মিছিল খন্দকারের গুচ্ছকবিতা
মায়ের কবর
গাঢ় শীতরাতে আমি কবরস্থানের দিকে বয়ে যেতে থাকি। ভাবি, যে কোনো ভাঙা কবরে ঢুকে দেব নিরীহ ঘুম, কিংবা আদতে ঘুমাতে পারি কিনা; দেখি। পথে ভাবনার দিক বদলায়। আর পরিজন হাওয়া— কেমন ঠাণ্ডা হাত তার, যেন ইয়ার্কি করে তার ভেজা হিম করতল শরীরে ঢুকিয়ে দেয়। গাছে গাছে শরশর করে ওঠে পাতা। এসব গাছ সব মৃতদের সুহৃদ কবরের আশপাশে সন্ত ভূমিকায় দাঁড়ানো। যে কোনো কবরের পাশে গাছের লাইনে দাঁড়িয়ে আমি পাঠ করি নিজের কিংবা পছন্দসই যে কারও কবিতা। কার যে কলধ্বনি আমার ভেতরে তখন হু হু করে বাজে, সামান্য পরিচিত লাগে কিংবা লাগে না, নাকি বাতাসের কারসাজি দূরাগত যে কোনো সংকেত? যে কোনো কবরকে আমার আসলে মায়ের কবর মনে হয়!ইবাদত
সারা দিন জিগিরে জিগিরে সারা রাত ধ্যানে জায়নামাজে আমার সকল পূণ্য পাপ তুলে দেব প্রভুর জাহাজে।
খেলনা জীবনের চাকা
বলার অধিক কতো কলস্বর কথায় কথায় হাতের রেখার মধ্যে ফুঁসে ওঠে বিগত নদীরা তাড়িত বিদ্যুত লেগে রক্ত আর(ও) উজ্জ্বলতা চায় আর জ্বলি আর নিভি, সব জুড়ে না বলার পীড়া। অথচ খেলেছে কথা, হাতে হাতে চলেছে ইশারা নদীর পাশেই শুয়ে নদী হতে চাওয়া(র) বাহানা বুকের ভেতরে ঢুকে খুঁজে দেখা তৃষ্ণানেভা ধারা পাওনা ফিরিয়ে দিয়ে পেতে চাই যা-ই পেতে মানা!
পাওয়ার কিছু নেই, আছে শুধু ফুঁ’য়ে ওড়া চুল এমন দৃশ্যের দিকে চোখ তাক করে করে রাখা যতোটা দেখেছো দৃশ্যে তার সব নয়তো নির্ভুল। নাই থাক, খেলনা জীবনে এই আছে তাও চাকা পাশাপাশি বয়ে যাই, যেতে চাই জীবনতো যায় না চাওয়া এখানে এসেছে আজ, সেও পেতে ধায়!
মৃত্যুচিন্তা
বন থেকে কতো দূরে ছাপাখানা- একটা শিমুল গাছ বাতাসের কাছে জানতে চায় রোজ।
মৃত্যুর পরে লেখা নিজের কবর আমি নিজেই খুঁড়েছিরে মিথুন। আর শরীরে আগুন ধরিয়ে তাতে ঢুকে পড়েছি, শীতে মানুষ যেভাবে ঢোকে লেপের ভেতরে। তখন হয়তো শ্রাবণ মাসের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে জলে ও পিতলে, গির্জার ঘণ্টাধ্বনিতে, সাবলীল সন্ধ্যার টিনে, বর্ষার আঁচে গলে যাওয়া উঠানে, ভেসে ওঠা আনত কোনো গ্রামে। পানিতে পূর্ণিমা চাঁদ খুটে খাচ্ছে মাছ, বৃষ্টির তবলা ধ্বনি মিশে যাচ্ছে মোয়াজ্জিনের আজানে।আর এদিকে, অভ্যাসবশত বৃষ্টি ভিজতে ভিজতে জ্বর বাধিয়েছে আমার কংকাল। আমাদের জাগতিক স্মৃতি জ্বলে উঠছে মেঘের মলাটে, বিদ্যুতে। জীবনের ঝাল হাসছে বজ্রপাতের নিনাদে। তখন অত রাতে, বৃষ্টিতে একা একা তুই বোকা কী করছিস ছাদে!
দুঃখ থেকে সটকে পড়ার কৌশল যে কোনো মেঘলা সন্ধ্যায় আমি পৃথিবীর সব থেকে দুঃখী কবিতাটি লিখব নিশ্চিত! যা পাঠে বৃক্ষরা বনভূমি ছেড়ে ছ’মাইল হেঁটে এসে উঁকি দেবে, কবির তন্দ্রাভুখ জানালায়। দুঃখকে জলের খনি ভেবে শুকনো নদীরাও ছুটবে, হৃত যৌবন পুনরুদ্ধারের আশায়। সমুদ্র পা টিপে এসে ঠাঁয় বসে থাকবে অদূরে; দরজার কাছে। চাটগাঁয়ের ছোট ছোট টিলা, রাঙামাটি ও বান্দরবানের পাহাড়— এ খবরে দ্রুত রওনা হবে বাসে। চাঁদ এসে বসবে উড়ে বারান্দার গ্রিলে। প্রিয় সব বন্ধুরা দুঃখকে বদপাখি ভেবে, তাড়িয়ে দিতে চাইবে ঢিলে। এবং দুঃখ দেখতে দলে দলে উৎসুক নারীর দঙ্গল এসে, উঁকি মারবে বাড়ির পাঁচিলে। আমি তখন দুঃখ রেখে ফাঁক বুঝে সটকে পড়ব, এত সবের মিছিলে। হৃৎপিণ্ড যতটা নীল ভাব, ততটা নীল নয় কিছুটা বিভ্রম, চোখেতো লেগে রয়। দূরেরও চাওয়া থাকে, দেখবে কাছ থেকে অতটা বাঁকা নয়, যতটা গেছি বেঁকে। সে ভালো বেঁকে যাওয়া, বৃত্ত হতে গেলে ঘুরব চারপাশে, কেন্দ্রে তাকে পেলে। সে ঠিক আমি নয়, আমিও নয় সে এ টান চোরাটান, বুঝেছি বয়সে। যা দেখি আসলে তো সবটা দেখা নয় আমি যা ঠিক দেখি, তার তা ভুল হয়। ভুলকে ভুল বলা, কতটা ভুল-ঠিক? আমার গভীরে সে চলছে টিকটিক। বায়বীয় ছায়া আমাদের বাগানের স্কুলে যে সব সুদর্শন গাছ দুই যুগ ধরে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত— পুকুরের আয়নায় তাদের ছায়া বাতাসে যখন দোল খায়; অবাক চোখে তাকায় মাছেরা ছায়ার রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে— প্রকৃত অর্থে, গাছকে তখন তারা বায়বীয় ছায়া মনে করে! নৌকা মাকে আমার আদতেই এক শব্দের বিচ্ছিন্ন বকুল ফুল মনে হয়নি। যেমন বাবাকে মনে হয় না সাঁকোহীন মায়ের ওপাড়। বরঞ্চ তাদের দুজনকে মিলেই আমার মনে হয়েছে একটা নৌকা— মা যার ছই আবৃত পাটাতন ও গলুই বাবা যার পাল এবং বৈঠা। মন খারাপ সুহৃদ তুলসী পাতা, লেবু ফুল বারান্দায় ঢুকে পড়া ঘ্রাণ, নির্ভুল বাতাসে ঝরা আমলকি — কেউই মানো বা না মানো, নিশ্চয়ই কোথাও মানুষ খুব কষ্টে আছে, না হলে আজ আমার এত মন খারাপ হবে কেন! সম্পর্কের মিথ যার সাথে যার মেলে, তার সাথে তার দেখা হয় কদাচিৎ! বাড়ি ফেরা তারপর সরের মতোন ছড়িয়ে পড়বে রোদ। বিনা বাক্য ব্যয়ে ভোর কাঁচুলি খুলে দেবে, নামাজ ফেরত মুসল্লিরা দেখার চেষ্টা করবে আমি আদতেই সেই আমি কিনা। চকিত সালাম বিনিময়ে তাদের উৎসুক দৃষ্টির সুরাহা না করে, প্রকৃত কাঙ্ক্ষার নিকটে পৌঁছে গেলে আমার আভাস রিকশার টুংটাঙে কড়া নাড়ার আগেই, অভ্যস্ত হাতে খুলে যাবে পরিচিত দরজার কবাট। ও পাশের প্রতীক্ষিত মুখে তখন শিশুর বিস্ময়! যেন আমি না জানিয়েই এসেছি চলে সেই খুশিতে মুখে নেই কোনো রা! অথচ সে জানতই— সকালের প্রথম কড়া নাড়াটা হবে কার। আব্বা, আমাকে তখন বাবা মনে হবে আপনার!