| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-৩) । বল্লরী সেন

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

 ॥ ঝাঁকা ভরা দোয়াত কলম॥

সগুর মিস্ত্রির দুতলা ঘর পেরোলেই নবাব পরিখা শুরু। ইমামবারার  সফেদ ছায়া মুখে নিয়ে হাঁটলেই দোয়াত কলমের কারখানা। এখানেই ন ঘর ডোম পরিবারের পুরানো বাস। ফুলকুমারী আজ আঁতুড় কাটিয়ে তের দিন পর রাস্তায় নেমেছে; হলুদ পলাশ ছাপানো শাড়ি, চুলে রাঙা করবী, কব্জিতে ধানগুটির ভাঙা চুড়ি দু’গাছি আর ঘাসের চুড়ি এক গাছি করে। মটুকসর্দার আজ দাদাকে পেয়ে বেজায় খুশি, মাও রান্না চাপিয়ে গল্প শুনছে। প্রায় ৩৩ দিন পর ফিরেছে মোর বাপ্। বহরমপুরে খাগড়ায় কাঁসার দোকানে কাজ পেয়েছেল, তাই কিছু রোজগার হইছে।আবার পরব কাটিয়েই চলে যাবে। মায়ের জইন্য কস্তাপাড় শাড়ি আর নানা রং মাথার ফিতে এনেছে। নবজাতকের জন্য কিছুই ভাবতে পারেনি, তা মটুক তো বাপজির চশমা পেলেই হাসে, হাসি তো ফোকলা, বাপজি তাকে কোলে নিয়ে এতগুলান দিনের শোধ তুলে নেয়। ভাবতেই সামনে নিজামের কালি করার দোকান খুলছে। আপু দেখবামাত্র হেসে ওকে সমাদর কুরতে লগছে,

“ আরে মেয়ে, কেমন আছে পোলাপান?”

মেয়ে হইছে গো আপু।

— তাইঅ? বেশ তো।তুমার মতো হবেক, লাল মাটির রক্ত ওর শরীরে ঘড়ি

হয়ে রইবে। কুনোদিন কুনো জালকাজে থাকিব না, ও হবে চেরাগ আলির

খাস মশাল, খাস মানুষ। মেয়েদের পাঠনশিক্ষে সমস্ত তুমি ওকে দিবা। এই লও, কলম-কালি-দোয়াত। আখরোটের তেল আনিয়ে আঠার সঙ্গে জারানো, রং হবে নীলচে কালো,শুকালে বেগনি বর্ণ হবে। বাসি বৃষ্টির পরদিন কালি তৈরি হলে যে লেখা আসবে, তা যুগ যুগ মানুষের হিদয় কামড়াবে। মানুষ চিতা পর্যন্ত তা ভুলবো নাই।


আরো পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-২)


—- এই বলে ঝাঁপিতে তেল সর্ষে আর পালক কালি নিয়ে প্যাকেট ধরিয়ে তত্ত্ব করলা বিবি। তহমিনা বিবির এমন দিল এ তল্লাটে কজনের আছে! অবাক কাণ্ড ভাবছিল ফুলি, সে তো নিজের জইন্ন কালি কলম কিনতে এয়েছেল, উল্টে এরূপ তোহফা পেয়ে দৌড় দিল পাখির ডানায় ভর করে,

চুরাশি সিদ্ধার খাল পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই ডোমপল্লীর পাশ দিয়ে। যাচ্ছে আর মাটির দাওয়ায় তখন পলাশরঙে কাপড় ছাপানোর বেলা। এ এক দেখার পরব বটে। তিন সারি মেয়েরা বালতির রঙে কাপড় ডুবিয়ে বসে থাকে প্রায় দু’ ঘন্টা। তখন ওরা গান বাঁধে, কথা বাঁধে, সুর সেঁটে দেয়।

আহ্লাদে মুখে খই ফোটে আর চোখে নামে জল। চন্দনবিলের থেকে শালুক তুলে সব মেয়েরা শালুকের কোঁড় রান্না করে আর পাতা বুনে নকশাদার শেমিজ বোনে। মুসুরি মেলে এক দল আইবুড়ো রোদের গান ধরলো এবার:

‘ হিয়ায় টানা রোদের গাড়ি

 আমের পাতায় হাঁড়ি

 পেঁচাফুলের বীজের ভিতর

 আটকুঁড়ের আড়ি’

ঢেঁকির চালে পা মিলিয়ে সেও যদি গাইতো? আর ভাবামাত্র মটুকের ভ্রূহীন

শ্যাওলামাখা দুটো চোখ আর দুধের ঠোঁটের ঘ্রাণ ভেসে এল। এবার আর দেরি সয় না, বুক ভার হৈছে, শুধু সে নতুন হওয়া কয়দিনের মা, কি করে বুঝবে, তার অমৃত যে গড়িয়ে মামড়ি হৈয়া গেল। ওদিকে বসন নাতিনের কান্না থামাবে কী দিয়া ! 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত