| 20 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-১) । বল্লরী সেন

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

কিরীটেশ্বরী পূজা দিতে গেলা শীঘ্রগতি।

কথোগুলি বাত্রী গেলা কর্ত্তার সংহতি।।

মহাসরঞ্জাম সঙ্গে গিয়া কিরীটকোণা।

দেবীকে প্রণাম কৈল দিয়া কিছু সোনা।।

ষোড়শোপচারে পূজা কৈল ভগবানে।

দক্ষিণা করিলা কত কৈল বিতরণে।।

বসন এই কিরীটেশ্বরীর ছড়া কাটে আর মেয়ের জঠর আগলায়। তার কেমন মনে হয়, কেউ পাশেই আছে যে  নষ্ট করতে চায় শিশুটিকে, মুণ্ডারিদের দলের রাজা হবে যে, তাকে মারবার জন্য দল পাকিয়েছে নবগ্রাম থানার চেরাগ আলির বিরোধীপক্ষ। পোয়াতি ফুলকুমারীকে সে যে কিরীটকোণার মায়ের থানেই কবুল করেছিল, তাই মেয়ে জন্মের মুহূর্তেই স্মরণ করেছিল কিরীটেশ্বরী মাকে। বলেছিল, হেই গো মা — আমার জমির মালিক হ, মানসের জমির কর্তি করো ওকে, ও যেন লড়াইয়ের সামনে থাকে। আর আজ, এই মুহূর্তে, ফুলির পেট যেন চিরে ফেলতে চায় মটুকসর্দার, কী তার খ্যামতা। ঢাউস ছুঁছালো বহর, মায়ের রূপ ভূতের মতো জিরজিরে, তাই ছেলা বেয়াবে এ তো নিশ্চিত। এ সব ভাবা আর ডুকরে ককিয়ে উঠলেক বিটি। তাকে ভুলিয়ে এক কলি সুর গেয়ে ওঠে বসন। সেই কচি বয়সের রং লাগার গান, ভরা বাদলের ঝিঝি ডাকে মেয়েদের মজলিসে সেবার ডাকাতির সাঙ্যাত করছে বাস্কে কামায়ণী। তার কথকতার জরিপ করছি আমরা,বাকিরা। মোট ১২ জনার হূন। হূনের নেত্রী বাস্কে, পেছনে থাকবেক চেরাগ আলির বিশ্বস্ত কিছু মুণ্ডারি। কিরীটকোণার মায়ের মন্দিরে জমায়েত রওনা হইলাম প্রায় রাত ১২ টা মতো। যাব আজিমগঞ্জ, নৌকা রাখা থাকবে। 

হঠাৎ মেয়েটোর জল ভাঙ্গতেছে, বসন সজাগ হল। হাতের আঙুলে সে মুণ্ড স্পর্শ করলো, না দিপ্ কাঁপন উঠতেছে, তাইলে মটুকসর্দার ঠিক আছে নিচয়, আশঙ্কা নাই। এদিকে মেয়েটা ছটফট করে। হাঁসগুলান এই ফিরলো খামারে। তাদের দলীয় ডাকে চমকে উঠে না যেন জঠরস্থ শাবক। মানসের ছা বলে কতা ।

ফুলকুমারীর গায়ের বস্ত্র তলপেট আটকে রেখেছে গত ৬৪ মিনিট।সাদা পায়জামা পরে বাবুদের ছোটকর্তা কিছু হয়নি মুখ করে একবার ভ্রূ নাচিয়ে ঘুরে গেছে, চোখে চোখ পড়তেই তার কিন্তু কিন্তু ভাব ধরা পড়ে গেলে, “ ঐ, মানে, তমিজ কি বার হইসে?” প্রশ্ন ছুঁড়ে উত্তরের নিরপেক্ষতায় দ্বিতীয়বার আসার পথ পরিষ্কার করে চম্পট দিলে। ঘরে পোয়াতির হুঁশ সম্পূর্ণ, তাই দরজার দিকে মাথা ঘুরিয়ে মেয়েকে আকুলিবিকুলি অবস্থায় পাঁজাকোলে স্থান রূপান্তর করলে বসন। বেবাক ব্যথা খাচ্ছে ফুলি, দাপনার মধ্যে একটা যেন খলবলানি, শুয়োরের পো— বলি, কদ্দূর এল্যা? কিষ্ণচূড়ার টুকটুকে যোনি, তার মাংসল জিহ্বাশুক লক্ লকে। বস্ত্র আরো নিপিট করে বান্ধ্যা হল, মনে আছে সেবার বাবুর সেজ বিটির ঠ্যাং বান্ধার লুক নাই, মুই যেয়া পোয়াতির চোপড় সামলে দিনু। তখন বড়কর্তা জীবিত, হাতেনাতে নতুন ট্যাকার নুট দিয়ে বইল্ল, দরকারে জ্যাঠাবাবুকে স্মরণ লিস্, শরম করবা না কিন্তুক। সেই বাবুদের সঙ্গে গা ঘষার শুরু; ধান রুইয়ে পূজার পেসাদ দিতে এলে গিন্নি হলুদ তেল দিয়া কোরা কাপড় একটো গুছিয়ে দিতেন। কাছে এসে চিবুক ধরে বইল্লে, “ওলো, তুই যে সাক্ষাৎ নক্ষী,কী অপরূপ পায়ের সুভাগা, তুর লগেই দেখিস সংসারে তমিজের মন নেগেছে।” তারপর একদিন খুব বেখুব তলব এল জমিদারবাড়ি থেকে তখন রায়চৌধুরীদের মেজ পুত্র ডাক্তার,পলসণ্ডায় মহলা তুলে পসার জমিয়েছে। হপ্তায় তিনদিন নগরায় আইসে, ভিটের রুগি তদারকি করে ভর বিকেলে সাইকেল চালিয়ে ফেইরে যান। পাঁচ ক্রোশ পথ, বিষ্টির সময়ে কাঁদরে জল বোঝাই। 

“ মা গো ! কিরকম হইসে দ্যাখ কেনে, কত মুড়ি ভাজবি আর, সেই কখন থেকা, তুর মন কোতি রে মা—”

হ্যাঁ। শিশুমুণ্ড প্রায় ঠাহর হয় এখন।

“ হুম,ফুলি আর একটুস কষ্ট কর, খুউব চাপ এলে যেমন বাহ্যে চাপ মারিস, কিন্তক সে তবু বেরোয় না, হেমনি কইরা চাপ দিবি, বুঝলা?”

বলে একটা ফর্সা কাপড় ভাঁজ দিয়ে তাকে খোলা উনানের উপর ধরে রেখে

বেশ খরমুশ করে মেয়ার পায়ুলম্ফে তাপ ধরলে, সেঁক বেশ খরমুশ হলে লক্ষ করলে তলপেটের নাবাল অংশ কেমন একটা তদ্বির করছে, কিছু একটা ঘটবেই, আজই। বাঁধনদড়ি আরও জোর হল। ‘আর লয় গো, আর লয় গো, মা গো’, দম টুটে যাবে যে। মেয়েমানসের আবার দম। ক্রমশ ব্যথায় বসন দেখলো তার কইন্নার মুখ কেমন নয়নতারার মতো সাদা হয়ে যেতে লাগছে, সে কী ! অঙ্কে কি তবে কুনো ভুল ছেল? ওদিকের শ্মশানে কার যেন দাহ হচ্ছে, মরা পোড়া গন্ধ চতুর্দিকের বৃক্ষ গুল্ম ঘাসের ফুলে, দোলনচাঁপায় মগ্ন। বুজকুরি দিয়ে বাতাসে কাঠের পুড়তে থাকা শব্দ যেন আলগোছে বসনকে সাবধান করে গেল। মনে হল,মৃত মায়ের মুখ, মায়ের ঝাঁপিতে কাপড় পেঁচিয়ে একটু আঁটো আলগা করতেই বিষম চিৎকারে চমকে দেখলে, কুচকুচে মাথা দোর ধরে দাঁড়িয়েছে আর বিষরক্তে আঁতুড় টাটিয়েছে।

