| 24 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-১০) । বল্লরী সেন

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

দশম পর্ব  

“উঁচা উঁচা পাবত তোঁহি বসতি শবরী বালি”

মটুকের স্বপ্ন দেখার রোগ আজকের নয়, কলিয়ান সাধুর চোখের দৃষ্টি ঘুমের মধ্যেও চেয়ে আছে।

নিক্তি মেনে একটা পেখম তার পিঠে ছোঁ মেরে আটক করে কী একটা আঠায় লাগিয়ে দিয়েছে কলিয়ান। তার পরেই স্বপ্ন বা জাগর, মটুকের খেয়াল পরোয়ানা কুছু লাই। সে উর পেখম ন্যাংটো করে বালিশের খোলের ভিতর লিজ মুখ পুরে দিল আর আহ্! চোখের পরে চোখ, চোখের পরে কান, কানের পরে রোখ, রোখের পরে নাক, নাকের পরে ঠোঁট বালিশের তুলোর ভেতরে অবিরাম ফেটে যাওয়া তুলোর মধ্যে, তুলোর শিরশিরানো পেঁজা মেঘের ভেসে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে সরে যেতে লাগল আগম- বেদ- কলাপ- মূণ্ডক। নীলের ধুলো লাগছে পায়ে, আঁশটে যোনির ঘ্রাণে থিতু হচ্ছে পের্জাপতি, তাহার বরণ হলুদ আর শ্যাওলায় মোড়া। ঠুনকো মাটির গা হৈল ঝুরঝুরে, মাট্যি যেন লাঙল চায়, মাটি য্যান কান্দে, মাটি য্যান খা খা করে। চুনি জেগে উঠতে লাগল, চুনির রং লাল, চুনি জেগে উঠতে লাগল নীলের ধুলোর ভেতরে।চুনি জেগে উঠল মালোপাড়ার পাশপথ দিয়ে অবারিত, মুক্ত, স্বয়ম্ভূ। উর পরনে তখন নীলাম্বরীগাছ, শাখায় ফুটতে চলেছে তুলসীর পিঠের মতো রোঁয়া, গন্ধরাজ পাপড়ির পশম বোনা শিরা, কর্কশ মামড়ি কাটা হরিদ্রার চামড়া বিস্ফারিত হচ্ছে, সুখ উঠছে তাঁবুর মতো উপছে। সন্ধি নেই, বিচ্ছেদ ও নেই। চুনির নাভিময় কাশফুলের গন্ধ, আখরোটের খোলার মতো ওর জিভ নামছে জঙ্ঘার আরও তলায়, আরও সুদূরে, আরও তির-বেঁধা খিদের ভেতরে, ঘোর আলকাতরায়। চুনির কান বেঁধা হৈল যে বিহানবেলায়, শবরদের বুড্ঢা মায়ের হাতে লম্বা সুই দিয়ে মাধবীলতার মাকড়ি পেঁচিয়ে নিমকাঠি পরানো হৈলে চুনি নিজেই ঘর কো হাঁইটে ফিরলেক। ব্যথায় টনটন্ করিলেক, রাতে সিধা শুইয়া তার মনে হৈচ্ছিল, কানদুইটা কেটে ক্যান্ ফেলাইয়া দিল না? তাইলে আরো কষ্ট হৈত না। লোধা পরিবারের মেয়েরা দুই বা তিনবার কান বেঁধায়, তিন বা চারবার ধাতুর পাত পরে। যাতনা সহনের এ হেন বেবস্থায় চুনির সমস্ত মন জিহাদ করে, মূক চিৎকারে সে ফুলির কাছে নিজের সব কথা খুলে বলতে গিয়ে আরও বেপদ ডেকে নিল। তখন সে ছুটিল বসনের খোঁজে। বসনের সময় কৈ নাতনির গল্পগাছা শুনে। পাদ্রি  জোনাথানের নির্দেশে সে কয়েক মহিনা যাবত হরিণচুমুকের দিকে গির্জার পাশের রাস্তায় গুমটিতে দুপুরের আহার দিতে যায়। বয়স তাকে কাবু না করলেও, হাঁটার গতি বেশ শ্লথ। কিন্তক শত বেথা হলেও, সে যাবেই। কাকভোরে উঠে আখায় আঁচ ধরানোর মুহূর্তে, তার পাশে গিয়ে উবু হয়ে বইসে কত কথার খিল ঝরে গেল । মিহি গলায় আজ চুনি বসনের এই সময়টুকুর ওৎ পেতেছিল। রোজ সে ভাবে, কিন্তু ঘুম ভাঙে কৈ। আজ বহু চেষ্টায় তক্কে তক্কে সে ঠিক উঠে এসেছে।


আরো পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-৯) । বল্লরী সেন


– মটুক! তু এত্ত বিহানে কী করতি উঠিলি বেটি ? ঘুম লাই চোখে তুর ? গরম কাপড় দে গায়ে 

জার লাইগছ , দোলাই নে আয়, দ্যাখ তুহার মা কোতি রেখেছে। দেহ খারাপি লাগছস লয় তো? 

-একটু ওম্ দাও গো আখার, বেশ জার লাগছে গো: বলে চুনি বসনের গায়ের কাছটিতে ঘেঁষে

বসলো। 

– ক্যান্ জাগছস্? লিখাপড়া রইছে তুর? অবাক হলেন বসন। এ সময়ে সাধু কলিয়ানের কুপি জ্বলে, তিনি দোরে আলো দিয়া পুথি নিয়ে বসেন। তাই তো তিনিই গেরামে মালোদের সাবধান করেন যে গোরা সেনা এখানে ঠিকা লিচ্ছে, তাদের বুট পরা পায়ের দাগ তাঁর দাওয়ার গাবরাবর।

সচকিত হৈছে মুণ্ডারাও। দিকুরাজের ইদিকে লজর! তাজ্জব বেপার। তাইলে মেয়ে মরদের কপাল এবার পুড়িবেক।

– আম্মো কলিয়ান বাবার আসনে যাব। মাকে বইলে যাব, কিন্তুক মা কুন্ মতে যাইতে মানা করবেক, বুঝি লাই। কলিয়ানবাবার কাছে আমায় জানতে হবে মুণ্ডাদের কেন হটিয়ে দেছে ওরা— কিসের তরে সিধু কান্হু খুন হৈল, কিসের তরে জনমনিষ সবাই মিলেও দিকুদের সরাতে লারলো? আর… তুমি জানো, মায়ের জুরওয়া বিহিন কুথায়? ক্যান্ তাকে দূর করিলে, বলো ক্যান্, কাদের ভয়ে? এ পর্যন্ত বলে দম নিতে লাগল মটুক। বসন বুঝলেন, এবার তাকে সমস্ত বাতলে দিতে হবে, সময় বুঝি উপস্থিত। শঙ্কায় তিনি উনান বাঢ়য়ে দেন, কয়লা আর গুল মুঠা করে মুখ চাপা দিয়ে ব্যস্ততার জাঁক করেন, কিন্তু মটুক ঠায় স্থির থেকে মুহূর্তগুলা য্যান যাচিয়ে নেয়।

বসন টের পায় ফুলির প্যাটের হুন্দোল। পূর্ণিমের সাঁঝে নিমের তেল মালিশ দিতে গিয়ে দুই চারবার স্পষ্ট মনে আছে— দু জোড়া পায়ের কচি একটা ঠেলা, সন্দেহ হৈছিল যমজ লয় তো! কিন্তুক হব্যে কী করে। সে তো কন্যাকে কুনোদিন জোড়া কলা দিল নি? তবে ক্যান্ হৈব এমন দুর্যোগ। আর দুটাই নাকি মেয়া? ঠিক তার নিজের শরীলে যেমনডা… 

– হ মটুক। ঝানোকে দূরে পাইঠে দেলাম, দিকুরা ওর রূপে পড়িছিল, এক দিকু সেনা। সে রাস্তায় বের হলেই উর সাথে কথা বলবেক। তখন বাবুরা নজর করিলে, ভয় পেয়ে আমো চোখের জলে তাকে, তাকে পর করে দিলাম একদিন। 

– লয় গো। ভয়ে লয়। আসল কথাটি মিছা বইললে। মায়ের বিহিন ছোট মা, দিকু সেনা তাকে একদিন জোর কইরা ছাউনিতে উঠিয়ে নিয়ে বাণ মারলে। বলো, ঠিক লয়? ছোট মা এখন অনেক সবল হৈয়াছে। সে পশ্চিমে, ধলো কাবেরীর সোঁতায় এখন শবর মেয়াদের ইস্কুল দিদি।

সারা গেরামে বেশ নামডাক তার। দিকুর গুষ্ঠিকে উঠিয়ে ছাড়বে সে। আমো যাব তার সঙ্গে এই কাজে। কলিয়ান বাবা সব বেবস্থা দিবেন মাকে জানিও।

রাগে ফুঁসছে আর দৌড়ে সে মেথরপট্টির দিকে চইলে গেল, সূর্য প্রায় আগুতি। হতচকিত হাতে চালের হাঁড়ি চাপাইয়া হাঁপ ছাড়তে চাইল বসন।

বাদুড়ের ঝাপটে বটের মহীরুহ শেকড়ের মধ্যে দোলাচল লেগে তখন একটু একটু করে পুবের আকাশে রং ধরছে আর সেপাই বুলবুলের ডাক শোনা যাচ্ছে। বসন উঠে দাঁড়ালে দৃঢ় মাটি ভর করে। ঊর্ধ্বে শাঁখের শব্দে গোল আলোর রোশনাই কে চক্কর দিতে দিতে অসীমের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে ডানা সোজা করে চিল। তার চিঁহি শুনতে শুনতে অন্যমন বসন দেখল, ফুলির কাচা কাপড়ের গায়ে যমজ পের্জাপতি এসে বইসলে। একটি লয়, দুটি। মটুক আর চুনি। তারপর আর কেউ খপর দেয় না, ঝানো যখন বড় হৈল, উহার সংবাদ পেলাম এক কুটুম্বের থেকা; সেও এখন আর বহু যুগ কুনো সংবাদ দেয় লাই কো।

-ছোটমা, ছোটমা বললে তুমাকে সে দেখতে চায়, বহুত ঈপ্সা জাগিছ। আমি কলিয়ান বাবার থান থকা ঘুরে আসি, কিন্তুক মা তো কুনোদিন এ সব বলবেক নাই আমারে, তুমিও বুড়ি বজ্জাত আছহ।

ক্ষোভের শ্বাস টেনে দীর্ঘ হলে চুনি এবার পাখা নাড়তে নাড়তে কেঁদে ফেললে, অন্যায়কে সে কুনোদিন সহজে নিতে পারেনি, আজিও বেমালুম ফেটে পড়ল সে।

– আর আমার জুড়ওয়াডা? বল্, সে ছেল কিনা? স্বীকার কর্ সত্যি কিনা! 

– হ। কিন্তুক গর্ভে সে মরে যেছিল। তাই তো তুকে একযোগে ফুলি মটুক বলে। মটুক যে আর আমাদের কোলে এল না রে বেটি। ফুলির গভ্ভ হাতড়ে দাই প্যাল না কিছু। মটুকের বিষদেহটুকু নিয়ে তু এসাছিলি রে— বলে চুপ করে বের হৈয়া গেল কাজে। নিভু উনানের গুল নিজের হাতের চেটোয় যে ফোস্কা করে দেল, তা যে সাত জন্মের রোখ্। এর শ্যাষ হবে না।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত