| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতীর ছোটগল্প: জিন । যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

নির্দিষ্ট তারিখের পরে আরও কয়েকটা দিন পার হয় এমন নয় যে দুএকদিন আগে পরে কখনও হয়নি তবে এবার কারণের পিছনে কাজের হাউসটা আউলালো তো তারই! তনুজা ভিন্ন অন্য জনমনিষ্যি ছিলো না মোটে। নিরালা বাড়িতে সেদিন সে নিজেই বারে বারে তালমতো খপখপিয়ে মাছ ধরলো নামাছও খলবলালো সে তখুন যেন আঁকশি ছাড়া লতাটিদুব্বল গাগতরেএমন করে ঝাঁপালো চুমুর পর চুমুতে – যেন নেশা লেগে গেলযেন তার বাঁশপাতা শরীলথরথরিয়ে কাঁপন দিলো যেন ধানকাটা পৌষের মাঠে শীতশীত হাওয়া উঠচে তা সমেত ছুঁইমুই ইন্ধনে জ্বলে উঠলো আগুন। সেথা থেকে উঠে আসা অমৃত গরল হয়ে উঠলো না তোমনে মনে নিজেকে নিজেই এখন গালাগাল দেয় রহিমা জানাবুঝা লক্ষণগুলো লক্ষ্য করার পর সে বুঝেছে দুই এ দুইএ চারই হয়!

আরও কটা দিন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে কাটে কী করবে সেতার ঠিকবুঝ হওয়া দরকার শেষে ভরসা বলতে তনুজাতনুজ গোড়ায় পাত্তাই দেয় না আরেকোনো কারণে দেরী হচ্ছেএমন তো হয়ইআসলে সেতো আর জানে না যে তার দুশ্চিন্তার পিছনে রয়েছে কার্যকারণের বাঁধা সূত্র। যখন রহিমা কুয়োয় ঘটি পড়ে যাওয়ার বিচলিতভাবে বলে, “না রেশোন্ নাআমার না খাবারে রুচি হচ্ছে নাবমিভাব তো আছেইবমিও হয়েছে দুএকবার“ তখন যেন সে খানিকটা তলায়আঁচ পায় আপদের মেঘের বিষয়টা যে ফাজলামি করার মতো নয় এটা জেনেও জিগ্যেস না করে সে পারে না, “কখন হলো রে এসব?”

আমতা আমতা করেনীরস আমসি মুখে জবাব দেয় সে, “ওই তো -, সেদিন তুই রান্নাঘরে ম্যাগি বানাতে গেলি-?”

এবার হেসে ফেলে তনুজা। বলে, “ম্যাগি তাহলে সত্যি সত্যি দুমিনিটে বানিয়ে ফেলা যায় নাবল-!”

পরদিন আবার ওদের বাড়ী যায় রহিমা তনুজা টিউশনি পড়তে গিয়ে জিনিসটা নিয়ে এসেছে। ওর হাতে দেবার আগে দরজা বন্ধ করে তনুজা ভালো করে বুঝিয়ে বলে কারও কাছে এ জিনিস আপদবালাইকারও কাছে বাঞ্ছাকারণ হাতপা কাঁপতে শুরু করে তার। বাথরুমে যায় গভীর উদ্বেগে লক্ষ্য করতে থাকে। মনে মনে দোয়া করে – তার ক্যানসার হলে হোককিন্তু কিটে যেন কণামাত্রও লাল দাগ না আসেআল্লাকিন্তু আল্লার রহমত হলো না কিটটা লুকিয়ে কুর্তির আড়ালে নিয়ে এসে বন্ধুকে দেখায়

মঞ্জুরভাইকে ফোনে সবটা জানিয়ে রেখেছিল তনুজা পরের দিন রহিমা মাকে বলে, “মাতনুজার সঙ্গে ওর কলেজে যাবওদের একটা অনুষ্ঠান আছে ও যাবার জন্য খুব ধরেছে যাই নামা?”

মা রাজি হলে একটা বাধা দূর হয় বাবা পাশের গাঁয়ে গেছে। একবার বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়লে আর চিন্তা নেই

বিগ বাজারে ঘুরতে ঘুরতে তিনজনের কথা হয় সহমত হতে পারে না তারা মঞ্জুর গর্ভপাত করার পক্ষে পেট খসালেই বালাই দূর হয় বাকি দুজনা দু’রকম কারণে সায় দেয় না। বিরাট এই বিগবাজারের হিমায়ণ রহিমার শরীলের অন্ধিসন্ধি জাাড়িয়ে ফেলে কী জাড় কী জাড়তনুজা খুব ভয় পেয়ে যায় ঘটনাটা জানাজানি হতে পারে বলে আর রহিমাকে মায়ায় পায় তার মনে হয়তারা তো দুজন দুজনকে ভালোবাসে। তবে ভালোবাসার ফসল ঘরে না তুলে কেন নষ্ট করতে হবেতাছাড়া তার তো বয়স আঠারো পেরিয়ে গেছে!

মঞ্জুর এখনও কলেজ ছাত্র তার সবে তৃতীয় বর্ষের শুরুর দিক টিউশনি করে কোনোমতে সে বান আটকায় নিজের পড়াশুনাটা চালিয়ে নেয়তার পক্ষে এখন সমুদ্দুর ধারণ সম্ভববেচারা রহিমাঝড়ের মুখে তার নৌকো বেসামাল কী করে দিকদিশা পাবে সেচিন্তায় হরপা বানের মেঘ পাক খায় মঞ্জুরের মনে  অঙ্কে অনার্স করছে সে ; কিন্তু জীবনের এই অঙ্ক তার কাছে জটিল হয়ে দেখা দিলএর সমাধান সে কীভাবে করবে বুঝ পায় না

দুপাশে সভ্যতার গেঁজলা রঙীনআপাত নির্বিষ সাপ বুকের ভিতরি হিলহিলিয়ে যায় তাকত না থাকলে ঢোঁক গিলে গিলে জিভের লালায় গলা ভেজাতে হয় পণ্যের মাঝের একটা নিরালা গলিতে কেঁদে ফেলে রহিমা বন্ধুর ব্যথায় তনুজাও কষ্ট পাচ্ছেতার মতো করে একটা সমাধানও বের করে ফেলেছে

সে বলে, “মঞ্জুরভাইতোমরা রেজিস্ট্রি বিয়ে করো ক্যান্যা বর্ধমানে একটা ছোট ঘর ভাড়া লাও তুমি টিউশনি করবেরহিমা কোনো দোকানে সেলসগার্লের কাজ লেবেঘরে বসে ঠোঙা বানাবে – তোমাদের ঠিক চলে যাবেদেখো না!”

এত জলদি আর এমন সরল সমাধান বানিয়ে দিলো তনুজা শুনতে বেশ-, স্বপ্নের মতো সহজ সে কীকরে জানবে – এ কত কঠিন বিষয় – তার গুহাকাল শেষের প্রাগৈতিহাসিক গলিঘুঁজির হালহকিকত?!

মঞ্জুরের মতো একজন ২২বছরের ছাত্রের পক্ষে শুধু তো বিয়ে নয়ছেলেমেয়ের বাবা হওয়া!… সে ভাবতেই পারছে না! – বন্ধুসহপাঠীআত্মীয়স্বজন কী বলবে তাকেতাছাড়া রহিমার বাবা এই সম্পর্কবিয়ে – কিছুতেই মানবে না সম্পর্কের ব্যাপারটা হয়তো নিশ্চিতভাবে জানে নাতবে আঁচ করে থাকতে পারে তাতেই রাস্তাঘাটে কখনও সামনাসামনি হয়ে গেলে যেভাবে তাকায় যেন আস্ত গিলে নেবে!

নিজের কৃতকর্মের জন্য এখন আফশোস হচ্ছে তার বুকের ভেতর হড়পা বান বুঝি ভেঙেই পড়লোরহিমাকে সে ভালোবাসে ঠিকইএকটুনও খাদ নেই তাতে তাকে ঠকানোর কথা কখনই ভাবে না তবে পড়াশুনা শেষ করে একটা চাকরিবাকরি জোগাড় করে সে নিশ্চয় বিয়ে করতো তবে এটাও তার চিন্তায় থাকা উচিত ছিল বইকি – যেরহিমা যেহেতু পড়াশুনা করে নাতার আাব্বা তাই শীঘ্রই তারে বিয়েয় বসাবে কোনো কারণ ছাড়া আইবুড়ো সোমত্ত মেয়েকে বেশিদিন বাড়ীতে রাখবে কেন তাদের মতো খুঁটাখুঁটির পরিবারেউচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত যে এগোতে পেরেছে সেটাই বরং আশমান থেকে খসে পড়া তারা পোটমানে ভরে রাখার মতো ঘুরতে থাকে তিনজনে খানিক চুপচাপ

তনুজাই মঞ্জুরকে বলে, “যা সিদ্ধান্ত লিবে লাও মঞ্জুর ভাইকিন্তু তাড়াতাড়ি করবে রাত্রে আমাকে ফোনে জানাবে তুমি কী ভাবলে

দুই

সবে সাঁঝ লেগেছে বোসপাড়া থেকে শাঁখের শব্দ ভেসে আসছে রহিমা বাড়ী ঢোকার আগে দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারেআব্বু নেই তো বাড়িতেটিনের আগলের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করে নিশ্চিন্ত হয়ে ছটাক– নয়াসিকির উঠোন পেরিয়ে দুয়ারে মায়ের সামনে পড়ে যায় সে

মা ধমক মারে, “কোন্ চুলোয় ছিলি ক‘ দিনিএতক্ষণে ফেরার সময় হলোআব্বু বাড়িতে থাকলে অশান্তি শুরু হয়ে যেতুনিসেটা ভালো হতো কি?”

যাক বাবাআব্বু নেইবাঁশা গেলো!

আব্বু কোথায়মা?”

মা জানায় যেবর্ধমানে সে তার খালুকে দেখতে গেছে

বর্ধমান?” কপালটা সামান্য কুঁচকে যায় তার

শাকিলা বলে, “ রহিমাতোর আব্বু কিন্তু তোর উপর রেগে আছে কিছুদিন তুই খুব বারমুখো হয়েছিস” একটু থেমে সুর পালটে বলে, “সে কিন্তু তোর বিয়ের কথা বলছে কোন্ এক পাত্র নাকি পসন্দ করেছে ফিরে এসে কথা বলবে বলে গেছে”

রহিমা দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ঘরে যায় সে ছোট বোন পড়তে বসেছে বড় বোন নিশ্চয় বাবামার ঘরে টিভি দেখছে। বড় বোনতার দিদি হালিমার একটা পা স্বাভাবিক নয়। মানবশরীরের রহস্যময় আলোআঁধারির ভেতর অভিশাপের মতো কিছুনাকি সভ্যতার অভিশাপ – কে জানে! – হালিমার ভ্রুণশরীরকে ভর করেছিল হাঁটুর নীচ থেকে তার পা সরু হয়ে এসে থেমে গেছে পায়ের পাতা নেইনখবিহীন দুএকটা মাংসপিন্ড আঙুলের মতো ঝুলছে নীচের দিকে

টিনের দরজা দেওয়া কাজচালানো বাথরুমে গায়ে জল ঢালতে ঢালতে নানা চিন্তায় পেয়ে বসে রহিমাকে তার দিদির বিয়ের সম্ভাবনা কমতাই আগে তার বিয়ের কথাই ভেবেছে আব্বু অনেকক্ষণ ধরে চান করে সে একটু জাড় জাড় করতে লাগলো

তার মায়ের সঙ্গে উনুনশালে বসে চামুড়ি খাচ্ছিল। তার অনিশ্চয়ের চোখ বাইরে গিয়ে পড়ে। বাইরে যেন অমাবস্যার ঘুটঘুটে আঁধার কোথাও আলোর ছিটে নেই একটাদুটো জোনাকি মিথ্যে আলোর আশা জাগায়

মা বলে, “তোর আব্বু খালুকে দেখতে যাবার সাথে আরও একটা কাজ করে আসবে মনে হয় “

কী কাজমা?”

মনে হয় তোর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যি গেছে খালুর মতামত না নিয়ে তো কোনো কাজ সে করে না! – ”

শুনতে শুনতে রহিমার মুখ কালচে মেরে ওঠে। খরখরে গরম পাক খাওয়া হাওয়ার পিঠে চেপে জিনপরীর দল হোহো করে উড়ে যায় আঁশতলা বাঁশতলা বিয়েসাদির কথায় চামুড়ি তার বিস্বাদ লাগে বমি পায় হঠাৎ চেপে রাখতে চায় সে। পারেও না সে বেগ চেপে রাখার জিনিস নয় হুড়মুড় করে উঠে যায়। রান্নাশালার পাশে ইট পেতে বালতি ভর্তি জল আর মগ রাখা থাকে। হাতমুখ ধোওয়া আর দুএকটা দরকারী বাসন চটজলদি ধুয়ে নেবার তরে  সেখানে বসে ওক তোলে বমি তেমন হয় না উনুনশালে বসে শাকিলা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিক পানে মেয়েটা কদিন ভালো করে খাচ্ছে নাপ্রায় দিন বমি পাবার মতো করছে কী যি হচ্ছেআজ হয়তো আরামবাগে গিয়ে হাবিজাবি খেয়েছেমেয়ের কাছে গিয়ে হাতে জল ঢেলে দেয়

মা হালকা গলায় বলে, “এই যে তুই সাঁঝবেলা পর্যন্ত বাইরে থাকিসতোর দাদি থাকলে এটা হতোকী বোলতো স্মরণ হয় তোরসাঁঝের বেলা ঘরের বাইরে থাকবিনিচুল খুলে রাখবি নিকোনো লাঠি ডিঙোবি নি– “

দাদির সেসব কথা শুনেজিনে পাওয়ার গল্প শুনে রহিমার বুক কেঁপে উঠতো ভয়ে

মনে আবার নেইসূর্য ডুবলেই আর বাইরে থাকার উপায় ছিলনি লুৎফাসাহানাজদের সঙ্গে গল্পের শেষটুনি বাকি রেখেই আমাকে ঘরে ঢুকতে হতো। যেন গোয়ালে গরু বাঁধা পড়লোখোপে হাঁস ঢোকানো হলোআমাকে নিয়ে সব দুশ্চিন্তা এখন তার বদলে আব্বু করে

তোর খুব ট্যাঁকট্যাঁকে কথা হয়েছে আজকাল “ মা গজগজ করতে থাকে

রাতে খাবার পর মা রান্নাঘর গুছোয়। ভাদ্রমাসের গুমোট গরম রহিমা বোনকে বলে, “চল রেশমাবাইরে যাবিখুব গরম লাগছে।“

বাঁশবনের ফাঁকফোকর দিয়ে পীরতলার মিটমিটে বাল্বের আলোটা এখান থেকে মরা মাছের চোখের মতো সেদিক থেকে মুখ ফিরায়ে নিলে ঘুটঘুটে আঁধার চারদিকে হাওয়া খেতে নাকি বাইরে এলোঅথচ একটুও হাওয়া নেই ডোবার ওপারে ছাতিমগাছটায় সময়ের একটু আগে আগেই ফুল ফুটেছে তার গন্ধে বাতাসের বুক আরও ভারীঅচিরেই বিয়াবে এমন গব্বন গাইএর দুধেল পালান যেন দুএকটা জোনাকি জ্বলছে নিভছে। এমন রাতেই বোধহয় জিনপরীরা বাতাসে কালো আঁচলা উড়িয়ে আমোদে ভেসে চলে। নানা বিদঘুটে শব্দ হয় এখানে ওখানে রহিমা অত ভয় পায় নাতবে গাটা একটু ছমছমিয়ে ওঠে শুধু  বোন বকবক করে চলেছেও অত কান করে না সেসব কথায় তার মনেই যত ভাবনার গিঁট পাকানো আজ আব্বু না থাকায় মনে হয় বচ্ছরভর বন্ধ জানলা খোলা হলো। আর বাড়ীটা যেন জল থেকে ওঠা ভিজে ডানার পানকৌড়িসে ডানা মেলে দিয়েছে কী একটা কথা বলতে গিয়ে এগিয়ে যায় রহিমা উঁচু হয়ে থাকা গরু বাঁধার গোঁজ ঠাওর হয় নাহোঁচট লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে একদলা গোবরের উপর। অন্ধকারে আনমনে গোঁজগুলোর কথা একদম মনে নেই তার এখন আবার তাকে গা ধুতে হবে। নিজেকে তার একটা রুগ্ন অসুস্থ গরুর মতো মনে হতে লাগলযার সারা গায়ে কাঁচা গোবর লেগে আছে

বোন হাত ধরে টেনে তোলে “ কী করিস বল তোঘরে চলঅনেক হয়েছে।“

মা শুনে বিরক্ত হয়, “ ওই জন্যেই রাতবিরেতে বাইরে যেতে নেই

খুব সকালেই নাসির বাড়ী ফেরে ফিরেই রহিমার খোঁজ করেছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনেছে তার নাথাকা কালীন বাড়ীর সব খবরাখবর রহিমাকে দরকার তাই তাকে ডাকতে এসেছে শাকিলা মেয়েকে নাড়া দিতে গিয়ে দ্যাখে গা তার পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে দুতিনবার ডাকার পর সে চোখ মেলে যেন সসপ্যানের ঈষদুষ্ণ জলে ভর্তি তার চোখতাতে লাল আঁচের আভাস শাকিলা তার কপালে জলপটি দেবার সরঞ্জাম আনতে রান্নাঘরে যায় নাসির সেখানে হাজির হয়

কী হলো?”

খুব জ্বর এসচে দেখছি – “

“ তা কীকরে হলো বল দিনি হঠাৎ? “

নাসিরের কথা বলার ট্যারাব্যাঁকা ধরণে বিরক্ত হয় সে তবু শান্তস্বরে উত্তর দেয়, “ তার আমি কী জানিআমাকে বলে কী জ্বর এসচে?”

নাসির চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “ তুই মা, – তুই জানবিনি তো কে জানবে? – এটাও জানিস বুধায় – তোমার মেয়ে কাল আরামবাগ লয়বর্ধমান গিয়েছিলসঙ্গে ওই মঞ্জুর বলে ছেলেটাও ছিল? “

নাসির খেজুর পাতার খরচোখে তাকিয়ে থাকে শাকিলার পানে ও কিছু জানে কিনা আঁচ করতে চেষ্টা করে। ও একেবারেই বিশ্বাস করে না শাকিলাকে আসলে মেয়েদেরই সে বিশ্বাস করে না ও মাগীদের বুদ্ধি বলেই কিছু নাই। ওদের ইস্থান সবসময় অন্দরেই হওয়া উচিত। মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছা তার ছিল না। শাকিলা খালুর কাছে কেঁদে পড়েছিল তখন খালুও সায় দেয়। মেয়েমানুষকে লেখাপড়া করানোর কথা সরকার থেকে ইদানীং খুব বলা হচ্চে। সরকারকে তো মানতেই হবে! – খালুর কথা অমান্যি করে নাই সে কখনই করে না

ও জানে,শাকিলার দুঃখ ছিলহয়তো এখনও আছে – তার সঙ্গে বিয়ে হওয়ায়। তার বাপের নুন আনতে পান্তা ফুরানো না হলে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় কুড়ি বছরের বড় নাসিরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়তার উবরি সে সুন্দরীসেও এমন কিছু ধনী লয় বটপ তবে বাপমার একমাত্র ছেলে ছিলআর বিঘে দেড়েক জমি – সে কি এতই গাড়োল যে ঘেন্নাটা বুঝবে না?

দাঁত কিড়মিড় করতে করতে সে বেড়িয়ে যায় বাড়ী থেকে শাকিলা যায় মেয়ের মাথায় জলপট্টি দিতে জ্বর একবার সামান্য কমে তো পরেই আবার আগের জায়গায় নাসির দুপুরের আগে আর বাড়ী ফেরে না একেবারে খাবার সময় আসো স্নান খাওয়া সেরেই আবার বেরিয়ে যায়

তিন

রহিমার জ্বরের দ্বিতীয় দিনেও কোনো ওষুধ বা ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করল না নাসির। তবে সারাদিন ধরে সে অন্যকিছু ব্যবস্থার সলতেতে পাক মারে। আজ সকালেও জ্বর ছাড়েনি ছোটমেয়ে রেশমাকে সেদ্ধভাত খাইয়ে স্কুলে পাঠি দিয়েছে শাকিলা রহিমার জন্য একটু সুজি বানাবে বলে ঠিক করে সে রান্নাঘরে সুজিটা একটু চেলে নিচ্ছিল

বেলা নটা/দশটায় রোদ গোঁয়ার মোষের মতো তেড়িয়া। জ্বরের তাড়সে রহিমার তবু জাড় পায় সে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল মঞ্জুরের কথা ভাবছিল কখনওকখনও ভাবতে চেষ্টা করছি। মন এলোমেলো হাওয়ায় অস্থির ন্যাকরার ফালির মতো পতপতায় উদব্যাস্ত করেঠিক গুছিয়ে নেওয়া যায় না তনুজাকে ফোনে সে কী বলল তা সে জানে না তনুজা তো একবার এলুনি কো ব্যাপার কী?… হয়তো সে যায়নি দেখে নিশ্চয় ভেবেছে বাড়ীতে আব্বুর কারণে পরিস্থিতি জটিলতাই হয়তো ভয়ে আসেনি

হঠাৎ নাসির হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢোকে – “রহিমা-!” গমগম করে তার উচ্চকিত ডাক

তার দবদবিয়ে পা ফেলায় দম্ভে পতাকা পতপত আওয়াজে ও ডাকহাঁকে সান হলে শাকিলা ছুটে আসে ততক্ষণে অসুস্থ মেয়েটাকে হ্যাঁচকা টানে বিছানা থেকে তুলে ফেলেছে নাসির 

-“পাগল হলে না কিগোহয়েছে কীমেয়েটার উপর এমন অত্যেচারটা করছ কীজন্যি? – দুদিন ধরে জ্বরে ভুগচেএকবার তো খর নাওনি ও কেমুন আছেতার উপর এমন মারমুখী ব্যাভার ! অবাক হয় সেরাগ দুঃখ – একাকার হয়ে যায় তার গলাার স্বরে

-জ্বরনা হাতিওকে জিনে ধরেছেসে ছাড়ানোর ব্যবস্থাই হচ্ছে

কথাটা শুনে হাজার হাতির পা পড়ে শাকিলার বুক

কিন্তু রাগে যেন ফেটে পড়বে নাসির  ”সেদিন যখন বলেছিনু সমসেরের সঙ্গে ওর বিয়ে দোবতখন তো তার বয়েসের কথা তুলে খোঁচা মারলে পুরুষ মানুষের আবার বয়ে! – অথচ তোমার মেয়ে কী কচ্চে চালচুলো নাঘরদোর নাই – সেই হারামজাদা মঞ্জুরের সঙ্গে ওর কীসের ফস্টিনস্টিকাল ও বদ্ধমান গিয়েছিল তার সঙ্গে – সেকথা জানো?”

শাকিলা আর রহিমা যেন গভীর জলে জড়াজড়ি করে ডুবছে! শাকিলার মুখে কথা সরে না রহিমাকে তার আব্বু গভীর জলে ঠেলে ফেলেছে অবাক হয়ে সে তাকিয়ে থাকে

শাকিলার মঞ্জুরকে খুব পছন্দ ভদ্র আর নরম স্বভাবের ছেলে লেখাপড়ায় খুবই ভালো সে আজ হয়তো গরীবকাল যে পয়সার মুখ দেখবে না তা কে বলতে পারে? – অবশ্য এসব কথা সে তখন নাসিরকে বলতে পারেনিআজও পারল না নাসির তাকে একদিন লোভ দেখিয়েছিল সমসেরের বউ মরেছে বেশ ক’বছর আগে তার পয়সাকড়িও ভালো একটি মোটে ছেলেসে বিয়ে করে আলাদা থাকে।… কিন্তু সে লোক রহিমার বাপের বয়সী না হলেওতার বয়সের যে কাছাকাছিতাই শাকিলা সে প্রস্তাব শুনে সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করেছিল তিতকুটে হয় তার মন। কিন্তু নাসির হাল না ছেড়ে তার ছক পাতে,দান সাজায়

বল, “শোন্সমসেরের সঙ্গে রহিমার বিয়ে দিতে পারলে হালিমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না! সমসের ওর দায়ীত্ব লেবে

কিন্তু একথা শুনে শাকিলার মন আরও রিরি করে ওঠে সে যেন আবছাভাবে বিষয়টার ভেতরের ময়লা অনুভব করে নুলো পায়ের মেয়েকে বিয়ে করা যায় নাকিন্তু তার ‘দায়িত্ব’ নেওয়া যায়সে তাইলে উপরি বা ফাউ দোকানে ভালো বেগুনের সঙ্গে একটা ব্যাঁকাসামান্য পোকালাগা বেগুনটা খদ্দের তুলে নেয়কখনও দোকানদারই তুলে দ্যায় থলিতে

শাকিলার মন বিত্তিষ্ণায় ছেয়ে যায় প্রতিবাদ ওঠে নিঃশব্দে আবার কিছু পরে মন শান্ত হলে সেও যেন নাসিরের প্রস্তাবের একটা যুক্তি খুঁজে পায় হালিমার যদি কখনও বিয়ে না হয়তবে তাদের স্বামীস্ত্রীর অবর্তমানে তাকে কে দেখবেবোনেরা কি দায়িত্ব আদৌ লেবেনা– নাতাবলে হালিমার জন্যে রহিমাকে বিসর্জন দিতে পারে নাহায় আল্লাকী করে সেঝড়ে পড়েচে এলোমেলো পাক খাওয়া লৈকো

দোনামনা করছিল সে রহিমার প্রতি তার আশাআকাঙ্ক্ষা বেশিটানও বেশি মঞ্জুরের বদলে বাপের বয়সী একটা লোকের সঙ্গে তার বিয়ে – ভাবলেই মন হুহু করে যেন খাঁখাঁ মাঠে ঝলক ঝলক গরম বাতাস বইছিল  রহিমার পাশে হালিমাকে রেখেও সে ভাবে লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারে নাতার পায়ের দিকে তাকানো যায় নাএতটাই অদ্ভূত দেখতে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটার অভ্যাসে অল্প কুঁজোটে হয়ে গেছে মাঝারি গায়ের রঙসাধারণ মুখশ্রী তার। তবে এই খুঁত সত্ত্বেও শরীরটা তার বেশ পোক্ত এবং পুষ্টভারী বুক  মা হয়ে তাকে এমনটা ভাবতে হচ্ছেনাএমন একটা ঘোচ পোঁচ উদ্দেশ্যকে সে মানবে কীকরেদোনামনা কাটিয়ে ফেলে দাঁড়ি টেনে দেবার মতো নাসিরকে জানিয়েছিল যেতার এতে মত নেই  নাসির কোনো কথা বলেনি। গোঁজ হয়ে ছিল

এখন সে কী করতে চাইছে তা বোঝা যাচ্ছে না  অসুস্থ মেয়েটার উপর জুলুম করার কারণটা কীনাসির রহিমাকে হতভম্ব করে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যায় উঠোনে শাকিলা তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বাইরে এসে অবাক হয় দ্বিগুন

সমসের দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে আলখাল্লা পরামাথায় টুপিঝোলাঝাপ্পি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে খুনে মগরেব ওঝা। এই বদনাম তার মিথ্যা লয় জিন তাড়াতে গিয়ে তার হাতে অত্যাচারিত হয়ে এর আগে মানুষ মরেছে। তবু তাকে স্বার্থের কারণে লোকে ডাকে আজকাল কেউ কেউ সচেতন হলেওমানুষ কখনও বা অবস্থা বিপাকে ওঝাগিরিকে ভরসা করে সেই লোকটাকে ডেকেছে নাসিরসমসের আর মগরেবকে একসঙ্গে দেখে শাকিলা চক্রান্তের আঁচ পায়

এসব ভাবনার মুহূর্তেই রহিমাকে উঠোনে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দেয় নাসির রহিমা চিৎকার ছেড়ে ছুটে দুয়ারে উঠে আসতে চায় কিন্তু নাসির তাকে ধরে ফেলে বসিয়ে দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে ততক্ষণে কুস্তির রিঙের ভেতর রিঙমাস্টারের মতো লাফিয়ে পড়েছে ওঝা। চটপট সে সাজিয়ে নেয় তার জারিজুরির মালমশলা। রহিমা নিজেকে উগড়ে নিতে চায়হাপুড়িঝুপুড়ি কাঁদে। ঘর থেকে লাঠি ভর দিয়ে ঠুকঠুক করে এই সময় বেরিয়ে আসে হালিমা ঘটনার আগাপিছে কিছু বুঝেছে কিনা তার মুখ দেখে বোঝা যায় না

রহিমা ফুকুরে কেঁদে ওঠায় দুএকজন উঠোনে ঢুকে আসে । এতক্ষণে মেলা বসে যেতনেহাত তাদের বাড়ীটা একটেরে জায়গায় ওঝা তখন আগুন জ্বেলেছে বড় মালশায় নানা অংবং করতে করতে সরষেই যেনছুঁড়ে দেয় আগুনে সেগুলো আগুনের সংস্পর্শে ফটফট করে ফেটে যায় কিছু ছিটকে গিয়ে লাগে রহিমার গায়ে

জ্ঞানের জাহাজ ওঝা লাফ মারেআর বলে– “বল – তুই কেকেন ওকে ধরেছিস? – বল্… বল্… “ আবার সরষে ছোঁড়ে রহিমা ভড়কে যায়তার খুব জাড় লাগে

সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি রহিমা গো! – আমাকে ছাড়ো– আমি ঘরে যাবো আব্বু – “বলতে না বলতে ওঝা এসে সপাটে চড় মারে

তড়পে ওঠে, “ মিথ্যা কথা বলছিস বল – তুই কেতুই কার জিন?”

এবার স্বভাব বিরুদ্ধভাবে অধৈর্য রহিমা বলে ওঠে “তুই জিনতুই জিনের বাচ্ছাতুই রাক্ষস! “

এরপর উপর্যুপরি জিনসংক্রান্ত নানা প্রশ্নঝাঁটাকঞ্চির বাড়ি মারাঅংবং করতে করতে জল ছেটানো চলতে থাকে। তার ধমকচমকেরও জোর আছে এখন কোনো কথা বলছে না রহিমা ঠান্ডা মাটিতে পড়ে আছেচোখ বন্ধ তবে শরীরটা তার শীতল হয় নাবরং গায়ের তাপ বাড়তে থাকে মাঝে মাঝে তার কাঁপ উঠছে 

ওঝা বলছে, ”বল্ ছেড়ে যাবি কিনাবল্ – “

তার জ্বোরো ও অত্যাচারিত শরীরটা প্রতিরোধহীন আলগা হয়ে পড়ে আছে। সমস্ত চিন্তাশক্তি তার চলে গেলেও মনে মনে মঞ্জুরের মুখটা মনে করতে চেষ্টা করে। লালচে ও ভেজা চোখদুটো অল্প খুলে মাকে দেখতে চায় শাকিলাও বোবা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাকে আটকে রেখেছিল সমসের শাকিলা সমানে চিৎকার করেকেঁদে কেঁদে ক্লান্ত তার বুক ফেটে যেতে চায় মেয়ের উপর এই অত্যাচারের দৃশ্য দেখে। সে অসহায়আর এখন প্রতিরোধ করার চেষ্টাও নেই কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে আরও কিছু লোক জড়ো হয়েছে উঠোনেজিন তাড়ানোর কেরামতি দেখছে ভয়ভক্তিতে

উদ্দেশ্য মেটার পথ এত দীর্ঘ হোক তা যেন চাইছে না নাসির। সে সামান্য একটু শাস্তি দিয়ে “জিনপরী” তাড়িয়ে চটপট কাজ হাসিল করতে চেয়েছিল যেন খানিকটা অধৈর্য হয়ে সে একবার সমসেরের দিকে তাকায়একবার ওঝাকে দেখে গলা খাঁকড়ায়ওঝা তাকালেও নাহয় একটু ইশারা করা যাবে সমসেরের সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়কিন্তু ওঝা বড্ডই ওঝাগিরি করছে বেটা সত্যি সত্যিই খুনে! মেয়েটাকে মেরে ফেলবে নাকিসামান্য যেন চলটা মেরে ওঠে তার মনের মধ্যে মেয়ের বাপ তো বটে!

মরিয়া ওঝা যেন শেষ সুযোগ দিচ্ছে তখন  – “বল্ হারামজাদিতুই ওকে ছাড়বি কিনা! “ – বলতে বলতে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা রহিমার পেটে হঠাৎ একটা লাথি কষায়

মরণ ডাক উঠে আসে কোন্ গহীন খাদ থেকে অতৃপ্ত আত্মার মতো –“মাগো-!”

হঠাৎ চাদ্দিক নিঝুম। রহিমার শরীর নিঝুম গাছের পাতা নড়ে না কটকটে রোদও যেন ধাৎসে যায়ছায়া নেমে আসে কি?

এক মুহূর্তই তারপরই কেমন রক্ত ছোটে শাকিলার শিরায়গায়ে খুব বল চলে আসে । সমসেরকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ছুটে এসে আছড়ে পড়ে মেয়ের উপর – “মারেরহিমা! ” – সোনা আমার – জান আমার-! “ মায়ের ডাকপ রহিমা তাকানোর চেষ্টা করেকিন্তু পারে না

নাসিরসমসের আর ওঝাকে আশ্বস্ত করে রহিমার এলোমেলো শরীরের নীচের অংশের পোশাক ভেদ করে লাল একটা ধারা উঠোনের মাটিতে গড়িয়ে নামে আকালের দিনে চোখ নিংড়ে আসা পানির মতো

সম্ভবত জিন এবার তাকে সত্যিই ছেড়ে যায়

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত