সবাই গেছে বনে
কম্বলের মতো আমাকে আপাদমস্তক ঢেকেরেখেছে একাকীত্ব।কিন্তু শীতের রাতে একটুও উষ্ণতা দিচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে একটা জেলখানায় বুঝি আটকে রেখেছে আমাকে। হাঁসফাস করছে মন।
প্রায় সোয়া শো দিনের অসাধারণ জীবনযাপনের পর এই একাকীত্ব এসেছে আমার জীবনে। হিসেব করে দেখলাম, এই কম্বলের বয়স পাঁচ বছরেরও বেশি। এ সময়ে আমি আমার জীবনের রুটিন ঠিক করে নিয়েছি। ভোর পাঁচটায় উঠে নিজেই এক মগ কফি বানিয়ে খাই। হ্যাঁ, খাই। মোটেই পান করি না। বাংলায় আমরা কিছুই পান করি না। পানি খাই, চা খাই, কোক খাই। ভাত খাই, ডাল খাই, মাছ খাই। আরো অনেক কিছুই খাই। সুতরাং এ নিয়ে কেউ তর্ক করতে আসবেন না।
কফি খেয়ে একটা সিগারেট হাতে নিই। (হ্যাঁ, সিগারেটও আমরা খাই)। একটা লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালাই। কিন্তু সে আগুন সিগারেট পর্যন্ত নিয়ে আসি না। কয়েকবার লাইটার ধরাই, কয়েকবার নেভাই। তারপর সেটা রেখে দিই। সিগারেটটাও ঢুকিয়ে রাখিপ্যান্টেরপকেটে।
ছটার দিকে আমার নতুন অ্যাডিডাস কেডস পায়ে দিয়ে হাঁটতে বের হই। চন্দ্রিমা উদ্যানে গিয়ে দেখি, একদল মানুষ ব্যায়াম করছে। এক জায়গায় একদল মানুষ নয়। নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ব্যায়াম করছে শত শত মানুষ। নারী–পুরুষ সবাই এসেছে স্বাস্থ্যোদ্ধারে। আমি একসময় মনে করতাম, দেশের সব কিশোর–তরুণই সারা রাত জেগে জেগে অন্তর্জালে ঘোরাফেরা করে, দুপুর একটা পর্যন্ত বেঘোরে ঘুমায়, তারপর শুরু হয় তাদের দিন। কিন্তু সকালে উদ্যানে এসে মনে হচ্ছে, অনেক তরুণই এখানে আসছে, দৌড়াচ্ছে, হাঁটছে। ঘুমাচ্ছেও কি অনেক তরুণ? জানি না। আমি চাইলেই অবশ্য যে কোনো বাড়িতে ঢুঁ মেরে আসতে পারি, কিন্তু সেটা অরুচীকর। চেনা নেই, জানা নেই, হঠাৎ করে কারো বাড়িতে ঢুকে যাওয়া ঠিক নয়।
পাঁচ বছর আগে যখন আমার জীবন বদলে গিয়েছিল, তখন এই একাকীত্ব নিয়ে আমার বেশ হা–পিত্যেশছিল। এখন সয়ে গেছে।আমার কম্বলটা দিয়ে নিজেকে ঢেকে দিলেই আমি ফিরে যেতে পারি আমার সেই সোয়াশো দিনের কাছে। সেটুকুই সান্ত্বনা।
গল্পটা আর দশটা গল্পের মতোই। ওই প্রেমের বিয়ে, বাড়ি গোছানো, কিছুটা রোমান্টিক আবহে সময় কাটানো। যে কোনো নববিবাহিত দম্পতি যেভাবে ধীরে ধীরে নিজেদের নতুন জীবনে অভ্যস্থ হয়, সেভাবেই আমরা অভ্যস্থ হয়ে উঠছিলাম।এবং এরই মধ্যে কিছু মান–অভিমানও জন্ম নিচ্ছিল। যেটুকু জানি, এভাবেই গড়ে ওঠে এক একটি পরিবার।
আমাদের পনেরশো স্কয়ার ফুটের ভাড়া বাড়ি জুড়ে ছিল নন্দনকানন। যে কোনো সময় আমরা সেখান থেকে ছিড়ে নিতে পারতাম পারিজাত ফুল। আমরা অক্লান্তভাবে ভালোবাসার কথা বলে যেতে পারতাম। দীর্ঘদিনের ঝলসে যাওয়া পাকা পরিবার হওয়ার আগেই মাত্র সোয়াশো দিনের মধ্যেই আমাদের এই গল্পটা পরিবর্তিত হয়ে গেল।
এই ভাই! যদি মনে করে থাকেন, এখন আমি আমার স্ত্রীর নামে কুৎসা রটানো শুরু করব কিংবা এমন একটা গল্প ফেঁদে বসব, যেখানে আমি এক নীরিহ হরিণছানা আর আমার স্ত্রী এক পাঁশুটে নেকড়েরূপে আবির্ভূত হবেন—তাহলে ভুল করছেন। এ রকম কোনো ঘটনাই আমাদের সোয়া শো দিনের জীবনে ঘটেনি।
একটা অতি নীরিহ ঘটনা থেকেই এরপরের ঘটনা বিকশিত হয়েছে।
আমার স্ত্রী, মানে নীলিমা সোয়া শো দিন পর নেটফ্লিক্সে ‘ব্যাবেল’ ছবিটি চালু করল। ছবি শুরু হওয়ার আগে আমি তাকিয়ে দেখলাম, ওর বুক থেকে বেরিয়ে আসছে একটা দীর্ঘশ্বাস। বিয়ের আগে দু–একবার এ রকম দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখেছি নীলিমাকে। সেটা দেখে আমার মন হাহাকার করে উঠত। বিয়ের জন্য আমরা দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষা করেছিলাম। নীলিমাদের বাড়িতে আমাকে মেনে নিতে চাইছিল না। আমি যে চাকরি করি, সেটা সমাজে খুব নামিদামি চাকরি নয় বলে মনে করত নীলিমাদের পরিবার। ফলে, যুদ্ধটা চলেছে একটু বেশি সময় ধরেই। পরে যখন দেখা গেল, সৎ পথেই আমার রোজগার কম নয়, একটা বড়সড় বাড়ি ভাড়া করেও আমার হাতে যথেষ্ট টাকা থাকে, তখন আর অমত করল না তারা। আর হ্যাঁ, নীলিমা সেই যে আমাকে বিয়ে করবে বলে ঘাড় বাঁকিয়ে বসে ছিল, যার কাছে পরাজিত হয়েছিল ওর পরিবার—সে কথা না বললে মিথ্যে বলা হবে।
বিয়ের পর আমি কোনোদিন দীর্ঘশ্বাস নিতে দেখিনি নীলিমাকে।
তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে, নীলিমা?’
নীলিমা কোনো কথা না বলে হাসল। তারপর তাকাল টেলিভিশনের পর্দার দিকে। কেন নীলিমা দীর্ঘশ্বাস নিল, এ প্রশ্ন আমার মনে বার বার ঘণ্টা বাজাতে লাগল।
আমি বললাম, ‘এ রকম একটা ছবি বেছে নিয়েছ! কষ্ট পাবে দেখে।’
‘তুমি আগে দেখেছ?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি! দারুণ ছবি! কীভাবে যে একটা ঘটনার সঙ্গে আরেকটার যোগ করল ইনারিত্তু!’
‘বাহ! তুমি ঠিকই দেখেছ, আর আমাকে দেখতে মানা করছ!’
‘মানা করছি কোথায়? আমি তো বলছি, দেখে কষ্ট পাবে।’
‘দূর, দেখব না! তুমি আগে থেকেই তো কাহিনী বলে দিলে!’
আমি একটু অবাক হলাম। বললাম, ‘কাহিনী বললাম কোথায়?’
‘বললে না? এখন তো শুরু থেকেই আমি বুঝব যে এই সিনেমার শেষটা কষ্টের!’
একটু দমে গেলাম। নীলিমা মিথ্যে বলেনি। এ সিনেমা দেখা শুরু করলে নীলিমা এখন কষ্টের প্রতীক্ষা করবে!
আমি কিন্তু দীর্ঘশ্বাসের কথাটা ভুলিনি। তাই কেন ওর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, তা নিয়ে ভাবলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু আমাদের সুখের সংসারে এখন পর্যন্ত এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, যা দীর্ঘশ্বাসের জন্ম দিতে পারে! ভেবে কুলকিনারা পাব না জেনে ভাবনা–চিন্তা বাদ দিলাম। তারপর রিমোটটা নীলিমার হাত থেকে নিয়ে টেলিভিশন বন্ধ করে দিলাম।
যারা ভাবছেন, এবার ডিম লাইটে একটা রোম্যান্টিক দৃশ্যের জন্ম হতে যাচ্ছে, তাদের নিরাশ করেই আমাদের কাহিনী এগিয়ে চলবে। আমি নীলিমাকে সে সময় বললাম, ‘বহুদিন বাইরে খাওয়া হয় না। চলো, আমরা কোথাও ডিনার করে আসি।’
‘না, আজ খাসির মাংশ আর ডাল রান্না করেছি। বাইরে খাব না।’
আমি ওর হাত স্পর্শ করে বললাম, ‘ফ্রিজে থাকুক ওগুলো। আমরা আজ বাইরে খাব।’
বিশ্বাস করুন, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে আমি এ রকম কথা বলিনি। সত্যিই আমার মনে হচ্ছিল, এই দীর্ঘশ্বাসে কিছু যন্ত্রণা লেখা আছে। জীবনটা একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে—এ রকম একটা লুকনো আভাস রয়েছে তাতে। তাই আমি আমার বাইকটা বের করার কথা বলে বেরিয়ে এলাম। নীলিমাকে বললাম, কাপড় চেঞ্জ করে যেন বেরিয়ে আসে।
নীলিমা পরল সবুজরঙের স্যালোয়ার–কামিজ। সঙ্গে লাল ওড়না। ওকে লাগছিল দারুণ। ওর পাশে কালো টি–শার্ট আর নীল জিনস পরা আমি ছিলাম ম্রিয়মান। মোটর সাইকেলে ওঠার পর আমি নীলিমাকে বললাম, ‘কী খাবে? বিরিয়ানী না কাবাব? চায়নিজ বা মেক্সিকান?’
নীলিমার মন সত্যিই আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছিল। ও বলল, ‘বেরিয়েছি যখন, তখন আমাকে দূরে কোথাও নিয়ে চলো।’
‘কোথায় যাবে?’
‘তোমার যেখানে খুশি নিয়ে চলো।’
আমার ওপর ভ্রমণের ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাইকে বসে থাকল নীলিমা।
সন্ধ্যা কেবল রাতের হাতে পৃথিবীর ভার ছেড়ে দিয়ে বিশ্রামে গেছে। এমন কোনো রাত হয়নি, যাতে লোকে গিজগিজ ঢাকা শহরে নিরিবিলি বাইক চালানো যাবে। তাই আমি ভাবলাম, একটু দূরে কোথাও যাই। আপনি যদি কাউকে সত্যিই ভালোবাসেন, তাহলে তার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া যে কী সুখের, সেটা যে বিলিয়ে দেয়নি, সে কোনোদিন জানতেও পারবে না। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার।
আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম গাবতলী পেরিয়ে সাভারের দিকে। আমার মন ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল। আমার মনে হয়েছিল, সাভারের কাছে গিয়ে ব্র্যাকের টার্কের ওদিকটা দিয়ে আবার আশুলিয়ার রাস্তা ধরে উত্তরা হয়ে ফিরে আসব কলাবাগানে। তারপর কোথাও কোনো রেস্তোরাঁয় খেতে বসব।
বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমাদের রাতটাকে আনন্দে ভরে দিতে সেদিন আকাশে উঠেছিল দারুণ এক চাঁদ। একে বলে পূর্ণিমার চাঁদ। এই চাঁদকে মোটেই ঝলসানো রুটির মতো লাগছিল না। মায়াবী চাঁদের আলোয় খুব নিচু কণ্ঠে নীলিমা গাইছিল ‘আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।’
ঠিক এই গানটাই নীলিমা বেছে নিল কেন জানি না। জোৎস্না রাত ঠিক আছে, কিন্তু বন কোথায়? এটা তো জ্বলজ্যান্ত রাজধানী। আর যেদিকে যাচ্ছি, সেখানেও তো বন বলে কিছু নেই। বরং সুন্দরবন উজাড় হয়ে যাচ্ছে কিনা, তা নিয়েই আন্দোলন চলছে কয়েক বছর ধরে। তবুও, নীলিমা যা করে, সেটাই ভালো লাগে আমার। এখানে যুক্তি খাটবে না।
আমরা আরিচা রোড থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়ে সরু এক রাস্তায় নেমে গেলাম।
আকাশে চাঁদটা ছিল।আমি নিশ্চিত হয়ে বলছি, আকাশে চাঁদ ছিল।
সামনে জ্যাম। সন্ধ্যা পার হওয়া এই শিশু রাতেই একটা বুলডোজার এসে ওমে বসেছে সরু রাস্তায়। যেখানে সে দাঁড়িয়েছে, তার ডানপাশে গর্ত খোড়া। অর্থাৎ তিনি নড়েচড়ে না বসলে এ পথ দিয়ে কোনো কিছুই এগোবে না। রাস্তার দুদিকেই গাড়ি, রিকশা, মোটর সাইকেল, টেম্পুর ভিড়। হর্নের আওয়াজে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। আর ঠিক সে সময়ই হঠাৎ করে চাঁদটা কোথায় হারিয়ে গেল আর চারদিকে শোঁ শোঁ করে আওয়াজ হতে লাগল। আওয়াজটা এত তীব্র হলো যে কানে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না আর একটু পর এমন ধুলিঝড় উঠল যে চোখও বন্ধ হয়ে গেল আমার। নীলিমা আমাকে জাপটে ধরে বসে থাকল। তীব্র আওয়াজের কারণে ওর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল না, কিন্তু বুঝলাম, নীলিমা আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে।
এরপর যা ঘটল, তা আপনাদের বিশ্বাস হবে না। কিন্তু অবিকল এই ঘটনাগুলোই ঘটেছে।
দেখলাম, একটা বিশাল বড় ধূ ধূ প্রান্তরে আমি আর নীলিমা। বাইকটা নেই। নীলিমা আমার হাত ধরে আছে। আর আমাদের সামনে তিনটে ডাইনী মাথা নেড়ে নেড়ে বলছে, ‘কেন এলি, এদিকে কেন এলি, এদিকে কেন এলি।’
ডাইনি তিনটি মেয়ে, কিন্তু তাদের রয়েছে দাঁড়ি!
এই ডাইনি তিনটিকে আমি দেখেছি কোথাও! কোনো নাটকে? কোনো সিনেমায়? বাস্তবজীবনে? মনে পড়ছে না।
ডাইনিগুলো বাতাসে ভাসতে ভাসতে আমাদের সঙ্গে চলতে লাগল।
একটু এগোলেই সামনে এসে দাঁড়ালো রাজার সেপাইয়েরা। জনা সাতেক।
ওদের মধ্যে পাণ্ডা যেটা, সেটা বলল, ‘মেয়েমানুষ নিয়ে তুই কই যাস?’
‘মেয়েমানুষ’ শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে গেল আমার। কিছু বলতে যাব, কিন্তু সেই পাণ্ডা ঠোঁটে আঙুলের ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে বল। এরপর নীলিমাকে বলল, ‘মউজ মারতে আইসো?’
আমার মেজাজ তিরীক্ষি হয়ে উঠল। আবার ভয়ের ঠাণ্ডাস্রোতও বইতে থাকল শরীরে। এ এক অদ্ভুত অবস্থা।
এখন মাথা ঠাণ্ডা না রাখলে সমূহ বিপদ। চুপ করে থাকলাম। তারপর বিড়বিড় করে বললাম, ‘আমরা স্বামী–স্ত্রী।’
‘স্বামী–স্ত্রী? ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখা!’
‘আপনি কে ভাই যে আপনাকে ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখাবো!’
পাণ্ডা এবার দুলে দুলে বলল, ‘আমাকে চেন না, মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন।’
এবার আমার ধড়ে পানি এল। বললাম, ‘ও আপনার বোন আছে? ছোকানুর ভাই খোকা আপনি? যাক! তাহলে তো মা–বোন আছে আপনার।’
‘চুপ শালা!’ চিৎকার করে উঠল পাণ্ডা। বলল, ‘ছোকানু আমার বোন, কিন্তু আমি ছোকানুর ভাই না। বুঝছস? আমি কারো ভাই লাগি না। আমার কোনো মা নাই, বইন নাই। বুঝছস?’
আমার কী যেন হলো, জানি না, আমি নীলিমার হাতটা ছেড়ে ডান হাতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পাণ্ডার মুখে মারলাম ঘুষি। পাণ্ডা যন্ত্রণায় মুখ ঢেকে বসে পড়ল। আর চারদিক থেকে বাকি ছয়জন এগিয়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে। ওদের হাতে লোহার রড, চাপাতি। একটা পিস্তলও দেখলাম বোধহয়।
আমি একবার নীলিমার চিৎকার শুনলাম।
যারা ভাবছেন, আমি রসিয়ে রসিয়ে এরপর কী হলো, তার বর্ণনা দেব, তারা এখনই পড়া বন্ধ করুন। এখানেই ক্ষ্যামা দিন। আপনাদের চাহিদামতো আমি গল্প লিখতে পারব না। গল্প লেখা আমার কাজও নয়। যা ঘটেছে, তা একটু বলছি আপনাকে, এটুকুই।
এরপর বুঝতে পারলাম মাথার পিছন দিকটায় একটা ধাতব কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা থাকল কয়েক সেকেন্ড, তারপর সব যন্ত্রণা দূর হয়ে ফুরফুরে হয়ে গেল শরীর। বেশ হালকা লাগল নিজেকে।
ডাইনি তিনজন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেন এলি, এদিকে কেন এলি!’
আমি ডাইনিদের ধমক দিয়ে বললাম, ‘চুপ করো। আমি নিজে এসেছি নাকি? এখানে নিজে কেউ আসে না।’
ডাইনিরা পৈশাচিক হাসি দিয়ে কাঁপিয়ে দিল আকাশ বাতাস। তারপর বলল, ‘কী কথা হচ্ছে, সেটুকু শুনে নে। পরে কাজে লাগবে।’
এবার চারদিক থেকে কিছু শব্দ শুনতে পেলাম। জানি, আপনারাও এই শব্দগুলো শুনতে পান।
‘এই বেশ্যামাগি, কয় টাকায় আইছস?’
‘দাঁড়া, তোরে দেখামু।’
একজন হঠাৎ বলে ওঠে, ‘এমন কিছু কোরো না, যেন আমার হেডিং লিখতে অসুবিধা হয়। এমন কিছু করো, যেন পাঠক পড়ে। দর্শক দেখে। যে কোনো মানবিক ঘটনাই মানুষকে আকৃষ্ট করে। অমানবিক ঘটনাও। কী হেডিং দেব, বলো দেখি?’
‘ধর্ষণের পর তরুণীর মৃত্যু’ দাও।’
‘দূর দূর, ও সব এখন মানুষ পড়ে না। এমন কিছু করো, যেন লিখতে পারি, ‘তরুণীর বিবস্ত্র লাশ উদ্ধার’। কিংবা ‘গণধর্ষণের পর তরুণীর লাশ উদ্ধার।’
‘অ্যাই, লাশ উদ্ধার কীরে? লাশ উদ্ধার হলে ময়না তদন্ত, লাশের সঙ্গে কী হয়েছে, এগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে আমাকে! ও সব বাদ। লাশ পাওয়া যাবে না। শোনো, লাশ পাওয়া যাবে না কোথাও!’
‘আমার নিউজে লাইক পড়তে হবে। আমার ভিউ হতে হবে। তাহলে আমি হেডিং করব, ‘ধর্ষণের পর টুকরো টুকরো করে কাটা হলো তরুণীকে।’
আমি রাগে ক্ষোভে কথাই বলতে পারছিলাম না। ডাইনি তিনটি বলল, ‘এবার তুই যা। যেদিকে ইচ্ছে চলে যা। কেউ আর তোকে মারতে পারবে না।’
‘নীলিমা কোথায়? ওকে নিয়ে যাব।’
ডাইনী তিনটি উড়তে উড়তে বলল, ‘দেখা হলে হতে পারে, দেখা নাও হতে পারে। তুই চলে যা।’
এরপর আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমাদের ড্রইংরুমে। ফ্রিজ থেকে খাসির মাংস আর ডাল বের করে খেলাম। খিদে লেগেছিল খুব, তাই। একটু রেখে দিলাম নীলিমার জন্য, যদি ও আসে!
মাথা একটু ঠাণ্ডা হলে ভাবতে বসলাম, আসলে কী হয়েছে। ভেবে কোনো কূল–কিনারা করতে পারলাম না।
এরপর থেকে আমি আমার বাড়িতেই থাকি। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠি। এক কাপ কফি খাই। হ্যাঁ, কফি খাই। বাঙালি সবকিছু খায়, আমিও তাই সবকিছু খাই।
এরপর সিগারেট হাতে নিই। লাইটার জ্বালাই। কিন্তু সিগারেট খাই না।
এরপর আমি অ্যাডিডাস কেডস পরে হাঁটতে বের হই।
আমি চাইলে উড়তেও পারি। যে কারো বাড়িতে ঢু মারতে পারি। কিন্তু আমি তা করি না।
আমার পনেরশো স্কয়্যার ফুটের বাড়িতে আমার অনুমতি ছাড়াই নতুন ভাড়াটে এসেছে। বাড়িওয়ালা বেশ হেসে হেসে আমার চাবিগুলো নতুন ভাড়াটেদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন। সে দিক। আমি আমার বাড়ি ছাড়ব না। আমি এখানেই থাকব। দেখি, কীভাবে আমাকে ঘরছাড়া করে!
ও হ্যাঁ, আমি এর মধ্যে পাঁচবার সাভারে গিয়ে ওই পাণ্ডার গলা টিপেছি। কিন্তু কেন যেন ও টেরই পায়নি।
আমি আর কোনোদিন নীলিমাকে দেখিনি। ওর সঙ্গে আসলেই কিছু ঘটেছিল কিনা, তা আমি জানি না। যেহেতু আমি জানি না, তাই আশা করব, নীলিমা ভালোই আছে কোথাও না কোথাও। কে যেন বলেছিল, মরে গেলে সবাইকে দেখা যায়। তাহলে কি সেটা মিথ্যে? নীলিমাকে কি আমি আর দেখব না কখনো? মৃত মানুষদের কি মৃত মানুষেরা দেখতে পায় না? শুধু জীবিতদেরই দেখতে পায়? আমার মাথায় কিছু ঢোকে না।
সারাদিন আমি কী করি, সে কথা আর না–ই বা বললাম, কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, ওই একাকীত্বের কম্বলটা মোটেই ওম দেয় না আমাকে, শুধু চেপে বসে, শুধুই চেপে বসে শরীরে… আর মনে পড়ে, নীলিমা একটা গান গেয়েছিল। রবিঠাকুরের গান, ‘আজ জোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে…
এবার আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি, ‘সবাই গেছে বনে’। না, ‘জঙ্গলে বলি না। বনেই বলি। বন–জঙ্গল সব একই জায়গা তো তাই।
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অনুবাদক