মেইয়ের মতো লাগতেছে, হ। কেমন থুবড়া নাকের পাটা, ঢাককপালি কিন্তুক ঠোঁটের ডিবেয় য্যান কে লাল ঢেল্যা দিইছে। লক্ষণযুক্ত মেইয়া হইছে ফুলির। বাথানের মতো চারদিকে রক্তের আঁশটে ঘেরান, বেশ লাগছে বসনের। গামলায় মন্দজলে ধুইয়ে দিলেন ছানাকে, যেন চেট্যা সাফ হল বাছুরটোর। কাঁকই চালাবেন নয় দুটো দিন যাক। তখন আপনিই কপালের, ভুরুর, চুলের চাকলি সব ঝরে যাবে একটু করে। কেমন উৎসাহে উদ্দীপনায় ঘোর এল,মনটা কে যেন রাহাজানি করে লিল। জবাফুলের হাঁ তাকেও কামড়ায়, মেয়ার বিয়োলো সমাপনে নিজের ঐ প্রথম কলঘরের আরশিতে নিজ কলেবর নির্মুক্ত করে দেখার স্মৃতি গাঢ় হল। সে ছিল মেজবাবুর প্রাসাদের লাল মেঝেতে এক দুপুরের পূর্ণিমে। মা বলেছেল, পেরথম মাসের রক্তবিন্দু বাহুমূলে আচ্ছা করে মাখিয়ে রাখবা, তাইলে কুনো রোম গজাবে না। সুতরো থাকবেক বাহুর খাঁজ খপ্পর। অভ্রের মতো চিকচিক করবেক এক লহমা ঘাম, এক মুহূর্তের পুরুষমরদের গায়ের আহ্লাদ, রোমশ রেখার বুকে কপাল রেখে সেদিন সে নিজের অঙ্গসংস্থানকে একবার কুর্নিশ করে জান কবুল করে ভালোবাসা দিলে, ঢেউ তোলা মকরমুখী আয়না সাক্ষী রেখে তিনি তখন বসনকে পিছন থেকে দু’ বাহুতে পেখম তুইলে দিলে, দুই হাত বেন্ধে নিজের হাতে, ঘাড় সমেত দুই বুক তখন তাঁর। পেটের পাশ দিয়ে সেই হাত তখন কাঁচুলির কুচি থেকে বসনের একটো বুক বাইরে বার করে নেল। বাঁ টো! এটিই বেশি ডাগর,কেমন ভারবন্ত। দেখলেই স্পর্শ কাড়ে, বৃত্ত আঁক কেটে কেটে দুটিকেই এবার কাঁচলমুক্ত করলেন। বসনের চোখ তখন তার শরীরের দ্বিগুণে ঠিকরে পড়ছে আলোর ছটায়। যতগুলান জানলা এ ঘরে, ততগুলান রৌশনচৌকে সে নিজের অর্ধ নগ্নশরীরকে দেখতে লাগল। দেখে দেখে সুখ উথলে ওঠে, তখন সে নিজমনে অচেতন, পুরুষটার দিকে তাকাবে কে? সময় পেরিয়ে যায় আর এদিকে ছোকরার কবলমুক্ত দানবী তখনও স্নান করতে ব্যস্ত। জমিদার বাড়িতে শোর চলছে, গিন্নীমা এবার ছেলেকে ডাক দেবেন, অথচ গাড়িবারান্দায় বসনের ভ্যানরিক্সা মজুদ। মেয়েটা এ যাত্রায় ডোবাবে, বললেন চন্দ্রোদয়। ছোটকর্তার কাছের দোস্ত্। এত দেরি! এত দেরি কিসের রে? দোর বন্ধ, আওয়াজ নেই, হচ্ছেটা কী। সেই বেলা ১২ টায় ওটাকে এনে ঢুকিয়েছেন, আর এখন প্রায় ৪.৩০ বাজে। হ্যাঁ, বসনের সামনে উলঙ্গ আয়না, পিছন থেকে তার লাল বোঁটায় আঙুল ঘষছে মদ্দাটা।

