ইরাবতী এইদিনে: বোতলচিঠির উপাখ্যান । জাহীদ রেজা নূর
আজ ০৬ মে কবি,আবৃত্তিশিল্পী,কথাসাহিত্যিক,অনুবাদক ও সাংবাদিক জাহীদ রেজা নূরের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
আগের দিনের অ্যাডভেঞ্চার গল্পগুলোয় বোতলচিঠির অস্তিত্ব ছিল। সাগরে চলেছেন কেউ, পড়েছেন বিপদে। তখন হয়তো একটি বোতলে নিজেদের কথা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছেন নিয়তির কাছে। কেউ যদি খুঁজে পায় সে চিঠি, কেউ যদি বাঁচাতে পারে তাঁদের, কিংবা মরে যাওয়ার পরও ‘আমিও ছিলাম’ ধরনের একটা তৃপ্তিবোধ থেকেও কেউ কেউ বোতলে চিঠি পাঠিয়ে থাকতে পারেন।
বোতলের চিঠি শুধু গল্প-উপন্যাসের বিষয় ছিল না। বাস্তবেও ছিল তা। অনেকেই বলে থাকেন, খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক তেওফ্রাস্ত এ রকম একটি বোতলচিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভূমধ্যসাগরের পানি আসলে কোন দিকে যায়, সে গবেষণা করা।
১৯১৪ সালে স্কটল্যান্ডের একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন ব্রাউন এ রকম বোতলচিঠি ছেড়ে দিয়েছিলেন সাগরে। সে চিঠিতে লেখা ছিল, যিনি এই চিঠি উদ্ধার করবেন, তাকে ছয় পেন্স দেওয়া হবে উপহার হিসেবে। বোতলচিঠিটি উদ্ধার করেছিল স্কটল্যান্ডেরই একটা জাহাজ, নাম ছিল যার কোপিয়াস। কিন্তু ক্যাপ্টেন ব্রাউনের ছয় পেন্স পুরস্কার তারা পায়নি। কারণ, চিঠি ছাড়ার ৯৭ বছর পর যখন এই চিঠি কোপিয়াস জাহাজের নাবিকেরা পান, তত দিনে ব্রাউন আর বেঁচে নেই। কে দেবে পুরস্কার?
তবে এ কথাও সত্য, বোতলচিঠিগুলো আবিষ্কার করার জন্য সব সময়ই ৯৭ বছরের মতো সময় লেগে যায়, এ কথা সত্য নয়। একটা ঘটনার কথা এখানে বলাই যায়। ২০০৫ সালে পেরু আর ইকুয়েডর থেকে ৮০ জন মানুষ চেপে বসেছিল নৌকায়। এখনো যা ঘটে চলেছে, তেমনি তখনো নিরাপদ জীবনের লক্ষ্যে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমাত মানুষ। এরাও সেভাবে আমেরিকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। কিন্তু পথে তারা পড়ল এক বিশাল সমুদ্রঝড়ে। হতবিহ্বল হয়ে তাদের একজন খুব দ্রুত লিখে ফেলল একটা চিঠি। তারপর তা ছুড়ে দিল সাগরে। সে চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমরা ঝড়ের কবলে পড়েছি। সাহায্য করুন।’
খুব তাড়াতাড়ি সে বোতল উদ্ধার করলেন কোস্টারিকার একদল জেলে। তাঁরা ছুটে গেলেন শরণার্থী এই মানুষদের কাছে এবং তুমুল ঝড়ে নিরাপত্তাহীন মানুষদের বাঁচিয়ে তুললেন।
মার্কিন ধর্মযাজক জর্জ ফিলিপস ভাবলেন, বোতলচিঠি সমুদ্রে ছাড়বেন। বোতলে যে চিঠিটি থাকবে, তাতে থাকবে মদ্যপানবিরোধী প্রচারণা। খালি মদের বোতলেই চিঠিগুলো ভরে তিনি পাঠিয়ে দিলেন। তিনি বোতলগুলো ছাড়লেন প্যুজেট-সাউন্ড উপসাগরে। সেখানে ছিল তীব্র স্রোত। কিছুদিনের মধ্যেই জর্জ সেই মানুষদের কাছ থেকে চিঠির উত্তর পেতে থাকলেন, যাঁরা পেয়েছিলেন বোতলগুলো। মজার ব্যাপার হলো, চিঠি যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই জর্জের অনুরোধ রেখে মদ্যপান ছেড়ে দিয়েছিলেন।
জাপানের মাতসুইয়ামা গুপ্তধন খুঁজে বেড়াতেন। ১৭৮৪ সালে তিনি তাঁর দলবল নিয়ে গুপ্তধনের সন্ধানে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছিলেন। এ সময় ঝড় এসে তাঁদের এক মনুষ্যহীন দ্বীপে নিয়ে যায়। এই দ্বীপ ঠিক কোথায়, তা তাঁরা কেউ বলতে পারলেন না। মাতসুইয়ামা যখন বুঝতে পারলেন, মৃত্যুই তাঁদের ললাটলিখন, তখন বোতলে করে একটা চিঠি পাঠালেন। তিনি তাতে বর্ণনা করলেন তাঁদের মর্মন্তুদ জীবনকাহিনি। আশা করলেন, কোনো না কোনো সময় তাঁদের এই কাহিনি জানতে পারবে মানুষ। হ্যাঁ, মাতসুইয়ামার চিঠিটি পাওয়া গিয়েছিল, তবে সেটা ছিল চিঠি পাঠানোর ১৩৪ বছর পর। তবে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক সত্য হলো, চিঠিটি পাওয়া গিয়েছিল জাপানে মাতসুইয়ামার নিজ গ্রামের সামনে নদীর জলে!
মার্কিন গবেষক ডিন ব্যামপাস সমুদ্রস্রোতের গতিপ্রকৃতি জানার বৈজ্ঞানিক লক্ষ্যে ১৯৫৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মোট ৩ লাখ বোতলচিঠি ভাসিয়ে দিয়েছেন পানিতে। এর মধ্যে ৩০ হাজার বোতলচিঠির উত্তরও তিনি পেয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে।
জেমস গ্লিজন নামের একজন নাবিক বউ খোঁজার জন্য একটা বোতলচিঠি ছেড়েছিলেন ১৮৯৫ সালে। তিনি সেটা ছুড়ে ফেলেছিলেন আটলান্টিক মহাসাগরে। তিনি লিখেছিলেন চিঠিতে, এমন একজন বউ চান, যিনি ‘দৌড়ে বেড়াবে না আর ভালো রান্না করবে।’ মনে হয় জাহাজের খাবার একদম পছন্দ হতো না গ্লিজনের। চিঠিটি উদ্ধার করা হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। আয়ারল্যান্ডের কুইন্স টাউন পোর্টে যখন এই চিঠিটি জল থেকে তোলা হয়, তখন বিয়ে করার জন্য জেমস গ্লিজন আর বেঁচে নেই। ১৯০০ সালে গ্লিজন যে জাহাজের নাবিক ছিলেন, সেই ভিক্টোরিয়া জাহাজটি ডুবে যায়। অন্য নাবিকদের সঙ্গে তাঁরও সলিলসমাধি হয়।
একটা সুখের সংবাদ দিয়ে শেষ করি বোতলচিঠির উপাখ্যান। ১৯৫৭ সালে ২২ বছর বয়সী সুইডিশ নাবিক আবে ভাইকিং একটি বোতলচিঠি পাঠান। তাতে লেখা ছিল, ‘অনেক দূরের একজন অজানা সুন্দরীর জন্য।’ সে চিঠিতে তিনি অনুরোধ রেখেছিলেন, ‘সাড়া দাও।’ জিব্রালটার প্রণালিতে ছাড়া হয়েছিল সে চিঠি।
দেড় বছর পর সে চিঠি এসে হাজির হয় সিসিলি দ্বীপে। সে চিঠি যার হাতে এসে পড়ে, সে এক জেলের ১৭ বছর বয়সী কন্যা। নাম পাওলিন পুজো। পাওলিন সেই বোতলেই একটি চিঠি লিখে আবার ভাসিয়ে দেয় পানিতে। সে লিখেছিল, ‘আমি সুন্দরী নই, কিন্তু এই ছোট্ট বোতলটা ভাসতে ভাসতে আমারই হাতে এসে পৌঁছেছে, এ কারণেই আমি আপনাকে না লিখে পারলাম না।’
সবচেয়ে অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হলো, এই বোতল গিয়ে হাজির হলো সেই মানুষটির কাছে, যিনি তা পাঠিয়েছিলেন।
এরপর?
এরপর সে ঘটনাই ঘটল, যা প্রত্যাশিত ছিল, যা আপনার মন ভরে দেবে। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে ইতালির সিসিলির সাইরাকস শহরে বিয়ে হলো সেই দুজনের, যাঁদের পরিচয় হয়েছিল অদ্ভুত বোতলচিঠির চালাচালির মাধ্যমে!
তথ্য: আই-ফ্যাক্টডটরু
কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অনুবাদক