলও হয় না।
তবে?
বুঝলাম, তা হলে ওরই পালক।
ওরই পালক মানে? ঘোড়ার আবার পালক হয় নাকি?
ঝগড়ু উঠে পড়ল, কী যে বল! ঘোড়ার পালক হয় না? এবার হয়তো বলবে ঘোড়ার ডানাও হয় না। কঙ্কালটার কাঁধের কাছে দেখলাম, মুরগিদের ডানার হাড়ের মতো বিরাট দুই হাড়।
রুমু হাত দিয়ে নিজের মুখ চাপা দিয়ে চাপা গলায় বলল, তবে কি তবে কি ওটা পক্ষীরাজ ছিল ঝগড়ু?
তা জানি না, তবে শুনেছি পক্ষীরাজরা বুড়ো হলে, পুরোনো দেহটাকে ছেড়ে নতুন দেহ গজিয়ে নেয়!
বোগি বলল, না, তুমি ভীষণ গাঁজাখুরি গল্প বল, ঝগড়ু, নতুন দেহ গজিয়ে নেয় আবার কী?
তা তোমাদের এখানে কী হয় না হয়, সে বিষয় আমি তো কিছু বলতে পারি না, কিন্তু দুমকাতে হয় না এমন আশ্চর্য জিনিস নেই। তা ছাড়া টিকটিকির ল্যাজ গজাতে পারে, আর পক্ষীরাজ দেহ গজাতে পারে না বললেই হল!
ঘোড়ার কঙ্কাল তো এখানে পেয়েছিলে বললে।
এখানে পেলেই তাকে এখানকার ঘোড়া হতে হবে? আমিও তো এখানে আছি, তা হলে কি আমিও দুমকার ছেলে নই?
ঠিক এই সময় ওদের কানে এল স্পষ্ট ঘোড়ার খুরের শব্দ! সবাই অবাক। তারপরে পাশের গর্ত মতন জায়গা থেকে হাঁচড়-পাঁচড় করতে করতে উঠে এল একটা হাড়-জিরজিরে সাদা ঘোড়া।
তার খুর ছাড়া সবটা সাদা। গায়ের লোম, চুল, ল্যাজ, চোখের পাতি সব সাদা। খালি খুর চারটে আর চোখের মণিটা কুচকুচে কালো।
ওদের দেখে ঘোড়াটা চারটে পা এক জায়গায় জড়ো করে থমকে দাঁড়াল, তার সমস্ত শরীরটা থরথর করে কাঁপতে লাগল, চোখের কালো মণির চার ধারে অনেকখানি করে সাদা দেখা গেল। ঠোঁটের কোনায় একটু সাদা ফেনা লেগে রয়েছে, বুকটা হাপরের মতো উঠছে পড়ছে।
বোগি রুমুর মুখে কথা নেই। ঘোড়াটার প্রত্যেকটা পাঁজর গোনা যায়, আর কাঁধের উপর দুটো হাড় অদ্ভুতরকম উঁচু হয়ে রয়েছে। ঝগডুওদের কানে কানে বলল, নড়বে না, খবরদার আওয়াজ করবে না।
তারপর দু-হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে, মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত পাখি-ডাকার মতো নরম শব্দ করতে করতে ঝগড়ু ঘোড়াটার দিকে এগোতে লাগল। আস্তে আস্তে ঘোড়াটার কাঁপুনি থেমে গেল, চোখ দুটো কালো মখমলের মতো হয়ে গেল, সেও একটু এগিয়ে এসে মাথা নীচু করে ঝগড়ুর হাতের তেলোয় মুখ গুঁজে দিল। ঝগড়ু, অন্য হাতটা দিয়ে তার পিঠে হাত বুলোতে লাগল।
এবার তোমরা কাছে আসতে পারো, দিদি, ও আর কিছু বলবে না। কিন্তু সামনে দিয়ে এসো, ঘোড়ার পিছন দিক দিয়ে কখনো আসতে হয় না।
তুমি এত কথা কী করে জানলে, ঝগড়ু?
ঝগড়ু মুখটা তুলে, দূরে যেখানে গাছের পিছনে সূর্য ডুবে যায়, সেই দিকে চেয়ে বলল, বলেছি তোমাদের, হলদে পাখির ডানার ঝাঁপটা লেগেছে আমার গায়ে, দেশে আমি তিষ্ঠুতে পারি না। কোথায় কোথায় যে সে আমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে সে আর কী বলব। বললেও তোমরা বিশ্বাস করবে না, তোমাদের কেতাবে সেসব জায়গার কথা লেখে না। ঘোড়দৌড়ের মাঠে কাজ করেছি আমি পাঁচ বচ্ছর। বোগিদাদা, ভালো ঘোড়া রেসের দিনে কেন দৌড়োয় না তাও জানি, খারাপ ঘোড়া কেন হঠাৎ ঝড়ের মুখে খড়ের কুটোর মতো ছুটে চলে তাও জানি। চলো, ওঠো, ঘরে যাবার সময় হয়েছে।
সাদা ঘোড়াটা দুটো কান খাড়া করে ঝগড়ুর কথা শুনছিল, এবার মুখ তুলে ঝগড়ুর চোখের দিকে চেয়ে রইল, ওর চোখ দেখে মনে হল যেন কালো দিঘির জল, তার তল নেই, থই নেই।
বলোনা ঝগড়ু, হলদে পাখির ডানার ঝাঁপটা লাগলে কেন ঘরে তিষ্ঠুনো যায় না?
বুকের মধ্যে খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়, ফোঁপরা হয়ে যায়, দুনিয়াতে হরেকরকম ভালো জিনিস আছে, কিন্তু কিছুদিয়েই আর সে ফাঁকা ভরানো যায় না, বোগিদাদা; ঘর ছেড়ে, ঘরের মানুষ ছেড়ে তাই বেরিয়ে পড়তে হয়। চলো, আঁধার নামছে।
কিন্তু তাহলে সাদা ঘোড়ার কী হবে? ওকে বাড়ি নিয়ে গেলে হয় না, ঝগড়ু?
থাকবে কোথায়? খাবে কী? তোমাদের দিদিমা কেন থাকতে দেবে?
তোমার ঘরে থাকবে, ঝগড়ু, তরকারির খোসা খাবে, দিদিমা জানতেও পারবে না।
রুমু বলল, আর জানলেই-বা কী হবে? তোমার ঘরে যে কালো ছেলেটা এসেছে, দিদিমা বলেছে কিছু?
ঝগড়ু মাথা উঁচু করে বলল, ও তো দুমকার ছেলে। আর তা ছাড়া ও হল পক্ষীরাজ, এদের ঘরে বেঁধে রাখা যায় না।
পক্ষীরাজ তো ডানা কোথায়, ঝগড়ু?
ঝগড়ু অবাক হয়ে গেল। সব পক্ষীরাজের কি ডানা গজায় ভেবেছ নাকি? দেখছনা ওর কাঁধের উপরকার হাড় কেমন উঁচু হয়ে রয়েছে? ওর যে ডানার কুঁড়ি রয়েছে, বোগিদাদা। ডানার কুঁড়ি থাকলেও সকলের ডানা গজায় না, গায়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে থাকে, একটুখানি জিরুতে দেয় না, সারাটা জীবন জ্বালিয়ে খায়।
এই বলে ঝগড়ু ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিল। ঘোড়াটাও একবার ঘাড় কঁকি দিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার চিহি করে ডাক ছেড়ে, পেছনের দুটো পায়ের উপর একবার দাঁড়িয়ে উঠে, খোয়াইয়ের উপর দিয়ে খটাখট শব্দ করে দৌড় দিল। চারটে খুর থেকে আগুনের হলকা ছুটতে লাগল, চারিদিকে ধুলো উড়তে লাগল, কাশবনের মধ্যে দিয়ে, তিরের বেগে ছুটে, দেখতে দেখতে সাদা ঘোড়া অদৃশ্য হয়ে গেল।
সারাটা পথ কারো মুখে কথা নেই। ভুলো সেদিনও ফিরল না। ঝগডুর ঘরে কালো ছেলেটা অঘোরে ঘুমুচ্ছে বোগি গিয়ে দেখে এল। রাতে খেতে বসে দাদু বললেন, কী হে, নেড়িকুত্তোর দুঃখ ঘুচল? আনবে নাকি সেজো মামা বিলিতি কুকুরের ছানা?
রুমু বোগির মুখের দিকে চেয়ে দেখে, বোগি মাথা নাড়ছে।
দিদিমা বললেন, কী জানি, পায়ে পায়ে অষ্টপ্রহর ঘুরঘুর করত, ভারি বিরক্ত লাগত, এখন আবার যেন খালি খালি লাগে।
বোগি তবুও কিছুনা বলে, একটা পরিষ্কার চুলের কাটা দিয়ে নলি হাড়ের ভিতর থেকে রস বের করে খেতে লাগল।
রুমু বলল, ভুলো ছাড়া আর কাউকে আমরা চাই না, দাদু।
০৬. রান্নাঘরের পিছনে ঝগড়ুদের ঘর
রান্নাঘরের পিছনে ঝগড়ুদের ঘর আর রান্নাঘরের পাশে গরম জলের ঘর। সেখানে তিনটে বড়ো বড়ো পাথর দিয়ে উনুন করা আছে, তার উপর কেরোসিনের টিনে স্নানের জল গরম করা হয়।
ওই উনুনে কয়লার বদলে কাঠ জ্বালানো হয়। কতরকম কাঠ, তাদের কতরকম রং, কতরকম গন্ধ। মাঝে মাঝে কাঠে আগুন লাগলে কেমন একটা শোঁ শোঁ শব্দ হয় আর সারা ঘর একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধে ভরে যায়।
ঝগড়ু, বলে, তা হবে না, ও যে কাঠপরিদের চুলের সুবাস।
কাঠপরি হয় না, ঝগড়ু।
কাঠপরি হয় না এটা একটা কথা হল, বোগিদাদা?
কোনোরকম পরিই হয় না, ঝগড়ু, কাঠপরিও না।
তবে তোমাদের বইতে লেখে কেন? দিদিমা কাল যে বই থেকে পড়ে শোনালেন?
সব বানানো গল্প, ঝগড়ু, পরি হয় না।
না হয় না! বইতেও লিখেছে, তবু হয় না! তা ছাড়া আমি দেখেছি।
তুমি নিজের চোখে দেখেছ?
না, ঠিক নিজের চোখে দেখিনি, আমার বাবা দেখেছেন। তবে কি আমার বাবা মিছে কথা বলেছেন?
কোথায় দেখেছেন ঝগড়ু, কবে দেখেছেন?
অনেক বছর আগে, রমুদিদি। দুমকার পাহাড়ে দেখেছেন অবিশ্যি, তোমরা হয়তো বিশ্বাসই করবে না।
না, না, ঝগড়ু, বলোই-না তোমার বাবার কাঠপরি দেখার কথা।
ঝগড়ু জল গরমের উনুনে একটা ফিকে সবুজ রঙের কাঠ গুঁজে দিয়ে বলল, এইরকম কাঠে পরি থাকে, শুকনো মরা কাঠে থাকে না। বলতেই সারা ঘর একটা মিষ্টি ধুনো ধুনো গন্ধে ভরে উঠল।
ঝগড়ু বলল, ভালো করে আগুনের মধ্যে চেয়ে দেখো, বোগিদাদা, যেখানে নতুন ধরেছে সেখানে নয়, যেখানে গনগন করে জ্বলছে সেখানে দেখো৷ কিছু দেখতে পাচ্ছ না, ঘরবাড়ি, গাছপালা?
অমনি রুমু বোগিরও মনে হতে লাগল সত্যি বুঝি আগুনের তৈরি ঘরবাড়ি, গাছপালা দেখতে পাচ্ছে, লাল, একটু একটু নীল, দেয়াল ছাদ ডালপালা কেবলই কাঁপছে, নড়ছে, ভাঙছে আবার গড়ছে। মনে হল আগুনের তৈরি একটা শহরই দেখতে পাচ্ছে।
বোগি চোখ ঢেকে বলল, শুধু কাঠ জ্বালালে নয়, ঝগড়ু, আমি কয়লার আগুনেও দেখেছি যুদ্ধ হচ্ছে, শহর পুড়ে যাচ্ছে, বিরাট বিরাট প্রাসাদ ধসে পড়ছে।
তা হবে হয়তো, বোগিদাদা, দুমকায় আমরা কাঠ জ্বালাই, কয়লার কথা অত বলতে পারব না।
দাদা, তুমি অত কথা বল কেন? বলো ঝগড়ু, তোমার বাবার পরি দেখার কথা।
বুঝলে, বাবার তখন বয়স হয়েছে, হাড়ের ভিতরে শীত আর কিছুতেই যায় না, সারাটা দিন গোল লোহার চুল্লির ধারে বসে থাকেন, হাতের কাছে কাঠের গাদা, থেকে থেকে আগুনে একটা কাঠ গুঁজে দেন, ধোঁয়ায় চারদিক ভরে থাকে, যে আসে তার চোখ জ্বালা করে, তারা বাবাকে শুধোয়, তোমার চোখ জ্বলে না, বুড়ো? বাবা বলেন, আরে বুকের জ্বালাই আর টের পাই না, তা আবার চোখের জ্বালা!
সারা দিন চুল্লির ধারে বসে থাকেন বাবা, আর কাঠির আগায় বিঁধিয়ে রাঙা আলু পুড়িয়ে খান! যে আসে তাকে খাওয়ান। তারা মাঝে মাঝে বলে, রাঙা আলুতে ইঁদুরের দাঁতের দাগ কেন, বুড়ো? তোমাদের খেতে বুঝি ইঁদুর হয়েছে? বাবা চোখে ভালো দেখেন না, রাগ করেন, বলেন, ইচ্ছে না হয় খেয়ো না।
একদিন আগুনের মধ্যে যেই-না কাঠির আগায় বিঁধিয়ে রাঙা আলু ফেলেছেন, অমনি মনে হল যেন আগুনের ভিতরকার ঘরবাড়িতে মানুষ আছে, কে যেন রাঙা আলুটাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পোড়াতে লাগল, লম্বা দাড়ি কে একজন বুড়ো লোক রাঙা আলুতে কামড় দিল। অমনি বাবা তাড়াতাড়ি কাঠি টেনে আনতেই রাঙা আলুর সঙ্গে সঙ্গে বুড়োও বেরিয়ে এল। একটুক্ষণ দেখতে পেলেন, তারপরেই সে ঝুরঝুর করে বাতাসে মিলিয়ে গেল। বলতে চাও এসব বানানো কথা, বোগিদাদা? শুধু বাবা কেন, বনে-জঙ্গলে যারা কাঠ কাটতে যায়, তারা সবাই জানে জঙ্গলে এমন অনেক জিনিস আছে, যাদের কথা কোনো বইতে লেখে না। গাছগাছালির কথা যারা চারটে দেওয়ালের মধ্যে বাস করে তারা জানবে কোত্থেকে?
কিন্তু জন্তুজানোয়ারদের তো মানুষরা ভালোবাসে, তাদের কথা তো জানতে পারে?
কে বলেছে মানুষরা জন্তুজানোয়ার ভালোবাসে? একবার হাতি ধরার খেদায় গিয়েছিলাম। দেখলাম সুন্দর সব পোষা হাতি সাজিয়ে রেখে, বুনো হাতি ধরা হচ্ছে। ভালোবাসে বললে? যারা দলে দলে গাছপালা ভেঙে হুড়মুড়িয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নামে, তাদের পায়ে শেকল পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখলাম।
হাতির বাচ্চার ভীষণ কাতুকুতু তা জান? খররা বুরুশ দিয়ে ঘষে তাদের কাতুকুতু ছাড়িয়ে, পিঠে হাওদা চাপানো হয় তা জান? তা নইলে একটুকু ছুঁলেই তারা হেসে লুটোপুটি। তোমরা কি এগুলোকে ভালোবাসা বল?
রুমু বলল, আমরা কুকুর ভালোবাসি, না দাদা? আমরা ভুলোকে ভালোবাসি। তুমিও তো বলেছ মকার লোকরা বেড়াল বাদে সব জন্তুজানোয়ার ভালোবাসে।
দুমকার লোকদের কথা আলাদা। একবার দুমকার বনে দাবানল লেগেছিল। দলে দলে জন্তুজানোয়ার ভয়ের চোটে ছুটে বেরিয়ে এল। গাঁয়ের লোকেরাও তাদের ঘর বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল, জানোয়ারদের কেউ কিছু বলল না।
একটা ভাল্লুক ছিল, সেরকম ভাল্লুক কেউ কখনো দেখেনি। তার গলার লোমগুলো ছিল সাদা, মনে হত ফুলের মালা পরেছে বুঝি। আর যেমনি তার গায়ের জোর, তেমনি তার সাহস! ওর জ্বালায় কারো মৌচাকে মধু থাকত না, আর কত লোককে যে খুনজখম করেছিল তার ঠিক নেই। কিন্তু এমনি চালাক যে কেউ তাকে মারতেও পারেনি, ধরতেও পারেনি।
দাবানলের দিন সে-ও বন থেকে বেরিয়ে এল, সঙ্গে একটা বাচ্চা, তার পায়ে কী হয়েছে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। পড়ে গেল আমাদের সর্দারের একেবারে সুমুখে। আগের বছর সর্দারের ছেলের পায়ের হাড় চিবিয়েছে ওই ভাল্লুক, সর্দারের হাতে তির-ধনুক।
মেরে ফেলল?
সর্দার ধনু তুলতেই ভাল্লুক তার বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে সর্দারের মুখের দিকে চেয়ে রইল। আর সর্দারও ধনুক নামিয়ে পিছন ফিরে চলে গেল। জন্তুজানোয়ারকে ভালোবাসা চারটি খানিক কথা নয়, দিদি। একটা কুকুর কি একটা বেড়াল ঘরে বেঁধে রেখে তাকে আদর করলেই কি আর ভালোবাসা হল!
রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রুমু ডাকল, দাদা!
কেন, কী হয়েছে?
মাঝে মাঝে ভুলো কেন পালিয়ে যায়? হয়তো এখানে ওর ততটা ভালো লাগে না?
বোগি উঠে বসল, ভালো লাগে না? এখানে ভুলোর ভালো লাগে না? তুই কি পাগল হয়েছিস?
তবে আসছে না কেন?
বোগি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, আসছে না কারণ আসতে পারছেনা। আর হয়তো আসবেও না!
নিশ্চয় আসবে। একটা পাঁচ-ঠেঙা মাকড়সা আর একটা সোনা রুপোর মাদুলি পেলেই আসবে দেখো।
০৭. খরখরে শুকনো হলে হবে কী
ঝগড়ু, বলল, আমাদের দুমকা একেবারে খরখরে শুকনো হলে হবে কী, আমাদের পাহাড়ে নদীর জলে যখন বান ডাকে তখন সব ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। এই ভিন গাঁয়ে গেলাম দিব্যি সুন্দর পায়ে হেঁটে নদী পার হয়ে, আর ঘণ্টা তিন বাদে এসে দেখি লাল ঘোলা জলে-ভরতি বিরাট নদী, আর তার সে কী আওয়াজ, কান ঝালাপালা হয়ে যায়। আবার রাত পোয়ালে যে নদী সেই। পায়ে হেঁটে পার হয়ে গায়ে ফেরা যায়।
কোত্থেকে বানের জলে হাজার হাজার মাছ ভেসে আসে। নদীর জল দুই পাড় ছাপিয়ে ওঠে, তারপর যখন আবার নেমে যায়, যেখানে-সেখানে পাথরের ফোকরে ফাটলে জল আটকে থাকে, তার মধ্যে কতরকম মাছ কিলবিল করতে থাকে।
সে মাছ তোমরা ধর, ঝগড়ু?
ধরি বই কী। ক-দিন ধরে গাঁয়ের লোকে মনের সুখে মাছ খায়। দুমকার লোকরা বড়ো গরিব হয়, দিদি। তাদের বড়ো কষ্ট। শীত কালে টোপাকুল পাকলে, বিচিসুদ্ধ পাথর দিয়ে হেঁচে খায় লোকে। তাহলে অনেকক্ষণ পেট ভরে থাকে, ভাত খেতে ইচ্ছা হয় না।
তবে শুধু কি আর মাছ ধরে, তার চাইতেও আশ্চর্য সব জিনিস মাঝে মাঝে ধরা পড়ে।
কী জিনিস, ঝগড়ু?
একবার আমাদের গাঁয়ের নান্দু জল নেমে যাবার পর, সন্ধে বেলায় চাঁদের আলোয় গেছেনদীর ধারে, বর্শা দিয়ে মাছ গাঁথবে, তীরের কাছ থেকে। দেখে কিনা চাঁদের আলোয় কী একটা লম্বা জিনিস বালিতে বেধে গিয়ে, স্রোতের সঙ্গে একটু একটু দুলছে।
কাছে গিয়ে দেখে আগাগোড়া আশ্চর্যরকম কারিকুরি-করা সাদা রঙের একটা ছোটো নৌকো। হাতির দাঁতের কি হাড়ের তৈরি বুঝতে পারল না। নৌকোর সামনের দিকটার গড়ন একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ের মতো, কিন্তু তার পায়ের বদলে আঁশে-ঢাকা মাছের ল্যাজ।
হাত বাড়িয়ে নৌকোটাকে টেনে ডাঙায় তুলতেই, নান্দুর চক্ষু চড়কগাছ!
নৌকোর মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে আশ্চর্য একটি মেয়ে। তার গায়ের রঙও হাতির দাঁতের মতো, হালকা পালকের মতো গড়নটি, চোখ খুলতেই নান্দু দেখল তার ঘোর নীল রং, পরনে একটা ঘন সবুজ রেশমি কাপড়। চমকে মেয়েটি উঠে বসল একবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, তারপরে এক নিমিষে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিল।
নান্দু তার আঁচলখানি চেপে ধরল, এক মুঠি সবুজ রেশম তার হাতে রয়ে গেল, মেয়েটি স্রোতের মধ্যে তলিয়ে গেল আর নৌকোটা বালির উপর পড়ে থাকল। ছোটোবেলায় ওই নৌকো আমিও দেখেছি।
ঝগড়ু থামলে বোগি রাগ করতে লাগল। তোমার সব গল্প হারানোর গল্প, ঝগড়ু, পাওনি কখনো কিছু?
তাহলে যাবে কাল দোলতলার মেলায়? সেখানে কিছু পাওয়া যেতে পারে। রমুদিদি, যাবেনাকি তোমার সেই একচোখা লোকের খোঁজে?
রমু বলল, যাব, যাব, ঝগড়ু। চিনির মঠ কিনে দেবে তো?
দিদিমাকে নিয়ে একটু গোল বাধল, ঝগড়ু, তোমার সঙ্গে না গিয়ে ওদের দাদুর সঙ্গে গেলেই ভালো হত-না?
না, দিদিমা, দাদু গাছতলায় বসে খালি বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে চায়, হাঁটতে চায় না।
শেষপর্যন্ত ঝগড়ুর সঙ্গেই যাওয়া হল। দিদিমা বললেন, সারাক্ষণ ঝগডুর সঙ্গে সঙ্গে থাকবে, তেলেভাজা খাবে না, অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলবে না।
মেলার মাঠের উপরে মেঘের মতো ধুলো উড়ছে, পা পোঁ করে বাজনা বাজছে। বোগি বলল, সার্কাস দেখাবে তো, ঝগড়ু? জান, বাঁদরে ছাগল-টানা গাড়ি চালায়, টেবিল-চেয়ারে বসে চা ঢেলে খায়! আছে তোমাদের দুমকাতে অমন বাঁদর?
ঝগড়ু বলল, হাসিয়ো না, বোগিদাদা, দুমকাতে ওসব ছেঁদো বাঁদরকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। পয়সা নষ্ট করে সার্কাস দেখে একবার দুমকার বনের মধ্যে যেয়ো দিকিনি!
সে কীরকম বন, ঝগড়ু?
ঝগড়ুর মুখটা অন্যরকম হয়ে গেল, মেলার মাঠের উপরে ধুলোর মেঘের দিকে তাকিয়ে, হোঁচট খেতে খেতে ঝগড়ু চলতে লাগল। সে গভীর বন, রমুদিদি, শাল গাছ, মহুয়া গাছ, সীতাহার গাছ, শিমুল গাছের ভিড় সেখানে। গাছের গা জড়িয়ে লতা ওঠে, শীতের আগে সেই লতায় ঝুরো ব্যুরো সাদা ফুল ফোটে। বুনো মুরগি দেখেছ, রমুদিদি? দুমকার বনে বুনো মুরগি চরে, কী তাদের রঙের বাহার। সমস্ত বন জুড়ে জন্তুজানোয়ারদের খুটখুট কিচিরমিচির, কিন্তু হঠাৎ চোখে কাউকে দেখতে পাবে না। নজর করে দেখো, দিদি, গাছের ডালের সঙ্গে রং মিলিয়ে ছাই রঙের পাখি বসে থাকে, চোখে পড়ে না। যেই-না একটু বাতাস বইল, লতাপাতা ডালপালা শিরশির দুলদুল করে উঠল, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক রোদ্দুর এসে পাখির গায়ে লাগল, অমনি সে ডানা মেলে আকাশে ওড়ে। বাইরেটাই শুধু ছাই রঙের, ডানার তলাটা শাঁখের মতো ঝকঝকে সাদা। গাছতলায়। ঝোঁপঝাঁপ থাকে, দিদি, তাতে ফুল ফোটে, কী তাদের সুবাস, ঝাকে ঝুঁকে প্রজাপতিরা সেখানে ঘোরাফেরা করে।
কিন্তু ঝোঁপের মধ্যে না যাওয়াই ভালো, বোগিদাদা, সেখানে সাপের বাস। হঠাৎ যখন চক্কর মেলে ওঠেন তারা, যেমনি তাঁদের রূপের ছটা, তেমনি তাদের বিষের জ্বালা। রূপের বড়া জুলুনি, দিদি।
তোমরা ঝোঁপের মধ্যে যাও না, ঝগড়ু?
আমরা যাব না কেন? দুমকার ছেলেরা সবাই সাপের মন্ত্র জানে।
কী মন্ত্র বলো।
ঝগড়ু জিব কেটে বলল, সে অন্য কাউকে বলা যায় না, বোগিদাদা, তবে ছোট্ট একটা তামার মাদুলিতে ভরে, তোমার হাতে বেঁধে দিলে, আর ওঁরা তোমায় কিছু বলবেন না।
বলো, দুমকার বনের কথা আরও বলো।
ওইখানে ছোটোবেলায় বাবুদের সঙ্গে পাখি শিকারে গিয়েছিলাম।
পাখি তো বিলের ধারে শিকার করতে হয়, আঃ, রমু, খালি খালি কাঁদ কেন?
সবুজ পায়রার গলায় বন্দুকের গুলি লাগলে রক্ত বেরোয় দেখেছি।
না, দিদি, না, সে সবুজ পায়রার সময় নয়। আমাদের বনে একরকম লালচে রঙেরল্যাজ-ঝোলা পাখি থাকে, মাথায় তাদের কালো ঝুঁটি, বাবুরা তাদের শিকার করে। সে পাখি বিলের ধারে থাকে না।
তারপর কী হল?
বাবুরা অন্য পাখি দেখে, ছোটো ছোটো জানোয়ার দেখে, কিন্তু সব ছেড়ে দেয়। এমনি সময় এক পাল বাঁদরের সামনে পড়ে গেল। বাঁদর মারতে ওরা যায়নি, শুধু শুধু মজা করে বন্দুক তুলতেই, বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, বাঁদরগুলো সব হাতজোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তাই দেখে বাবুরা হেসে উঠল, কিন্তু একজনার হাতের বন্দুককী করে জানি ছুটে গিয়ে, একটা বাঁদরমরে গেল। অমনি এক নিমেষে সব বাঁদর হাওয়া! মরা বাঁদরটা পর্যন্ত রইল না।
তোমার দুঃখ হয়নি, ঝগড়ু?
দুঃখ বলে দুঃখু, রমুদিদি? কিন্তু কী করি, বাবুরাও কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। আর কী আশ্চর্য কথা, বনটার চেহারাও যেন বদলে গেল। হঠাৎ একসময় সকলের খেয়াল হল, কোথাও একটা টু শব্দ নেই। গহন বনটা যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে, কোথাও একটা পাখি নেই, কাঠবেড়ালি নেই, পাতার খসখস শব্দ নেই, ঝোঁপের মধ্যে চকচকে চোখ নেই।
তারপর, ঝগড়ু?
০৮. তারপর বাবুদের মনে ভয় ঢুকে গেল
ঝগড়ু বললে, তারপর? তারপর বাবুদের মনে ভয় ঢুকে গেল, তারা বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচে। যার হাতের বন্দুক ছুটে গেছিল, সে যাচ্ছে সবার আগে, এমন সময় তাকে খরিশে ছোবলাল।
খরিশ? খরিশ কী, ঝগড়ু?
খরিশ আমাদের সাপ, রমুদিদি, ভারি তার তেজ। মাথায় তার খড়ম আঁকা থাকে।
তারপর লোকটা বোধ হয় মরে গেল?
না, বোগিদাদা, আমরা পাঁচজনা দুমকার ছেলে ছিলাম সাথে, মরবে কেন? তাকে আমরা ওষুধ করে বাঁচিয়ে দিলাম, তবে তাকে কথা দিতে হল আর বন্দুক ধরবে না।
তা কেন ঝগড়ু? তোমরাও তো জানোয়ার মার।
বোগিদাদা, আমরা মারি পেটের জ্বালায় কিংবা প্রাণের তরে। তারপর শোনোই-না, এমনি সময় আমার নাকে এল কী মিষ্টি গন্ধ সে আর কী বলব। বাবুরা এগিয়ে গেল, আমি খুঁজে খুঁজে মরি, দেখি গাছের গোড়ায় মাটি থেকে ফুটে আছে এক গোছা উঁইচাপা। কী তাদের রূপ দিদি, মনে হয় সাদা মোমের তৈরি, তার মধ্যে বেগুনি রঙের চিত্তির করা। আর ভূঁইচাপার পাশে মাটির উপর পড়ে আছে সাপের মাথার মণি।
না, ঝগড়ু, যা-তা বললে হবে না, আমাদের বইতে আছে, সাপের মাথায় মণি হয় না।
সে তো তুমি বললেই হবে না, বোগিদাদা, নিজের চোখে দেখলাম।
কোথায় সে?
আরি বাবা! সাপের মাথায় মণিতে হাত দেব আমি! তুমি কি পাগল হলে? তাহলে উনিই-বা আমাকে ছাড়বেন কেন? যেখানেই লুকোয়-না কেন, ঠিক খুঁজে বের করবেন। না, বোগিদাদা, যেখানকার জিনিস সেইখানেই রেখে ঘরে ফিরে এলাম।
সাপের মাথার মণি কেউ নেয় না, ঝগড়ু?
নেবে না কেন, দিদি? যাদের দেখাশুনো শেষ হয়ে গেছে, তারা নেয়। আমার যে এখনও ঢের বাকি আছে। চলোই-না মেলায়, সেখানে একটু খুঁজে দেখা যাবে।
ততক্ষণে মেলার কাছে ওরা পৌঁছে গেছে। কী নেই ওই মেলায়? বোগি রুমু মাথা উঁচু করে নাক তুলে বুক ভরে মেলার গন্ধ শুকে নিল। সব্বাই তেলেভাজা খাচ্ছে, পাঁপড় খাচ্ছে, আলুকাবলি খাচ্ছে, গোলাপি বাতাসা খাচ্ছে, টানাল্যাবেঞ্চুষ খাচ্ছে।
ঝগড়ু বলল, এদিকটা ঢের ভালো, দিদি, দেখো এই সব ভালো ভালো বাঁশি, আয়না, কাচের পুতুল, দু-আনা করে বিলিয়ে দিচ্ছে। দেখো কেমন কাচের চুড়ি, মোতির মালা, চুলের ফিতে। ছাঁচি পান খাবে? দিদিমা তো পানের কথা কিছু বলেননি—
ঝগড়ু এইরকম বলছে, এমন সময় একটা অদ্ভুত লোক এসে ওদের পাশে দাঁড়াল। বেজায় লম্বা, বেজায় রোগা, হাড়গোড় বের করা, গর্তের মধ্যে চোখঢোকা, তার ঢাকনি পিটপিট করছে, ভুরু নেই, ছককাটা সরু-ঠ্যাং পেন্টেলুন পরা, মাথায় একটা বারান্দাওয়ালা টুপি, বগলে রুপো-বাঁধানো ছড়ি আর একটা থলে, আর দশ আঙুলে দশটা চমৎকার লাল নীল পাথর-বসানো আংটি।
তাকে দেখেই বোগি রুমুকে অন্য পাশে টেনে নিল! তাই দেখে লোকটা সোনা দিয়ে মোড়া, সোনার পেরেক ফোঁটানো লম্বা লম্বা দাঁত বের করে খিকখিক করে হাসতে লাগল।
কোথায় সরাবে ওকে, খোকাবাবু, ইচ্ছে করলেই আমি ওকে এক্ষুনি একটা জোনাকি পোকা বানিয়ে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, তা জান? অমনি আমার কত আছে, এই দেখো। বলেই লোকটা হাতের মুঠো খুলে দেখাল, আট-দশটা কালো পোকা কিলবিল করছে।
রুমু বলল, যাও, বাজে কথা, ওগুলো মোটেই জোনাকি পোকা নয়, জোনাকি পোকাঁদের আলো জ্বলে।
লোকটা খুব হাসল। রাতে এদের দেখো খুকি, চোখে তাক লেগে যাবে। সুন্দর জিনিস চেন না? সাদা চোখে কালো কুচ্ছিত, নকল আলোয় চমৎকার।
পোকাগুলোকে লোকটা পকেটে পুরে রাখল।
ওরা মরে যাবে না?
গেলই-বা, এমনি আরও কত পাব।
বোগি রুমু একটু সরে দাঁড়াল। ঝগড়ু, চলো।
লোকটাও একটু ঘেঁষে এসে বলল, ভয় পাচ্ছ?
ঝগড়ু বলল, যাদের সঙ্গে সঙ্গে দুমকার ছেলে রয়েছে, তাদের আবার ভয় কীসের?
লোকটা খুব হাসল। উত্তর মেরুতেও ঘুরে এসেছি, ভয় কোথায় নেই বলতে পার?
ঝগড়ু বুক ফুলিয়ে বলল, দুমকায় ভয়ের জায়গা নেই।
নেই, যাবে আমার সঙ্গে ঘোর রাত্রে তোমাদের মহাশিরীষ গাছের তলায়?
ঝগড়ু বোগি রুমুর হাত ধরে টানতে লাগল, চলো, দিদিমা না অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে মানা করেছেন?
তাই শুনে লোকটা হেসেই খুন। কে অচেনা? যে মনের কথা জানতে পারে, তাকে দেখেনি বলেই ব্যস সে অচেনা হয়ে গেল? তোমার সাহস থাকতে পারে, কিন্তু বুদ্ধির বহরটি তো বেশ! তা ছাড়া আমার কাছ থেকে একটা কিছু না কিনে যেতে পাবে না।
না, না, ওদের কাছে বেশি পয়সা নেই, মেলা কেনবার আছে।
লোকটা রুমুকে বলল, ঘুম থেকে উঠে কী খেয়েছিলে, দিদি?
ডিমসেদ্ধ, রুটি, দুধ, কলা।
তারপর দুপুরে?
মাছ-ভাত।
আর আমি কী খেইছি জান? সেই কাল রাত্রে চাট্টিখানিক বকফুল ভাজা। তাও একজনকে ভাঁড়িয়ে, পাঁচটা মিথ্যে কথা বলে। মিথ্যে বলা ভারি খারাপ জান তো? কিনবে কিছু? সেই পয়সা দিয়ে আমি আলুকাবলি কিনে খাব।
ঝগড়ু তখনও বোগি রুমুর হাত ধরে টানছে। রুমু বলল, কই, দেখাও কী আছে?
লোকটা বলল, তিনফলা ছুরি কিনবে? বলেই একটা আশ্চর্য তিনফলা ঝিনুক দিয়ে বাঁধানো ছুরি বের করল।
ঝগড়ু বলল, না, ওতে ধার থাকে না।
তবে কি জাপানি তারের ধাঁধা কিনবে? বলেই একটা চকচকে সোনালি জড়ানোমড়ানো তারের গোছা বের করল।
না, ও দু-দিনে পাকিয়ে যায়।
তাহলে এই সাপের মাথার মণিটা কেনো। বলেই ফস করে থলে থেকে একটা লাল ন্যাকড়ার টুকরো বের করল। তার মধ্যে এই এত্ত বড়ো একটা সাদা পাথর হিরের মতো জ্বলজ্বল করছে, চারদিকে তার পল কাটা, তাতে রোদ পড়ে রামধনুর রং ঠিকরোচ্ছে।
ঝগড়ু চেঁচিয়ে বলল, দেখো রুমুদিদি, ওতে হাত দিলে, ভালো হবে না বলছি।
লোকটা হেসে বলল, কেন, কী হবে?
তাহলে আমি– দুমকা চলে যাব।
না, ঝগড়ু না, সাপের মাথার মণি নেব না। আর কী আছে দেখাও।
লোকটা রুমুর দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বলল, সাপের মাথার মণি দিতে আমারও একটু আপত্তি ছিল, খুকি, নেহাত তুমি বলেই দিচ্ছিলাম। তা ভালোই হল, কলজের জিনিস কি আর অন্য লোকের হাতে তুলে দিতে হয়? তবে তুমি কি বাক্সের ভিতর বাক্সের ভিতর বাক্সের ভিতর আশ্চর্য জিনিস নেবে? বলে একটা কাঠের বাক্স বের করল। এতটুকু, রমুর হাতের মুঠির সমান হবে। চীনে কারিগররা ছাড়া এ জিনিস বড়ো-একটা কেউ করে না, খুকি। এই দেখো কেমন ডিমের খোলার মতো পাতলা বাক্সের গা।
একটার ভিতর–একটার ভিতর একটা করে দশটা বাক্স বেরুল। শেষেরটার মুখ এঁটে রয়েছে, ঝাঁকালে ভিতরে কী নড়ে।
নখের কোনা দিয়ে খুঁটে লোকটা সে বাক্সটাও খুলে ফেলল। ভিতরে একটা লম্বা লাল বিচি, অনেকটা নিমের বিচির মতো, কিন্তু অনেক বড়। পালিশ করা চকচক করছে, এক কোনায় একটা সাদা চোখের মতো।
কী ওটা?
ওইখান দিয়ে ওর শেকড় গজাবে, দিদি। পৃথিবীতে এ-রকম গাছ আর একটাও পাবে না খুঁজে। পুঁতবে কিন্তু ছাইয়ের গাদায় কী আস্তাকুঁড়ে। ফুল যখন ধরবে দেখবে কোথায় লাগে পারিজাত। ভালো জায়গায় লাগালে ফুল ধরবে না কিন্তু।
ঝগড়ুর বোধ হয় একটু রাগ হয়েছিল, দূর থেকে টাকাটা ফেলে দিয়ে, ওদের টেনে নিয়ে চলল। প্রায় দৌড়ে চলল ঝগড়ু।
লোকটা গোড়ালি ঠুকে একটা সেলাম ঠুকল।
রুমু বলল, রাগ করলে, ঝগড়ু?
ঝগড়ু, ওদের হাত ছেড়ে দিয়ে, আস্তে আস্তে চলতে লাগল। না, দিদি রাগ করিনি। মাঝে মাঝে মনটা কেমন করে ওঠে। রাগ করিনি। ও গাছ হল গিয়ে মানুষের মনের গুণের মতো, কষ্ট না পেলে ফুটে ওঠে না। ওর নাম দিয়ো গুণমণি। আমাদের রান্নাঘরের পাশে ছাইগাদার মধ্যে পুঁতো।
০৯. বাড়ি ফিরেই ছাইগাদার মধ্যে
বাড়ি ফিরেই ছাইগাদার মধ্যে বোগি বিচিটা পুঁতে ফেলল। ঝগডু একটু হেসে বলল, কই নাচ গান হল না? গাছ পুঁতলে যে নাচতে হয়, গাইতে হয়।
রুমু বোগি কী করে? অবিশ্যি একটু নাচলে গাইলেও হয়। ঝগডু ছাড়া কেই-বা দেখবে। কিন্তু ঝগড়ুই বলল, এ গাছের জন্য নাচ-গান লাগে না, বোগিদাদা, অমনি পুঁতে দাও। এ হল দুঃখীদের গাছ, তোমাদের ঘটা করার জন্য বসে থাকবে না। তিন দিন বাদে দেখো এসে, ওর কল বেরুবে।
থেকে থেকে কালো ছেলেটার জ্বর হয়। ঝগড়ুর বউ তখন রাঁধা-বাড়া ফেলে তাকে দিনরাত বুকে করে বসে থাকে। রুমু ওর কপালে হাত দিয়ে দেখে, আগুনের মতো গরম।
একটু ওষুধ খাইয়ে দাও না, সেরে যাবে।
ঝগড়ুর বউ বলে, দুমকা থেকে মাদুলি আনতে দিয়েছি, দিদি, তাহলে আর জ্বর আসবে না।
ঝগড়ুকে বোগি জিজ্ঞেস করল, শেয়ালরা কুকুররা হলদে পাখি খেয়ে মানুষ হয়, তারপর যদি মরে যায়, তা হলে কি আবার শেয়াল কুকুর হয়ে যায়?
ঝগড়ু, তাই শুনে অবাক। মরে গেলে আবার শেয়াল কুকুর কী, বোগিদাদা? মরে গেলে মানুষই-বা কী? দেখো গিয়ে ছাইগাদায় গুণমণির কল গজিয়েছে।
ওমা তাই তো! বিচি পুঁতেছিল বোগি ছাইগাদার ঠিক মাঝখানে, কেমন করে সরে গিয়ে, ছাইগাদার একপাশে মস্ত একটা বাঁকানো বোঁটা দেখা যাচ্ছে।
দিদিমাও দেখতে এলেন। ওমা, ওই বুঝি তোদের সেই মেলায় কেনা শিম গাছ? ছুঁস নে, রুমু, ও জায়গাটা বড়ো নোংরা, ভালো জায়গায় লাগালি না কেন? তবে ওখানে সার পাবে যথেষ্ট, দেখতে দেখতে লকলকিয়ে উঠবে দেখিস।
ভালো জায়গায় লাগালে গুণমণির ফুল ধরবেনা। মেলার সেই লোকটা কোথায় থাকে কোথায় শোয় কে জানে? ঝগড়ুকে জিজ্ঞেস করতে হল।
ওই লোকটা? ওকে নিয়ে আবার তোমরা মাথা ঘামাচ্ছ? পাজির পা ঝাড়া ব্যাটা। কাচের গোলা নিয়ে বলে সাপের মাথার মণি!
ওটা সত্যি সাপের মাথার মণি নয় ঝগড়ু?
বোগিও বিরক্ত হল। তবে ওটা দেখে ঘাবড়াচ্ছিলে কেন? আমাদের হাত দিতে বারণ করেছিলে কেন? তোমার চালাকি আমরা বুঝি না ভেবেছ? সারাক্ষণ দুমকা দুমকা কর, কতদিন দুমকা যাওনি বলো তো?
ঝগড়ু জল গরমের কাঠ কাটছিল। কুড়ুল দিয়ে কাঠ লম্বা করে চিরে, কাঠের গাদায় কাঠটা আর কুড়লটা ফেলে দিয়ে, বারান্দার কোনায় ওদের পাশে পা ঝুলিয়ে বসল।
দিনের হিসাব আর রাখি না, বোগিদাদা। দুমকা যাবার আমার দরকারটাই-বা কী বল? আমার মনের মধ্যে আমি দুমকাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। দুমকায় কী করে যাই। সেখানে বড়ো কষ্ট।
কেন, তোমার মনের দুমকায় কষ্ট নেই?
ঝগড়ু, একবার বোগির মুখের দিকে, একবার রুমুর মুখের দিকে চেয়ে দেখে। কষ্ট কাকে বলে জান?
রুমু বলে, ভুলো চলে গেছে বলে আমাদের কষ্ট হয়, ঝগডু। ভুলোকে আমরা ভালোবাসি। তোমার বাড়ির লোকদের তুমি ভালোবাসো না?
ঝগড়ু হেসে বলল, তা আর বাসি না? বুড়ি মাকে মাস মাস টাকা পাঠাই। সে রুপোর পৈঁচে গড়িয়েছে। ভারি খুশি হয়েছে। আর বোশেখে আমার সবার ছোটো ভাই নানকুর বিয়ে দেব, যাব তখন।
নানকুর বিয়েতে আমাদের নিয়ে যাবে, ঝগড়ু? আমাদের দুমকায় যেতে ইচ্ছে করে।
সে তো আমার মনের দুমকায়, বোগিদাদা। পাহাড়ের ধারের ওই দুমকা হয়তো বদলে গেছে, শুনেছি ভালুকরা আর মহুয়া খেতে আসে না।
ঝগড়ু, তুমি কি ওই সত্যি দুমকাকে ভালোবাস না?
কী জানি দিদি, আজকাল আমার ভালোবাসাগুলো কেমন গুলিয়ে গেছে। তবে এটা ঠিক যে দুমকার মতো জায়গা নেই কোথাও।
দিদিমা ভুলোর থালা, ছেঁড়া কম্বল, আর চেন কলার জল গরমের ঘরের তাকে তুলে রাখলেন। কিন্তু দরজায় জানলায় যেখানে সেখানে ভুলোর নখের সব আঁচড়ের দাগ, বারান্দার দেয়ালে ভুলোর পিট ঠেসার দাগ।
ঝগড়ুর ঘরের কালো ছেলেটা রুমু-বোগির কোলে আর আসতে চায় না। ওদের দেখলে বউয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে।
বউ ওদের বুঝিয়ে বলে, জ্বর হলে ওদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, বোগিদাদা। রাতে ভালো ঘুমোয় না।
রুমু জিজ্ঞেস করল, সেই মাদুলি আনলে না? কীসের তৈরি হয় সে মাদুলি?
তা সে তামার হয়, সিসের হয়, অনেকরকম হয়।
সোনা রুপোর হয় না, বউ?
আমরা গরিব মানুষ, সোনা রুপো কোথায় পাব বল? দেখো গিয়ে তোমাদের শিম গাছে পাতা হয়েছে।
না। আমাদের গাছের উপর কাল ঝগড়ু, ভুলে ছাই ঢেলে দিয়েছে, গাছ মরে গেছে।
তোমরা দেখোই না গিয়ে।
গিয়ে দেখে সত্যি সত্যি রাতারাতি গুণমণি আরও খানিকটা লম্বা হয়ে, আবার ছাইগাদার উপর মাথা তুলে আছে, ছোটো ছোটো ফিকে সবুজ চারটি পাতা বাতাসে নড়ছে।
ঝগড়ু শুনে বলল, তাতে আর আশ্চর্যটা কী, বোগিদাদা? দুনিয়াটাই তো আশ্চর্য জিনিসে ঠাসা; তোমার বইওয়ালারা সেসব কথা না লিখলে আর আমি কী করব?
বোগি বলল, বইতেও অনেক আশ্চর্য জিনিসের কথা থাকে, ঝগড়ু। তুমি জানো উত্তর মেরুতে ছ-মাস করে রাত হয় আর ছমাস করে দিন হয়?
ঝগড়ুকে নিয়ে মহা মুশকিল, কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। হ্যাঁ! ছ-মাস ধরে দিন হয় বই কী! তবে কি বলতে চাও সূর্যটার ছ-মাস লাগে আকাশটা পেরুতে?
না ঝগড়ু আমার বইতে লিখেছে, ওখানকার সূর্য মাঝ আকাশ পর্যন্ত ওঠেই না, চাকার মতো আকাশের চারদিকে ঘোরে। প্রথমে, যেখানে মাঠ গিয়ে আকাশে মিশেছে– তাকে দিগন্ত বলে ঝগড়ু- সেইখানে চারদিকে বালার মতো ঘুরে আসে। তারপর তিন মাস ধরে একটু করে উঁচুতে উঠে ঘোরে। আবার তিন মাস ধরে একটু করে নীচে নেমে ঘোরে। শেষটা ছ-মাস হলে, গাছের পিছনে তলিয়ে যায়, তারপর ছমাস আর তার মুখ দেখা যায় না। জানতে এসব?
ঝগড়ু হেসে বলল, এত সব কথা বিশ্বাস কর বোগিদাদা, অথচ আমি যদি আমাদের জাদুকরা ছাগলের গল্প বলি, বিশ্বাস করবে না তো? বোগি রুমু ঝগড়ুর কাছে এসে বলল, বলো-না জাদু-করা ছাগলের গল্প, ঝগডু।
১০. তোমরা ছাগল ভালোবাস
ঝগড়ু বলল, তোমরা ছাগল ভালোবাস, দিদি
রুমু বলল, দাদুকে ছাগলে তাড়া করেছিল, জান ঝগড়ু?
বোগি বলল, হ্যাঁ, ভীষণ দুষ্টু হয় ওরা। ছাগলটা অনেকক্ষণ দাদুর পিছনে পিছনে ঘুরেছিল, যাতে দাদুর কোনোরকম সন্দেহ না হয়। তারপর একটি পেয়ারা গাছে শিঙে একটু শান দিয়ে নিয়ে, হঠাৎ তেড়ে এল। দাদু দারুণ ছুটতে পারে, জান ঝগড়ু? তবু অমরকাকাঁদের বারান্দায় উঠে তবে প্রাণ বাঁচল।
রুমু আরও বলল, আর দাদু বলেছে, ছাগলটা যখন দেখল শিকার হাতছাড়া হয়ে গেছে, তখন সে রেগে নাক দিয়ে হাওয়া ছাড়তে লাগল, আর মাটিতে খুর ঠুকতে লাগল। ভীষণ দুষ্টু হয়।
ঝগড়ু রাগ করে বলল, বেশ, তাহলে রইল জাদুকরা ছাগলের গল্প। কোথায় কার দাদুকে ছাগলে একটু তাড়া করেছিল, কামড়ায়নি পর্যন্ত, আর তাই সব ছাগল দুষ্টু হল, এ-রকম কথা তো কখনো শুনিনি। উঠি আমি, কাজ আছে অনেক।
না ঝগড়ু, না। দুমকার ছাগলের কথা বলিনি আমরা। বলতেই হবে তোমার গল্প।
ঝগড়ু, খুশি হয়ে বলল, আচ্ছা, তাহলে একটা পান মুখে দিয়ে আসি।
ঝগড়ু বলতে লাগল, আমার বুড়ো ঠাকুরদার কাচ তৈরির গল্প তো তোমাদের বলেইছি। তার ছেলে, আমার ঠাকুরদা ভারি নেশা করতেন।
ইস, কী খারাপ!
কেন, খারাপ কেন?
দিদিমা বলেছেন খারাপ লোকেরা নেশা করে।
তা বলতে পার তোমাদের ইচ্ছে হলে, তবে কী জান, খারাপ লোকেরা তো ভাতও খায়। আর আমার ঠাকুরদা অন্য কারণে নেশা করতেন।
কী কারণে বলল, ঝগডু।
কী মুশকিল, এত ভালো লোক ছিলেন সব বিষয়ে, আর নেশা করবার জন্য এক পয়সা খরচাও হত না, বন-ভরা মহুয়া ছিল, কত খাওয়া যায়। জান বোগিদাদা, উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চারটে তো মোটে দিক। তা ছাড়া এক যদি কয়লার খনিতে মাটির নীচে সেঁধিয়ে যাও, তাহলে আবার শুনেছি বাইরের চোখ-কান আর মনের চোখ-কান সবেতে নাকি ধাঁধা লেগে যায়। নয়তো আকাশে উপরের দিকে ডানা-ভাঙা চিলের মতো চেয়ে থাকা যায়। মোট কথা ঠাকুরদার অতটুকু জায়গাতে কুলোত না, তাই নেশা করতে হত। নেশা করা খারাপ হতে পারে, কিন্তু ঠাকুরদা খারাপ ছিলেন না।
না, না, আমরা জানতাম না। বলো তারপর।
তার উপরঠাকুরমার ছিল যেমনি রাগী স্বভাব, তেমনি গায়ে জোর। ঠাকুরদাকে নানারকম ফন্দি করে বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে থাকতে হত। অথচ বাড়ির মতো আরামটি কোথায় পাবেন?
তখন ঠাকুরদা বুদ্ধি করে ওখানকার সব চাইতে উঁচু পাহাড়ে ছাগল চরাতে যেতে আরম্ভ করলেন। ছাগলরা খুশিমতো চরে বেড়ায় আর ঠাকুরদা গাছতলায় পড়ে ঘুম লাগান। যেই সূর্য নেমে যায়, পাহাড়ের উপর থেকে রোদ সরে যায়, ঠাকুরদার শীত করে, আর অমনি ঘুম ভেঙে যায়, ছাগল গুনে নিয়ে ঠাকুরদা পাহাড় থেকে নেমে আসেন, ছাগল নিয়ে গিয়ে ঘরে তোলেন, ছোট্ট কাঁসার বালতিতে দুধ দোয়ান, তবে তার কাজ শেষ হয়।
একদিন কেমন যেন বেশি ঘুমিয়ে পড়েছেন, কখন রোদ নেমে গেছে টের পাননি। ঘুম ভাঙতে চেয়ে দেখেন গাছের ছায়াগুলো ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে, হিম পড়ছে, ছাগলরা পায়ের কাছে জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে।
ঠাকুরদা তাড়াতাড়ি ওদের নিয়ে নেমে এলেন। জায়গাটার নাম বড়ো খারাপ-ঠাকুরদা ছাড়া কেউ সেখানে যেতেই চায় না– ছাগল গুনে নেবার আর তর সইল না, সরাসরি বাড়িমুখো চললেন।
দোরগোড়ায় ছাগল গুনে ঠাকুমা দেখেন একটা ছাগল কম! ঠাকুরমার রাগ দেখে কে! সোনালিয়াকেই ছেড়ে এলে! এত নেশা কর! যাও তাকে খুঁজে নিয়ে এসো।
ঠাকুরদার নেশার ঘোর তখনও ছোটেনি, রাগ হল বটে, কিন্তু যা কান বোঁ বোঁ করছে, রাগটা আর দেখাতে পারলেন না। ফিরে গেলেন পাহাড়ে।
চাঁদের আলো ফুটফুট করছে, পাহাড়ে উঠে দেখেন সেই চাঁদের আলোয় হাজার হাজার ছাগল চরছে। মাঝখান দিয়ে ঝিরঝির করে এক ঝরনা বয়ে যাচ্ছে, তার এপারে-ওপারে ছাগল চরছে। কই দিনের বেলায় তো ঝরনা চোখে পড়েনি!
কয়েকজন দাড়িওয়ালা বুড়ো লোক ছাগল চরাচ্ছে, ঠাকুরদা তাদের কাছে গিয়ে সোনালিয়াকে চাইলেন। তারা উত্তর না দিয়ে ছাগলের পাল দেখিয়ে দিল।
ঠাকুরদা সোনালিয়াকে চিনতে পারেন না। যে ছাগলের দিকে তাকান তাকেই মনে হয় সোনালিয়া। রগড় দেখে দাড়িওয়ালা বুড়োরা হেসেই কুটোপাটি। সেই হাসি শোনবামাত্র ছাগলরা সব দলে দলে ঝরনা পার হয়ে চলে যেতে লাগল।
তখন ঠাকুরদা সামনে যাকে পেলেন, তাকেই মনে হল সোনালিয়া, তাকে কোলে তুলে নিয়ে, দৌড়োতে দৌড়োতে পাহাড় থেকে নেমে একেবারে বাড়িতে।
সোনালিয়াকে দুইতে গিয়ে ঠাকুরদা অবাক হয়ে গেলেন, বালতি ভরে দুধের গঙ্গা বয়ে যেতে লাগল, তবু থামে না। এমনসময় ঘরের দরজায় কে টোকা দিল।
গিয়ে দেখেন একজন দাড়িওয়ালা বুড়ো দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে, সঙ্গে তার সোনালিয়া। এতক্ষণে সত্যি সোনালিয়াকে চেনা গেল। ঠাকুরদা অন্য ছাগলটাকে এনে দিলেন। লোকটা যাবার আগে মুচকি হেসে ঠাকুরদার তামাকের দিকে দেখিয়ে দিল। দিলেন তাকে এক দলা তামাক, তার বদলে সে তাকে এই জিনিসটে দিয়ে গেল।
এই বলে ঝগড়ু তার কোঁচড় থেকে ছোট্ট একটা কালো গোল ফল বের করে দেখাল, তার বোঁটার কাছটা রুপো দিয়ে বাঁধানো।
কী হয় এতে, ঝগড়ু? কেন দিয়েছিল?
কী হয়? এ কাছে থাকলে লোকে স্বপ্ন দেখে বোগিদাদা, আর কোনো দুঃখু তার গায়ে লাগে না। নেশা করবারও দরকার লাগে না। চলো, চলো, মেঘ করে আসছে, দেখো এবার জোর জল পড়লে গুণমণির কী দশা হয়।
১১. রুমু দেখল কিছুতেই কিছু হয় না
রুমু দেখল কিছুতেই কিছু হয় না গুণমণির; ছাই দিয়ে চাপা পড়ে যায়, বৃষ্টির তোড়ে শুয়ে পড়ে, পরদিন সকালে আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়, জোড়া জোড়া পাতার কুঁড়ি ফুটে যায়। দিনে দিনে গুণমণি বাড়তে থাকে।
কিন্তু ভুলো আর আসে না।
দাদা, ভুলো একদিন কাদা পায়ে তোমার খাটে উঠেছিল বলে তুমি ওকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে কেন? রুমু খুব কাঁদতে থাকে।
ঝগড়ু এসে বলে, ও কী, খালি খালি চোখের জল! তবে আর সুখনের কথা কাকে বলি?রুমু চোখ মুছে বলে, কে সুখন, বলো ঝগড়ু।
ঝগড়ু বলে, আমার ছোটো ঝমরু, তার ছোটো সুখন, তার ছোটো নানকু। সুখনও মাটিতে শেকড় গাড়লে না।
মাটিতে কেন শেকড় গাড়বে, ঝগড়ু?
ফেরারি হয়ে রইল, দিদি, ঘর বাঁধল না কোথাও। আগে কিন্তু ভারি সুখের প্রাণ ছিল তার। ভালোটি খাবে, ভালোটি পরবে, এ চাই, ও চাই। সেই লোভে সর্দারের বোবা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলল সুখন, কারো মানা শুনল না। এমন সময় ভারি জলের কষ্ট হল সেবার।
আমাদের গাঁয়ের লোকে চাঁদা করে বড় ইদারা কাটাবে ঠিক করল। জল-খোঁজারা এল।
জল-খোঁজা কারা, ঝগড়ু?
তারা বেদেনি, বোগিদাদা। হাতে একটা তিনমুখো কাঁচা লাঠি নিয়ে ঘুরতে লাগল, পাহাড়ের কোলের কাছে এসে লাঠির মুখ বেঁকে মাটিতে ঠেকে গেল। বেদেনিরা সর্দারকে বলল, এইখানেই খোড়ো, সর্দার, এইখানে জল আছে।
অমনি আমাদের গাঁ-সুন্ধু লোকে, পুরুষ-মেয়ে, ছেলে-বুড়ো কোদাল নিয়ে লেগে গেল। খুঁড়তে খুঁড়তে এক মানুষ, দুই মানুষ মাপ করে করে যায়। আট মানুষ হয়ে গেল, তবু আর জল বেরোয় না।
বেদেনিদের আবার ধরে আনা হল। তারা তবুবলে, আছেই জল, ঝরনার মুখে কিছু বেধে আছে, বের করে ফেলো, জল পাবেই।
সেদিন বিকেলে খুঁড়তে খুঁড়তে সুখনের কোদালে কী একটা জিনিস লাগল। বের করে দেখে, পাথরের মতো শক্ত একটা বাঁশের চোঙ। কিছুতেই খুলতে পারল না, কোদাল দিয়ে ভেঙে ফেলতে হল। খানিকটা কাঠের গুঁড়োর মতো কী জিনিস ঝুরঝুর করে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল, আর পড়ল একটা ফিকে হলদে পাথরের মূর্তি।
আধ হাত লম্বা হবে দিদি, পাতলা ফিনফিন করছে, লতাপাতার মাঝখানে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ নীচু করে। পড়ন্ত রোদে সুখন তাকে হাতে করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। আমি কাছে যেতেই বলল, দেখো, দাদা, ওর বন্ধ চোখের তারা দিয়ে আমার বুকের ভিতর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।
ঘরে নিয়ে গেলাম মূর্তিটাকে। গা-সুন্ধু সবাই দেখতে এল। সর্দার বলল, ওর পুজো না দিলে খারাপ হবে সুখন, মাটি থেকে না তুললেই ভালো ছিল। বন্ধ চোখে দৃষ্টি থাকে এমন তো কখনো শুনিনি।
সর্দার বলল, সুখন, পুজো না দাও, কাল আমাকে সদরে যেতে হবে, ওকে সরকারের কাছে জমা দিয়ে আসি। এসব জিনিস ঘরে রাখতে নেই, সুখন।
তারপর কী হল, ঝগড়ু?
তারপর কী হল? সেই রাত্রেই মূর্তিটাকে নিয়ে সুখন কোথায় চলে গেল। আর তাকে দেখিনি।
মরে গেছে তা হলে।
সবাই মরবে কেন, বোগিদাদা? সুখন মোটেই মরেনি, মাঝে মাঝে দেশে টাকা পাঠায়। তবে ওর শেকড় কেটে গেছে।
তাহলে দেশকে ভালোবাসে না বোধ হয়।
দেশে না থাকলেই দেশকে ভালোবাসা যায় না? ভালোবাসার জিনিসকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে হবে নাকি?
আচ্ছা, আচ্ছা। আর ইঁদারার কী হল?
ইদারায় সে কী মিষ্টি জল উঠল, দিদি। এখনও আমাদের গাঁয়ের লোক ওই ইঁদারার জল খায়, ফটিকের মতো পরিষ্কার, মধুর মতো মিষ্টি। জষ্টিমাসে দারুণ খরার সময়ও ওই কুয়োতে দু-মানুষ জল থাকে। কিন্তু সুখনকে আর দেখলাম না।
তোমাদের বাড়ি কীরকম বলোনা ঝগড়ু।
মাটির বাড়ি বোগিদাদা, শীতের ভয়ে ছাদগুলো নীচু করে তৈরি। তবে চারদিকে ঘুরে উঁচু মেটে দাওয়া, গোবর দিয়ে নিকিয়ে আমার মা তকতকে করে রাখে। জানালার চাটাইয়ে, দোরের দুই পাশে আমার মা নিজের হাতে ফুল লতাপাতা মাছ শাঁখ এইসব এঁকে রাখে। সে দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়, বোগিদাদা, মনে হয় মনের পাখি ডানা ঝাঁপটানি বন্ধ করে বাসায় এসে বসুক। আমার মা রাঁধে ভালো, রুমুদিদি, মেয়েমানুষকে রাঁধা-বাড়া শিখতে হবে।
দিদিমা আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় না।
আঃ, রুমু, চুপ করো। বলল, ঝগড়ু, তুমি এতকাল দেশে যাও না, তোমাদের বাড়ি কেমন দেখতে হয়েছে জানলে কী করে?
বাঃ, তা জানব না, আমার চোখের মণিতে গাঁথা হয়ে থাকে, কেমন দেখতে জানব না?
দিদিমাকে বলে একবার যাও-না কেন ঝগড়ু? তোমার বুড়ি মা কত খুশি হবে।
নানকুর বিয়ে দিতে যাব মনে ঠাউরেছি। কী জান, দিদি, আমাদের গুষ্টির ছেলেরা যে ধানের চাল খাবে সে হেথা-হোথা কত দূর দূর দেশে বোনা হয়েছে।
তা কেন, ঝগড়ু? তোমার বাবা, ঠাকুরদা তো দেশে থাকত।
চিরকাল কি আর দেশে থাকত, বোগিদাদা? আমার বাবা সে একরকম ছিলেন। আর জন্তুজানোয়াররা ছিল তাদের ঘরের লোক। একবার দুমকার ঘোর জঙ্গলে কাঠের খোঁজে গিয়েছিলেন, দেখেন কিনা গাছের গোড়ায় একটা এতটুকু বনবেড়ালের বাচ্চা মিউমিউ করে কাঁদছে। বাবাকে দেখে সে দারুণ খুশি,দু-পা তুলে নেচে-টেচে একাকার। বাবা তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার চোখের দিকে চাইলেন। মনে হল তার হলদে চোখের পিছনে আলো জ্বলছে। বুকে করে বাবা তাকে ঘরে নিয়ে এলেন।
সে-রাত্রে আমাদের গায়ের কেউ ঘুমুতে পারল না, নেকড়ে বাঘ এসে সারা রাত দাপিয়ে বেড়াল। বাবা বনবেড়ালের বাচ্চাকে বুকে নিয়ে শুয়েছিলেন, শেষ রাত্রে মনে হল বাঘ বুঝি উঠোনে এসে কেঁদে বেড়াচ্ছে। জানলার ঝাঁপি খুলে বাবা তখন বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিলেন, অমনি নেকড়েও তাকে মুখে করে তুলে নিয়ে এক ছুটে চলে গেল।
তাহলে বনবেড়ালের বাচ্চা নয়, ঝগড়ু, নেকড়েরই বাচ্চা।
কী জানি, রমুদিদি, ওদের জাতই আলাদা। ওরা মানুষের বাচ্চাও পোষে তা জান? আমাদের। গাঁয়ের একটা ছোট্ট ছ-মাসের ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল, তার গলায় মোটা রুপোর কণ্ঠি ছিল। দশ বছর বাদেও নেকড়ের দলে একটা মানুষের ছেলেকে চার হাত-পায়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত, তার গলায় রুপোর কণ্ঠি।
ওর বাবা-মা ওকে ধরে আনল না কেন?
সে কি আর চেষ্টা করেনি, দিদি, মানুষ দেখলেই সে কামড়াতে আসত, ঝোঁপের মধ্যে মিলিয়ে যেত। যে মানুষের রক্তে নেকড়ের দুধ মিশেছে সে কি আর অন্য মানুষের মতো হয় কখন?
ঝগড়ু, তোমার বাবা চিরকাল দেশে থাকেননি বললে, কোথায় গেছিলেন?
