আজ ২১ ডিসেম্বর কবি, কথাসাহিত্যিক শ্রীজাত’র শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
১
না, তুমি অক্ষত আছো। আঁচড়ও লাগেনি।
যা হয়েছে, দূর দেশে। পাশের বাড়িতে।
জীবিতের ধর্ম বহু। মৃত এক শ্রেণি।
সেহেতু সুবিধে হয় মাথা গুনে নিতে।
যেসব মাথার কোনও ধড় নেই আর
তাদের কথার দায় কে নেবে তাহলে?
তোমার শহর শান্ত, নিস্পৃহ বাজার
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়, অন্য কথা ব’লে
তুমিও তো অন্য লোক, অন্য কোনও নামে
বেঁচে আছো জুড়ে থাকা ধড়ে ও মাথায়…
জল গড়ায় বহু দূর। রক্ত কিন্তু থামে।
সে কী বলছে? ভুলে যেতে? ডাকছে না তোমায়?
যে এখনও ভেবে দেখছ, পথে নামবে কি না –
আমি তার মনুষ্যত্ব স্বীকার করি না!
২
ওকে যা যা বলতে দাওনি, আমি বলব সেটা।
আমি যা পারব না, কেউ ঠিক বলে দেবে।
আমরা তো অক্ষরমাত্র, সময়ই প্রণেতা
দেহ গুনে সবটুকু পাবে না হিসেবে।
এ গ্রন্থ বিরাট। তাকে পড়া শুরু করো।
আমরা যে ছিলাম, আছি, থাকব – জেনে নাও।
মৃতদেহ একইসঙ্গে নীরব, মুখরও
না হলে তো জন্মাত না এই কবিতাও।
পাঁচ আঙুল কাটা গেলে দশ আঙুল জাগে
মুঠো হয়ে গেলে তাতে থাকে না বিভেদ
কাকে মারছ তা অন্তত বুঝে নাও আগে –
তোমার আক্রোশ থাকলে তারও আছে জেদ
তুমি যদি বারংবার কোপ মারতে পারো,
ছিন্ন কাঁধে ফের মাথা জন্মাবে আমারও!
৩
মেঘ করে এসেছে এই সমুদ্রের ধারে
বাতাস জীবন্ত শুধু। বাকি সব ক্লীব।
কে দোষী সাব্যস্ত হয়, জলের বিচারে?
বালিতে বিছিয়ে আছে অগনন জিভ…
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্রুশ আর শেকলও –
সে কোন জেরুজালেম? আর এ কোন ঢাকা?
কোনওভাবে যদি তুমি সত্যি কথা বলো,
হিংসা ঠিকই বুঝে নেয় নিজের এলাকা।
সে যেটা বোঝে না, এই সমুদ্র প্রাচীন।
জিভের সমস্ত বাক্য শুষে নিয়ে বালি
জীবন্ত বাতাসে মিশে যাবে একদিন…
কেটে নেওয়া জিভগুলো পড়ে থাকবে খালি।
মৃত্যুরও বলার থাকে কিছু কিছু কথা –
সহজে মরে না কারও বাক-স্বাধীনতা।
৪
অমুক বিষয়ে তুমি লিখেছিলে কিছু?
তাহলে এখন কেন প্রতিবাদী এত?
যেখানে সবার মাথা মাটি ছুঁয়ে নিচু,
সেখানে মিথ্যেও কত সহজে বিখ্যাত।
না, লিখিনি। তাহলে কি এখনও লিখব না?
ধর্মের সমীকরণে কাটাব সময়?
ধিক্কারেও দিক দেখাবে পদবি-ভজনা?
যে-ধর্ম এসব বলে, সে আমার নয়।
যে-সত্যির জন্যে আজও প্রাণ দিতে হয় –
সে হিন্দু না মুসলমান? সে বৌদ্ধ না শিখ?
কারও মাথা উপড়ে যায়, কারও মনে সয়…
কারও মৃত্যুদিন আর কারও বা তারিখ।
হত্যাই হিংসার ধর্ম। এ-কথা জেনেও
যে মৃতের ধর্ম খুঁজছ, মৌলবাদী সে-ও।
৫
রাগ তুলে রাখছি আর পড়ে আসছে রোদ…
কার যেন কোথায় কবে এমনি মরে যাওয়া?
গেরস্ত উঠোনে ডাই রান্নার রসদ –
আনমনে রক্ত দিয়ে নিকিয়েছি দাওয়া
দরগার জমিতে ফোটে মা কালীর জবা
মা মেরির উড়নি বাঁধা গাঁয়ের মসজিদে
এত দূর পৌঁছয় না মিছিল আর সভা
এখানে শাসন করে সোজাসাপটা খিদে।
দিন শেষে দানা চাই। দরজা দিয়ে বসি।
শ্মশানে কাদের ছেলে এনেছে পোড়াতে?
আজ সে-বাড়ি খাওয়া নেই। বাপ-মা উপোসী।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে। হে
জননী, আজও যদি আঁচলে আবৃত,
তোমার সন্তান তবে এমনিতেই মৃত।
৬
দুটো রুটি বেশি পাবে। পৈতে খোলো আগে।
মকুব হয়ে যাবে সুদ। তসবি ছেড়ে এসো।
মিলবে না সুবিধে, যদি গির্জা ভাল লাগে।
যেখানে যেমন পারে, শর্ত দেয় দেশও।
গরিব লোকের ধর্ম বিক্রি হয়ে যাওয়া।
এ-হাতে ও-হাতে ঘোরা, খাবার তাগিদে।
বাকিরা চালায় দেশ, পালে লাগে হাওয়া…
যে-কোনও দলের ধর্ম জিইয়ে রাখা খিদে।
এরই মধ্যে তুমি খোঁজো, প্রভুর পা-দুটি?
এরই মধ্যে তুমি পাও, আল্লার ইশারা?
বিশ্বাসে মিলায় খিদে। বিক্রি করলে রুটি।
তাদের শাসাও দেখি, ভাগ করে যারা?
যে-দেশে পেটেই জ্বলে অধিকাংশ চিতা,
সে-দেশে বিশ্বাস পণ্য। ধর্ম বিলাসিতা।
৭
যে-রংই মাখাও গালে, রক্ত মনে হয়।
নিশ্চিত তোমারই জাদু, হে লেডি ম্যাকবেথ –
গোটা দেশ বৃন্দাবন, হোলির সময়।
রঙের কুয়াশা থেকে জেগে ওঠে প্রেত।
সে বলে, ‘আমাকে নাও উৎসবে এবার।
ঠান্ডা এ-কপাল, এসো, পরাও আবির…’
ভিড়ে তো সমস্ত মুখ মিশে একাকার
রং মেখে ভূত হল ছিন্ন হওয়া শির।
মৃত্যুর পরেও একই তাড়া করে ফেরা –
এ কোনও কাব্যের চেয়ে কম কিছু নয়।
শুনেছি সহজে পথ ছাড়ে না প্রেতেরা?
যে-রক্ত মাখাও গালে, রং মনে হয়।
কুড়িয়ে এনেছি মাথা, ফুলের বদলে –
পলাশ ফোটেনি ভাল এ-বছর দোলে।
বৃষ্টি বিকেল
বিকেল বেলার ভাঙা ঘুমে পর
এক কাপ চা, ধোঁয়ায় ঢাকা ঘর,
দুপুরে খুব বৃষ্টি হয়ে ঝিম
দূরে যত বাড়ি টিম টিম
কেমন একটা ভিজে মত মন
মুখ থুবড়ে বন্ধ আছে ফোন।
পাড়ার মোড়ে মাথার গিজগিজ
গাড়ি টানায় পিছল ওভার ব্রিজ
বৃষ্টি থেকে উঠেই এ কোন দেশ?
ঠান্ডা হাওয়ায় মনে পড়ার ছল।
কোথাও কোথাও দাড়িয়ে গেছে জল…
রিক্সার ভেঁপু মন কেমনের সুর।
কলেজ ফেরত মেয়েরা চুরমুর
জানলা খুলে এমনি বসে। চুপ।
থমকে থাকা মেঘেরা বিদ্রুপ
যা গেছে তা গেছে জানি, যাও।
এমন বিকেল অনন্ত হয়। তাও
চোখের কোণে যেটুকু চিকচিক…
তুমি এলেই সরিয়ে দিতে, ঠিক।।
প্রিয় চড়াই
জাপটে ধরে বলব, ‘আমায় চাই?
বৃষ্টি তখন উল্টো ডাঙার মোড়ে
নরম গালে মাখিয়ে দেবো ছাই।
জানিস না তুই, পাখিরা রােজ ওড়ে?
ডানার ভাঁজে মুখ ঘষে, বেশ।
ভিড় করে সব দেখবে কেমন যা তা!
লজ্জা উধাও, ওড়না যখন শেষ…
এক মুহূর্ত থমকে কলকাতা।
পাখির নীড়ের মত না, তাদের চোখ।
আমি বরং বলে, ‘ছিলি কোথায়?
আজকে একটা হেস্তনেস্ত হোক
দিস না বাধা, আমার অসভ্যতায়।
ঠোটের গায়ে ঠোটের গরম ফু…
বৃষ্টি ভেজা শরীর দেখে সবাই
মন কখনও দেখতে পারে,
ধর তারে দেখি, আয় তোকে আজ সবাই
রাত নামছে উল্টোডাঙা মোড়ে
অন্ধ আকাশ, বন্ধ টেলিফোন…
দুটো মানুষ জলের ভাষায় পােড়ে।
‘কি হচ্ছে কি?’ বললে খাবি চড়।
আদর খেয়ে চুপ হে, প্রিয় চড়াই
দুটো পাখির ঠোটেই এখন খড়…
চল না, তাদের আবার প্রেমে পড়াই?
অনেক দিনের চেনা
দাড়িয়ে দুরে। অনেকদিনের চেনা।
আজকাল যার সঙ্গে থাকো, সে না।
একলা তুমি কফিশপের ভেতর
ঝগড়া করে পালিয়ে এলে। সে তাে।
দাঁড়িয়ে আছে উল্টো ফুটপাতে
আগের মতই ব্রিফকেস হাতে
তোমার কফি আসতে দেরি, তারও
বাস আসতে মিনিট পাঁচেক আরও।
মনে হচ্ছে ফুরিয়ে গেছে কথা।।
আজ ফের সেই ঝগড়াঝাটি করে।
বসেছ কফিশপের ভেতরে।
উল্টো দিকের ফুটপাতে যে, তাকে
ডাকবে নাকি, সময় যদি থাকে?
আঙ্গুল দিয়ে নাড়ছে চামচ, মানে।
ভাবছ সে লােক যাবে কতক্ষণে
আসলে তার অনেক আগেই যাওয়া
আগের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে হাওয়া
প্রাক্তন বর, প্রেমিক ভবিষ্যতের!
আজকাল তাদের আকসার এসব ঘটে—
বিশু পাগলের কবিতা
বিপদ আবার ডাক দিয়েছে, দমকা বাতাস… আলগা বোতাম…
বসন্তকে সাক্ষী রেখে আজ যদি ফের সঙ্গী হতাম?
একখানা দিন ওলোট পালট, একখানা বেশ ঝাপটা বিকেল
পাগল হওয়া বিশুই কেবল সামলে রাখে নন্দিনীকে।
যা ইচ্ছে তাই বলুক লোকে, নিন্দুকে আর কী না রটায়
অনামী সেই বাস স্টপেজে দেখা হবেই পৌনে ছ’টায়।
একটু হাঁটা, একটু চলা, একটু বসা পাড়ার রোয়াক…
মিথ্যে একটা আঙুল তোমার কপালে আজ সত্যি ছোঁয়াক।
মাথার মধ্যে গুমরে মরে পাগলা হাওয়ার একলা পোকা।
ফিরবে তুমি ভিড় বাসে আর আমার ফেরা চুপবালিশে
চোখের পাতা কমল কি না, কে আর অত রাখছে হিসেব…
কেবল তোমার ফুলের মালা, রাজার দিকে সপাট জেহাদ –
যুগ পেরিয়ে আরেকটিবার আমার হাতে দিও সে হাত…
হাতের রেখায় থাকবে জানি মাইলফলক, সরাইখানা…
কৃষ্ণচূড়ার ছোট্ট চিঠি, রাধাচূড়ার বলতে মানা
বিপদ আসুক, লাগুক বাতাস, ছুটুক সময় তোমার দিকে
পাগল হওয়া বিশুই জেনো আগলে রাখে নন্দিনীকে!