| 24 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-৬) । বল্লরী সেন

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

চড়কমেলার বিহা 

“চেদা এগেয়া ক্যানা!’

রাত্রি রসম্ শামুকের দেহ ব্যাপ্ত করে স্বপন বুনে চলে, গায়ের কন্থায় ফুটে ওঠে 

ধামসার আবডালে ঝিঙ্গাফুলের দিয়া। ঝাবু তন্দ্রাগত, কিন্তু সে নিজেই এখন শিবতলা পেরলো, অবাক হাঁটন দিয়া জোঁকাপুকুরির বিলে ভেসে রইল তার চশমা সমেত হিমে পোড়া দেহ। স্বয়ং ভৈরব স্বপ্নে দেখালেন, ঐ, ঐ, কুটিলাপুকুর, তার

দক্ষিণে নীরদাসুন্দরী স্কুলের বসত কাটাও, এগাও, এসো তালদীঘিতে। এই হল ঘুঘুরি ডাঙা, এই হল উচ্ছ্বেলতার পাড়ি, রাঙা আলুর বাগান। এর পাশ দিয়ে বহে যেছে ভরা কোটালের দাদন নদীর সরু একতারা। ঝিরিঝিরি বাতাসে সুর বুনে নদীর কাছে আসে খবর, জালতা মাঝির ছেলা চুঁড়কে মাঝির মনে রং ধরিছে, অরে অ ছোকরা!

খেয়াল আছে, বট দিঘির কালিজলে কিন্তু কুমির নেমেছে, সাবোধান মাহিন্দার। সেবার ৫৫ সালে এক দীর্ঘাকার কুমিরের অত্যাচারে রুইদাস কামারের পরিবার ভেসে যায় আর কি, সেই যেবার রায়চৌধুরীদের ডাক্তারকত্তা বন্দুক চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন? মনে আছে? জালতা মাঝি খুব সাহসের পেমাণ দিইছিল সেইবার, বাপ্ রে হেই সামালো কী কাণ্ড। গহীন নাগবাহী জলের তরঙ্গে সাঁঝ বাইছেল চালকি, তার

চুল খুলে টান দেল কুমির, সে ভাবলে কুনো পাথরের চোখামুখ ধরেছে, কিন্তু যত টান বাড়ে সে লম্বা চুল পেঁচিয়ে যায় গলায়। সে কী সাঙ্ঘাতিক অবস্থা, ঠিক সে সময়ে তালের রস নিতে এয়েছেল জালতা মাঝি ও তার তিন ইয়ার। গোঁ গোঁ রব উঠলে তারা ছুটে এসে খবর দেয় বাবুদের মেজ তরফে ডাক্তারবাবুর ঘরে। জালতা এদিকে জলে নেমে চালকিকে কিছুটা সরানোর চেষ্টায় বর্শা দিয়ে গোত্তা মারে কুমিরকে, তখন পেচন্ড আক্রোশ তার। জালতার ও চালকিকে বাঁচানো যেত না। কিন্তু বন্দুক চালিয়ে বাবু তাদের পেরাণ বাঁচালেন।

কুলগাছের জংলাডালে কুলের ঢল। শিউলি ফুলের মাটি পা না দিয়ে চলা যায় না এমন অবস্থা। ঝাবু তখন মাহিন্দার, বাবুদের দো ফসলি জমি পেষাই করে, তাদের 

সার, তাদের বলদ, কেবল ফসল ফলানোর কাজ। রাগ হয় মাঝে মাঝে খুব। কিন্তু 

খাবে কী। চড়কের পর ঘুঘুরিডাঙায় বাসা নেবে, নিকা করবে, চড়কের মাঠময় তারা

কোমর ধরে মাতাবে, গাইবে, সং সাজবে। বিদ্যাসিনির দোর ধরে রুজির উপায় করবেই।

“ তু মনের সাজে সাজিয়া

   চতুর্দশীর চন্দ্রিমা

   তুর হাজার ওজর শুনিয়া

    আমার কানে তালা;

   তাই উলু দিয়ে সিঁদুর দিয়ে

   ডাকি, বলি, সই একবার 

    আমার বাসায় আয়”

   — নাচবে, নূতন গান বাঁধবে পিঠে পিঠ। মাদলের তালে নির্ভুল শীতের কুয়াশায় লবণ চা খেলেই কনের বাপ মজবে, ব্যস্। সোজা যাব দুজনে কিরীটেশ্বরীর মন্দিরে। হলাকর্ষের শান্ দিয়ে ফিরতে পারলে বিটিয়ার মন ঠাঁই পায়। দর্জিপাখির পুরুষটো

যেমন কারুকাজ বুনে বাসায় অপেক্ষা করে থাকে, বুড়ো মোড়লের দিষ্টি এড়িয়ে তেমনি আমো ও থাকি। একদিন সে গাছকোমড় শাড়িতে পেঁয়াজ আলু পালং নিয়ে আইসে আর আমাদের দুজনার গীত বাঁধা হৈ গেলা। ঝাবু মুর্মু তার সাকি পেয়েছে।তাই ভৈরবের কল্কে দেব মানত করেছি এবার। ভোর থেকা চড়কপূজার হট্টমেলা।

পাশের গোঁসাইভাসা, অলঙ্কার গেরাম থিকা লোকের টানা ভিড় চলে তিন দিন, সন্ধেয় হাঁড়িয়া মোচ্ছব। নিকাহ বলে কতা। মেয়ে মদ্দা কেউ বাদ নেই সেখানে। শূকরীমাংস পুড়িয়ে আগুনে ঘ্রাণ চলকায়, ঘিলু, নাদোস পেটের মেদ মসলা মাখানো আঁচে সূর্য ডুবলেই সেজে ওঠে। রান্না তৈরি হতে প্রায় চার ঘন্টা সময় লাগে।গেরামের অভিজ্ঞ তুষুবুড়ি ও তার যুপতি বউ এ রান্না করবে। খাবে সবাই একত্রে। মাছ পোড়া ভাত দিয়ে শিকারে হাঁস, মোরগ যে যেমন উপহার দিবেক নববধূকে। মূল খরচ করবেক ঝাবু মুর্মু নিজেই, বন্ধু ইয়ার মিলে তার আয়োজন, কিন্তু বাপ দিবেক লাই, এডা নিস্চিত। বাজের নখ পর্যন্ত ভেঙে আনবে পণ করে ঝাবু।


আরো পড়ুন: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-৫)


॥ গা শিউরানো কাঁদরের নাম সীমানা পাড়া॥

চুনি এখন মায়ের সঙ্গে আতাগাছে হানা দেয়। চালতা বা লাল জামরুলের দেখা পেলে ছুট্টে রা দেয় আর খিলখিলে হাসিতে মাতায়। আজ বাপজীর সঙ্গে সে তালপুকুরের পাশে রাসের মেলা যাবে বলে বায়না করেছে, বাপজীর সম্মতি মেলেনি। তাই কৈহলুদের মাঠে মায়ের গাছকোমর ধরে সে হাঁটি হাঁটি চললো হিণ্ডালিয়ামের চকচকে থালা কিনতে, মেলার মাঠে মিহিদানা আর রঙিন চিনির মঠ খেতে। আর এক মহা আকর্ষণ হল বুড়ির চুল, গোলাপি রঙের দেখেই কিনে দিতে হয়।ফুলি বিরক্ত হয় না, বরং আশ্বস্ত হয় অন্য খাদ্যের টানে দুধ ছেড়ে দেবে বলে। তখন বাবুদের খামারে দীর্ঘ সময় সে কাজ করে ঘর ছাওয়ার রুজি জিতে নিতে পারবে। সুভালাভালি হলে, বর্ষা লাগার আগেই শীতে ঘর সিজান হৈয়া যাইবে। তমিজও নিশ্চিন্তে চেরাগ আলির কারখানায় না গিয়ে চুনিকে দেখে রাখবে। অলস সরায় চালের মধ্যে রাঙা আলু দিয়ে নরম করে ফেনাসহ চুনিকে খাইয়ে দিবে খণ। মা নিজেও পটু হাতে শামুক চচ্চড়ি এক একদিন কৈরা লিবে, উঠানটো লিকাবে, মুড়ি ভেজে কিছু পয়সা হবেক। ফুলকুমারীর মাথায় ঘোমটা তুলে মেয়াকে এবার পিঠে বাঁধলে, মেঘ ঘন হৈয়া সাজে এদিকে, পেটে দানা নেই কতক্ষণ। চুনিরও খিদা পেয়েছে বটেক, তবু তাকে ভোলানো চাই। একটা লাল মঠ আর বুড়ির চুল ধরিয়ে দিলেই হবে; হনহনিয়ে ফুলি চললো রাসের দিকে। রোদ নেই, তাই আকাশের এক কোণের দরজায় পুন্নিমের গোল রূপার থালা মেঘ ছাপিয়ে উঠছে পুবের তলার প্রান্তে। আর ঠিক এ সময়েই সে বুঝে লতুন বেলাউজটা ভিজে ও ভারি ঠেকছে। রাসের চত্বরে রাধাকুণ্ডে মাথা ঠেকিয়ে যখন পরিচিত দুজন সইয়ের দেখা মিললেক, তখন তার পোষাক সিক্ততার দাগ নিয়ে জেগে উঠছে। অসহায় একটা কাপড়ের আস্তরণে নিজের মাতৃত্বের শরীরকে ঢাকা দিয়ে মেয়েকে মঠ দিয়ে ভুলিয়ে রাখে, কিন্তু বেজায় কষ্ট হতে শুরু করলে টাটানো স্তনদুটিকে নিয়ে আড়ষ্ট ফুলি শেষে ফিরে যাবার পথ দেখলে। মটুক রাগ করে কান্না জুড়লে সন্ধ্যার গাছের পাশে সে সন্তানের মুখে তার অসহায় শরীরকে ঢুকিয়ে দিয়ে হাল্কা হতে চাইলে।

মটুক মায়ের শরীরের অমৃতে ক্রমশ ঝিম্ হয়ে যেতে থাকে আর ফুলি নিজেও সারাদিনের ক্লান্তি টের পায়। না, থামার উপায় নেই। পা চালিয়ে আরো এক ক্রোশের পর ইস্কুলের ফটক।ঘুমন্ত মটুককে পিঠে বেঁধে এর পর হনহনিয়ে ছুট্ দিলে ফুলকুমারী। একা রাস্তায় ঝানোকে মনে পড়ে, হয়ত সেও এমনতর কোনও লাল মাটির দেশে খরা পায়ের চাতালে পেটের শত্রুটাকে রেখে চাল বাছে, গম বাছে, বাবুদের মেঝেন হয়। ঘুনসিতে জমায় কাঁইবিচি, কুমড়োর পাতায় প্রতি মাসিকের হ্যাঁ ও না লিখে রাখে। কমনীয় মাথা হেলিয়ে মটুক ঘুমিয়ে আছে, দেখে মনে হয় অলীক একটা অন্য জগতের কথা সে ভাবছে। গভীর আচ্ছন্ন তার অবস্থা, ল্যাঙোট ভিজিয়েও সে নীরবে নিদ্রায় মগ্ন।

মা হয়ে ফুলি হাসে, মেয়ের মুখে কেমন যেন তেজ একটো। সে চোখ ভরে দেখে, নজরটিপ পরায়। মায়ের নজর যে খুব খারাপ। ওকেই সবচেয়ে ক্ষতি করে।বসন সর্বদা মেয়েকে শাসায়, মা হৈয়া কুনোদিন মটুকের পানে চাইঅ না। বলিও না কাহারে, আমোর মেয়ার গড়নপেটন দেখছস্? বৈল না, নজর লাগে লতুন মায়ের, সে খেলার চিজ ভাইব্যা উহাকে ঘুরায় ফিরায়, দেখে।সব ভুইলা উহাকেই লাচায়, টাইনে, এধার ওধার করে। 

আসলে এ যেন মা হওয়ার এক অবাক বেরাদরি। বসন তার নিজের মা হওয়ার গাথা বলে। ফুলো, তুই ছিলি খুব দাপটি,কোলের কাপড় থেকা মুণ্ড বাহির কইরা তুই বিশ্ব গিলতিস, এমনি এক ভরম বরিখদিনে তোকে লেয়া যাচ্ছি রায়চৌধুরীদের ডাক্তারখানায়, হেই সীমানাপাড়ায়। তুর সুই দিবার দরকার, তাই পিঠে বেন্ধে লিয়ে চলেছি, আর তু কাঁদরে হেই বইলে লামবার সময়ে মুণ্ডটো বার করিয়া লেগে পিট্পিট্ কইরা চাইয়া আছস্। এভাবেই তু আকাশপথের বরোজ থেকা পানি খেয়ে অমর হ। আষাঢ় মাসের ঝিলিক দিয়া বৃষ্টি আসবেক, ন্যাংটা পানি চড়বড়িয়ে মাথাখান ভিজিয়ে লাট কইরবেক, চক্ষু মুদিকিরি তু দেখিব কী মহান একটো আকাশ এই পৃথিবী। প্রান্ত বৈকালে ভরা কোটাল এলে, তমিজ গাড়ি আনে নিয়ে যাবার লেগে। তখন ফুলি মায়ের খেয়ে ডাঁটো ঘুমে মাত।পরীর দেশের মেয়েরা তখন শালফুলের মতো রোগা ফুরফুরে পায়ে আকাশে বারিশ বিছানো পথে কুলোয় করে রোদ মেলে দিচ্ছে কেবলি, লম্বা ঘোড়াঘাসের জঙ্গল, ঘাসের পাঁশুটে ফুল, তনুডাঁটির মাথায় তিনটে করে সাদা ফুটকি লাগা পুঁতি, রাস্তা ছোপানো বুনো কামিনীর গাছে পাতা নেই কেবলি যোনি। আমো ডাকি উকে,তবু তমিজের খেয়াল নেই যে গাড়ি এক দণ্ড থামাবে। সে ‘হ হ চল্ চল্’ বলে হাঁকে আর গরুদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। উহার চিল্লামিল্লি জাগিয়ে দেল ফুলিকে। সে তখন ঠিক মটুক মটুক দেইখতে। চোখের কাজল ধেবড়ানো, নাকের পাটায় কাজলের ফোঁটা, কিন্তু মুখে হাসি। দুর্গা ডোমের ঘর নিকানোর পরব, সে নিজে কাঠখড়ি নিয়ে ঘরদোরে অপূর্ব লতাপাতা বুনে দেয়। পলাশ রঙের আঁজলে তার বাসা ছাড়িয়ে এবার সাঁঝ নামছে চতুর্দিকে, কলাগাছের পাতায় ভেজা জলের ধোওয়া দাগ, আমপল্লবে সামান্য আলো এখনও বেঁচেছে। তমিজের গাড়ি ছুটছে কাদাজল ডিঙিয়ে শনিবারের হাটের দিকে।

এ সবই মা বেরাদরির গল্পগাছা, মায়ের শরীরসত্তায় মিশে থাকা এক পুকুর জোনাকিমালা। কাঁপন দেয় দেহ, কত যুগের মা দিদিমার বিশ্বাস ও আঁতুড় তোলার ইতিহাস এর মধ্যে জমানো। সদ্য আঁতুড়ে পোয়াতির নব কলেবর হয়, গর্ভফুল ভেঙে সন্তানের বিয়োনো আর সঙ্গে সঙ্গেই আউশের খামারে বিন্দু বিন্দু অচেনা অতিথি অঙ্কুরিত হয়। কাপড়ের পাড় যোগাড়ের সে এক হিড়িক। নরম ধুতির কোল কেটে কাঁথাকানি সেলাইয়ের খুব প্রয়োজন, প্রথম জন্মানোর পরে শিশু কেবল খায় আর ঘুমায়, কিছু সার নেই তার। কিন্তু মায়ের নতুন দেহে তখন বিস্তর ঝড়। বসনের মনে হল, লুপ্তপ্রায় একই দেহ ভাঙতে ভাঙতে গোটা জরায়ুটা ক্রমে হাজার বছরের পূর্ণিমায় কিরীটেশ্বরীর বিগ্রহ হয়ে যায়, তখন দেব মানুষে আর ভেদ থাকে না আর।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত