| 29 মার্চ 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-৭) । বল্লরী সেন

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

।। শেষ মটুকচরণ ।।

পৌষপাব্বনে বাঁদনা পরব। সংক্রান্তির পাঁচদিন পূর্বে পরবের শুরু। বিরবঙ্গা, বিদ্যাসিনি, ফলনবঙ্গার পৃথক সেজ মেজ কাহিনি বুনে পরবের সমাপন হয় তৃতীয় দিনে।

চুনি এখন অল্প ডাগর, মাথায় লম্বা, হাত পা যেন কাঠ। ফুলকুমারী সেদিন নাইবার কালে ওকে হঠাৎ দেখে ফেললে, তরতরে বাড়ন্ত গ্রীবা ক্রমশ দুই বাহুসন্ধির কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। মেন্জহি বল্যে দেছে, নিজের মেইয়াকে চোখে চোখে রাখবা। মেইয়ার পানে চোরা চাহনি, নজরে এল তার দেহে বর্শার ফলা গজাইছে, হাল্কা রোম ত্রিভুজ, কিন্তুক খুব দেরি লাই যে সেই উমদিনে, শুভদিনে মটুকচরণ সত্যিই একজন ফলনশীল গাছ হবে। কত এলাকায় তখন কত লতুন দিশা, পাশ দিয়ে গেলে ঘামের বাস কদমের কুঁড়ি ধরার সময়ের পারা। অচিন মিঠাস্ মধু জমিয়ে ধরে ধানের ডাঁটিতে। আর মেয়েলি গালগল্পের আসরে এয়োবৌরা মিলে কুলোয় দুটি পদ্মকুঁড়ি রেখে মেয়াকে আপ্যায়ন করেন। মানে এইবার তার প্রতি মাসের তারিখ পাহারা, গাছে চড়া সব অবস্থায় সম্ভব লয়। তারপর মটুকও নাকি একদিন খেতখামারে তমিজের ভাত নিয়ে আসার মুহূর্তে বাপের চোখেও বড় হৈয়া গেল। 

“ মটুক, তু শিকার পারিব? শিখে লিস কেনে… সব জানতি লাগে রে” চুনির শরীর কেমন ঘুরন দেছে, উ বাপজীর কতক কতক চেহারা দেখছে আর দুনিয়া যে পাক দেছে এমন হতে হতে আউশের আলের পাশে বইসে সটান শুইয়া পড়লো একটানে। তমিজ এমন ভেলকি দ্যাখেনি কুনোদিন। মুখে চোখে জল দিয়া নাম ধরে ডাকে আর আশঙ্কায় তার ডর লাগে খুব। 

“ মেইয়া কত হল তমিজ?”  মাতুয়ানিদিদি ডাকলে।

– বারো হৈল সবে।

‘ডর লাই। ঘরে লিয়ে যাও, ফুলিকে বলো উমের শুরু হৌক। শুভদিনে বিরবঙ্গার থানে বসন লয় পূজা চড়িয়ে দিগ্।’ তারপর থেকে মা আর কুনোদিন আমায় মটুকচরণ বল্যে লাই। কুলোর আগায় পদ্ম শালুক আর দু পায়ের মাঝে ইঁটের মতো কাপড়ের ঠোঙা দিয়া আমায় টিপ পরালে। বুঝলাম, আর মটুক হওয়া নাই এ জেবনে। তবু তো রক্তের রং চুনির মতো লাল; সে লাল আমি চোখে দেখেছি, সে লাল আমার দেহে বাইছে, হড়পা বানের সময় সে লাল আমি দ্বিতীয় তৃতীয় দিন প্রতিটো পল ঢুণ্ডেছি কোথাও কেউ বলেনি যে লাল আমার অংশ, আমার জন্মেরও আগের জবান্। আমার মায়ের গায়ে, দিদামার  গায়ে এমনই বাস পেয়েছি। আঁশটে ক্লান্ত দরিদ্র কাপড়ের আর তুলোর গন্ধ, যার কথা কেউ বলে না, লেখে না , ক্যালেণ্ডারে নেই। কিন্তুক, আমি খুশি। পেরথমে লাল দেইখা মূর্ছা হৈল তো কী, তারপর তারিখ মনে রাইখতে হয়, হিসাব ভুল হলে ভুলের মাশুল চোগাতে লাগে। ‘সারাজেবন এবার চলা শুরু, কত যুদ্ধু কত হেরে যাওয়া। বাপজীকে সমস্ত বলিও না, তু মাইয়ামানস তো। অনেক কষ্ট হবেক। কিন্তু কাইন্দ না।’

‘জেবন এত ছোট ক্যানে এ ভুবনে!’ ঠাকুরঝি বলেছেল, আমোও বুঝি এই রক্ত দিয়া শোধ দিব।’ মায়ের পাশে শুয়ে একদিন বাপজীর কথা শুনে ফেলে পরদিন থেকা আলাদা বিছনা করে রোয়াকে মশারি খাটিয়ে শুই। দিদামা এখানে এলে দুজনার শোবার জায়গা একই হয়। এই মাটির উঁচু রোয়াকের বাঁধানো ধাপিতে উচ্ছেঝোপ, কুমড়োঝোপ, আর ওদিকে পেয়ারা পাকার গন্ধে টিয়ার ঝাঁক আসে দুপুরবেলা। লাল পেয়ারার বীজ খাবে বলে ওদের নোলা খুব বেশি। কবে, কখন পেখম মেলেছে ফুল থেকে ফল, খবর পায় ঘ্রাণে। যেমন আকাশের সুদূরতর নীল থেকে নেমে আসে কাঙাল খয়েরি ডানার চিল— এক ফোঁটা টলটলে পেয় জলের জন্যে। পাঁচিল থেকে খাদের ওপারে শাল,গামার,নোনা,ফলসা,তেঁতুল, জামরুলের বন। গোয়ালপাড়ার পাশে যে লাল মেটে রাস্তা, ওদিকে চার ক্রোশ পরেই মনিহারির দোকান, যেখানে পেনসিল, রবার, দিস্তাকাগজ সব মিলবে। ঝকঝকে দোকানের পাশে রহমতের সেলুন আর টিমটিমে মাটির ঘরে আলপনা দিয়ে বইঘর চালায় রঘুনাথ। একদিন সাহস করে তার বইঘরে ঢুকতে খুব আগ্রহ।


আরো পড়ুন: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-৬)


সমস্ত বই , বইয়ের গন্ধ, নতুন পৃষ্ঠার গায়ে লেগে থাকে অচেনা গন্ধের শব্দ। কত হরফ, কত অন্য মরসুমের বৃত্ত ফিরে ফিরে আসে। চুনির ঘুম আসে না, কে যেন কেবলি ঘুমের মধ্যে তার চোখের পাতা টেনে খুলে দেয়। রোমান হরফে নয়, অলচিকির অক্ষরে টান জন্মায়, কেমন সব রেখা, দেখামাত্র মনে হয় শিখি, ওর গায়ে সেই রক্ত দাগ দেওয়া আছে। বাম থেকে ডাইনে রেশমের পরশ ছুঁয়ে আছে সন্ধ্যার প্রান্তে। কী মধুর ঐ আপ্যায়ন, যেন আসমানি কাপড়ে কেউ রঙিন আলোর সুতো দিয়ে কারুকাজ বুনে রেখেছে। সে আলো চুনিকে স্বপ্নের একটা চাবি খোলা গায়ে হরফের রেখা চিনিয়ে দেয়। স্বপ্ন যেখানে আরম্ভের, সে স্বপ্নের অন্ত নেই। বেলা নেই। নহবত নেই। তাই একদিন সত্যিই দোকানে রঘুনাথের কাছে গিয়ে বইললে, “রঘুনাথস্যার, আমায় হরফ চেনাবেন একদিন?”

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত