উৎসব সংখ্যা: চালচিত্রের এখন তখন : একটি মৃণাল সেন শ্রদ্ধার্ঘ্য । ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
“আই লাভ কলকাতা। আই হেট কলকাতা। আই অ্যাম ফ্যাসিনেটেড বাই কলকাতা। আই অ্যাম ডিজঅ্যাপয়ন্টেড বাই কলকাতা। কলকাতা ইজ মাই এল ডোরাডো!”
এল ডোরাডো। সোনার শহর। অতুলনীয় ঐশ্বর্য আর অকল্পনীয় সম্পদের সেই অমৃতকুম্ভ, মৃণাল সেনের কলকাতা!
ভারতীয় সিনেমায় নব্য যুগের কাণ্ডারী এবং সত্তর আশি দশকের একমাত্র স্বঘোষিত রাজনৈতিক মতাদর্শভিত্তিক চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনের শুরু এবং শেষ, দুইই একমাত্র কলকাতাই। ১৯৫৫ থেকে ২০০২ অবধি যতদিন ছবি করেছেন, এ শহরের ঘ্রাণ সেনের ছবির শরীরে মাখামাখি হয়ে আছে। শহর কলকাতার বহুমাত্রিক বহুস্তরীয় চরিত্রের প্রতি তাঁর প্রেম ছিল আমরণ, কিন্তু সে প্রেমে অকারণ মোহ ছিল না কোনদিন। শহরটাকে তিনি ভালবেসেছিলেন তার সমস্ত ক্ষত নিঃস্বতা রিক্ততা নিয়েই। তাই তাঁর প্রথম দুটি ছবি রাত ভোর(১৯৫৫) এবং নীল আকাশের নীচে(১৯৫৯), এমনকি বাইশে শ্রাবণও(১৯৬০) পরবর্তীকালে তিনি নিজেই অপছন্দ করেছেন শুধুমাত্র এই কারণে যে তাতে আবেগ ছিল বেশি, বাস্তবতা কম। বাস্তব জীবনের গল্প, তা সে যত নির্মমই হোক, সবসময়ই তা তিনি গ্রহণ করেছেন সমস্ত হৃদয় পেতে এবং পর্দায় দেখিয়েছেনও সম্পূর্ণ সততার সাথে। পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিস্থিতি, মূল্যবোধের ক্রমাণ্বয়ী অবক্ষয় এবং ভোগবাদী আদর্শের নগ্ন কুশ্রী অস্বস্তিকর ছবিগুলো কি ভীষণ চাঁচাছোলাভাবে উঠে আসত তাঁর চলচ্চিত্রে। সেসব ছবি দেখলে তাই চোখের বা মনের আরাম হত না, বরং, অন্ধ বধির মূকের মতো আশেপাশের সব অন্যায় দুর্নীতি শোষণ থেকে স্বেচ্ছায় চোখ সরিয়ে রেখে কেবলমাত্র নিজে সুখে বাঁচার চেষ্টার অসারতা সম্বন্ধে ভীষণরকম অস্বস্তিকর একটা সচেতনতা আসত! মৃতপ্রায় বিবেকের বুকে তীব্র কশাঘাত করত তাঁর ছবি, এবং, আশ্চর্য এই যে আজও, তাঁর জন্মের শতবর্ষ পরেও সেসব ছবি একইরকম প্রাসঙ্গিক! তাঁর ছবি তাই স্বস্তি দেয় না, তাঁর ছবি তাই বিনোদন দেয় না। তাঁর ছবি ভাবায়, তাঁর ছবি শিহরিত করে, তাঁর ছবি মনে গেঁথে থাকে কালের সব সীমা অতিক্রম করে।
সত্তরের দশক থেকেই রাজনীতি মৃণাল সেনের ছবির একটি মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। যদিও ব্যক্তিতে নয়, সমষ্টিতে সমাজতান্ত্রিক আদর্শেই বিশ্বাস করতেন তিনি, তবুও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলটির প্রতি কোনও প্রকার অন্ধ আনুগত্য ছিল না তাঁর। নিজেকে সর্বদা তিনি বলে এসেছেন প্রাইভেট মার্ক্সটিস্ট, ব্যক্তিগত মার্ক্সবাদী। তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ কার্ল মার্কস প্রভাবিত হলেও সে বিষয়ক ধারনা, বিশ্বাস ও তার প্রয়োগ ছিল পুরোদস্তুর তাঁর নিজস্ব মূল্যবোধে জারিত। সামাজিকভাবে সমষ্টির প্রয়োজন বা দায়বদ্ধতা মেনে নিয়েও নিজের জীবনে ভীষণভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন সেন। আসলে একেবারে প্রথম থেকেই জীবন তিনি দেখেছিলেন রূঢ় হিসেবি বাস্তবের কঠিন মাটিতে পা রেখে, তাই কোনও বিষয়েই কোনোরকম গোঁড়ামি ছিল না তাঁর। আর এই মানসিক উদারতার জন্যেই যেকোনও বিষয়েরই সবক’টা দিক খুব সহজে পরিস্কার দেখতে পেতেন তিনি, এবং, তার সবরকম ভাল মন্দ শক্তি দুর্বলতা অক্লেশে মেনেও নিতে পারতেন, এবং, সদর্পে স্বীকারও করতেন অবলীলায়। এই কারণেই অনেক সময়ই অনেকে তাঁকে বিঁধেছেন সেল্ফ কন্ট্রাডিকটারি অর্থাৎ স্ববিরোধী বলে। এমনকি তিনি নিজেও মাঝেমধ্যেই বলতেন যে, ‘বেশি কথা বললেই আমি নিজেকে কনট্রাডিক্ট করে ফেলব!’ আসলে সবদিক খুঁটিয়ে দেখে শুনে বুঝে সবেরই ভাল মন্দের হিসেব যখন স্রেফ সাদা কালোর সহজ নিক্তিতে মাপা যায় না, তাকে সহজেই স্ববিরোধের আখ্যা দিয়ে ফেলে সমাজ। এই সীমাবদ্ধতাটি আসলে সমাজেরই, সেনের নয়। মৃণাল সেন তাই কখনোই স্ববিরোধী ছিলেন না, যেকোনও বিষয়কে সার্বিকভাবে সম্পূর্ণরূপে দেখার ও ব্যাখ্যা করার আশ্চর্য চোখ ছিল তাঁর, দুর্ভাগ্যক্রমে সেকালে বা একালেও যা অনেকাংশেই সাধারণের বোধগম্যের অতীত।
কাট টু, আরও এক আদ্যন্ত কলকাতা প্রেমিক চির যুবক অঞ্জন দত্ত, সত্তর দশকের শেষের দিকে বুকের মধ্যে এক আগ্নেয়গিরি গনগনে আগুন নিয়ে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি শহর দার্জিলিঙ থেকে নেমে এসে যে পা রাখল আরেক টগবগে ফুটন্ত শহর কলকাতায়। পাহাড়ের উন্মুক্ত খোলা প্রাকৃতিক পরিবেশ আর মুক্ত সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা অঞ্জনের মন প্রথমেই ভীষণভাবে ধাক্কা খায় কলকাতার শিল্পজগতের বদ্ধ ঘোলা জলের ঘূর্ণিতে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অঞ্জন যখন তাঁর একসময়ের স্বপ্ননগরী কলকাতা চিরতরে ছেড়ে দেশান্তরী হবার জন্যে মনস্থির করে ফেলেছেন, হঠাৎই দেখা হয়ে গেল তাঁর চলচ্চিত্রজীবনের ধ্রুবতারা, মৃণাল সেনের সাথে। এবং, এই দেখাটিই শেষ অবধি অঞ্জনের জীবন দেখার, কলকাতা দেখার চোখকে বদলে দেয় আমূল। যে কলকাতার স্বপ্নে মজে এ শহরে এসে কলকাতার প্রতি চূড়ান্ত বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন অঞ্জন, সেই কলকাতাকেই এবার যেন একেবারে নতুন রূপে চিনলেন তিনি। কলকাতার ভাল, কলকাতার মন্দ, কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় খেটে খাওয়া অসংখ্য মানুষের দুঃসহ দিনপাতের গল্প, কলকাতার নোংড়া ঘিঞ্জি বস্তির পাশ দিয়ে খাড়া উঠে যাওয়া শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল বাড়ির চৌখুপ্পির ভেতরের সম্পূর্ণ অন্য এক বিচিত্র দুনিয়ার আজব কাহিনী, কলকাতার বহুস্তরীয় এই সব সাদা কালো ধূসর ছবির খোঁজ এতদিনে তিনি পেলেন একজন আপাদমস্তক সৎ নির্মোহ প্রকৃত কলকাতাপ্রেমীর কাছে, এবং, ছবির কাজ করতে করতে, একসঙ্গে থাকতে থাকতে শেষমেষ নিঃশর্তভাবে সমস্ত মস্তিষ্ক হৃদয় ও অস্তিত্ব দিয়ে প্রেমে পড়ে গেলেন শহরটার। ওপর ওপর ঝোঁকের বশে যে এ শহরকে চেনা যায় না, জানা যায় না, বোঝা যায় না, এই এক শহরের বুকের মধ্যেই যে লুকিয়ে আছে লক্ষ কোটি ছোট ছোট অসংখ্য কলকাতা, যার হদিশ পেতে যে তাকে সম্পূর্ণ শর্তহীন হিসেবহীনভাবেই ভালবাসতে হয়, তাই তাঁকে হাত ধরে শেখালেন সেন। সহজে এ শহরের মনের তল পাওয়া যায় না, বহু সাধনার ফল এ, এই গুরুমন্ত্রটাই বড় অনায়াসে তাঁকে সেদিন শিখিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর পিতৃপ্রতিম জীবনগুরু মৃণাল সেন, যা শুধু পরবর্তীকালে এ শহর সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটুকুই বদলে দেয়নি, বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবনও। ১৯৮১ সালের ৯ই সেপ্টেম্বরে মুক্তিপ্রাপ্ত ( থিয়েটারে নয়, চলচ্চিত্র উৎসবে) চালচিত্র ছবির সবচেয়ে বড় সাফল্য বোধহয় এটাই। সেলুলয়েডের ৩৫ মিলিমিটারের ছায়াগল্প শেষ অবধি আসলে বাস্তবেই গড়েছিল এক চিরকালীন রূপকথা।
চালচিত্র এখন(১০ই মে, ২০২৪ এ কিছু নির্বাচিত প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিপ্রাপ্ত এবং বর্তমানে হইচই ওটিটি মাধ্যমে) ছবির মুখ্য চরিত্র যুবক রঞ্জন আসলে চালচিত্রের সেই তরুণ অঞ্জন দত্তেরই গল্প বলে, গতানুগতিক বাণিজ্যিক ধারার যেকোনও সাংস্কৃতিক শিল্পের প্রতি যার তীব্র বিদ্বেষ, স্বঘোষিত আগুনে বিদ্রোহ। কিন্তু কলকাতার জটিল গোলকধাঁধায় অচিরেই ঠোকর খেতে খেতে নিজের স্বপ্নের প্রতি একসময় আস্থা হারিয়ে ফেলে রঞ্জন। অনেক আশা নিয়ে তৈরি করা নিজের নাটকের দল চালাতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে যায় পুরোপুরি, যার কিছুটা তার নিজের অ্যান্টি মার্ক্সবাদী, সমাজতান্ত্রিকভাবে সমষ্টির ধারণায় বিশ্বাস না রাখা ব্যক্তিসর্বস্ব একনায়কবাদী মানসিকতার জন্য, কিছুটা তার সব নাটকেই তৎকালীন সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বিরুদ্ধমতপুষ্ট বিষয়কে চাঁচাছোলাভাবে প্রদর্শনের জন্য। ঘরে বাইরে তীব্র বিরোধিতা ও অসহযোগিতা, নিজের জীবনের টালমাটাল ভঙ্গুর পরিস্থিতি, বাইরের পৃথিবীর সুবিধেবাদী নীতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারার ব্যর্থতা, নিজের নীতিগত আদর্শ, নিজের মূল্যবোধ, নিজের বিশ্বাসের সাথে সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারনার চূড়ান্ত বৈষম্য, এই সব কিছু নিয়ে আদ্যন্ত ঘেঁটে থাকা একটি অস্থির অধৈর্য্য দুঃসাহসী দিশাহীন বিদ্রোহীচিত্ত তরুণের জীবনে এক মাহেন্দ্রক্ষণে যোগাযোগ হল সেই সময়ের নতুন যুগের ভারতীয় সিনেমার পথিকৃত কুণাল সেনের(অর্থাৎ, মৃণাল সেন)। আশির দশকের শুরুতে তখন নিজের নতুন ছবির জন্য একটি নতুন মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি, সমাজের দুমুখো সাঁড়াশি চাপে বিদ্ধস্ত মূল্যবোধ আর একটু ভালভাবে বাঁচার আকাঙ্খার মাঝে পড়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা হতে থাকা এক সাধারণ মধ্যবিত্ত যুবক দীপুকে। ছবির নাম চালচিত্র, তৎকালীন কঠিন মধ্যবিত্ত সমাজের জীবনযাপনের এক সৎ ও নির্মোহ বাস্তব আখ্যান, বাঁচার লড়াইয়ে শেষমেষ নিজের আদর্শের সাথে আপস করে ফেলে যে ছবির নায়ক। একরকম জোর করেই রঞ্জনকে নিজের ছবিতে নিয়ে নেন কুণাল সেন। রঞ্জনের ভূমিকায় এ ছবিতে অভিনয় করেছেন শাওন চক্রবর্তী এবং পরিচালক কুণাল সেনের ভূমিকায় চালচিত্র এখনের পরিচালক ও মৃণাল সেনের মানসপুত্র অঞ্জন দত্ত স্বয়ং। ছবি এগোয় চালচিত্র ছবি নির্মাণের কাহিনীকে কেন্দ্র করে। আর ফাঁকে ফাঁকে উঠে আসতে থাকে সেনের জীবনের নানা বাঁকের গল্প, তাঁর ভীষণরকম স্বাধীনচেতা, নীতিসচেতন, ছকভাঙা দৃঢ় চরিত্র ও মানবিক সহমর্মী ব্যক্তিসত্তার বিভিন্ন স্তরগুলি। ছবির জন্য অভিনেতা নির্বাচন সেন সর্বদা করেন নিজের শর্তে এবং তাঁকে ছবির চরিত্রে ব্যবহারও করেন সেভাবেই। স্ক্রিপ্টনির্ভর নয়, বরং তাৎক্ষণিক নির্দেশে ছবির বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অভিনেতার স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ই তাঁর ছবির প্রাণ। ছবির বাইরেও ছবির সাথে যুক্ত সকলের প্রতিই আবার তাঁর সযত্নলালিত পিতৃসুলভ মনোযোগ। তাঁর পরিচালনায় বাৎসরিক একখানি ছবি চলাকালীন কলাকুশলীসহ সেটের সকলের জন্য প্রতিদিনের ভাল মন্দ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হোক কি পুরো শুটিং সেটে ছবির শেষ অবধি সকলের সেটে উপস্থিত থাকাই হোক, ছবি তৈরিকে নিছক একটি কাজ বলে কখনও মনে করেননি তিনি, ছবি নির্মাণের সাথে যুক্ত সকলকে আক্ষরিক অর্থেই নিজের পরিবার বলে মনে করতেন সর্বদা। একই কথা প্রযোজ্য তাঁর বাড়ির সদস্যদের সম্পর্কেও যেখানে সকলেই ভিন্ন ভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসী হলেও বিভেদ নয়, মিলে মিশে একত্রে সহাবস্থানেই থাকতে পারে অনায়াসে। এই আশ্চর্য উদারতার এত সহজ বাস্তব প্রয়োগই ছবির কাজ শেষ হতে হতে অস্থির দিশাহীন রঞ্জনকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে ও তার সব ছেড়েছুড়ে জার্মানি চলে যাবার এতদিনের পরম আকাঙ্খাকে অর্থহীন করে তোলে। যে কলকাতার নির্দয় স্বার্থপরতা, নোংরা দলাদলি, চরম বিরোধিতায় একসময় এ পোড়া শহর থেকে তীব্র ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল রঞ্জন, ছবি শেষ হতে হতে সেই কলকাতাকেই সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালবেসে ফেলে সে। এক আমৃত্যু কলকাতা প্রেমিক শুধুমাত্র তাঁর নিখাদ ভালবাসা, ধৈর্য্য আর সহমর্মিতা দিয়েই বদলে দেয় আরেকটা জীবনকে, কলকাতাকে চেনাতে, কলকাতাকে ভালবাসাতে বাধ্য করে নিঃশর্তে।
চালচিত্র এখন ছবির মূল প্রাপ্তি রঞ্জনের ভূমিকায় নবাগত শাওন চক্রবর্তী। অস্থিরমতি, অধৈর্য্য, বিরক্ত, ক্রুদ্ধ, অসহায়, ঘরে বাইরে প্রবলভাবে কোণঠাসা যুবক রঞ্জনের চরিত্রে শাওনের জীবন্ত অভিনয় এ ছবির অন্যতম সম্পদ। সারা ছবি জুড়ে তাঁর আগুনে উপস্থিতি ছবিটিকে যেন সত্যিই প্রাণ দিয়েছে। ছবিতে তার দলের নাটকের উক্তি,‘ নিজেকে নিজের চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করানো, নিজেকে ওলট পালট করে ঝাঁকানো, তারপর গোটা পৃথিবীটাকে একটা তরতাজা দৃষ্টিতে দেখা’, এ সংলাপের বারংবার ব্যবহার মাঝে মধ্যে অতি ব্যবহৃত মনে হলেও রঞ্জন এবং কুণাল সেনের জীবনের ব্যক্তিগত উত্তরণের গল্পের সাথে এ বোধ ভীষণরকম সম্পৃক্ত। মৃণাল সেনের চালচিত্র ছবিতে অভিনয়ের জন্যে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সর্বশ্রেষ্ঠ নবাগত নায়কের পুরস্কার পেয়েছিলেন অঞ্জন দত্ত। এ ছবির রঞ্জন সামান্য কিছু ক্ষেত্রে অতি অভিনয়দোষে দুষ্ট হলেও সেই সম্মানের মান ধরে রাখতে পেরেছেন অনায়াসে। বাকিদের মধ্যে মৃণাল সেন ওরফে কুণাল সেনের চরিত্রে অঞ্জন দত্ত এবং তাঁর স্ত্রী গীতা সেন ওরফে মিতা সেনের চরিত্রে বিদীপ্তা চক্রবর্তী মনে দাগ কেটে যান। ছবির মধ্যের ছবির প্রোডাকশন ম্যানেজার বিপুলবাবুর চরিত্রে শুভাশিষ মুখোপাধ্যায় এবং ক্যামেরাম্যান মহাজন ওরফে মাধবনের চরিত্রে সুপ্রভাত দাসও অত্যন্ত সাবলীল। এছাড়া অন্যান্য কলাকুশলীরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে যথাযথ। অঞ্জন দত্তের ছবির একটা বিশেষ প্রাপ্তি তাঁর গান। এ ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। অঞ্জনের কণ্ঠে এ ছবির গানে কলকাতা ও মৃণাল সেন মিলে মিশে আছে একই সাথে। তার মধ্যে ‘একটা দিন’, ‘এ পোড়া শহর’ এবং ছবির শেষে মৃণাল সেনকে উৎসর্গ করে অঞ্জনের ‘অল আই হ্যাভ টু ডু’ ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও মনে থেকে যায়। আর ত্রুটির কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় এ ছবির কালার প্যালেট ও ভিস্যুয়াল বা দৃশ্যায়নের বিসদৃশতা বিষয়ে। ১৯৮১ সালের ছবি চালচিত্রের সময়ের কলকাতা এ ছবির দৃশ্যায়নে একেবারেই উঠে আসেনি। আজকের কলকাতাতেই সে সময়ের গল্প যেন বুনতে চেয়েছেন পরিচালক যা মনকে না হলেও চোখকে পীড়া দেয়। ছবির মূল ভাবটুকু অত্যন্ত মরমী আদরে তুলে ধরলেও এই টেকনিক্যাল ত্রুটিটি ছবির সম্পূর্ণতার পথে এক অন্তরায়। তবে এটুকু বাদ দিয়ে সার্বিকভাবে দেখলে ছবির মূল ভাবনাটি চালচিত্র এখন ছবিতে বড় হৃদয়স্পর্শীভাবে উঠে এসেছে, আর, ছোটখাট বাহ্যিক দোষ ত্রুটির বাইরে বেড়িয়ে সেখানেই বোধহয় এ ছবির আসল সার্থকতা।
১৯২৩ সালের ১৪ই মে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে জন্ম মৃণাল সেনের। সে হিসেবে গত বছর ছিল তাঁর জন্মশতবর্ষ। নব্য যুগের চলচ্চিত্রে স্বাভাবিকতাবাদ এবং নতুন এক সাহসী ভাষার উদ্ভাবক এই প্রবাদপ্রতিম পরিচালক আদতেই সম্পূর্ণ স্ব চেষ্টায় আমূল বদলে দিয়েছিলেন সে সময়ের বাংলা সিনেমাকে, যা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও গৃহিত হয়েছিল দারুণ শ্রদ্ধার সাথে। এবং, সেই সাথে তিনি বদলে দিয়েছিলেন বহু জীবনও, চালচিত্র এখন ছবির এন্ড ক্রেডিটেও যে উপলব্ধি তাঁকে এককথায় বর্ণনা করেছে। আর সে কারণেই হয়তো অঞ্জন দত্তের চালচিত্র এখন ছবির পাশাপাশি তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গত বছরই মুক্তি পেয়েছে কৌশিক গাঙ্গুলির পালান এবং এ বছরের অগাস্টেও মুক্তি পেতে চলেছে সৃজিৎ মুখার্জির পদাতিক। মৃণাল সেন আসলে সিনে শিল্পের একটি প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান যেকোনও ঘুণধরা পচে আসা জড়ভরত প্রাতিষ্ঠানিকতার চোখে চোখ রেখে বিদ্রোহ করতে জানে, যে প্রতিষ্ঠান অক্লেশে স্ব বিরোধী হয়ে দুঃসাহসী সত্যকে সর্বসমক্ষে দর্পের সাথে স্বীকার করতে জানে। যে প্রতিষ্ঠান আপসে নয়, সত্যে বিশ্বাস করে যেকোনও মূল্যে। এবং, এখনকার প্রধানত মধ্যমানের বাজার চলতি বাণিজ্যনির্ভর বাংলা ছবির ভিড়েও অন্তত তাঁর আদর্শকে সম্মান জানিয়ে মৃণাল সেন জন্মশতবর্ষে যে এ বাংলার তিনজন গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক পরিচালকের উদ্যোগে অন্তত তিন তিনটে গুরুত্বপূর্ণ ছবি শ্রদ্ধার্ঘ্য হচ্ছে, অনেক অন্ধকারের মাঝে এটুকুই আশার আলো।

গল্পকার ও চলচ্চিত্র সমালোচক। জন্ম ৭ ফেব্রুয়ারি, গঙ্গাতীরবর্তী শ্রীরামপুর শহরে, কিন্তু স্কুলজীবন কেটেছে উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে। কিশোরীবেলা থেকেই লেখালেখিতে আগ্রহ এবং জেলা ও রাজ্যস্তরে বিভিন্ন সাহিত্য প্রতিযোগিতার পরিচিত নাম। পরবর্তীতে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা, শ্রীরামপুর শহরের কিছু সাহিত্য সভার সদস্য এবং বিভিন্ন পত্রিকা এবং ই পত্রিকার নিয়মিত লেখিকা। বর্তমানে সাহিত্য চর্চা ও চলচ্চিত্র সমালোচনার কাজে যুক্ত।