বসনের আঙুল যতবার নিজের ইচ্ছামতো নিজের জমির ওপর চাপ দিতে চাইছে, যতবার তার আঙুলের নিয়ন্ত্রীশক্তি নিজের নাভি, নিজের ত্রিবলি, নিজের কানের লতি গূঢ়স্পর্শ চেয়েছে, ততবার হারমোনিয়ামের রিডে তার এলাহি সুর সম্মেহন হয়েছে, নারী যেন সুরবাহার। আর সে কেবল যন্ত্র, কেবল তহবিলের রক্ষক। ছোটকর্তা কেমন দিশেহারা। ঠিক বুঝে উঠবার আগেই তার রস-সম্পদের দফা গয়া। কিন্তু তাতেও ছুকরির হুঁশ হয়নি। না, চন্দ্রোদয় এবার সটান টোকা দিলে, সাবধান করলে। আর এই ফাঁকে কর্পূরের মতো উবে গেল ক্যামেলিয়া। হুঁ, এ তাঁর দেওয়া নাম, যদিও ডাকতে শরম হয়। কলেজে একজনও ওর মতো না। ও যে বহু যুগের ওপার হতে হারানো এক নারী, যার কাছে প্রথম তার শরীর পাখা মেলে দিয়েছে, প্রথম কিছু না বলে এসে দাঁড়িয়েছে চৌকাঠে। মেয়েটা সাঁওতাল, কিন্ত ওর দেহ মসৃণ কালির মতো, যেন এইমাত্র কেউ ছোবরা দিয়ে পেতলের কড়াই ঘষে মেজে রেখেছে। কানে সেই সূর্যমুখী ফুল, খোঁপায় বেগমবাহার আর দুই বুকের মাঝখানটাতে ভুল করে কেউ দোপাটি রেখে চলে গেছে, নীল দোপাটি। হলঘরের ছটি কাচের জানলায় সে খেলে আর নিজের গা খুলে দ্যাখে— কখনও ভয়ে, কখনও উদলা আনন্দে নিজেকে একটু খোলে, একটু ঢাকে, একটু কাঁদায়, একটু কাঁদে। শেষ রোববার, ওর চারদিন, তবু এল,দৌড় নয়, শান্ত; আলনার মতো গুটিয়ে নিজেকে কেবল, মানে নিজের গ্রীবায় পরলো মসুরডালের ছড়া। তখন একবার দপ্তরে এসে বললে, “আমি আজ তবে যাব।” নূপুর পরালাম, পায়ের গোছে কেমন চরণচক্র ফুটেছে দেখে যখন অবাক হয়ে চেয়ে আছি, সে লজ্জা না পেয়ে কাপড় সরিয়ে আরেকটু দেখালে। আমি কিছুটা সিঁটিয়ে তাকে ফেরত পাঠালাম, নির্লোম জানুর শুরুতে তার লাল জরুল চকচক করছিল সারাদিন আমার মনে।

এ সময়ে কাছে যেতে নেই, কিন্তু তার ইচ্ছে কাছে থাকার।

– “ মহুয়া খাওয়াবে বলেছিল আমার এক বোন— খাবে কর্তা ?”

“না, এখন কদিন তুই পড়ায় মন দে, আমারও নানা ঝামেলা। না ডাকলে আসিস না। মা জানলে তুলকালাম করবেন। ”চুপ করে থাকল একটু, তারপর কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল একটা কোনও ঘোরের মাঝামাঝি সে রয়েছে; রিক্ত ও ভরপুর। নিজের ভেতরের গূঢ় শরীরকে জেগে উঠতে দেখে ভারি খুশি, আবার অন্যদিকে লজ্জা, ব্রীড়া, শঙ্কা তাকে ঘিরে রেখেছে। অবিচল এক উদ্দীপনায় নিজেকে সে খুলে নেড়ে দেখছে আর মুখে শব্দ সরছে না তার।

 

 

 

 

 

 

3 thoughts on “ধারাবাহিক উপন্যাস: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-১) । বল্লরী সেন

  1. কী অসাধারণ এক উপাখ্যান লিখেছেন। দুবার পড়লাম। এমন চমৎকার উপমা আর শব্দ বিন্যাস যে মন ভরে গেল পড়ে। অপেক্ষায় থাকব পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য।

  2. অসাধারণ বললে কিছুই বলা হয় না। প্রতিটি ধাপের কী নিখুঁত বর্ণনা, অনুভব, যন্ত্রণা, সুখ আর বিশ্লেষণ। এ যেন খুলে খুলে সব ভাঁজগুলি নিপুণ প্রদর্শন। এমন লেখা, এমন অচিরাচরিত ভাষা পড়ে থম মেরে গেলাম। কিছু লিখতেই পারছি না। কী শুরু। উফ। দুর্ধর্ষ শুরু হল।

  3. অপূর্ব! অনুভূতির স্তর ছুঁয়ে ছুঁয়ে সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছলাম। পরবর্তী দরজাটি খুলবার অপেক্ষায়…

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত