ফরাসি বিপ্লবে বাঙালি বিপ্লবী
ফরাসি বিপ্লব এনেছিল বিশ্বমানবের মুক্তির বার্তা। কিন্তু দুনিয়া পাল্টে দেওয়া সে বিপ্লবে যে অংশ নিয়েছিল এক বাঙালি ছেলে, তা কে জানত? কৌতূহলী অনুসন্ধানে আস্তে আস্তে হাতে আসতে থাকে আরও লেখা: ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ-এ অভিজিত গুপ্তের ‘চাইল্ড ফ্রম চিটাগাং’, দ্য হিন্দুতে সরোজা সুন্দরারাজনের ‘ফর লিবার্টি অ্যান্ড ফ্রেটারনিটি’, আনন্দবাজার পত্রিকায় অভিমন্যু সারথির ‘বাঙালি এক বিপ্লবী দাসের কথা’। বহু তথ্য পাই ক্রিস্টোফার এল মিলারের বই দ্য ফ্রেঞ্চ অ্যাটলান্টিক ট্রায়াঙ্গল: লিটারেচার অ্যান্ড কালচার অব স্লেভ ট্রেড থেকে। জানতে পারি, জামরের ছবি আছে প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরে; ফ্রান্সে আছে তাঁকে নিয়ে বিচিত্র প্রকাশনা। ইতিহাসের অজানা এক অধ্যায়।
কে এই জামর?
বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় ইউনিয়ন জ্যাকের কালো আঁধারে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তর রুধিরাক্ত হয়ে ওঠে দেশপ্রেম আর দেশদ্রোহিতার মিথস্ক্রিয়ায়। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার মহান অধিপতি নবাব সিরাজউদ্দৌলা এখন অতীত। মসনদের নিয়ন্ত্রণ এখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতে। স্বাধীন সার্বভৌম এ দেশবাসী হঠাৎ হওয়া এই পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। ক্ষণে ক্ষণেই বিদ্রোহী হয়ে উঠছেন তারা। আর এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে ১৭৬২ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জামর। জামর ঠিক বাংলা নাম নয়। উপনিবেশের দুঃসহ গোলকধাঁধা পেরিয়ে আদি কোন নামটি যে জামর হলো, কে জানে? জমির কি?
১৭৭৩ সাল। চট্টগ্রামের উপকূলে হানা দিচ্ছে ইংরেজ দাস-ব্যবসায়ীরা। একটি দলের হাতে ধরা পড়ল ১১ বছরের জামর। জাহাজে তাকে পাচার করা হলো মাদাগাস্কারে। সেখান থেকে ফ্রান্স। পূর্ববাংলার এই বালকটিকে কিনে নিলেন ফরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুই। কয়েক জোড়া পশুপাখিসহ তাকে তুলে দিলেন প্রিয় রক্ষিতা কাউন্টেস দ্যু বারির (১৭৪৩-১৭৯৩) হাতে।
মাদাম বারি জামরকে ভেবেছিলেন আফ্রিকান। কৃষ্ণকায় এ বালকটিকে তিনি পুত্রস্নেহ দিয়েছিলেন। সাজিয়েছিলেন রেশম আর মসলিনে। খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা দিয়ে সম্রাটের উপাধি যুক্ত করে নাম রেখেছিলেন লুই-বেনোয়া জামর। দিয়েছিলেন শিক্ষা-দীক্ষাও।
দাস হলেও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন জামর।
অবশ্য তার সঠিক জন্মসাল নিয়ে কারো কারো দ্বিমত আছে। এর কারণও আছে অবশ্য। মাত্র এগারো বছর বয়সে এক ইংরেজ দাস ব্যবসায়ীর করাল থাবায় পাচার হয়ে যান ছোট্ট জামর। জাহাজে করে তাকে নিয়ে আসা হয় আফ্রিকার মাদাগাস্কারে। সেখান থেকে এক ফরাসি দাস ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ফ্রান্সে। অতঃপর বিক্রি করে দেওয়া হয় ফ্রান্সের তৎকালীন রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের কাছে। পঞ্চদশ লুই জামরকে তার উপপত্নী মাদাম ব্যারির (১৭৪৩ – ১৭৯৩) কাছে হস্তান্তর করেন। মাদাম ব্যারি জামরকে পছন্দ করতেন। তিনি জামরকে পড়াশোনা করার সুযোগ দেন। শুরু হয় জামরের ফরাসি ভূমিতে দিনযাপন। পেছনে ফেলে আসেন তার জন্মভূমি চট্টগ্রামকে; তার ছোট্টবেলার স্মৃতিকে।
ফরাসি বিপ্লবে বাংলার বিপ্লবী জামর; এই ছবিটি বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরে আছে; ছবিসূত্রঃ Jacques-Antoine-Marie Lemoine (১৭৮৫)
দর্শন ও সাহিত্যে জামরের আগ্রহ বাড়তে থাকে। তিনি গোপনে গোপনে বিপ্লবী দার্শনিক ও লেখক জ্য জ্যাক রুশোর সব সাহিত্যকর্ম পড়ে ফেলেন। এগুলো জামরের মনে দাগ কাটে। তিনি ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। রাজনীতির প্রতি তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। গোপনে যোগাযোগ রাখতে থাকেন লুকিয়ে থাকা সুপ্ত বিপ্লবীদের সাথে। জামর প্যারিসের রয়্যাল ক্যাফেতে নিয়ম করে যাতায়াত করতেন। সেখানে ইংরেজ বিপ্লবী জর্জ গ্রিভের সঙ্গে জামরের বন্ধুত্ব হয়। পরবর্তীকালে জামরের কাছে শোনা তথ্যের ভিত্তিতে মাদাম ব্যারিকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে গ্রিভ ভূমিকা রাখেন।¹ যা-ই হোক, ‘থার্ড স্টেট’ বলে সে সময় পরিচিত সাধারণ জনগণের ক্ষোভ যখন তুঙ্গে, ফ্রান্সের মসনদে তখন অত্যাচারী রাজা ষোড়শ লুই।
অত্যাচারী, স্বৈরাচারী ষোড়শ লুই ছবিসূত্রঃ Antoine-François Callet
শত শত বছরের চেপে থাকা ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিলো ফ্রান্সের অলিতে-গলিতে; নির্যাতিত ও বঞ্চিত সাধারণ মানুষদের প্রতিটি দারিদ্রপীড়িত গৃহে। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত জনগণ হানা দেয় কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গে। শুরু হয় ইতিহাস বিখ্যাত ফরাসি বিপ্লব।
বিলাস ব্যসনে উন্মত্ত ভোগ-বাসনার চরিতার্থতায় আকণ্ঠ নিমগ্ন ফরাসি রাজপরিবারকে টেনে হিঁচড়ে গদি থেকে মাটিতে নামান বিপ্লবী জনতা। গণহারে বন্দী হয় অভিজাত শ্রেণী ও দুর্নীতিগ্রস্ত ধর্মগুরুরা। পতন ঘটে স্বৈরাচার, নির্যাতন ও জুলুমের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের। ফরাসিদের এই বিপ্লবে রাজপ্রাসাদের বাসিন্দা জামর বিপ্লবীদের পক্ষ নেন। যোগ দেন বিপ্লবকালীন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংঘ জ্যাকোবিন ক্লাবে। ফরাসি বিপ্লবের ফসল এই সংঘের মূলমন্ত্র ছিল ‘Vivre libre ou mourir’ অর্থাৎ ‘Live free or die‘; ভাবার্থে ‘স্বাধীনভাবে বাঁচো অথবা মৃত্যুকে বেছে নাও (তবুও পরাধীনতা নয়)’।
বার্তাবাহক হিসেবে জামরের অবদান তাকে কমিটি অব পাবলিক সেফটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত করে। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯২, জামর এখন কমিটির একজন সেক্রেটারি, যার কাজ ছিল সমাজের অভিজাতদের উপর নজর রাখা। তার কথায় ১৭৯২ সালে গ্রেফতার করা হয় কাউন্টেস ব্যারিকে। তার দেওয়া সাক্ষ্য নিশ্চিত করে রাজবংশের এই কাউন্টেসের মৃত্যুদণ্ড। এক সময়ের অচিন্ত্য ক্ষমতার অধিকারী এসব মানুষকে (ষোড়শ লুইসহ) গিলোটিনে নিয়ে শিরশ্ছেদ করে নির্যাতিত বিপ্লবীরা।
কাউন্টেস ব্যারি তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এটাই জানতেন যে, জামর আফ্রিকার কোনো এক দেশের অধিবাসী। সবাইও তাই জানতো। জামর তাদের এই ভুল ভাঙান কাউন্টেস ব্যারির বিচারের সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেবার সময়। কাউন্টেসের অনুপস্থিতে দেওয়া তার এই সাক্ষ্যে তিনি নিজের সত্যিকারের পরিচয় দেন। বলেন, তিনি আফ্রিকার নয়; বরং সুবা বাংলার চট্টগ্রামের ছেলে। দাস ব্যবসায়ীরা তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় মাদাগাস্কার । সেখান থেকে এখানে অর্থাৎ ফ্রান্সে।
জামরের জন্মস্থান নিয়ে ভুল তথ্য জানার প্রমাণ তাকে নিয়ে আঁকা ছবিগুলোতে প্রতীয়মান। এসব যৎকিঞ্চিত ছবির প্রতিটি জামরকে আফ্রিকা থেকে আগত দাস হিসেবে উপস্থাপন করেছে। যা-ই হোক, কাউন্টেসের শিরশ্ছেদের পরপরই জিরোন্ডিনরা জামরকেও গ্রেফতার করে। এই জিরোন্ডিনরাও ফরাসি বিপ্লবের বিপ্লবী। কিন্তু এই তারাই জামরকে জ্যাকোবিন ক্লাবের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতার করে। প্রায় ছয় সপ্তাহের মতো তাকে জেলে বন্দী থাকতে হয়। ছাড়া পেয়ে জামর ফ্রান্স থেকে পালিয়ে যান।
১৮১৫ সালে ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর জামর আবার ফিরে আসেন ফ্রান্সে। বসবাস করতে থাকেন প্যারিসে। বাচ্চাদের একটা স্কুলে শিক্ষকতাও করেন কিছুদিন। ১৮২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জামর মারা যান। অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়া এই বিপ্লবীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে খুবই কম সংখ্যক মানুষ নাকি উপস্থিত হয়েছিল।
জামরের আরেকটা নাম ছিল। ফ্রান্সে তিনি লুই বেনোয়া নামেও পরিচিত। খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হবার পর জামর এই নাম গ্রহণ করেন। এতকিছুর পরও একটা কথা না বললেই নয়। ব্যক্তিগত জীবনে জামর বুদ্ধিমান ও পড়ুয়াটাইপ হলেও স্বভাবে খুবই দুর্জন ছিলেন। Lenotre-এর Romances of the French revolution বইতে উল্লিখিত কাউন্টেস ব্যারির কথনেও এর প্রমাণ নিহিত,
The second object of my regard was Zamor, a young African boy, full of intelligence and mischief; simple and independent in his nature, yet wild as his country. Zamor fancied himself the equal of all he met, scarcely deigning to acknowledge the king himself as his superior.
এছাড়াও ১৮১৫ সালের পর জামরের ফিরে এসে যে স্কুলে শিক্ষকতা করাতেন, সেখান থেকেও তাকে বের করে দেওয়া হয় তার বাজে স্বভাব আর শিশুদেরকে নির্দয়ভাবে প্রহারের অভিযোগে।
ফরাসি লেখিকা ইভ রুজিয়ের তার ‘লো গেভ্ দ্য জামর‘ তথা জামরের স্বপ্ন (২০০৩) উপন্যাসের মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন,
“কৈশোরে ভারতের দক্ষিণের বেলাভূমিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জামরের জীবন। সাগর-মহাসাগর আর দ্বীপের বন্দরে বন্দরে কেটেছে জীবনের একটা সময়। দাস হিসেবে সে এসে পৌঁছায় কাউন্টেস ব্যারির কাছে। কৃষ্ণাঙ্গ এ তরুণ একসময় হয়ে ওঠে ভার্সাইবাসীর চোখের মণি। কিন্তু এ সৌভাগ্যের আড়ালে ছিল তিক্ততা ও অসম্মান, যা একসময় তীব্র হয়ে ওঠে।”
জামরের উপর ফরাসি লেখিকা ইভ রুজিয়ের
লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ; ছবিসূত্রঃ Le rêve de Zamor
ফরাসি বিপ্লবে জামরের অবদান সেই রকম আহামরি টাইপের কিছু হয়তো নয়। কিন্তু এদেশের ভূমিতে জন্ম নেওয়া একজন সন্তান হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়া এক বিপ্লবে তার উপস্থিতি বিশেষ কিছু বৈকি। জামর হয়তো দুর্জন বিদ্বান বলে ঐতিহাসিকদের কাছে পরিচিত; কিন্তু দাসপ্রথার নির্লজ্জ আগ্রাসনে সুবা বাংলার এক সহজ-সরল এগারো বছরের বালকের জীবন তছনছ হয়ে যাওয়ার পর তার চারিত্রিক বিশ্লেষণ করা কতটুকু যৌক্তিক এটাও ভাবা উচিৎ নয় কি? ফ্রান্সের সেকালের কয়েকজন শিল্পী জামরের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। ল্যুভরে রক্ষিত একটি প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন ফরাসি নারী-শিল্পী মারি-ভিক্তোয়ার লোমোয়ান। তাতে ঘন কোকড়া চুল, পুরু ঠোঁট, উঁচু কপাল ও গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের জামরকে কৃষ্ণাঙ্গ বলে মনে হয়। তাঁর পরনে অভিজাত ধূসর রেশমি কোট। নিচে উঁকি দিচ্ছে বাহারি লেসের কাজ করা জামা। অনেক ইতিহাসবিদের ধারণা, এ প্রতিকৃতি অতিরঞ্জিত, সম্ভবত কল্পিত। শিল্পী তাঁকে মাদাম বারির চোখে দেখেছেন। জামরের জীবনতথ্য নিয়ে ১৯৭৮ সালে ফ্রান্স থেকে বেরিয়েছে লা রু পের্দু্য নামে একটি কমিক উপাখ্যান।
ফরাসি বিপ্লবে জামরের অনস্বীকার্য অবদান তার চরিত্রের ঋণাত্মকতাকে ছাপিয়ে হিরণ্ময় দ্যুতিতে চিরভাস্বর হয়ে আছে এবং থাকবে।