| 28 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ছোটগল্প: পিঙ্গল বিকেলের আয়নায় ॥ মাহবুব আলী

আনুমানিক পঠনকাল: 19 মিনিট

এই অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। আচম্বিত। আকস্মিক। অকল্পনীয়। গতকাল দুপুর থেকে এখন শেষ-বিকেল। একটি দানা পেটে পড়েনি। না একবিন্দু পানি। মুখ-গলা-ফুসফুস শুকিয়ে কাঠ। মাথা ঢুলুঢুলু। ঘুরছে। যখন সে-সবের মুখোমুখি। কোনো অর্থ নেই। অহেতুক। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে প্রচণ্ড রাগ আসে। অভিমান। শিহাব কি করে? কেউ তাকে বোঝে না। বুঝতে চায় না। সে ঘরে বসে থাকেনি। রাস্তায় নেমে যায়। ক্ষুধা লেগেছিল। পকেট হাতড়ে দেখে, টাকা তো দূরের কথা; একটি কয়েনও নেই। কোত্থেকে থাকবে? তখন একবার তমালের কথা মনে পড়ে। সেই একজন বন্ধু, যার কাছে মন খুলে সব বলা যায়। জানাবারও আছে কি? সকল কথা জানে। যত তিক্তস্বাদ-আনন্দ-দুঃখ-বেদনা কিংবা আগামী স্বপ্নকথন…হয়তো সামান্য হালকা হওয়া যায়। সে খানিকক্ষণ ওই ভাবনা নাড়াচাড়া করে। কোন্‌ ভরসায় কে জানে। যাবে কি যাবে না? তারপর একসময় বুকের মধ্যে সিদ্ধান্তহীন প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে চুপসে পড়ে। না যেয়ে কিছু হবে না। সে একা মানুষ… একলাই থাক। যত ঘনিষ্ঠ হোক প্রত্যেকের নিজস্ব ভুবন আছে। সেখানে কাউকে ডেকে আনা কিংবা উপসি’ত হওয়া ঠিক নয়। সকল কথা নিজের মধ্যে রাখতে হয়। অবশেষে কিছু হল না।

রেল-স্টেশনে রাত কাটানো মজার। বিশাল টিন-চাদোয়ার নিচে আলোছায়া পৃথিবী। নানারকম মানুষজন। সে বসে থাকে পিলার ধরে রাখা গোল পাটাতনে। ফেরারি যাত্রী। গন্তব্যহীন গন্তব্যের অচেনা পথিক। কেউ কেউ জুলজুল দৃষ্টি রাখে। গোয়েন্দা কুকুরের মতো কৌতূহলী দৃষ্টি। বিশ্রি অনুভূতি। দু-একটি ট্রেন আসে, ভিড়-কোলাহল; সহসা থেমে যায়। ফেরিঅলার ফ্লাক্সে গরম-চা চিৎকার শীতল হয়ে পড়ে। ট্রেন চলে যায়। এরমধ্যে একসময় রহমান আঙ্কেল এদিক-ওদিক কাউকে খোঁজে। অনুসন্ধান যে সে… হয়তো তেমন, অথবা নয়; তখন চুপ করে করমচা ঝোপের দিকে নিজেকে লুকোয়। বাবার একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। যখন তখন উঁচু কথাবার্তা বলা উচিত নয়। মায়ের জন্য শুধু কষ্ট। তবে কিছু পেতে গেলে কষ্ট সহ্য করতে হয়, কেউ কষ্ট পায়; কাউকে কষ্ট দেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সে এর জন্য দায়ী নয়। পরিসি’তি তেমন। উপায় নেই। রাস্তার জীবন বেঁচে থাকা অন্যরকম। অথচ কত মানুষ ঘুরে বেড়ায়। কে কার দিকে তেমন করে মনোযোগ রাখে? এ তার বিচিত্র উপলব্ধি। ভোর-সকালে পার্কে চলে আসে। বড়মাঠের নির্জন নিরিবিলিতে আকাশ দেখা। সীমাহীন শূন্য দিগন্ত। দু-একটি চিল দূর আকাশে ভেসে ভেসে ঘোরে।

মাঠের এই বিবর্ণ ঘাসে শুয়ে থাকতে দেখে কেউ কিছু ভেবে বসে কি না? অকারণ ভাবনা। তখন তীব্র অস্বস্তি। সে নিশ্চুপ এক লাশ। নট-নড়ন-চড়ন। কখনো বুকের তলায় গমক হাসি। হাসেনি। সময় সু-সময় নয়। সকাল হতে কড়কড়ে রোদ। ঘন উত্তাপ। ঘাসের নিচ দিয়ে লাল পিঁপড়ে হেঁটে হেঁটে কোথাও কোনো অভিযানে চলে। দু-একটি কামড়ে দেয়। ওদেরও অপছন্দ। সেই দংশনের যন্ত্রণা এড়িয়ে যায়। কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে ইচ্ছে হয় না। একবার ঠান্ডা পানির তীব্র পিপাসা জাগে। পানি জীবন…পানিই মরণ। মুখস্ত পড়ার মতো জানা বাণী গুনগুন সুর। সে তাকলা মরু অভিযানে বের হয়েছে। আদিগন্ত ধু-ধু বালু আর বালু। কোথাও কোনো ঘাস নেই। লতাপাতা কাঁটাগুল্ম দেখা যায় না। মাথার উপর গনগনে সূর্য। উত্তাপ বাড়ে। আকাশে কোনো পাখি নেই। মেঘমুক্ত তীব্র নীল-সাদা। সে নিঃসঙ্গ একলা মানুষ। হেঁটে যায়… হেঁটে যায়। কোথায় গন্তব্য? আকাশ স্পর্শ করার দুর্লভ সাধ? তারপর আচমকা বালুর উপর ভেসে ওঠে কোনো অচেনা প্রাণির বিশাল হাড়গোড়। মুখ-ব্যাদান খুলি। তীব্র ছেঁদন দন্ত। শূন্য কোটরে অদৃশ্য চোখের উপহাস। হায় জীবন! আশ্চর্য কোনোদিন এমনভাবে ভাবেনি! জীবন দেখা হয়নি। এখন ক্ষুধার্ত পেটে পানি ছাড়া কিছু জোটানো সম্ভব নয়। হয়তোবা, অথবা নয়। বাঁ-হাতে গোল্ডক্রোমের ডিজিটাল ঘড়ি। দামি। জানিয়ে দেয় সময়। একবার সেটি ঝেড়ে দিয়ে বিদ্রোহের রসদ জোগানোর কথা ঘুরঘুর করে। তার কথা ভেবে হয় না। সেই মুখছবি বারবার ভেসে ওঠে। শেষ চিহ্ন। অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা আছে, কিন্তু সঙ্গে এমনকিছু নেই; যা দিয়ে তোলা যায়।

সেদিন চমৎকার বিকেল। উত্তর-বায়ু-পশ্চিম আকাশ জুড়ে হালকা পেঁজা তুলোর মতো খণ্ড খণ্ড মেঘ। শরতের উন্মুক্ত নীল পটভূমিতে অদ্ভুত মায়াময়। তার মধ্য দিয়ে সূর্যরশ্মি কৌণিক সার্চলাইট ছুটে নেমেছে। আদিগন্ত দেবদূত পোশাক-বর্মের সোনালি প্রচ্ছায়া। দোতলার রেলিং ঘেরা ছাদ। সামনে সবুজ গাছপালা। চারপাশে নানান ভবন-গলিপথ-রাস্তার দৃশ্যাবলী। এর মধ্যে আকাশের দেয়ালে কয়েকটি লাল-সবুজ-হলুদ-সাদা-বেগুনি বর্ণিল ঘুড়ি ভেসে বেড়ায়। ভালো লাগে। মন হারালো-হারালো শূন্য অনুভূতি। রুকুর হাতে দু-তিনটি লাল-নীল দোপাটি ফুল। অতিসাধারণ। তবু খুব প্রিয়। তার হাতে দিয়ে অদ্ভুত রহস্যময় দৃষ্টি মেলে রাখে।

‘শিহাব বাবার বদলির অর্ডার হয়েছে… এবার আমরা রাজশাহি যাব।’

যত সহজ উচ্চারিত কথা, তার অর্থ ভারী ছিল না। ছিল কি? কে জানে। কখনো কখনো রুকুকে তেমন বুঝতে পারে না। অদ্ভুত নিশ্চুপ নির্বিকার থেকে যেতে পারে। কোনোকিছুই তেমন গুরুত্বের নয়। অথচ শিহাবের মনে হয়, একমুহূর্তে আয়নার মতো সুন্দর বিকেল উঁচু ছাদ থেকে নিঃশব্দে নিচে পড়ে গেল। সেও পড়ে যায়। ডুবে যায় কোথাও কোনো অতল গভীরে। তখন আকাশ নিমিষে বিবর্ণ। কণ্ঠস্বর বিশুষ্ক। দু-চোখ কি আদ্র হয়ে পড়ে?