বর্মা, জান বোগিদাদা? সমুদুরের ওপারে বর্মা আছে, সেইখানে।
বলো তোমার বাবার বর্মা যাওয়ার গল্প। এখন তার সময় কোথায় দিদি? ওই দেখো নাথু এল কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে।
১২. নাথু হল ঝগড়ুর বন্ধু
নাথু হল ঝগড়ুর বন্ধু। ঝগড়ুর জন্য নাথু ট্যাকে করে গুণ্ডি নিয়ে আসে। ঝগডুর বউ নাথুকে দেখতে পারে না, তাই নাথুর কাজ সারা হলে ঝগড়ু ওর সঙ্গে মোমলতার তলায় বসে গল্প করে।
বোগি বলে, কেন তোমার বউ নাথুকে দেখতে পারে না, ঝগড়ু?
নাথু মুচকি হেসে বলে, আমার পা দুটো ডুবে থাকে এখানকার নদীর জলে, কিন্তু মন কোথায় থাকে ঝগড়ুর বউ জানে না, তাই আমাকে দেখতে পারে না!
কেন, নাথু, কোথায় থাকে তোমার মন?
বাতাস দিলে তোমাদের বাঁশ বনের শিরশির সরসর শব্দ শুনেছ, দিদি? বাতাস থামলে কোথায় থাকে সেই শব্দ? অমন বোকার মতো কথা জিজ্ঞেস কোরো না।
বোগি বলল, ভারি বোকা রুমুটা, নাথু। যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে। আমি মজা করে বলেছিলাম, পুতুল ভেঙেছে কাদিস না, পুঁতে রাখ গাছ হবে। ও সত্যি পুঁতে রেখেছিল।
রুমু বলল, মোটেই আমি বোকা না। মোটেই আমি যে যা বলে বিশ্বাস করি না। খালি তুমি যা বল বিশ্বাস করি। রুমুর কান্না পাচ্ছিল।
নাথু তাড়াতাড়ি বলল, আর বিশ্বাস করবে নাই-বা কেন? কীসের গাছ হয় আর কীসের হয় না, তার তুমিই-বা কী জান, বোগিদাদা? যারই বুকের মধ্যে শেকড়ের কলি আছে তারই গাছ হয়। আমাদের গায়ের কাছে এক সাধু থাকত, তার একটা কানাকড়িও ছিল না। সেবার বান ডাকার পর দুর্ভিক্ষ হল। সে সারা গাঁকে দশ দিন খাওয়াল কী করে? খালি রাশি রাশি চকচকে পয়সা এনে দেয়। তারপর সরকারি সাহায্য এল, সবার দুঃখ ঘুচল, তখন লোকে বলল, সাধু, তুমি পয়সা জাল কর নাকি, অত নতুন পয়সা পেলে কোথায়?
তাকে নাস্তানাবুদ করল গাঁয়ের লোক, মনের দুঃখে সে আস্তানা ছেড়ে চলেই গেল! সে গেলে সবাই বলল, দাও জালিয়াত সাধুর ঘর পুড়িয়ে, ভণ্ডামি করবার জায়গা পায়নি।
ঘরে ঢুকে দেখে কয়েকটি মাটির বাসন আর একটা চট আর ঘরের মাঝখানে ছোটো একটা শুকনো গাছ। তাকে উপড়ে ফেলতেই বেরুল একটা পয়সা, তার চারদিকে গাছের শেকড় ছড়িয়ে রয়েছে। ও কীসের গাছ?
বোগি বলল, তাই বলে তো আর পয়সার বুকে শেকড়ের কলি থাকে না যে গাছ গজিয়ে উঠবে। ওটা আপনিই কেমন করে শেকড়ে জড়িয়ে গেছিল।
নাথু গাঁটরি তুলে মাথায় নিয়ে বলল, পয়সার বুকে শেকড়ের কলি না থাকলেও, দয়ার বুকে তো আছে।
নাথু, যেয়ো না, তুমি একবার কী মাছ ধরেছিলে সেই কথা বলো।
নাথু আবার গাঁটরি নামিয়ে রেখে বলল, ঝগড়ু, বলেছে বুঝি? ঝগড়ু, তুমি বড্ড বেশি কথা বল!
মনের কথা যাকে-তাকে বিলিয়ে দিতে হয় না। হ্যাঁ, তবে বোগিদাদা রুমুদিদিকে বলা যায়, ওদের চোখেও ঘোর আছে কিনা।
বলল, নাথু, বলো। ঝগড়ুকে বোকো না। ঝগড়ুর ঠাকুরদার ঠাকুরদার পাঁচটা বন ছিল। গাছপালা জন্তুজানোয়ার মৌচাক সব ভঁর ছিল। দারুণ সাহস ছিল তার; আর এই বুকের ছাতি।
একবার কুড়ল দিয়ে লম্বালম্বি ল্যাজের ডগা পর্যন্ত বাঘ চিরে ফেলেছিলেন।
একবার ডাকাতে ধরেছিল তাকে, গাঁ থেকে এক কোশ দূরে, এমনি জোরে গাল বাজিয়ে লোক ডেকেছিলেন যে ঝড় উঠেছিল, ডাকাতরা ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল!
শুনে নাথু খুব হাসল, কে বলেছে এসব? ঝগড়ু তো? ও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে তাও জান না? তবে শোনো আমার মাছ ধরার গল্প।
যারা জলে জলে কাজ করে, জান তো তাদের জলের নেশা লেগে যায়, জল ছেড়ে থাকতে পারে না। আমারও হল তাই। রোজ কাপুনি দিয়ে জ্বর আসে, সে কী দারুণ শীত সে আর কী বলব, বুকের ভিতরটা পর্যন্ত হিম হয়ে যায়, তারপর বিকেল বেলায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়। কাজও করতে পারি না, অথচ ঘরে শুয়েও থাকতে পারি না।
কেন, নাথু, শুয়ে থাকতে পার না কেন?
শুলে যে সময় চলে যায়, রুমুদিদি, একটু একটু করে সময় ফুরিয়ে যায়। শোনোই-না গল্প। আমাদের গাঁ ছেড়ে খানিকটা উত্তরে একটা আম গাছ আছে জলের কিনারায়। সেইটে ঠেস দিয়ে বসে মাছ ধরি। পোকামাকড়ের টোপ দিই না, দিদি, পোকামাকড়ে সাধারণ মাছ ওঠে।
সাধারণ মাছ উঠলে কী হয়, নাথু?
কী জ্বালা! সাধারণ মাছ তো হাটেও কিনতে পাওয়া যায়, ও দিয়ে আমি কী করব?
আচ্ছা, আচ্ছা, বলো।
একদিন আমি বঁড়শিতে একটা লাল টুকটুকে কুঁচফল গেঁথে ছিপ ফেললাম। ভারি জল তখন, আমাদের এখানে রোদ ঝকঝক করছে, কিন্তু নদীর গোড়ায় কোথায় বৃষ্টি পড়েছে, ভারি জোর স্রোত। ভাবছি এত স্রোতে মাছ পড়বে না, সারা গা রোদে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু বুকের বরফ কিছুতেই গলছে না, এমনি সময় সুতোয় টান লাগল। টেনে তাকে তুলতে পারি না, হাঁপ ধরে গেল, শেষে অনেক কষ্টে তাকে ডাঙায় ওঠালাম। ওরকম মাছ তোমরা চোখে দেখনি, বোগিদাদা, রুমুদিদি। দেখবেও না কখনো।
থামলে কেন নাথু? বলো, বলো।
আঃ! থামলাম সেকথা মনে করেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে বলে। শোনোমন দিয়ে। মাছটা দুই হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। রোদের আলোতে স্পষ্ট দেখলাম তার মাথা-ভরা কালচে সবুজ চুল ঘাড়ে গলায় লেপটে রয়েছে, ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে বড়ো কষ্টে নিঃশ্বাস ফেলছে, মুক্তোর সারির মতো দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে, কানের কাছে চুলের সঙ্গে বঁড়শি আটকে গেছে, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। ছোটো দু-টি কানে দুটি সোনার মাকড়ি পরা। দেখলাম পদ্মফুলের মতো হাত দুটি দিয়ে শক্ত করে ঘাস আঁকড়ে রয়েছে, নীল নীল শিরা দেখা যাচ্ছে, দিঘির মাঝখানকার মতো ঘন সবুজ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, বুটা কত যন্ত্রণায় উঠছে পড়ছে। কোমরের তলা থেকে মাছের মতো দেখতে, ল্যাজটার কী রঙের বাহার, ময়ূরের পেখমের মতো মেলে রয়েছে। দেখতে দেখতে আমার চোখের সামনে তার সব রং ফিকে হয়ে আসতে লাগল, নিঃশ্বাসের ওজন যেন এক-শো মন, দু-ফোঁটা চোখের জল আমার হাতে এসে পড়ল। অমনি আমার বুকের ভিতরকার বরফ গলে গেল, আমি তাড়াতাড়ি টাক থেকে আমার ছুরিটা বের করে ছিপের সুতো কেটে দিলাম। ভয় হল এখুনি বুঝি এলিয়ে পড়বে, কোলে তুলে তাকে মাঝ নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। সারা গা আমার ভিজে গেল। তারপর আর মনে নেই।
যখন জ্ঞান হল, দেখি ঘরে শুয়ে আছি, জ্বর গায়ে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য বাড়ির লোকেরা রাগারাগি করল। এখন যাই, বোগিদাদা রুমুদিদি। ঝগড়ুর গল্প সব সত্যি না-ও হতে পারে।ও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে।
যেতে যেতে থেমে বলে, এই আমার এক কানে সোনার মাকড়ি দেখছ, এটিকে পরদিন ওই আম গাছের তলায় পেয়েছিলাম।
নাথু গাঁটরি নিয়ে চলে গেল, আর ঝগড়ু হেসে বলল, জ্বরও হল গিয়ে স্বপ্নেরই জাতভাই, দাদা। স্বপ্ন দেখতে না পারলে আর পারলে কী? উঠি। গা-টা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, কাঠ ফেড়ে ঘাম করিয়ে শরীরটাকে ঝরঝরে করে ফেলি। কাল সারা রাত ঘুমোইনি, বোগিদাদা, চাঁদনি রাতে কুকুররাও ঘুমোয় না, আমারও চোখে ঘুম থাকে না, আমার শালার ছেলেটা কিন্তু খুব ঘুমিয়েছে।
চাঁদনি রাতে ভুলো তো ঘুমোত, ঝগড়ু।
ভুলো? সে তো সুখী কুকুর, সুখীদের ঘুমোতে বাধা নেই।
সুখী তো পালিয়ে যায় কেন, ঝগড়ু? সুখীরা পালায় না কে বলেছে দিদি? সুখীরা পালায় ওই সুখের কাছ থেকেই; দুঃখ পায় না বলে দুঃখকে খুঁজে বেড়ায়। বলব একদিন আমার বাবার বর্মা যাওয়ার কথা!
১৩. চাঁদনি রাতে দুঃখী কুকুররা
চাঁদনি রাতে দুঃখী কুকুররা সত্যি ঘুমোয় না, সারা রাত চাঁদের দিকে মুখ তুলে হু-হুঁ করে কাঁদে। তাই শুনে রুমুরও কান্না পায়, বোগির খাটে উঠে এসে শোয়।
ঝগড়ু এসে বলে, শুনবে নাকি আমার বাবার বর্মা যাওয়ার গল্প?
হা, ঝগড়ু শুনব।
বুঝলে, আমার ঠাকুরদার তখন খুব ভালো অবস্থা। আমার বাবা আর কাকা রাজার হালে থাকে, কাজকর্ম বিশেষ করতে হয় না, সারাদিন হরিণ শিকার করে, বাঁশি বাজিয়ে, মাছ ধরে ঘরে ফিরে মাংস-ভাত খেতে পায়। রাতে বিছানায় নরম তোশক পায়, কম্বল পায়। সোনার আংটিও হল দু জনার, যার যা শখ ছিল মিটে গেল! তখন তারা আর সইতে না পেরে একদিন ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল।
কেন, ঝগড়ু, ভালো ছিল তো, পালাল কেন?
শখ মিটে যাওয়া ভালো নয়, দিদি, তখন পালানো ছাড়া আর উপায় থাকে না।
ঝগডু!
কী, বোগিদাদা?
তোমার কী মনে হয় ভুলোর সব শখ মিটে গেছিল?
তা কী করে মিটবে, বোগিদাদা? কয়েকটা শখ তো মেটেনি জানি। যেমন আমার পায়ের গুলি কেটে নেবার শখ। রেবতীবাবুদের বেড়াল খাবার শখ। তোমার দাদুর ইজিচেয়ারে বসবার শখ। না, দাদা, ভুলোর শখ মিটতে দেরি আছে।
আচ্ছা, তোমার বাবার কথাই বলো। কোথায় গেল তারা?
কাঠের আড়তে লোক নিচ্ছিল, বর্মায় কাঠ কাটতে যেতে হবে। বাবা আর কাকা সেইখেনে গিয়ে নাম লিখিয়ে, সেই রাত্রের গাড়িতেই এক দলের সঙ্গে রওনা হয়ে গেল। গাঁয়ের কেউ জানতে পারল না। ঠাকুমা কেঁদে কেঁদে সারা।
তারপর বর্মা গেল বাবা আর কাকা। জাহাজ করে সমুদ্র পার হয়ে। সমুদুর জান দাদা?
বাঃ সমুদুর জানি না? পৃথিবীর তিন ভাগই তো সমুদ্র, আর শুধু এক ভাগ ড্যাঙা!
ঝগড়ু তাই শুনে কিছুতেই বিশ্বাস করেনা। হ্যাঁ, জীবনের বেশিটাই কেটে গেল, একবারও সমুদুর দেখলাম না, বললেই হল তিন ভাগ সমুদ্র! যদি জানতে, ওই সমুদ্র পৌঁছোতে আমার বাবা কাকাকে কত কষ্ট করতে হয়েছিল, তাহলে আর ওকথা বলতে না, দাদা।
রুমু বলল, আচ্ছা, দাদা, তুমি থামোনা। হ্যাঁ, ঝগড়ু, তারপর।
তারপর বর্মায় পৌঁছে দেখে সে কী দেশ গো! ছেলেদের ভারি মজা, মেয়েরাই সব কাজ করে। দেয়। বাবাদের দেখে দেখে হিংসে হয়–
এই-না বললে, সুখে থেকে আর সইতে পারছিল না ওরা, তবে আবার হিংসে কেন?
নাঃ, তোমরা বড়ো বোকা, সুখী লোকেরা হিংসুটে হবে না তো কারা হিংসুটে হবে? দুঃখীরা? দুঃখীরা তো সুখ কী তাই জানে না, তবে আর হিংসে করবে কেন? এখন গল্পটা শোনো তো!
বাবাদের পাঠিয়ে দিল একেবারে ঘোর জঙ্গলে, সেগুন গাছের ঘন বনে। সেখানে একটা ছোট্ট ডেরা ছিল। দারুণ বেঘো জঙ্গল, ডেরার চারদিক ঘিরে পনেরো হাত উঁচু করে শক্ত কাঠের দেয়াল করা। তার গায়ে একটা মজবুত দরজা। বাঘ নাকি পনেরো হাত লাফাতে পারে না। ডেরাতে বিশেষ কিছু নেই, ওরা বারোটা লোক সারা দিন কাঠ কাটে, সূর্য ডোবার আগে ডেরায় ফিরে আসে। একটা বড়ো ঘর, তাতে বারোটা খাঁটিয়া আর বারোটা পিঁড়ে, পাশে রান্নাঘর, ছোট্ট কুয়ো। আর কীই-বা লাগে? সারা রাত দরজা এঁটে ঘুমিয়ে থাকে সকলে, সকালে কাজে বেরোয়।
একদিন কাকার দারুণ জ্বর এল। জ্বরের হাত থেকে কোথাও নিস্তার নেই, দাদা। সবাই কাজে চলে গেল। কাকা একলা কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপটি করে পড়ে আছে। পায়ের কাছে দরজা খোলা।
এমনি সময় একটা শব্দ শুনে চোখ খুলে দেখে কিনা একটা এই বড়ো বাঘ বেড়া টপকে ভিতরে এল। কাকা তো কাঠ!
বাঘটা ঘরে ঢুকে একটু ঘুরঘুর ছোঁকছোঁক করে বেড়াল, চারধারে মানুষের গন্ধ বোধ হয় তাই কাকাকে অতটা লক্ষ করল না। কিন্তু কাকা স্পষ্ট দেখলেন বাঘ শুকে শুকে পিঁড়েগুলোকে গুনে। গেল। তারপর আবার যেমন এসেছিল লাফ দিয়ে বেড়া টপকে চলে গেল।
বিকেলে সবাই ফিরলে পর কাকা বাবাকে ডেকে সব কথা বলল। বলল, সবাইকে বলো। বাবা বলল, যাঃ, বাঘ কখনো অত উঁচুতে লাফাতে পারে না। আর এলই যদি, তোকে কিছু বলল না? তুই জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখে থাকবি।
কী করে কাকা! সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, কাকা দেখল প্রথম রাত্রে বাঘটা এসে একটা লোককে তুলে নিয়ে গেল। খানিক বাদে এসে আর একটাকেও নিয়ে গেল। তখন বাবা সবাইকে বলল, কিন্তু কেউ বেরুতে রাজি হল না, বলল, বাঘ কখনো মানুষ মুখে করে অতটা লাফাতে পারে? ওরা দু-জনে আছে কোথাও এইখানে।
শুধু বাবা কাকাকে বলল, চল, কোথায় যাবি।
একটু দূরে নদী, তার জলে কাঠ কেটে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সেইখানে নৌকো বাঁধা থাকে। কাকা বলল, ওইখানে চলো নৌকা করে গাঁয়ে চলে যাই।
নদীর ধারে গিয়ে ওরা দা দিয়ে কাঠ ছুলে কয়েকটা বল্লম বানিয়ে নিল। তারপর যেইনা নৌকোয় চড়েছে, বাঘও এসে হাজির। ততক্ষণে ওরা মাঝনদীতে। বাবা নৌকোর উপর উঠে দাঁড়িয়ে বাঘের বুক লক্ষ্য করে একটা বল্লম ছুঁড়ল। দুমকার ছেলের হাত ফসকায় না, বোগিদাদা, বল্লম গিয়ে বাঘের বুকে বিঁধল। বাঘও অমনি মানুষের মতো চিৎকার করে উঠল। আর বাবা টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়ল। কাকা তাকে টেনে নৌকোয় তুলে, দাঁড় বেয়ে, যত তাড়াতাড়ি পরে সেখান থেকে চলে গেল। নদীর বাঁকে ফিরে চেয়ে দেখেছিল, মনে হল, বুকে বল্লম বিঁধে পড়ে আছে ওটা হয়তো বাঘ নয়, বাঘের ছাল-পরা মানুষ।
তার মানে, ঝগড়ু?
কে জানে, সত্যি কোথায় শেষ হয়, স্বপ্ন কোথায় শুরু হয়? আর যায়নি ওরা ডেরায় ফিরে। গাঁ থেকে পালিয়ে চলে এল দেশে।
বোগি বলল, না ঝগড়ু, তোমার বর্মার গল্প ভালো না।
অমনি রুমুও কান্না ধরল, মরে গেল কেন? ও বিশ্রী গল্প। দাদা, ভুলো কেন আসছে না?
ঝগড়ু বলল, আসবে দিদি, আসবে। সময় হলে সব.এসে তোমার হাতের কাছে জড়ো হবে। আজ গুণমণিকে দেখেছ নাকি? লক্লক করে ছাদ ছোঁয় ছোঁয়। কুঁড়ি ধরেছে গুণমণির। আর তিনটে দিন সবুর করো না। আচ্ছা, যাবে আজ সন্ধ্যা বেলায় ম্যাজিক দেখতে? খেলার মাঠে এত বড়ো কানাত পড়েছে। চোখের সামনে যা হয় না তাই হচ্ছে। হাজার লোক অবাক হয়ে যাচ্ছে। চোখ মোছো দিকিনি। দিদিমাকে বলে চলো যাই।
১৪. বোগি কাপড় ছাড়তে ছাড়তে বলল
বোগি কাপড় ছাড়তে ছাড়তে বলল, আসলে কিন্তু ম্যাজিক হয় না, সব চালাকি। দাদু বলেছে সব হাত-সাফাইয়ের বুজরুকি! লোকেরা সেধে পয়সা দিয়ে বোকা বনতে যায়।
ঝগড়ু রুমুর জুতোর ফিতে বেঁধে দিয়ে বলল, ম্যাজিক যে একেবারেই হয় না, তা বোলো না, বোগিদাদা। এদের কথা আমি জানি না, কিন্তু মাঝে মাঝে এমন ব্যাপার ঘটে তাতে ম্যাজিক হয় না একথা বলা চলে না। ওই তো নাথু এসেছে, ও-ই বলবেখন।
নাথু, যাবে তুমিও ম্যাজিক দেখতে? আমাদের গল্প বলতে হবে কিন্তু।
নাথু খুব ভালো কাপড়জামা পরে, গোঁফ আঁচড়ে, এসেন্স মেখে, সেজেগুঁজে এসেছিল। পায়ে চকচকে পাম্পসু,। তার গোড়ালির কাছে তুলো গোঁজা। নাথু জুতো জোড়া বোগির খাটের তলায় লুকিয়ে রেখে ওদের সঙ্গে চলল।
ম্যাজিকের গল্প বলো এবার নাথু।
নাথু বলল, সে আর এমন কী কথা! বছর বারো আগে একবার হাটের দিনে একটা লোক এসে নানারকম ম্যাজিক দেখিয়ে, এক পয়সা দু-পয়সা নিচ্ছিল। লোকেরা সব মজা পেয়ে গেল। ওকে ঘিরে তারাও রগড় করতে লাগল। লোকটাকে একটু বোকা মতন মনে হয়েছিল।
ক্ষেত্ৰী বলে একজন দোকানদার ছিল। ভারি পাজি আর কেউ পয়সা রোজগার করছে দেখলে তার গা জ্বলে যেত। লোকটা তার কাছে আট আনার কীসব জিনিস কিনে যেই তাকে একটা আধুলি দিয়েছে, অমনি সেও ঢং করে অন্য হাত দিয়ে চাপা দিয়ে বলেছে, ফুসমন্তর লাগ লাগ লাগ– কই হে, আধুলি দাওনি তো, এ তো একটা পয়সা!
লোকটা একটু যেন অবাক হয়ে আবার একটা আধুলি দিয়েছে, অমনি আবার সেটা পয়সা হয়ে গেছে। হাটের লোকেদের হেসে হেসে পেটে ব্যথা ধরে গেল। লোকটা ভারি বোকা বনেছে তো।
তখন কে একজন বলল, আরে, তুমিও কি কিছু কম যাও নাকি হে? দাও না ওকে ধুলো-পড়া করে উড়িয়ে!
বলবামাত্র লোকটা একমুঠো ধুলো তুলে শূন্যে ছুঁড়ে দিল, আর হাটসুষ্ঠু সকলের সামনে থেকে ক্ষেত্ৰী অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন এমনি একটা শোরগোল উঠল যে তার মধ্যে কোন ফাঁকে যে সে লোকটা সরে পড়ল, কেউ টেরও পেল না। ক্ষেত্রীর টিকিটি আর কেউ দেখেনি। ম্যাজিক যে একেবারেই হয় না, তা বোলো না বোগিদাদা।
তারপর ক্ষেত্রীর কী হল?
সে আর আমি কী জানি। যেমনি ব্যাটা পাজি ছিল, তার ঠিক সাজাই হল। ও কী রুমুদিদি, আবার কী হল?
যদি কেউ ভুলোকে ধুলো-পড়া করে দেয়?
আহা, ভুলো তো আর দুষ্টু নয়, ভুলো তোমাদের ভালো কুকুর।
ভুলো যে দাদুর দুধ খেয়ে ফেলেছিল? অনিমেষবাবুকে কামড়েছিল? দিদিমার জামা ছিঁড়ে দিয়েছিল?
বোগি বলল, কেউ ভুলোকে ধুলো-পড়া করেনি রুমু, ন্যাকামি কোরো না। একটা রুমালও আনতে পার না।
ম্যাজিক দেখে বাড়ি ফেরবার সময় বোগি দেখে, রুমু ফ্রকের কেঁচড়ে করে কী নিয়ে চলেছে। আঃ, রুমু, ফ্রক নামাও, আবার পেট দেখা যাচ্ছে।
রুমু মাথা নাড়ল। ঝগড়ু, বলল, কী আছে দিদি? দাও আমার হাতে, আমি নিয়ে যাই। ও কী! তোমার তো ভারি সাহস হয়েছে দেখছি, অত বড়ো মাকড়সাকে কোলে তুলেছ?
বোগি ব্যস্ত হয়ে উঠল। ছিঃ রুমু, মাকড়সারা বিষাক্ত হয়, কী বলে ধরলে? ভয়ও করল না? ফেলে দাও, ঝগড়ু।
রুমু কেঁদে ফেলল, না, ঝগড়ু, না, ওর পাঁচটা ঠ্যাঙ, ওকে ফেলো না।
ঝগডু একটুক্ষণ কী ভেবে, পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে মাকড়সাটা তার মধ্যে পুরে নিল।
রুমু খুশি হয়ে বলল, এত দিন পরে!
নাথু বলল, ব্যাপার যেন ঘোরালো বলে মনে হচ্ছে, দিদি।
ঝগড়ু বলল, ওকে বিরক্ত কোরো না, নাথু। বলবার হলে বলবে, কারো মনের কথা কেড়ে নিতে হয় না।
রুমু জিজ্ঞেস করল, নিদুলি মন্ত্রটা কী, ঝগড়ু?
ঘুমিয়ে পড়বার মন্ত্র, দিদি, বদলে যাবার মন্ত্র।
ঘুমালেই কি বদলে যায়, ঝগড়ু?
ওদের কথা শুনে বোগি খানিকটা এগিয়ে এল, তুমি বেশ বদলে যাও, রুমু। শোবার সময়ে খিটখিট কর, কথায় কথায় কাঁদ। আর সকালে ওঠ হাসিমুখে। ঝগড়ু তুমি তো জান নিদুলি মন্ত্র?
বলেছিনা দুমকায় সবাই জানে নিদুলি মন্ত্র, দাদা। দুমকার ঘুম তো আর এখানকার ঘুমের মতো ছিল না। দুমকায় লোকে ঘুমোত এক চোখ আর এক কান খুলে রেখে। সেও একরকম ঘুম, আবার ঘুমোয় না এমন লোকও তো আছে। তাদেরই জন্য নিদুলি মন্ত্র হয়েছিল। ঘুম পাড়াবার মন্ত্র, বোগিদাদা। তোমার রাতে ঘুম হয় তো?
রুমু বলল, ও ঘুমোয়, আমার কিন্তু ঘুম হয় না। যখনই ঘুম ভেঙে যায়, তখনই দেখি জেগে আছি।
আরে, তা হলে তোমারই জন্য তো নিদুলি মন্ত্র, দিদি।
রুমুর আর পা চলতে চায় না, পা ব্যথা করে, এমন সময় ওরা বাড়ি এসে পৌঁছোয়। রাত্রে শুলে পরে ঝগড়ু এসে পা টিপে দেয়। রুমুর কী যে আরাম হয়; ঝগড়ুকে বলে, ঝগডু, তুমি কি ওই কালো ছেলেটাকে ভালোবাস?
তা বাসি বই কী, দিদি, বউয়ের ভাইয়ের ছেলে, ভালো না বেসে কি আর আমার উপায় আছে?
আচ্ছা, ঝগড়ু, ওকে না দেখলে তোমার কষ্ট হবে?
কষ্টকে ভয় করলে তো আর ভালোবাসা যায় না, দিদি। ওর বাবা-মা এসে ওকে নিয়ে গেলে আর দেখতে পাব না। ভুলোকে দেখতে পাচ্ছনা বলে তোমার কষ্ট হচ্ছে দিদি? তবে কি ভুলোকে ভালো না বাসলে ভালো হত?
রুমুহঠাৎ এক গাল হেসে বলল, ভুলো তো আবার আসবে।তুমি একটা সোনা রুপোর মাদুলি খুঁজে পাও না, ঝগড়ু?
কী হবে, দিদি?
বাঃ, তুমি-না বললে নিদুলি মন্ত্র দিয়ে যে কুকুররা শেয়ালরা হলদে পাখি খেয়ে মানুষ হয়ে যায়, তাদের আবার জানোয়ার করে দেওয়া যায়?কিন্তু সেভারিশক্ত, পাঁচ-ঠ্যাঙ মাকড়সা চাই, সোনা রুপোর মাদুলি চাই। বলনি তুমি?
বোগি অন্য খাট থেকে মাথা তুলে বলল, বলনি তুমি? তবে কি ফের বাজে বকছিলে? গাঁজাখুরি কথা বলছিলে, ঝগডু?
না, না, বোগিদাদা। বিশ্বাস করো, আমি যেমন করে পারি সোনা রুপোর মাদুলি এনে দেব। কিন্তু কাকে জানোয়ার বানাতে হবে তা বললে না?
১৫. রুমু বোগি উঠে বসল
রুমু বোগি উঠে বসল।
বলল, দাদা, তুমি বলো।
ঝগড়ু, ভুলো যেদিন পালিয়ে গিয়ে রাত করে ফিরেছিল, সেদিন ও কোথা থেকে হলদে পাখি খেয়ে এসেছিল, ওর ঠোঁটের কোনায় হলদে পালক গোঁজা ছিল।
সে কী, বোগিদাদা!
হ্যাঁ, ঝগড়ু, হ্যাঁ। পরদিন সকালে দেখি ভুলো নেই, কিন্তু তোমার ঘরে একটা কালো ছেলে। তার চোখ পাটকিলে রঙের আর কানের উপরদিকটা খোঁচামতে। তুমি মুখ ঢাকছ কেন, ঝগড়ু?
বেজায় আশ্চর্য লাগছে কিনা। কিন্তু ও যে আমার শালার ছেলে।
রুমু ব্যস্ত হয়ে উঠল। না, ঝগড়ু, ওই ভুলো। সোনা-রুপোর মাদুলিটা জোগাড় করা, অমনি দেখবে ও ভুলো। আচ্ছা ঝগড়ু, তোমার বউ কিছু বলবে না তো?
আরে বউকে কিছু বলে কাজ নেই। তবে নাথুর সাহায্য দরকার হবে। এক-আধ দিন অপেক্ষা করতে পারবে তোমরা? আমাদের গাঁয়ের লখনিয়া ময়ূর-মেয়ের জন্য চল্লিশ বছর অপেক্ষা করেছিল, আর তোমরা এক-আধ দিন অপেক্ষা করতে পারবে তো?
পারব, ঝগড়ু, পারব! ময়ূর-মেয়ের কথা বলল।
বুঝলে বোগিদাদা, লখনিয়া তোমাদের মতো ছিল, কষ্ট পাবার ভয়ে কাউকে ভালোবাসত না, কোনো মানুষকে না, কোনো জিনিসকে না। মানুষ চলে যায়, ভুলে যায়, মরে যায়, আর জিনিস ভেঙে যায়, চুরি যায়, হারিয়ে যায়, মরচে ধরে, পোকায় খায়। কী হবে ভালোবেসে?
মেলা টাকাপয়সা ছিল লখনিয়ার, দিব্যি খেত-দেত, ফুর্তি করত। একদিন চাঁদনি রাতে লখনিয়া পাশের গাঁ থেকে বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছে, দেখে মহুয়া গাছতলায় ময়ূর নাচছে।
যাঃ, শুধু মেঘলা দিনে ময়ূর নাচে।
না বোগিদাদা, চাঁদের আলোতেও ময়ূর নাচে। লখনিয়া তাই দেখে থমকে দাঁড়াল, ময়ূরটা নেচে নেচে একেবারে ওর সামনে এসে দাঁড়াল, কী জানি কেন লখনিয়ার তাকে ভালো লাগল। যেই ভালো লাগল, চোখের সামনে ময়ূরটা একটি সুন্দর মেয়ে হয়ে গেল। ময়ূরের পেখমের মতো ঝলমলে রূপ। চেয়ে চেয়ে আর লখনিয়ার মন ভরে না, হাত বাড়িয়ে যেই-না তাকে ধরতে গেল, অমনি বাতাসের মতো মিষ্টি সুরে বলল, অত সহজে পাওয়া যায় না, লখনিয়া, অপেক্ষা করতে হয়। বলেই কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেল।
সবাই বলল, লখনিয়া বিয়েবাড়িতে নেশা করেছিল, কী দেখতে কী দেখেছে। কিন্তু লখনিয়া ময়ূর-মেয়ের জন্য চল্লিশ বছর অপেক্ষা করেছিল।
থামলে কেন, ঝগড়ু, তারপর সে এসেছিল?
তা আর আসবেনা? ততদিনে লখনিয়া বুড়ো হয়ে গেছিল, চোখে ভালো দেখতে পেত না, কিন্তু তবু ময়ূর-মেয়ের রূপটি ঠিক চিনতে পেরেছিল। মরার আগে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল, মুখোনি হাসিতে ভরে গেছিল। এটাও বিশ্রী গল্প, দিদি?
রুমু বলল, না, ঝগড়ু, খুব ভালো গল্প।
বোগি বলল, তাই বলে সত্যি করে ময়ূর কখনো মানুষ হয় না!
ঝগড়ু, একটু হেসে উঠে গেল।
চারদিকের শব্দ যেন ক্রমে দূরে সরে যেতে লাগল। টেবিলের উপর ঘড়ির টিকটিক কখনো এত জোরে মনে হয় যে কান ঝালাপালা হয়ে যায়; আবার তারপরই এত দূরে সরে যায় যে প্রায় শোনাই যায় না। চারদিক চুপ হয়ে যায়, এত চুপচাপ যে কানে তালা লেগে যায়। ঘুমে বোগির চোখ জড়িয়ে আসছে, মনে পড়ল সেজো মামা বলেছে কানের মধ্যে বোঁ বোঁ আওয়াজ হল নিজের রক্ত চলাচলের শব্দ।
ঠিক তারপরেই যেন সকাল হয়ে গেল। দিদিমা দরজা খুলে, জানলার পর্দা সরিয়ে বললেন, কত ঘুমুবি তোরা? ওঠ শিগগির, চেয়ে দেখ তোদের আঁস্তাকুড়ের শিম গাছে কী সুন্দর ফুল ধরেছে!
এক লাফে রুমু বোগি রান্নাঘরের সামনে। একটা-দুটো ফুল নয়, ছড়া ছড়া ফুল, ফিকে নীল, গাঢ় নীল, বেগনি, গোলাপি, আশ্চর্য তাদের রং, প্রজাপতির মতো গড়ন, মিহি এক্টা সুগন্ধ।
ঝগড়ুও এল একটু বাদে, কুয়ো থেকে জল তোলা হলে।নাথুও এসেছিল কাপড়ের গাঁটরি মাথায় করে। গুণমণির ফুল ধরেছে। একটা বিড়ি খাইয়ে দাও, ঝগডু, আজ বড়ো ভালো দিন।
নাথুকে নিয়ে ঝগড়ু, কুয়োতলায় গেলে পর ঝগড়ুর বউ এল কালো ছেলেটাকে কোলে করে গুণমণিকে দেখতে; ছেলেটার গায়ে লাল ফতুয়া।
কী রূপ গো, দিদি, বাড়িখানি আলো হয়ে গেছে!
ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে, বউ ছেলেটার গায়ের ফতুয়া ছাড়িয়ে দিল। তার গলায় একটা সোনা রুপোর মাদুলি বাঁধা।
কী দেখছ, দিদি, দাদা কাল রাতে পাঠিয়েছে দুমকা থেকে, জ্বর বন্ধ হবার জন্য।
তুমি যে বলেছিলে সোনা রুপো কেনবার পয়সা নেই?
কী জানি, দিদি, পাঠিয়েছে তো দেখছি।
সেদিন বিকেল বেলায় ভুলো ফিরে এল। নোংরা, ধুলো-মাখা গলায় একটা নারকোলের দড়ি বাঁধা, হাঁপাতে হাঁপাতে জিব ঝোলাতে ঝোলাতে এল। রুমু বোগিকে দূর থেকে দেখেই ভুলো দৌড়োতে লাগল। কাছে এসে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নোংরা পা দিয়ে ওদের কাপড়চোপড় ময়লা করে দিয়ে, ওদের মুখ চোখ চেটে একাকার করল।
দিদিমা এসে বললেন, স্নান না করিয়ে ছুঁসনে ছুঁসনে বলছি!
দাদু বললেন, দেখেছ ব্যাটার কাণ্ড! কেউ বেঁধে রেখেছিল নিশ্চয়।
এমন সময় ঝগড়ু, এসে দাঁড়াল।
ভুলোকে ফেলে রুমু ঝগড়ুর গলা জড়িয়ে ধরল। আর ভুলোও সেই সুযোগে দিল ঝগড়ুর পায়ের গুলিতে দাঁত বসিয়ে। পেজোমি একটুও কমেনি।
অনেক পরে, রাতে, ভুলোকে ঘরে নিয়ে শুয়ে বোগি বলল, রুমু!
কী দাদা?
ঝগড়ুর ঘরে কালো ছেলেটা নেই। বউ বলল, ওর বাবা-মা ওকে নিয়ে দুমকায় চলে গেছে।
সত্যি, দাদা, সত্যি?
নেই তো দেখলাম।
ও-ই তবে ভুলো, না দাদা? সত্যিই তবে ও-ই ভুলো।
কী জানি রুমু; ঝগড়ু বলে সত্যি যে কোথায় শেষ হয়, স্বপ্ন যে কোথায় শুরু হয় বলা মুশকিল।
লীলা মজুমদার (ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯০৮ – এপ্রিল ৫, ২০০৭) ছিলেন বিশিষ্ট লেখিকা। তিনি কলকাতার রায় পরিবারের প্রমদারঞ্জন রায় ও সুরমাদেবীর সন্তান। তাঁর জন্ম রায় পরিবারের গড়পাড় রোডের বাড়িতে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (যাঁর পৈতৃক নাম ছিল কামদারঞ্জন) ছিলেন প্রমদারঞ্জনের ভাই এবং লীলার কাকা। সেই সূত্রে লীলা হলেন সুকুমার রায়ের খুড়তুতো বোন এবং সত্যজিৎ রায়ের পিসি।
লীলার বাল্যজীবন কাটে শিলঙে। যেখানকার লরেটো কনভেন্টে তিনি পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি পরীক্ষায় তিনি ইংরাজিতে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন। পারিবারিক ধারার সঙ্গে মিশে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গেও তার পরিচয়টা ছিল গভীর। তার স্বামীর নাম ছিল ডা. সুধীর কুমার মজুমদার। লীলা মজুমদার ও সুধীর কুমার মজুমদারের ছিল দুই ছেলেমেয়ে। স্বামী, ছেলেমেয়ে, সংসার, কর্মজীবন সবকিছু ছাপিয়ে লীলা মজুমদার ছিলেন লেখিকা। যিনি অকাতরে দিয়েছেন কিশোর সাহিত্যকে। ভূতের গল্পে যার জুড়ি মেলা ভার। যিনি রচনা করতেন অদ্ভূতুড়ে সব স্বপ্ন। যে স্বপ্ন কেবল ছোটরাই দেখে। ভীষণ দ্যুতিময় তার গল্প বলার ঢঙ। তার কল্পনা আকাশ ছুঁয়ে যায়।
তিনি বহু বাংলা গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস রচনা করে অনেক পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেন। তিনি অনেক শিক্ষামূলক রচনা ও রম্যরচনা ইংরাজি থেকে বাংলায় অনুবাদও করেন। তাঁর প্রথম গল্প লক্ষ্মীছাড়া ১৯২২ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় সন্দেশ পত্রিকা পুনর্জীবিত করলে তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪ অবধি সাম্মানিক সহ সম্পাদক হিসাবে পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; ১৯৯৪-এ স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য অবসর নেন।