Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

নারীর ক্ষমতায়ন ও এলোমেলো কিছু ভাবনা

Reading Time: 3 minutes

আজ নারী দিবস নয়। প্রতিবছর নারী দিবস এলেই আমার মুখপুস্তিকার দেওয়াল ভরে যায় নারীমাহাত্ম বর্ণনায়। তারপর সারা বছর চুপচাপ। ইদানীং একটা নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে দেখতে পাই। ভাইফোঁটা, জামাইষষ্ঠী হবে বোনফোঁটা, বৌষষ্ঠী কেন নয়। ঠিক আমার ছানাদুটো এভাবে ঝগড়া করে। ওর বেলুনটা বড়, আমারটা ছোট কেন? মাম্মা, ওকে বল দিলে আমায় দিলেনা কেন? ওর ললিপপটা বেশি টেস্টি কেন? যাক গে, এসব কথা বলতে গেলে অনেকেই তেড়ে আসবে।

Women empowerment, বেশ গালভরা কথা, শুনতে বেশ লাগে। আচ্ছা, এর বাংলাটা ঠিক কি হবে? গুগলদাদা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়ন।ক্ষমতায়ন? সত্যি? মানে, ঠিক এখন কতটা ক্ষমতা আছে, আর কতটা ক্ষমতা হলে ক্ষমতায়ন সম্পূর্ণ হবে, সেই বিচারটা কে করবে। মানে আমি বলতে চাইছি, কোন মাপকাঠি আছে কি? কিছু স্কেল টেল?নেই? আচ্ছা, তা না হয় হল। কিন্তু তবু আরেকটা প্রশ্ন থেকে যায়। এই ক্ষমতায়নটা করবে কে?

বেশি ভাবতে পারিনা। কম বুদ্ধিসুদ্ধির মানুষ। একটু নিজের কথা বলি। খুব ছোট থেকে আমার বইয়ের নেশা, বোধ হয় যবে থেকে অল্প অল্প বাংলা পড়তে শিখেছি, তবে থেকেই। সেই বইয়ের যোগানে কখনও ঘাটতি পড়েনি। বাবা মা প্রচুর বই কিনে দিতেন। হ্যাঁ, বাবা ও মা। প্রথম ক্ষমতায়নটায় কিন্ত একজন পুরুষ ও নারীর সমান ভূমিকা ছিল। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। মায়ের কাছে শোনা একটা ছোট ঘটনা উল্লেখ করি এই সূত্রে। আমার জন্মের সময় আমাদের পারিবারিক আয় খুবই কম ছিল। বাবা নাকি মাকে হিসেব করে বলেছিলেন, “৫০০ টাকা হলে আমাদের হয়ে যাবে। ২৫০ টাকায় সংসার খরচ আর বাকিটা দিয়ে মেয়ের পড়াশোনা। “হয়তো মার নিজেরও আর মনে নেই। কিন্তু সেই খুব ছোটবেলায় শোনা কথাটা আমার মনে এখনও গেঁথে আছে। মেয়ে বলে কখনও কিছুমাত্র আদরের ঘাটতি হয়নি। বড় হয়েছি, আমার পড়াশোনার জন্য সাধ্যাতীত করেছেন আমার বাবা মা। বাবার একটাই কথা ছিল, “তুমি শুধু পড়াশোনাটা মন দিয়ে কর। আর যা খুশি কর,আমি কিচ্ছু বলবো না। “আর মায়ের কথা কি বলি, আমার সিলেবাস আমার থেকে মা ভালো জানতেন। মনে আছে, অনেক খুব কাছের আত্মীয়রা মাকে বলেছেন, “মেয়েকে একটু ঘরের কাজ শেখা ঝর্ণা”। মা হেসে উত্তর দিয়েছেন, “যখন শেখার হবে ঠিক শিখে নেবে। “প্রায় ২৩/২৪ বছর বয়স অবধি আমি গ্যাস আভেনও জ্বালাতে পারতাম না। আমি বলছি না সেটা খুব ভালো কথা। আমি মনে করি, সেটাও জানা উচিৎ। কিন্তু যেটা বলতে চাইছি, সেটা হল, শুধু মেয়ে বলে আমায় রান্নাবান্না, ঘরের কাজ শিখতে বাধ্য করেনি কেউ কোনদিন।

কলেজে পড়ার সময় হস্টেলে থাকতাম। তারপর যখন কলকাতায় চাকরি পেলাম, ঠিক হল, কলকাতার মেসে থাকবো। আবার সমাজ রে রে করে উঠলো। বাবাকে বলা হল, একা মেয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে চাকরি করুক। মেসে কেন থাকবে? এসব বেচাল চলবে না। আমি কারও বাড়িতে থাকতে চাইনি। বাবা মা আমার সিদ্ধান্তকে পূর্ণ সমর্থন করেছিলেন সেইদিন। মেসেই থেকেছি।

আমায় চাকরি ছাড়তে কেউ কোনদিন বাধ্য করেনি।আমি ছেড়েছি। আমার ভালো লাগছিল না, তাই।একটা সময়ে বুঝতে পারলাম, যে কাজটা করছি, সেটাকে ভালোবাসিনি কোনদিন। ভালোবাসতেও পারবো না। আমার বর ভদ্রলোক বললো, “যে সিদ্ধান্ত নেবে, তার জন্য যেন কোনদিনও অনুশোচনা করবে না। তোমার সব সিদ্ধান্তে আমার সমর্থন আছে।” আমি যখন যা করেছি, তাকে আমার পাশে পেয়েছি। সব ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছে আমায়।আমার প্রতিটা ভেঞ্চারে আমার থেকে তার উৎসাহ বরাবর বেশি থেকেছে।যখন ব্যবসা শুরু করেছিলাম, আমার ছোট ছেলের সবে কয়েক মাস বয়স। বড়টির পাঁচ বছর। সারাদিন অফিস করে এসে ও রাত দেড়টা দুটো অবধি ব্যবসার হিসেব রাখতো এক্সেলে। এখনও আমার এক্সিবিশন থাকলে ও সঙ্গে থাকে। আমার প্রতিটা লেখার প্রথম পাঠক সে। খুব কড়া সমালোচক, খুঁতখুঁতে। ওর ভালো লাগলে আমি নিশ্চিত হই যে ঠিক আছে।যতই ব্যস্ত থাকুক, ক্লান্ত থাকুক, প্রতিটা লেখা মন দিয়ে পড়ে সে। আমাকে নিয়ে হয়তো আমার চেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখে।

ক্ষমতার কথাই যদি আসে, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করিনা, মেয়েরা ছেলেদের থেকে কম কিংবা বেশি ক্ষমতাশালিনী। সারাদিন পরে অফিস থেকে ফিরে কোন পুরুষ যতটা ক্লান্ত থাকে, একজন মহিলাও ঠিক তততাই ক্লান্তি বোধ করে। আমার মনে হয়ে মেয়েদের মহিমান্বিত করাটা খুব একটা উদ্দেশ্যহীন নয়। ”মেয়েরা মায়ের জাত”,মেয়েরা মালটিটাস্কার’ এই সব পোস্টগুলো দেখলে আমার মনে হয়,যেন মেয়েদের তোল্লাই দেওয়ার চেষ্টা এগুলো। যাতে মেয়েরা সেগুলোকে ঠিক প্রমাণ করার জন্য সাধ্যের অধিক চেষ্টা করে যায়। এর সত্যিই কি কোন দরকার আছে? মানে কি দরকার? মেয়েদের ক্লান্তি লাগতে পারেনা? মেয়েদের সারাদিন বাচ্চা সামলাতে ইচ্ছে না করতে পারেনা? ছেলের চকোলেটটা খেতে ইচ্ছে করতে পারেনা? মেয়েদের রান্না না জানাটা অপরাধ? মেয়েদের ঘরকন্নার কাজ করতে ভালো না লাগতে পারেনা? মেয়েদের লক্ষ্মী হতেই হবে? কে দিয়েছে মাথার দিব্যি?
একটা ফেসবুক পোস্ট দেখেছিলাম। একটি আধুনিকা মেয়ের দশভুজারূপ। এক হাতে হাতাখুন্তি, এক হাতে ল্যাপটপ, একহাতে বাচ্চা, একহাতে লন্ড্রি, এরকম আরো কত কিছু। দেখে প্রথমেই মনে হল, এই ছবি দেখে কোন মেয়ে যদি এতে বিশ্বাস করতে শুরু করে,তাহলেই চিত্তির। আমি নিজে একেবারে অলক্ষ্মী। আমার রান্না করতে ভালো লাগেনা। আমার ঘর গোছাতে ভালো লাগেনা। আমি আমার ছেলের চকোলেট, আইসক্রিম লুকিয়ে খেয়ে নেই।আমি সেজন্য একেবারেই লজ্জিত নই। আমি নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজেকে মহান প্রমাণ করার চেষ্টা করিনা। আমি আমার শক্তি সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কিন্তু সেটা কারো কাছে প্রমাণ করার কোন দায় আমি নিজের মাথায় নেইনি। আমি মনে করি, প্রতিটি মেয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী, শরীরে ও মনে।তাদের সেটা বারবার মনে করানোর কিছু নেই। আর তাদের নতুন করে ক্ষমতায়নের প্রহসনটাও অনেক হয়েছে। তাদের পাশে থাকাটাই যথেষ্ট। তাদের শুধু মেয়ে মনে না করে, মানুষ মনে করলেই তাদের অনেক উপকার হয়। মেয়ে বলেই কোন চেকলিস্টের সব ক্রাইটেরিয়া মীট আপ করতে হবে, এরকম মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? আর শেষমেশ যেই কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা দিয়েই শেষ করি। নারীদিবসের আলাদা করে সত্যিই কোন প্রয়োজন আছে কি?

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>