‘খারাপ লাগছে? তুমি ভেবো না। আমি চিঠি লিখব। জানো, মাঝে মধ্যে কষ্ট হয়। আমরা হলাম যাযাবর। বাবার কী যে চাকরি! কাফেলা চলছে তো চলছে। এ বছর এখানে তো কাল ওখানে। বেদেদের নৌকা। আজ এই ঘাট তো কাল ওই ঘাট। অবশ্য অ্যাডভেঞ্চার আছে। নতুন জায়গা। নতুন পরিবেশ। নতুন মানুষ। সবকিছু নতুন।’

‘তুমি লিখবে না রুকু। কোনোদিন লিখেছ?’

‘আহ্‌! কি যে বলো? লিখব না কেন? তুমি ভুলে গেলেও আমি ভুলব না।’

‘তোমার ধারণা আমি ভুলে যাব?’

‘ধারণা নয়, বিশ্বাস। কে কার কথা মনে রাখে শিহাব? কেউ মনে রাখে? জগৎ এমনিই, কেউ কারও নয়।’

রুকু তেমনই। কখনো কখনো খুব সহজ নির্বিকার সত্য বলে ফেলে। রূঢ় কথন। তখন ওকে কেন জানি দূরের মানুষ মনে হয়। শিহাব এ নিয়ে তেমন ভাবে না। কখনো অস্বস্তি। বুক জুড়ে নিশ্চুপ ঝড়। ওকে দেখতে পাবে না। এই ভাবনায় মন অকারণ ব্যাকুল। একটি দিন না দেখে থাকতে পারবে? প্রতিদিন বিকেলে ছুটে আসে। নিজের ঘর থেকে ছাদের দিকে তাকায়। রুকু কখন ওঠে? সেই আকাশ-মাতাল দৃষ্টি। বুকের কোনায় শিহরন ঢেউ। শিহাব সেই চোখে চোখ রাখে। রুকুর বুকেও কি কোনো ঝড় বয়ে যায়? হয়তো অথবা কে জানে। সত্যি বলতে আজও ওকে বুঝতে পারে না। মন নির্মল-কোমল। স্পর্শকাতর অনুভূতি। এমন কথাই জানা। কিন’ রুকু বইয়ে পড়া মেয়ে নয়। অন্যরকম। আলাদা। ব্যতিক্রম কাছে টানে। শিহাব অনেক চুপচাপ। ভাবুক। তবু কখনো ওর কাছে প্রগলভ ঢেউ। মন মানে না। মনে থাকে না। সে বছর অনার্স শেষপর্বে। বাইরে কোথাও মাস্টার্স আর এমফিল করার ইচ্ছে। রুকু কলেজে এসেছে দেড়-দুই বছর। অথচ কত দিনের চেনা!

দিনাজপুর ছেড়ে রাজশাহি যেতে চেয়েছিল শিহাব। নানান টানাপড়েনে হয়ে উঠেনি। ইউনিভার্সিটি হাতছানি দেয়। চুপি চুপি আবাহন। উপায় নেই। রুকু সেই রাজশাহি চলে যাচ্ছে শুনে বুকে রক্ত ছলকে ওঠে। যদি ওখানে থাকার সুযোগ হতো? দিনকাল-সময় আনন্দ রাঙা। সুখস্বপ্নে বর্ণিল। এতদিনে হৃদয়ের গহিনে যে অদ্ভুত টান। মায়া-মায়া আকুলতা। ভালো লাগে। কেমন করে কখন যে ভালবেসে ফেলেছে। জানা হয়নি। বোঝা হয়নি। রুকু কিছু বলে না। কোনো ইঙ্গিত? না। তারপর দু-জন দু-জনকে না দেখে কোনো একটি বিকেল পেরিয়েছে? সেই চিরপুরাতন নতুন কথা, কবিতার সুর; বলি বলি করে বলা হল না। চোখ যে মনের কথা বলে…ভরসা নেই। কখনো চোখের দৃষ্টিতে খুুঁজে খুঁজে কোনো অলীক গোলকধাঁধায় নেমে যায়।

একদিন আলোছায়া ঝিরঝির শেষ-বিকেল। বিষণ্ন-উদাস রহস্যময়। নৈর্ঋত দিগন্তে সূর্য নেমেছে প্রায়। রুকুর প্রশস্ত কাঁধ ছড়ানো ঝাঁকড়া চুল বন্যফুল গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। কখনো দমকা বাতাসে চোখ-মুখ ঢেকে যায়। অচেনা রহস্যময়। পুব রেলিং-এর ধারে জাম্বুরা গাছ। হাজার সাদা ফুলে প্রাণ-উন্মন প্রগাঢ় সৌরভ। শিহাব জিজ্ঞেস করে, –

‘তুমি তো চুলে তেল দাও না। আজ দিয়েছ তবে?’

‘ভালো লাগছে না? প্রেত্নির মতো দেখাচ্ছে?’

‘উঁহু তুমি তো পরি। মেঘের হাওয়ায় হাওয়ায় তোমার চুল ভেসে যায়।’

‘তুমি কিন্তু খুব ফ্লার্ট করতে পারো।…তেল নয়, শ্যাম্পু করে কন্ডিশনার দিয়েছি।’

‘একদিন তেল দেবে। লক্ষ্মীবিলাস। না না কেয়োকার্পিন। ভারি খসবু!’

‘তাই! তোমার বউয়ের চুল সুগন্ধি তেলে ভিজিয়ে দেব। বেঁধে দেব প্রজাপতি বেণি। হবে তো?’

‘তুমি আমার বউ হবে?’

‘উঁ… কেন বললে এ কথা?’

‘জানি না।’

‘মন খারাপ?’

‘তুমি আমার বউ হবে না?’

‘জানি না।’

শিহাব অপ্রস্তুত। এত খুশি! বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ শব্দ! ঢেউ। সে কী করে? আকাশের দেয়ালে সন্ধের আলোছায়া। ইচ্ছে হয় একবার বুকে জড়িয়ে ধরে। দু-হাতে তুলে ধরে মায়াময় মুখছবি। পারে না। কেন সাহস হয় না তার? সময় চলে যায়। চলে যেতে থাকে। কতক্ষণ? হয়তো যুগ যুগ। নিশ্চুপ নিরিবিলি ভাবনা প্রহর। চারপাশে নিস্পৃহ আচ্ছন্ন অন্ধকার নেমে আসে।

‘আমরা কাল চলে যাব। খুব খারাপ লাগছে। তোমার?’

‘উ… নাহ্‌! আমাদের আবার দেখা হবে। তাই না?’

‘শুধু দেখা! আর কিছু না?…কি ব্যাপার আজ তুমি খুব অন্যমনস্ক!’

‘আসলে একটা বই পড়লাম। মন বিষণ্ন হয়ে আছে। ট্র্যাজেডি।’

‘তুমি ট্র্যাজেডি পড়ো? প্রেমের বই? ভালোবাসায় বিশ্বাস করো? কাউকে ভালোবাস?’

‘হ্যাঁ…ন্‌না, কি যে বলো; হা হা হা!’

‘গাধা কোথাকার?’

কোত্থেকে কি হয়! রুকু মৃদু ধাক্কা দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আলোছায়া আকাশে একটি ছায়া ধীরে ধীরে উঠে আসে ঠোঁটের কোনে। শিহাব আকস্মিক সচকিত। একরাশ সুগন্ধি চুলের মধ্যে খুঁজে নেয় পৃথিবী। স্বপ্ন শিহরন। কোনোমতো অস্ফুটে বলে বসে, –

‘তোমাকে খুব ভালোবাসি রুকু। আই লাভ ইউ।’

আজ বুকের গহিনে সেদিনের শব্দ ঢেউ হাতুড়ি হয়ে আছড়ে পড়ে। তার কথা শুনতে পেয়েছিল রুকু? পায়নি। কেন একটু শব্দ করে বলতে পারেনি? তখন দু-জন নিচে নেমে যায়। কঠিন সিমেন্ট উঠোন চত্বর। রুকুর দৃষ্টি সেই আগের মতো নির্বিকার। অথবা কেমন, রহস্যময়; বুঝতে পারে না। উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যায় ড্রইংরুম। এয়ার-ফ্রেসনারের মিঠেল সৌরভ বাতাসে মাতাল ঢেউ তোলে। শিহাবের বুকে শিহরন। এই মেয়েটি তার প্রেম। এই মেয়েটির অধরস্পর্শ লেগে আছে জীবনে। আশ্চর্য কোমল ঝাঁজালো সুবাসে ভরে আছে বুক।

‘তোমাকে কিছু একটা দেব।’

‘পেলাম তো।’

‘গাধা! অন্যকিছু দিতে চাই।’

‘হঠাৎ!’

‘থাকছি না। এটা দেখলে মনে পড়বে তোমার। তুমি ভুলে যাবে না তো?’

‘তোমায় ভুলতে পারি রুকু?’

উদাস সময়। একটি রিস্টওয়াচ। ফ্লুরোসেন্ট আলোয় চিকমিক করে ওঠে সোনালি রং। সন্ধে সাত বেজে তেরো মিনিট। তেরোই এপ্রিল। রোববার। উনিশ শ ছিয়াশি। সেই তারিখ-সময়-মুহূর্ত জীবনে কোনোদিন ভুলবে না। ভোলা যায়? ভুলবে না যখন ট্রেন চলে যায়, বিদায়বেলা রুকুর ধারালো দৃষ্টি আচমকা কেমন ছলছল; বেদনাময় হয়ে ওঠে। বাতাসে মেঘের মতো উড়ছে সেই প্রিয় রুক্ষ্ম চুল। শিহাব প্লাটফরমের পাথর নিভৃতে এককোনায় দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন নয়…সে নিজে ক্রমশ দূরে পিছিয়ে যায়। যেতে থাকে। যেতে থাকে দুরে-বহুদূরে। সমান্তরাল ইস্পাত লাইন কাছাকছি থেকেও দু-জন দু-জনকে স্পর্শ করতে পারে না। সেই দূরকে কাছে আনতে, ফিরে পেতে কোনো চিঠি লেখেনি রুকু। দেয়নি কোনো জবাব। দরজায় এসে ডেকে যায়নি দুপুরের কোনো বার্তাবাহক।

শিহাব একটি কলম দিয়েছিল। তার অসম্ভব প্রিয় ঝরনা কলম। যেটি সবসময় বুক-পকেটে রাখত। অনেক কবিতা লেখার সঙ্গী। সেই কবিতার বৃত্তে বিন্দু হয়ে জেগে থাকে একটি মেয়ে। কলাপাতা হালকা সবুজ কামিজ। অফ-হোয়াইট কিংবা ঘি-রং পাজামা। কাঁধের দু-পাশে ফুলে থাকে ঝাঁকড়া চুলের অবাধ্য মেঘঢেউ। কখনো ফুলরাঙা বেণি। দৃষ্টিতে কৌতুক। কখনো উদাস-নির্মোহ-নির্বিকার। শরতের মেঘলা আকাশ। পিঙ্গল বিকেল। সেই সে আপনজন রুকু। তাকে ভুলে গেছে। শিহাব সেদিন বলে, –

‘এ কলমটা আমার কবিতা লেখার। তুমি চিঠি লিখো, আমার কাছে কবিতা হয়ে থাকবে।’

‘আমি কবিকে পছন্দ করি না। সব সেন্টিমেন্টাল। পাগল।’

‘সে আমি জানি। কবিরা অলস। মিথ্যে-মায়াচারি। কল্পনাবিলাসী। আমি কি তেমন?’

‘তুমি একটা বুদ্ধু।’

‘মানে?’

‘মানে খুঁজে নিয়ো কোনো অভিধানে।’

‘আমার অভিধান চলে যাচ্ছে।’

‘বুদ্ধু!’

‘তুমি চিঠি লিখ। সে আমার কবিতা। ভেবে নেব, তুমি দোতলার ছাদে; কাছে বসে আছো। কথা বলছ।’

‘লিখব। তুমি ভালো থেকো।’

রুকুর দৃষ্টি অদ্ভুত রহস্যময়। এমনভাবে ছড়িয়ে দেয়, অতল সাগরের গভীরতা। শিহাব কোনো মানে খুঁজে পায় না। আরও একবার সাহসী হতে পারে না। জড়িয়ে ধরে নিবিড় বলতে পারে না, ‘তোমাকে খুব ভালবাসি রুকু…খুব মিস করব।’


আরো পড়ুন: ছোটগল্প: মুনিয়া এবং কাহিনী একাত্তর


সূর্য গনগনে হয়ে উঠেছে। মাথার উপর অসহনীয় তাপ-উত্তাপ। পেটের মধ্যে জ্বালাময় উল্লম্ফন। ক্ষুধা! হাজার বছরের ক্ষুধার্ত সে। অভাবিত। ভাবা যায়? আচ্ছা…এরমধ্যে কোথাও কি কোনো ঝড় বয়ে যায়নি? মা-বাবা কী করে? তার কথা ভাবে? নিশ্চুপ? হুলস্থুল? হয়তো…হয়তো না। সকল মনোযোগের দরজা সেই তো রুদ্ধ করে দিয়ে এসেছে। কে কোথায় কার জন্য চোখের দু-ফোঁটা জল ফেলে? আকস্মিক ইত্যাদি ধরনের প্রভৃতি ভাবনা…জিজ্ঞাসা কোনো গলিপথ খুঁজে পায় না। মুখ থুবড়ে পড়ে।

ওই বছর পরীক্ষায় ফেল। শিক্ষা জীবনে প্রথম অসফল। তিক্ত-বিষাদ অনুভূতি। কয়েক যুগ পেছনে পড়ে গেছে। রাজশাহি ইউনিভার্সিটি ফাইনাল ইয়ারে অ্যাড্‌মিশন নেয়ার সময় এসে যায়। একদিন তমাল মডার্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অনেক কথা বলে।

‘তোর তো ভালো প্রিপারেশন ছিল। ডাব্বা খেলি কীভাবে?’

‘কবিতা লিখছি বলে!’

‘যাই বল্‌‌, ওসব ফাল্‌তু জিনিস নিয়ে কি মজা পাস? বাদ দে। কবিরা আজকাল কি যে লেখে…অভিধান খুলেও অর্থ পাওয়া যায় না। দুর্বোধ্য। সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়?’

‘কি যা-তা বলছিস! আসলে আমার মন ভালো নেই। মনে হচ্ছে পড়ালেখা শিখে কী করব? চাকরি জোটানো তো সহজ নয়।’

‘পড়ালেখা কি শুধু চাকরির জন্যে? তুই সবকিছু বৈষয়িক মনে করিস কেন?’

‘আমাদের মতো নিম্নবিত্ত পরিবারে পড়ালেখা বা ডিগ্রি সেই তো সোনার ডিম দেয়া রাজহাঁস। তোর মতো ধনীর সন্তান হলে বিজনেস করতাম। ইউনিভার্সিটির উত্তপ্ত আমতলায় কাঁদানে গ্যাসে মুখ কালো করে নাক আর চোখের জলে ভাসতাম না’

‘তোর আইডলোজির কথা রাখ। তুই তো পলিটিক্স করিস না। বড় বড় বুলি ঝাড়িস কেন?…হ্যাঁ রে তোর রুকুর খবর কী?’

‘কিছুই জানি না। রাজশাহি গিয়ে ভুলে গেছে।’

‘আহা…তাই তো বেচারা ছ্যাকামাছিন হয়ে গেছিস রে!’

‘শ্‌শালা!’

রুকুর উপর প্রচন্ড রাগ হয় তার। রাগ না অভিমান? কেমন করে ভুলে যেতে পারল? অথচ শিহাব তার ডায়েরির পাতায় একেক দিনের ভাবনা তাকে দিয়েই শুরু করে। কতবার চিঠি লেখে। সব কথা ঠিকমতো বলা হয় না। লেখা যায় না। টুকরো-টুকরো কাগজ বাতাসে উড়িয়ে দেয়। সারারাত গুনতে থাকে ক্লান্তি-জাগরণের অণু-পরমাণু। তারপর যখন দু-একটি পাখি আকাশে ডানা ছড়িয়ে দেয়, বাঁশির সুর মেখে নেয় সূর্যকিরণ; কিছু লেখা হয় অবশেষে। রুকু সে চিঠির কোনো জবাব দেয় না। কোনো কোনো নীল খাম ফেরত এসে যায়। ভুল ঠিকানা। প্রাপক খুঁজে পাওয়া যায়নি। শিহাবের মনে অজানা শূন্য বিষাদ। দুশ্চিন্তা। তার মনপাখি তবে কোথায়? মন খাঁ-খাঁ অস্থির গুমরে মরে।

একদিন চুপ করে ট্রেনে ওঠে শিহাব। রাজশাহির অচেনা পথঘাট। ইউনিভার্সিটি চত্বর। সেই ঠিকানা? রুকু দিয়েছিল…সেখানে নেই। তাকে খুঁজে পায় না। বিস্ময়-বিমুঢ় রিক্ত বুকে ফিরে এল অবশেষে। কোথায় হারালো রুকু? যে হারিয়ে যায়…ফিরে আসে কি? ফিরে আসে…ফিরে আসে না। ফিরে এল না সে। তবু খোঁজে। অলিগলি পথঘাট মনের চৌরাস্তা। স্বপ্ন-জাগরণে।

দেড়-দু-বছর পর ইউনিভার্সিটি এসে দাঁড়াল। ফাইনাল শেষ করতে হবে। একদিন কী ভেবে সেই ঠিকানায় আবার উপস্থিত। দুপুরের রোদে কারও দরজায় যেতে নেই। সে তবু দাঁড়ায়। না সেই ঠিকানায় কেউ নেই। খুঁজে পেল না। পাওয়া গেল না ইউনিভার্সিটি চত্বর-আমবাগান-জুবেরির মাঠ। রুকু কি এখানে পড়ে? অথবা অন্য কোথাও? একজন মানুষ তো হাওয়া হয়ে যেতে পারে না। কে জানে! শিহাব হিসাব মেলাতে পারে না। জীবনে অনেক অঙ্কের হিসাব মেলে না। মেলানো যায় না। অবশেষে বুকের কোনো কোনায় থেকে গেল কিছু স্মৃতি কিছু গান, অনেক জমানো কথা; ব্যথা অভিমান। রুকু একদিন ঠিক ফিরে আসবে। দেখা হবে…হবে কথা।


আরো পড়ুন: ছোটগল্প: নীলছবি


সেদিন বিকেল আশ্চর্য পাণ্ডুর হলুদ। গুমট গরম। শিহাব প্রশাসনিক ভবনের আমতলায় এসে দাঁড়ায়। গাছের ছায়ায় পত্রিকাঅলা সব দৈনিক-সাপ্তাহিক দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকা সাজিয়ে রেখেছে। নতুন মুকুলের গন্ধে ম-ম চারপাশ। ইউনিভার্সিটির বাসগুলো গতানুগতিক পেট্রোল পোড়া নীলচে-কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে চলে যায়। শহর থেকে ফিরে আসে। শিহাব কি অস্বাভাবিক কেঁপে ওঠে? চমকে স্থির-নিশ্চুপ? রুকু…রুকু নামে। সেই মেয়েটি, যার খোঁজে কতবার কত রাস্তায় ঘুরে আসা হল। কত চিঠি লেখা হয়েছে। আহা সেই চিঠিগুলোর একটিরও কোনো উত্তর পাওয়া গেল না! শিহাব সেই অভিমান বিষণ্ন দিনকাল কোথায় লুকিয়ে রাখে? তার দৃষ্টি ছলছল। ঝাপসা দিগন্ত চত্বর। রুকু নেমে যায়। উজ্জ্বল বেগুনি রং শাড়ি। সোনালি ফ্রেমে জলরং সাদা চশমা। আরও সুন্দর। অপরূপা পরি। সেই কাঁধ ছড়ানো মেঘ-চুল হর্স টেইল। ঠোঁটে হালকা গোলাপি প্রলেপ। তাই কি? শিহাব কী করে? হারিয়ে যাওয়া মনপাখি পেয়ে গেছে আজ। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ গর্জন। দিগ্‌ভ্রান্ত আবেগ-আচ্ছন্ন ছুটে যায়। এতদিনে অভিধানের অর্থ খুঁজে পেয়েছে। ভালবাসা। আশ্চর্য স্বপ্নের সুখময় কবিতা ভাসে। সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব-ভীরু-কম্পন একপাশে সরিয়ে এবার খুব অনায়াসে ধরে নিতে পারে ভৈরবী-পুরবী। রাগ-অনুরাগের সেই চিরপুরাতন নতুন কথা। তেপান্তর যে ফুরোয় না। ফুরোয় না মন কাঙাল অনুরণন। অথচ রুকু তাকে দেখেও দেখে না। নাকি না চেনার ভান নিয়ে সরে যায়? শিহাবের দৃষ্টির সামনে নেমে আসে বিবর্ণ আকাশ দেয়াল। সেই চেনা সৌরভ মোহিত আমতলা চত্বর আনমনা উদ্ভট। তার লুকোচাপা বিষাদ শূন্য মনে ধাক্কা। বুক ভারী করে ফেলে। রুকু তাকে চিনতে পারল না। নাকি চিনল না? কেন?

তারপর কীভাবে কোন্‌ পথে হলে এসে তিনতলায় ওঠে জানা নেই। বোধহীন কোনো ক্ষুর অস্তিত্বের সকল প্রান্ত ফালা ফালা টুকরো করে। করতে থাকে। সেই চেনা-অচেনা অভিমান, প্রত্যাশা-স্বপ্ন, স্মৃতিময় বিকেলবেলা, সন্ধের বাতাসে আলোছায়া ছাদ, মুখোমুখি বসবার ইত্যাদি সব মিথ্যে হয়ে যায়। কত নিবিড় মনোযোগে এক-একেকটি শব্দমালা সাজানো চিঠি। ভুল ঠিকানা। বিফল ফেরত। রাজশাহির কত রাস্তা ঘুরে ফিরে দেখা। মনে পড়ে যায়। মনে আসে। বুকে তোলে ভ্যাপসা-গুমট ঝড়। তার নিজের কোনো নাম নেই। কেননা যন্ত্রণার কোনো পরিচিতি থাকে না। কোনো ব্যাকরণ মানে না। সেই রাগ গিয়ে পড়ে টোকাই সাইফুলের উপর। বেচারা কাপড় ধুয়েছে। ইস্তিরি করে এনেছে। পয়সার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। ধমক খেয়ে আস্তে সরে পড়ে।

অবশেষে সন্ধে নামে। দিগন্তবলয় সেজে ওঠে বাসন্তি-সোনালি রঙে। তার মনে কোনো রং নেই। সব হারিয়ে গেছে। অচেনা হয়েছে সকল গানের স্বরলিপি। সরগমের সাত সুর। সারারাত নির্ঘুম যন্ত্রণা। রুকু কি তাকে চিনতে পারেনি? তেমন তো হবার কথা নয়! শিহাব নিজে কেন একবার এগিয়ে গেল না? যেতে পারত। কেন পারল না? দ্বিধাদ্বন্দ্ব নাকি ঘনীভূত আবেগ? অথবা সেই…। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ। পুড়ে যায় বুক। ভস্মীভূত সময়। সব অকারণ-অহেতুক। একসময় টেবিলের উপর বাজতে থাকা এম. ব্যান্ড রিসিভার ছুড়ে ফেলে দেয়। শানাই বাজছিল অচেনা কোনো রাগে। চমকে থমকে স্তব্ধ। অশান্তি কমে না।

ভোর-ভোর রাত। শিহাব স্পাইরেল নোটবুক খোলে। আবার কবিতা লেখা শুরু। সেই চেনা আনন্দ গলিপথ সরুপথ নেই। অন্য কোনো অচেনা রাস্তা ধরে শব্দেরা হাঁটে। হেঁটে যায়। কী লেখে অথবা লেখা হয় জানা নেই। কেননা বেদনার কোনো ভাষা থাকে না। নিশ্চুপ কান্না। স্থবির সত্ত্বায় সকল শব্দ-শৈলী পথহারা দিশাহীন। উধাও বাতাসের মতো হারিয়ে গেছে। অনেক চেষ্টায় দুটো লাইনও লেখা যায় না। এর ঠিক দু-দিন পর দেখা পায় রুকুর। মুখোমুখি দাঁড়াবার। অথচ না হলেই বুঝি ভালো হতো! তাই কি?

সেদিন সকাল কর্মব্যস্ত ঝম ঝম গাড়ির মতো চলে। অনেকক্ষণ থেকে বসে আছে। বিষণ্ন অস্থির। চোখ-মুখ শুকনো। আজকাল পরিচিত কোনো সহপাঠি কখনো বলে বসে। ‘কি রে খুব পড়ছিস আজকাল?’ শিহাব কী জবাব দেয়? সহজ শুকনো হাসি। এড়িয়ে যেতে পারে। অথবা সবকিছু তো সহজে পারা যায় না। কোনো অজুহাত বের করে প্রত্যুত্তর। নিজের মনকে কী বোঝায়? সে তো কোনো ছল বোঝে না। এতগুলো দিন শেষে যখন দেখা পেয়েছে, অপ্রত্যাশিত; অথচ তার আচরণ। দোলাচল মন ভাবনা উন্মন নাকি কী সে জানে না। বুঝতে পারে না। পুরোনো দিনগুলো বারবার মনে এসে দোলা দেয়। ভেঙে যায় সকল বিশ্বাস স্বপ্নদোলা। ঝাপসা হতে থাকে নীল দোপাটির রং। রুকু দেখেও দেখল না! কেন তবে দু-চোখের পাতা ক্ষণেক থিরথির কেঁপে মিলিয়ে যায়? কেন? অবশেষে প্রতীক্ষা। অপেক্ষা সুযোগের। কোত্থেকে ভীরু মনে সাহস এসে ঋজু হয়। এবার একবার প্রয়োজনে পথের মধ্যে দাঁড় করাবে তাকে। কী এর অর্থ? আশ্চর্য সেই মুহূর্ত এসে গেল সেদিন। রুকু দশটা দশের বাসে নেমে যখন কলাভবনের দিকে হেঁটে যায়, শিহাব খুব কাছে গিয়ে মৃদু ডেকে ওঠে, –

‘রুকু!’

রুকু চমকে উঠে না। সেই রূঢ় রুক্ষ মেয়েটি স্তম্ভিত হয় না। অনেক স্বাভাবিক দাঁড়িয়ে পড়ে। সারিবেঁধে হেঁটে চলা মেয়েদের দল থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর একমুহূর্ত অথবা জনম জনম সময়ের দৃষ্টি সংযোগ। কত দিন…আহা কত দিন পর! শিহাব কী করে? তার হাত কাঁপে। আঙুল থিরথির বাতাস দোলা। সামলানো যায় না। বুকের মধ্যে সাগর উত্তাল ঢেউ।

‘কিছু বলবে শিহাব?’

‘কবে এসেছ এখানে? কত দিন তোমায় খুঁজে গেলাম।’

‘এই তো কিছুদিন এসেছি। বাইরে ছিলাম। কেমন আছো তুমি?’

একটি কাক সে-সময় মাথার উপর দিয়ে দক্ষিণে ভেসে যায়। কোথায় গন্তব্য তার? কী কথা বুকের গহিনে জমা রেখেছে শিহাব? মনে আসে না। অথবা সব কবিতা মাতম ঝড় তোলে। খেই পাওয়া যায় না। সেই পাখি উড়ে যায় অচিনপুর। যেখানে সুখ আছে। স্বপ্ন আছে। আগামীর কোনো প্রাপ্তি। তার দৃষ্টি আরও গভীর…আরও নিবিড়। অথচ রুকু এত নিশ্চুপ ঠান্ডা! নিস্পৃহ গলায় কথা বলা শিখেছে কোথায়? জেদি একরোখা স্বরে আপোষ আর পরাজয়ের সুর।

‘সেদিন তুমি দেখেও না চেনার ভান করে চলে গেলে?’

‘সত্যি! চেনা চেনা মনে হচ্ছিল, কিন্তু…অনেকগুলো দিন। তুমিই তো…অথবা তুমি নও। মাইন্ড করেছ?’

‘করলে কারও যায় আসে? সে যাক, তোমার সময় আছে? কোথাও বসি। অনেক কথা আছে।’

‘আমার খুব ইম্‌পোর্টেন্ট ক্লাস। এই আধঘণ্টা…ঘুরে আসি।’

‘আচ্ছা। তা হলে এখানেই থাকলাম।’

রুকু কথা রেখেছে। আধঘণ্টা নয়, কিছুক্ষণ পর সামনে এসে দাঁড়ায়। শিহাবের আকাশ উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যেতে থাকে। সকল অভিমান মুছে গেছে। কত দিনপর আবার সময় হল মুখোমুখি বসবার। যে মেয়ে তার সঙ্গে এতগুলো বিকেল পেরিয়ে এসেছে, শিহাব ছড়িয়ে দিয়েছে অপলক মুগ্ধ দৃষ্টি; কী করে চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যায়? সেই প্রশ্ন চিন্তার কোষে কোষে নিশ্চুপ তখন। সে আগের মতো সামনের মুখছবির দিকে পুরোনো মুগ্ধমায়া তুলে ধরে। স্মৃতিরা জেগে জেগে আকাশে মেঘের মতো জলছবি বর্ণিল। ভালো লাগে।

কাফেটেরিয়ায় কফির সুবাস। কাপের মধ্যে চামচের আন্দোলন-ঢেউ। টুং টুং ছন্দের মিঠেল সংগীত। পুবের বিশাল দরজার কোনায় জেগে থাকা জেসমিনের ঝাড়। আচমকা বাতাসে ঢেলে দেয় মনভোলানো সৌরভ। আজ শিহাবের বুকে হাজার কথামালার ভাসমান আকাশ ঘুড়ি। রং-বেরং আলোর ফোয়ারা। কোন্‌ কথা ছেড়ে কোন্‌ কথা বলে? দীর্ঘায়ত দু-ফুট দূরে বসে আছে রুকু। তার আপনজন। মনপাখি। সেই মুখছবি আরও কত মসৃণ। একটু কি বিষাদ…না কি সবটুকু বিষণ্ন মেঘছায়া? কবিতার পেলব ছন্দের মতো বুকের সকল গহিনে মন-হারালো আহ্বান।

‘তুমি কোথায় ছিলে? এতগুলো চিঠি দিলাম। একটিরও জবাব পেলাম না। ভুল ঠিকানা। ফেরত আসে?’

‘আমরা এখানে বেশিদিন থাকিনি। এক-দেড় মাস। তারপর…।’

‘আমাকে জানাবে না? রাজশাহি এসে খুঁজে গেছি। এত কষ্ট দিলে? দিতে পারলে?’

আকাশ কি স্তব্ধ হয়ে গেল? শিহাব নিশ্চুপ। কত আর অভিযোগ করে? রুকু কী বলে শোনা যাক। শিহাব উন্মুখ দৃষ্টি তুলে ধরে রুকুর দিকে। কিন’ সেই তির্যক-রুক্ষ মুখছবি এমন কেন? এই রূপ তো কোনোদিন দেখেনি। অনেকদিনের চেনা মানুষ দীর্ঘ সময় না দেখা পেরিয়ে গেলে কি অচেনা হয়ে যায়? কে জানে। তারপর রুকু যখন সামনে এসে দাঁড়াল, শত অভিযোগে বিস্ময়-বিমূঢ়? সময়ের ব্যবধান। এমনকিছু তো ঘটতে পারে অথবা পারে না, যার কথা জানা নেই।

‘তুমি ঝড় দেখেছ?’

‘মানে?’

‘আমি এক ঝড়ের কাছে হেরে গেছি। প্রলয়ংকরী ঝড়। সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। আমার আর কিছু নেই।’

‘এমন হেঁয়ালি করো না রুকু? সহজ করে বলো।’

‘আমার বিয়ে হয়ে গেছে শিহাব।’

কাফেটেরিয়ার ছাদ কি দুলে উঠল? আকস্মিক অন্ধকার চারদিক। নিথর নিশ্চুপ পতনের শব্দ। শিহাবের দু-চোখ অন্ধ। সামনের দেয়ালে কোনো কালো ছায়া নেমে আসে। কোনো বোধ নেই। চেতনা নেই। আচমকা উঠে দাঁড়ায় সে।

‘কি বলছ তুমি?’

‘তুমি ঠিক শুনেছ। বসো।’

‘কবে…কখন?’

‘এখানে আসার মাস দু-এক পর হঠাৎ একদিন বাবা স্ট্রোক করে বসল। আমরা চলে গেলাম দেশের বাড়ি। সেই বিপদের সময় বড় মামা কাছে এসে দাঁড়ান। দাদাবাড়ি যাওয়ার পথ বন্ধ। তুমি জানো। আমার লেখাপড়া শেষ। একদিন রাজিমের সঙ্গে বিয়েতে বসতে হল। বড় মামার ছেলে। তারপর…আর কি, একটি অসহায় পরিবার; বেঁচে থাকা। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করল না। কোনো কথা শুনল না। একলা কী করি। সব অদৃষ্ট।’

শিহাব কী বলে? তার কবিতা হারিয়ে গেছে। আর ফিরে পাবে না। ফেরানো যায় না। স্তব্ধ সময়ের সকাল গড়িয়ে যায়। উত্তরের কোন থেকে ভেসে আসে টুং টুং জলতরঙ্গ। মানুষের কথা। কত কথা কত সুর। তার কোনো কথা নেই। স্তব্ধ শব্দ। নির্বাক ভাষা। বুকে কোনো সুর নেই। কোনো গান কোনো স্বরলিপি নেই। মর্মর বাতাস তবু আচমকা থেকে থেকে বয়ে আনে ফুলের সুবাস। তার দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করে। সামনে শুধু ছায়া। দুপুরের আলোয় মাথা নিচু বসে থাকে। তার কোলে কাপড়ের প্রান্তসীমা আর করতলে নেমে আসে কোনো কান্না। অশ্রুবিন্দু। শিহাব সেই পান্না-মুক্তা নিজের বুকে তুলে নিল। একটি শুকনো দীর্ঘশ্বাস। সবকিছুর ইতি হয়ে গেছে।


আরো পড়ুন: ছোটগল্প: বিষ নীল আতর


 

সময় চলে যায়। একসময় উঠে দাঁড়ায় ছায়া। শিহাব ততক্ষণে হয়তো সহজ হয়ে গেছে। কে জানে। নিজেকে করতে পেরেছে। কাফেতে ভিড় শুরু হয়। লাঞ্চের সময়। অনেক ছাত্রছাত্রির প্রিয় খাবার পাওয়া যায়। সাদা পোশাকের বয়-বেয়ারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টেবিল ফাঁকা করা থেকে পরিষ্কার পরিবেশন অনেক কাজ তাদের। রুকু উঠে দাঁড়ায়।

‘আমি চলি।’

‘লাঞ্চ?’

‘অন্য একদিন।’

‘অন্যদিন কেন? বসো।’

‘আজ থাক।…একটা কথা বলব?’

‘বলো রুকু।’

‘আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো তুমি। ভুলে যেয়ো।’

রুকু আর দাঁড়ায় না। শিহা্ব মানুষের ব্যস্ত কথকতা ভিড়ের মধ্যে তার ছন্দবদ্ধ চলে যাওয়া দেখে। রুকু দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যায়। যেতে থাকে। তখন শিহাব আরও একবার ফেলে আসা দিন-অতীতের সুড়ঙ্গ খনন করে যায়। বুকের মধ্যে জেগে ওঠে দগ্ধ ক্ষত। প্রগাঢ় অন্ধকার দিশাহীন গোলকধাঁধা। একটি মেয়ে। রুপোলি আলোর মতো ভেসে ওঠে। তার পরনে অফ-হোয়াইট-ঘি রং পাজামা। কলাপাতা সবুজ কামিজ। ধবধবে সাদা ওড়না। তার দু-কাঁধ ছড়ানো ঝাঁকড়া চুল। কখনো টপনট অথবা প্রজাপতি বেণি। তার জলরং উজ্জ্বল মুখছবিতে শুধু বিষাদ জেগে থাকে। সেই হাসিমুখ খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে আর খুঁজে পায় না শিহাব। তার অস্তিত্ব নেই। একটি শব্দ শুধু ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে আঘাত করে। করতে থাকে।

‘তুমি একবারও আমাকে বললে না রুকু, কেন…কেন?’

কে দেবে জিজ্ঞাসার জবাব? জবাবহীন জিজ্ঞাসা। এতদিন যাকে খুঁজে গেছে, প্রত্যাশা ছিল; একদিন দেখা হবে। সে তো বিশ্বাস। যখন ফিরে পেয়েছে, সে তার নেই। হারিয়ে গেছে। জীবনের সকল আনন্দ-স্বপ্ন-মায়া-অভিধান শেষ। মন থেকে তবু হারায় না। পুরোনো দিন বিকেলবেলা-সন্ধের ছায়া-আকাশের গোধূলি খুব মনে পড়ে। হারিয়ে যাওয়া মনপাখি দু-চোখে বারবার ভেসে ভেসে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। সময় উদ্‌বেগ-উদ্‌ভ্রান্ত। অস্থির দিশাহীন। কেউ একজন আপন মানুষ ছিল…এখন নেই। কোথায় সে? দৃষ্টির সামনে থেকেও সেই মানুষ নেই। কিছু ভালো লাগে না। বিষণ্ন মন ভেবে ভেবে ক্লান্ত-অবসন্ন। এলিয়ে যায়। মধ্যরাতে মনে হয়, দেয়ালে কারও দুটো চোখ জেগে উঠেছে; নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। শিহাব চোখ খোলে। সেই দৃষ্টিতে অবসাদ নেমে আসে না। রাত পাহারা চোখ তার জেগে জেগে সময় গোনে। দূর থেকে ভেসে আসে নাইটগার্ডের হুইসিল। শিহাবের মন বাধাহীন অসি’র চঞ্চল। পুরোনো দিনের ছবিগুলোর মৌন-মিছিল।

কোনো কোনো রাত জেগে থাকতে থাকতে নিঃসাড়-ক্লান্ত। সাধ হয় আবার কবিতা লেখে। আনন্দ-স্বপ্নের পৃথিবী ছেড়ে বিষাদ-দুঃখের শব্দ-ভেলা সাজায়। ছেঁড়া-পাল বাতাস-ঢেউ দিশাহীন জীবন কোথায় নিয়ে চলে? পারে না। কবিতা লেখার মন হারিয়ে গেছে। একদিন নীল রেক্সিনে বাঁধানো কবিতার খাতা টুকরো-টুকরো ছিঁড়ে ফেলে। সব ভুল। অনর্থক মায়া। এবার পড়াশুনোয় মন দেবে। কয়েকদিন খুব চেষ্টা চলে। অথচ বইয়ের পাতায় বারবার ভেসে ওঠে কোনো বিষণ্ন মুখছবি। একদা সেটি রুক্ষ মনে হতো। পাথর কেটে তৈরী কোনো নির্বিকার ভাস্কর্য। তার দু-চোখ কেন হায় মলিন আজ?

সেদিন আর আজকের বেঁচে থাকা সমান্তরাল রেললাইন হয়ে মন বিছিয়ে থাকে। ইউনিভার্সিটির চত্বরে হেঁটে যায়। ক্লাস-রুটিন মনে থাকে না। লাইব্রেরি গিয়ে খুঁজে খুঁজে রেফারেন্স বই বের করে। নিশ্চুপ নীরবতার মধ্যে কোনো হিম শান্তি সন্ধান। সেই অন্বেষণ সফল হয় না। নিজের সঙ্গে ছলনা চলে না। কত আর মিথ্যে প্রবোধ শোনে মন? সে যে বড় ধূর্ত…বর্ণিল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। সাদা কাগজের উপর কালো কালো লেখা লাফিয়ে সরে যায়। মনোযোগ ধরে রাখা যায় না। অবশেষে মন যখন অকারণ ভেবে নেয়, আর কিছু হবে না. শেষ হয়ে গেছে জীবনের নান্দীপাঠ; একদিন ফিরে চলে নিজ-বাসভূম দিনাজপুর।

এরপর অনেকদিন দেখা হল না। হওয়ার কথা নয়। শহরের রাস্তায় সকাল হয়। দুপুর নেমে আসে। বিকেল হয়ে সন্ধের আঁধার ঘনায়। কোনোকিছু ভালো লাগে না। বুকের মধ্যে খাঁ-খাঁ। মন অকারণ শূন্য শূন্য। কি যেন ছিল, পরিপূর্ণ; এখন নেই। কে সে? প্রত্যাশা। আশার প্রদীপ। নিভে গেছে। মরে গেছ মন। যখন মন মরে যায়, সবকিছু মরে যায়। শুকিয়ে যায় সকল আনন্দ। জমে উঠে কষ্টের জমাট বরফ। চুল আর নখের মতো কষ্ট বাড়ে। ঘোলা দৃষ্টিতে সবকিছু অর্থহীন। সেখান থেকে বের হয়ে বসন্ত ফুল ফোটার কোনো পথ নেই। শিহাব কী করে? মনের সকল অলিন্দে অদ্ভুত টানাপড়েন। আহ্‌ রুকু তুমি ভালো থেকো…ভালো থেকো। বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়। মন তবু সান্ত্বনা পায় না। কখনো সাধ জাগে, যদি আরও একবার দেখা হয়ে যায়। যদি হয়ে যায়। কী হবে তখন? আর কী কথা তাহার সাথে?

শিমুল-পলাশ ফোটার সময়। দূরের আমবাগানে কোনো ছায়ায় দু-একটি কোকিল ডাকে। মনের বাগান শূন্য। রিক্ত। বড় ভালবেসে ছিল। ভুলতে পারে না। ভোলা যায় না। ভুলে যাবার চেষ্টা করেনি। তেমন হয় না। হয়তো ভুলে যাবে একদিন। কে জানে তেমন হয় কি না। সময়ই তো ক্ষত সারিয়ে তোলে। তার বুকে দগদগে ক্ষত। সারাজীবনের সঙ্গী। কী করার আছে তার? নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়া। এই ফুল পাখি…মানুষের পৃথিবী সবকিছু মূল্যহীন। তারপর সহসা বুকের অচিন গহিনে জেগে ওঠে অবিশ্বাসের তমসুক বীজ। অংকুরোদগম হয়। সেই গাছ ধীরে ধীরে বড় হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে দেয়। অন্ধকার ছায়া। নিস্তব্ধ শীতল। ভিন্ন আলো না কি অন্ধকার? ভেবে দেখবার মতো মন নেই। ‘আহ্‌ রুকু…রুকু…রুকু। আমার মনপাখি।’ কখনো দু-চোখ ভিজে উঠে। কখনো নির্বিকার নিষ্ঠুর দৃষ্টি। সে বদলায়। বদলে যায়। আঘাতে মানুষ বদলায়। সে আঘাত কি শুধু রুকু? কোনো প্রত্যয় নেই? একদিন বিকেলে মা বলে, –

‘কী হয়েছে বাবা? সবসময় অমন মুখ গোমড়া করে রাখিস কেন? আমাকে বল।’

‘কিছু হয়নি তো!’

‘কিছু তো হয়েছে। আমাকে বল বাবা। রুকুর দেখা পেয়েছিস?’

শিহাব নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। এই একজন মানুষ, যার চোখে কোনোকিছু লুুকোনো নেই। গোপন থাকে না। তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করে? মায়ের অনেককিছু জানা। রুকুর বিয়ে হয়ে গেছে জানে কি? জানা নেই। শিহাব সেই কথা কী করে বলে? রুকু যে হারিয়ে গেছে। সে এখন অনেক দূরের মানুষ।

‘আমার পড়ালেখা করতে ইচ্ছে করে না!’

‘সেকি কথা! আমরা কত আশা নিয়ে বসে আছি, আর তুই কি না …।’

‘কী হবে পড়ে বলো? চাকরি খুঁজি। অনার্স ডিগ্রিতে কোথাও কোনোমতো একটা জুটে যাবে।’

মা কিছু বলে না। বলতে পারে না। অথবা কী বলা দরকার ভাষা নেই। শিহাবের আত্ম-প্রবঞ্চনা। নিজের সঙ্গে কত আর ফাঁকি? সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এখন সকল অস্তিত্ব ঘর আর বাহির। আসলে কোথাও নেই সে। এই বিশাল পৃথিবীর মধ্যে ক্ষুদ্র ধূলিকণা জীবন, বেঁচে থাকা; অর্থহীন। সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। আনন্দ সুখ কিছু নেই। অস্তিত্বহীন। অস্তিত্বের পলায়ন।

সেদিন সন্ধে নেমে আসে। আকাশের পশ্চিম দেয়াল প্রান্ত ধরে আলোছায়া খেলা। শিহাবের মন জুড়ে হারানো দিনের গান। স্বপ্নভঙ্গের বিষাদ দোলা। টেবিলের উপর ফ্লাট-ক্যাসেট প্লেয়ার দীর্ঘ প্রলম্বিত পথ হেঁটে যায়। ধু-ধু মরীচিকা মরুভূমি। ঘরের দেয়ালে দেয়ালে সেই বেদনার বিমূর্ত চিত্রমায়া। বর্ণহীন নিরাকার। কষ্টের নীল রং দু-চোখের দৃষ্টিসীমায়। আসলে কষ্টের কোনো ব্যাকরণ নেই। ওপাশে যখন দু-একটি কাক সন্ধের অন্ধকারে গাছের উঁচু ডালে নিজেদের আড়াল করে, শিহাব বারান্দায় দু-একবার হেঁটে যায়। বাড়ির পশ্চিমে আঙিনা সি’র গুমট গম্ভীর। বিকেলে কিছুক্ষণ শিলাবৃষ্টি হয়ে গেছে। দেয়াল ঘেঁষে মুখ উঁচু বাড়িয়ে থাকা কয়েকটি দোপাটি গাছ। বৃন্তে বৃন্তে নীল-লাল-গোলাপি আলোর রেখা, দুমড়ে-মুচড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সে আলো-অন্ধকারে কোনো স্মৃতি হাতড়ায়। বড় অস্থির মন। বাবা কখন পাশে এসে দাঁড়ায় বুঝতে পারে না। হাতে সান্ধ্য-দৈনিক। আকস্মিক মৌনমুখর নীরব সময় ঝাঁপিয়ে পড়ে।

‘অন্ধকারে বসে রয়েছ? কী করো?’

‘কিছু না তো বাবা।’

‘বিশ্ববিদ্যালয় কি বন্ধ? অনেকদিন ধরে যাও না।’

‘যাব…দু-এক দিনের মধ্যে যাব।’

‘শুনলাম পড়ালেখা করতে মন চায় না। তা হলে কী করবে?’

বাবার ছায়ার পেছনে অন্য ছায়া। মা নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে। কখন সুইচ অন করে দিয়েছে? আলোয় ভেসে যায় প্রতিটি কোন। শিহাবের মনের মধ্যে অন্ধকার। মাথার উপর ফ্যান ঘুরে চলে। বুকের মধ্যে ঝিরঝির শব্দ। শিহাব কী করে? স্থির নিশ্চুপ।

‘পড়ালেখা বাদ দিয়ে কী করবে? দু-টাকার কেরানি?’

‘যাব তো!’

‘তবে যে শুনছি, চাকরি খুঁজছ। কবিতা লিখছ আবার? তুমি কি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল হতে চাও? নোবেল নেবে?’

‘লেখক কবি তো নোবেলের লোভে লেখে না।’

‘তুমি কী জন্যে ওসবে সময় নষ্ট করো? ইন্টারে থার্ড ডিভিশন। অনার্স যেনতেন। জীবনে দাঁড়াতে পারবে?’

‘পড়ছি তো।’

‘তোমার পড়া ভালো স্টুডেন্টের মতো নয়। ডিসগাস্টিং।’

‘তুমি আবার এত বকাবকি করছ কেন? সে তো যাবে।’

‘আমি তেমন কিছু তো বলছি না। এই তুমিই ছেলেকে আগলে রেখে রেখে ওর মাথা খেয়েছ। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা। তোমার ছেলে বাড়িতে বসে কবিতায় তা দিচ্ছে।’

‘যাবে তো। সেদিনই বলল, সামনের রোববার যেতে চায়। না কি বাবা?’

‘হ্যাঁ।’

‘দেখ মন দিয়ে লেখপড়া করো। আমার জমিদারি নেই যে, তোমায় দিয়ে যাব; আর তুমি রাজার হালে জীবন কাটাবে। কবিতা লেখা আর অন্যচিন্তা সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দাও। আগে নিজের প্রতিষ্ঠা, তারপর…।’

‘হ্যাঁ।’

শিহাব আলগোছে নিজেকে বের করে নেয়। বারান্দা হয়ে আঙিনাটুকু পেরিয়ে অন্ধকারে নামতে না নামতেই আরও কথা ভেসে আসে। সদর দরজার আড়াল। সে দাঁড়ায়। মা বলে, –

‘ছেলে বড় হয়েছে। ওকে এমন করে কথা বলো কেন? সে তো স্কুলে পড়ে না।’

‘স্কাউনড্রেল! পড়ালেখা করে নিজেকে গুছিয়ে নেবে, সে কি না…অসভ্য ইতর। দিন-দুনিয়া চেনে না। আওরাত কি মক্কর দুনিয়াকা চক্কর।’

‘তুমি আবার এসব কী বলতে শুরু করলে? মেয়েটা তো খুব ভালো ছিল। আমাকে আন্টি আন্টি করে ডাকত। বড় মায়াময়। ওর বাবার দোষে তো তার কোনো দোষ নেই।’

‘সেই গল্প আর করো না। করাপ্‌টেড ম্যান। দুর্নীতিবাজ। ঘুষখোর।’

‘মেয়েটা তো…।’

‘তুমি আর কোনো কথা বলবে না। পাস্ট ইজ পাস্ট।’

শিহাবের কানে পোকা। সে দাঁড়িয়ে থাকে না। থাকতে পারে না। পোকা কিলবিল হেঁটে হেঁটে মাথায় ওঠে। গহিন গহ্বর। কামড়াতে শুরু করে। উন্মন মন আরও বিক্ষিপ্ত অস্থির। রাতের দেয়ালে ভেসে ওঠে সেই মুখছবি। ‘রুকু…রুকু তোমায় দেখতে ইচ্ছে করে। কেমন আছ তুমি?’ রুকু ভালো নেই। তার সেই চঞ্চল অস্থির দু-চোখে বিষাদের ছায়া। বিষণ্ন দুঃখের মুখছবি। শিহাব সেদিন পান্না-হীরের অশ্রুবিন্দু সঙ্গে নিয়ে এসেছে। এর চেয়ে বড় সম্পদ আর নেই। বিষাদ-গাঁথা বেদনার মাহকাব্য। সে রাস্তায় গিয়ে অন্ধকার কোনো কোনায় নিশ্চুপ স্থির। বুকের মধ্যে কোনো দীর্ঘশ্বাস বের হতে আকুল হয়। অসম্ভব ভারী তার ওজন।

শিহাব আর ঘরে ফিরে যায়নি। পরদিন তার নিরিবিলি ঘরে সূর্যের আলো জানালার পথ বেয়ে মেঝেতে নেমে যায়। সে তখন সকল মান-অভিমান, হয়তো কারণ অথবা অকারণ; বড়মাঠের এককোনায় পড়ে থাকে। দু-চোখের সামনে বলাকা-শুভ্র আকাশ দিগন্ত নতুনের হাতছানি দেয়। সে চলে যাবে। যেদিকে দৃষ্টি যায় হারিয়ে যাবে। জীবন অন্ধকারের কানাগলি, না কি সময়ের কাছে নিজের উপর কোনো প্রতিশোধ ভেবে পায় না। কোনো যুক্তি বোঝে না। কখনো কখনো মন যে কোনো কথা শোনে না। কখনো মনে হয়, ভালোই করেছে। ফিরে যাবে না। কখনো…কি সব ছেলেমানুষি! সেই বিকেল মনে পড়ে যায়। রুকু ট্রেনে বসে আছে। জানালা গলিয়ে বাতাসে ভাসে বিষাদ চোখ। উদাস উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টি। শিহাব কাঠগোলাপ গাছের দূর-ছায়ায় দাঁড়িয়ে একাকী দেখে যায়। কত দূর থেকে ভেসে আসে ফরাসি সৌরভ। আচ্ছন্ন স্টেশন চত্বর। জীবনে হয়তো সেই বড় পাওয়া। উন্মন-মন। মন মানে না। কোনো-কোনোদিন তাই অকারণ ভাবনায়…কোনো অর্থহীন প্রতীক্ষায় গাছের নিচে বসে থাকে। ট্রেন আসে ট্রেন চলে যায়। যে আসার সে হায় ফিরে আসে না। ফিরে আসবে না। নিশ্চিত জেনেও কোন্‌ প্রতীক্ষায়? আর দূর…অতিদূর রেললাইনের একজোড়া লোহার পাত, চলতে চলতে কোথাও কোনো সীমান্তে এক হয়ে মিশে গেছে; তার তেমন হল না।


আরো পড়ুন: ছোটগল্প: অন্ধকারের বাজার


তিন বেজে ঊনপঞ্চাশ মিনিট। শিহাব হাত থেকে ঘড়ি খুলে ফেলে। ছুড়ে দেয় দূর অলক্ষ্যে। মাঠের কোন্‌ ঘাসের তলায় পড়ল কে জানে। হারিয়ে গেল। গেল কি? যে হারিয়ে যায়, ফেরে না। হয়তো ফেরে অথবা…। এসব ভাবতে ভাবতে ঘাসের ডগায় ব্যস্তত্রস্ত হাত রেখে খুঁজতে থাকে। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি যে হারানো যায় না। হারিয়ে গেছে কি? তার তন্দ্রাঘোর। স্টেশনের রাত। জেগে থাকতে থাকতে মানুষজন দেখতে দেখতে কখন কোনো স্বপ্নের মধ্যে দৃশ্যছবি আঁকতে শুরু করে বোধ নেই। এখন বিকেলের আলোয় ভেসে ওঠে কোনো অচেনা অজানা জায়গা। উজ্জ্বল নীল আকাশ। গোলাপি-সাদা শত পদ্ম বুকে নিয়ে জেগে থাকা দিঘির পাড়। সেটির পাশ দিয়ে কোনো প্রাসাদ-অট্টালিকা। অনেক উঁচু ছাদে দু-জন মুখোমুখি। আজও রুকু বাতাসে এলিয়ে দিয়েছে ঝাঁকড়া চুল। শুভ্র মেঘ চুল স্পর্শ করে যায়। অদ্ভুত আলোকিত মুখছবি তবু ধরে রাখে কোন্‌ বিষাদ। রহস্যময়? কী কথা বলতে চায় সে? শিহাব কোনো খেই পায় না। স্মরণের জানালায় কোনো সুর বেজে উঠতে উঠতে স্বরলিপি ভুল হয়ে যায়। এ কোন্‌ মায়াজাল?

শিহাব দু-চোখ রগড়ে নেয়। কোন্‌ জায়গা? কোন্‌ সময়কাল? সে কি অতীত? কোনো দৃশ্য অথবা আগামী দিনকাল? দু-জন মানুষ অপলক তাকিয়ে থাকে নিজেদের চোখের দৃশ্যপটে। নিজেদের খোঁজে। তারপর আকাশে ধীরে ধীরে নেমে আসে ধূসর-কালো মেঘ। প্রাসাদ বদলে হয়ে যায় কোনো তেপান্তর। ধু-ধু বালু আর বালু। সেখানে ছায়া ছায়া কোনো তাবু। দিগন্তের দেয়ালে মিশে থাকে দু-একটি তারা। আবছায়া চিকমিক। দূরের সমুদ্র থেকে ভেসে আসে মৃদু বাতাস। ঢেউ দোলায় পতপত ওড়ে লাল-সাদা-নীল পরদার ঝালর। কেউ একজন ম্যান্ডোলিনে করুণ সুর বাজিয়ে যায়। তার মুখছবি লাল-রুপোলি-রং জাফরি নেকাবে ছায়া-প্রচ্ছায়া। দেখা যায় না। শিহাব জানে সে সেইজন যাকে খুঁজে বেড়ায়। কত দিন কত রাত, চেনা-অচেনা অলিগলি সরুপথ; তপ্ত দুপুর দিগন্তের গলি-রাস্তা। তাকে পায় না। মন অসি’র-চঞ্চল। বুকে দীর্ঘশ্বাসের মেঘমালা। কোথায় পাবে তাকে? অবশেষে…অবশেষে সে তার সামনে। রুকু সুর তোলে। আঙুলের ডগায় বাহারি রং। কবজিতে রংধনু বর্ণিল কাচের চুড়ি। ছবি আবার বদলে যায়। আকস্মিক ধুলোঝড়। তীব্র বাতাসে দৃষ্টি ঝাপসা। তারা পরস্পর আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। পারে কি পারে না, দেখা যায় কি না যায় না; কেউ একজন বুকের কাছে এসে নিজেকে এলিয়ে দেয়। শিহাব দু-হাত বাড়িয়ে আগলে ধরে। ‘আহ্‌ রুকু…রুকু আমার রুকু।’ ছায়া নড়ে উঠে। মাথা উঁচু করে মুখছবি কী কথা বলে যায়। শিহাব কী শোনে? পৃথিবী আলোছায়া অন্ধকার। বাতাসে ধ্বনি প্রতিধ্বনি ব্যাকুল কান্না। আর্তস্বর। আর্তনাদ।

‘আমাকে বাঁচাও শিহাব। আমাকে বাঁচাও।’

‘ওহ রুকু…আমার রুকু!’ 

শিহাব এর দু-দিন পর ট্রেনে উঠে বসে। যেতে হবে। চেনা হয়েছে গন্তব্য। জানা গেছে সেই দু-ফোঁটা অশ্রুজলের মূল্য। সেদিন দুপুরবেলা খুব যতনে তুলে এনেছিল। কখনো কখনো দু-চোখের আর্তি যে সবকিছুর অর্থ বলে দেয়। রুকুকে এভাবে শেষ হতে দেবে না। ট্রেন চলে। চলতে থাকে।

শিহাবের দৃষ্টিতে কোনো এক বিকেলের পিঙ্গল আলোর লুকোচুরি খেলা।

 

 

 

2 thoughts on “ছোটগল্প: পিঙ্গল বিকেলের আয়নায় ॥ মাহবুব আলী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত