‘আর ইউ প্লেয়ার?’
‘হোয়াট ডু ইউ মিন প্লেয়ার?’
‘আই ওয়ান্ট টু নো, হোয়াট কাইন্ড অব প্লেয়ার ইউ আর? আর ইউ উইমেনাইজার?’
‘হঠাৎ করে আমার প্রতি এই অভিযোগ কেন? আমি কি যার সঙ্গে কথা বলছি তার পরিচয় জানতে পারি!’
‘আমি ভেরোনিকা সরকার। ডাক নাম আনা। আমার পরিবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছে। ভালো বাংলা বলতে পারি। তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বাস্কেটবল টুর্নামেন্টে।’
‘আমার নাম জামিল আহমেদ। সবাই আমাকে সংক্ষেপে জে বলে ডাকে!’
‘নাম বলতে হবে না। আমি জানি।’
আলোচনা শুনে ভাববেন না যে আনার হঠাৎ ফোন পেয়ে ভড়কে গিয়েছিল জামিল। ও হল জন্মগতভাবে চৌকস ছেলে। আটলান্টা এয়ারপোর্টের স্মোকিং লাউঞ্জে ইলেকট্রিক সিগারেটে ভ্যাপ নিতে নিতে আনমনে ঠোটের কোনায় একটু হাসি ভেসে ওঠে জামিলের।
একটু পরে জর্জিয়া থেকে প্লেনে নিউইয়র্কে উড়াল দেবে জামিল। প্রতিবার নিউইয়র্কে যাবার সময়ে বুকের মধ্যে এক ধরনের চিনচিনে ব্যথা হয় ওর। ওর মতো ঝকঝকে আর হাসিখুশী পুরুষের সঙ্গে যেটা একদম মানানসই নয়। ভালোবাসার সমস্ত অনুভবকে একটা গোপণ তোরঙ্গে রেখে দিয়েছিল এতোদিন। আজ তোরঙ্গের মুখ খুলে গেছে। সমস্ত আবেগ যেন বের হয়ে আসতে চাইছে হুড়মুড়িয়ে।
আনার সঙ্গে জামিলের পরিচয় হয় হাইস্কুলের টুয়েলথ গ্রেডে পড়ার সময়। জামিলরা তখন নিউইয়র্কের এলমাহার্স্ট এর বাসিন্দা। নোয়াখালির চাটখিল থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর পরে কুইন্সে ছিল ওরা এগারো বছর। যে কারণে নিউইয়র্কে গেলে ওর নিজেকে নিউইয়র্কার মনে হয়।
সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ এ্যাকশন নামের ওই বাস্টেকবল টুর্নামেন্টে তখন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপালের হাইস্কুলের পড়ুয়ারা অংশ নিতো। জামিল নিশ্চিত না, টুর্নামেন্টটা এখনো হয় কিনা!
সেবার জামিল ছিল টুয়েলথ গ্রেডের ছাত্র। সেই হিসেবে ওটাই ছিল ওর শেষ টুর্নামেন্ট। যে কারনে আগের যে কোন বারের তুলনায় ও ছিল বেশী সিরিয়াস। বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ছেলেদের নিয়ে যে দলটা গড়া হয়েছিল, জামিল আবার সেটার অধিনায়কও ছিল।
অথচ অধিনায়ক হবার কোন যোগ্যতা ওর ছিল না। বাস্কেটবল খেলোয়াড় মানেই লম্বায় ছয় ফুট বা আরো বেশী। এনবিএ লিগের খেলোয়াড়দের তো উচ্চতার কোন মা বাপ নেই। সেখানে জামিলের উচ্চতা ছিল মাত্র পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। বাস্কেটবল দলে রীতিমত বামন ছিল ও। তবু মনের জোর দিয়ে আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ও সবাইকে মাত করতো। ও গার্ড পজিশনে খেলতো।
সেই টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তান-নেপালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিয়ে জামিলরা যখন উল্লাসে মত্ত, তখন ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রবির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল আনা আর আরেকটি মেয়ে।
এতো বছর পরে অন্য মেয়েটির নাম মনে করতে পারে না জামিল। এবার নিউইয়র্কে আনাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। ভুলে যাতে না যায়, এজন্য মোবাইলের নোটপ্যাডে লিখে রাখে ও।
খেলার পরে সবাই যখন চলে যাচ্ছিল, তখন আনা এসে দাঁড়িয়েছিল জামিলের সামনে। ‘কনগ্রাচুলেশন্স’ বলে হাত মেলায়। ওই টুকু ঘটনা জামিলের মনে রাখার কথা নয়। ছেলেদের মতো মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বে ও ছিল সমান সাবলীল। কোন মেয়ের হাত মেলানোর ঘটনা যে কারণে ওর মনে থাকার কথা নয়!
দুইদিন পরে জামিলের পেইজারে একটা নম্বর এসে ঢোকে। ও নম্বরটা চিনতে পারেনা। তখন ও এক পারিবারিক দাওয়াত উপলক্ষে খালার বাসায় ছিল। নম্বরটা চিনতে না পেরে খালার বাসা থেকে বের হয়ে ফুটপাতে এসে দাঁড়ায় জামিল।
তখন অপরিচিত কণ্ঠ বলে ওঠে- আর ইউ প্লেয়ার?
ভ্যাপ নিতে নিতে সামনে থাকা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে হাসে জামিল। ফোনে কথা শুনে মনে হয়েছিল, আনা খুব সাহসী একটা মেয়ে। অথচ প্রথম যেদিন ওরা কুইন্স সেন্টার মলে দেখা করতে গেল, পুরো সময় জামিলের চোখের দিকে তাকাতে পারেনি আনা। লজ্জ্বায় একদম লাল হয়ে গিয়েছিল।
আনাকে স্বাভাবিক করতে বেশ কসরত করতে হয়েছিল সেবার জামিলকে।
‘তুমি কি সেদিন আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য ফোন করছ? নাকি অভিযোগ করার জন্য। আর এই অভিযোগ আসার কারণ কি?’
আঠারো বছর বয়সী তেজী একটা ছেলে যেভাবে প্রশ্ন করে, সেভাবেই জানতে চেয়েছিল জামিল।
আনা মাথা নীচু করে উত্তর দিয়েছিল-
‘কারণ ওই দিন তোমাকে আমার ভালো লাগছিল। তখন আমি কয়েকজনের কাছে তোমার নম্বর চাইলাম। ওরা বলল, তোমার বন্ধুরা বেশীরভাগ নাকি মেয়ে। সবাই আমাকে উপদেশ দিল, তোমাকে ফোন না করতে!’
‘তাহলে তোমার বন্ধুদের উপদেশ তুমি নাওনি কেন?’
‘তুমি কি খুশী হওনি আমি তোমাকে ফোন করেছি?’
‘আমি অবশ্যই খুশী। কিন্তু তুমি আবার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছ, তাতে আমি খুশী না।’
‘আমি আসলে সবার কাছে যেটা শুনেছি, আসলে তুমি সেই রকম মানুষ না!’
‘কিভাবে বুঝলে আমি সেই রকম মানুষ না?’
‘আমি দেখেছি, তোমার মধ্যে লিডারশিপ কোয়ালিটি আছে। তুমি যেভাবে পুরো টিমকে হ্যান্ডেল করছ, ম্যাচের মধ্যে সব খেলোয়াড়কে মটিভেট করছ- অসাধারণ। তোমাকে সারাক্ষণ দেখছি ছোটাছুটি করতে। কখনও এক মিনিট বস নাই।’
‘তুমি এতো সব কখন দেখছ?’
‘রবি নামে তোমাদের দলে যে খেলোয়াড় আছে, আমার এক বন্ধু ওর প্রতি ক্রাশ খেয়েছে। ও আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি শুরু থেকে ওখানে ছিলাম। তুমি আমার সঙ্গে যেভাবে হাত মিলিয়েছ, এটাও আমার খুব ভালো লাগছে। সাধারণত সবাই এভাবে করে না। মনে হয়েছে তুমি খুব জনপ্রিয়। তারপর আমি যখন আমার বন্ধুর কাছে তোমার নম্বর চাইলাম, ও বলল, তুমি এরচেয়ে ভালো কাউকে ডিজার্ভ কর।’
‘ধন্যবাদ সবকিছু বলার জন্য। তোমার অভিযোগের ব্যাপারে কিছু বলব না। সময় বলে দেবে। তবে তুমি আমাকে যে ফোন করেছ তাতে আমি খুব খুশী। হতে পারে এটা আমাদের শেষ দেখা।’
‘শেষ দেখা কেন হবে?’
আহত চোখে প্রথমবারের মতো তাকিয়েছিল আনা জামিলের দিকে।
‘তুমি যে চোখের দিকে তাকাচ্ছ না। কিভাবে আশা করব তুমি আবার দেখা করবে!’
কথাটা শোনার সঙ্গে আনার ফর্সা গাল লাল হয়ে যায়। ওই মুখের দিকে তাকিয়ে জামিল বুকের ভিতরে কি যেন ঘটে যায়! ও এক পা এগিয়ে, আবার দুই পা পিছিয়ে যায়! ও বুঝতে পারে, আনা সময় কাটানোর জন্য প্রেম করবে না ওর সঙ্গে! ওকে সারাজীবনের জন্য পাশে চাইবার জন্যেই করবে!
জামিলের গ্রাম থেকে আগত প্রচন্ড ধার্মিক বাবা-মা কি পারবে ভিন্নধর্মী কোন মেয়েকে ছেলের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে! পাঁচ ভাইবোনের সংসারে ‘বড় ছেলে’র ভূমিকায় জামিল কি পারবে পিছুটান রেখে নিজে সুখী হতে!
মার্কেন্টিংয়ে জামিলের দক্ষতা সেরার সেরা হলেও নিজের জীবনের হিসাব মিলাতে পারেনি ও।
তখন আনা যেত বে সাইডের এক হাইস্কুলে। জামিল যেত নিউটাউন হাইস্কুলে। জামিলের জন্ম বাংলাদেশের হলেও ও শুদ্ধ বাংলা বলতে পারতো না। পারতো শুধু বাবা মায়ের খাস নোয়াখালি ভাষা। আনার মা মেরি আন্টি ওকে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে শেখান।
আনার বাসার পরিবেশ ছিল অন্যরকম। ধীরে ধীরে ওর পরিবারের সঙ্গে জামিল খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল। আনার মা ওকে খুব আদর করতো। জামিল যে কোন পরিস্থিতিতে একটা সমাধান বের করে ফেলতে পারতো। আনার মা মাঝেমধ্যে অনেক ব্যাপারে জামিলের সঙ্গে পরামর্শ করতো।
ওদের দুজনের বন্ধুত্বের কথা আনার পরিবারতো বটেই, ওদের পরিবারের ঘনিষ্ঠরাও সবাই জানতো। ওদিকে জামিলের পরিবারের কেউ আনার নামও জানতো না। রক্ষণশীল বাবা-মাকে জামিল সব সময় খুব ভয় পেতো। অথচ আনার বাবা-মাকে কখনও ওর ভয় লাগতো না।
দিনে দিনে দুজনের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। মুখে ‘আই লাভ ইউ’ না বললেও চোখের তারায় লেখা হয়ে গেছে অনেক আগে!
জামিল হাইস্কুল থেকে বের হয়ে কুইন্স কলেজে ভর্তি হয়। আনা ভর্তি হয়েছিল সিটি কলেজে। আনার ইচ্ছা কলম্বিয়াতে পড়ার। জামাল ওকে স্বপ্ন দেখতে প্রেরণা যোগাতো।
প্রথমবার সাক্ষাতের মতো ওরা বেশীরভাগ সময় দেখা করতো কুইন্স মলে। আনা বাস দিয়ে কুইন্স মলে আসতো বে সাইড থেকে। জামিল ওর এলমহাস্টের বাসা থেকে হেঁটে যেতো। আনা ছিল পড়ুয়া ধরনের, একাডেমিকভাবে উজ্জ্বল একটা মেয়ে। জামিল জীবন যাপনের ক্ষেত্রে খুব চৌকস। যে কোন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেবার মতো মনের জোর ছিল ওর!
জামিলের মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে এতোটা মনের জোর ওর না থাকলে কিইবা এমন হতো! কেন সব দায়িত্ব ওকেই সারাজীবন বহন করে যেতে হবে!
বাবা যখন নিউইয়র্ক ছেড়ে ছোট্ট শহর বাফেলো চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন জামিলের মনটা সত্যি ভেঙ্গে গিয়েছিল। এই শহরে ওর এতো বন্ধুবান্ধব, এই শহরে আনা থাকে, সেই শহরকে ফেলে কেনো ওকে চলে যেতে হবে।! বাবা নিউইয়র্ক সিটিতে কোন কাজ করতে পারছিলেন না! তাই উনি সিদ্ধান্ত নেন বাফেলো চলে যাবার।
জামিলের এখনো মনে আছে, ওর বাফেলো চলে যাবার কথা শুনে আনার মুখটা কেমন বেদনায় নীল হয়ে গিয়েছিল। আনার মাও বুঝেছিলেন মেয়ের বেদনা!
‘জামিল, তুমি বাফেলোতে চলে যেওনা। বড় সিটি থেকে ছোট সিটিতে চলে গেলে তোমার ভালো লাগবে না!’
‘এখানে আমি থাকবো কোথায়?’
‘আমার বাসায় থাকবে’।
‘আমি বাবা মাকে বলতে পারব না। আমি সবার বড়। আমার ওপর অনেক দায়িত্ব।’
ধর্মীয় পার্থক্যের কথা ও আর বলেনা!
আনা খুব অনুরোধ করল, ‘যাওয়ার আগে তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দাও।’
জামিল বলে, ‘এটা সম্ভব না।’
‘তাহলে অন্তত তোমার ছোট বোনের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দাও। ওকে তো আমি দেখি নাই।’
যাবার দিন কুইন্স সেন্টার মলে দেখা হয় আনার সঙ্গে জামিলের ছোট বোন রওশনের। ওরা সারাদিন সেখানে ঘোরাঘুরি করে। কুইন্স মলের সামনে বাস স্ট্যান্ডে বিদায়ের সময় রওশনকে নিতে আসে জামিল। তখন আনা খুব কাঁদে।
বাফেলোতে যাবার সময়ে গাড়িতে হঠাৎ জামিলের খুব কান্না পায়। দীর্ঘদিনের বসবাসের শহর ছেড়ে যাওয়ায় ওর পরিবারের সবার মন খারাপ, তাই জামিলের কান্নার মধ্যে কেউ বিশেষ কিছু খুঁজে পায় না।
শুধু রওশন বলে ওঠে, ‘আব্বু, গতকাল না একটা মেয়ে কাঁদতেছিল ভাইয়ার জন্য।’
জামিলের বাবা প্রশ্ন করেন, ‘কে কাঁদতেছিল? তোমার বোন কি বলছে?’
‘আরে না বাসে একটা মেয়ে কাঁদছিল। আমি চিনিনা। কাঁদছে দেখে স্বান্ত্বনা দিতে গিয়েছিলাম।’
জামিল কথা ঘোরায়। রওশন ছোট বলে ওর কথায় এরপর কেউ আর গুরুত্ব দেয় না।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিকই সুযোগ পায় আনা। ওর গ্রাজুয়েশনের আগে জামিলকে বলে, ‘তুমি নিউইয়র্কে চলে আস। আমার পড়াশুনা শেষ করতে তিন মাস লাগবে। চাকরী নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি চাকরী পেয়ে যাব খুব শিগগির। তারপর আমরা বিয়ে করব।’
তখন জামিল বলল, ‘এখন এটা সম্ভব না। আমার পরিবারকে বোঝাতে পারব না। তাছাড়া আমি নতুন চাকরী শুরু করেছি।’
মেয়ের কষ্ট দেখে মা এরপর জামিলকে বোঝান, ‘দেখ বাবা। আমার মেয়েটা তোমাকে অনেক ভালোবাসে।’
আনারা ছিল দুই বোন। ওর বাবা সিটি জব করতেন। মায়ের ছিল একটি কনভিনিয়েন্ট স্টোর। ওদিকে জামিলের বাবা নিউইয়র্কের চাকরী হারিয়ে বাফেলোতে গিয়েও সংগ্রাম করছেন।
জামিল মুখে না বললেও আনার মা মেরি আন্টি ধর্মীয় পার্থক্যের বিষযটি বুঝতে পারেন, ‘আনা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে আমার আর ওর বাবার পক্ষ থেকে কোন বাধা নেই। আমার মেয়ে যদি মুসলমান হয়ে তোমাকে পায় তাহলেই আমি খুশী। আর তোমাকে হারালে ও খ্রীস্টান থেকেও লাভ নাই।’
জামিল আনার মাকে কিছু উত্তর দিতে পারেনি। তবে আনাকে বলেছিল-
‘আমি বলতে পারি ৫ বছর অপেক্ষা করতে। কিন্তু ৫ বছর পরে যদি সাহস করে না বলতে পারি।’
আনা সেদিন রেগে গিয়েছিল।
‘আমার ধারণা এটা তোমার কাল্পনিক সমস্যা। তোমার পরিবারকে এরকম হতে পারে না। আমার বিশ্বাস ওরা আমাকে মেনে নেবে। দায়িত্ব নাও। কাপুরুষের মতো আচরণ কর না। তোমার কাছে আমার ভালোবাসার কোন মুল্য নাই।’
‘কোন মূল্য না থাকলে কি আমি আসতাম। ভালোবাসা না থাকলেও বন্ধু হয়ে থাকতে চাই।
আনা পড়াশুনা শেষ করে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের চাকরী পায়।
জামিল ছিল মার্কেন্টিংয়ে দারুণ দক্ষ। ও পাশ করে আন্তর্জাতিক এক সংস্থায় উচ্চ বেতনে চাকরী পায়।
আনার মা জামিলকে চাকরী পাবার পরে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আমি তোমার জন্য গর্বিত জামিল প্রাউড। আনার সঙ্গে তোমার কি কথা হয়?’
একটু থেমে আনার মা বলেন, ‘তোমার জন্য ও এখনো বিয়ে করছেনা। এটা স্বীকার করে না। তুমি বোঝালে বিয়ে করবে।’
আনা ওর বিয়ের প্রসঙ্গে জামিলের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। পরে একদিন ফোন করে নিজেই বলে-
‘আমি ওখানে একজন প্রফেসরকে পছন্দ করি। আমি তো দিন দিন তরুণ হব না। তাই বিয়ে তো করতেই হবে। আর তোমার ওপর রাগ করে, বিয়ে করি নাই, এটা ভাবার কোন কারণ নেই। নিজেকে এতো গুরুত্বপূর্ণ ভেব না।’
প্রফেসরের সঙ্গে বিয়ে হয় আনার। আবার বিয়ের দুই বছর পরে দুজনের ডিভোর্স হয়ে যায়। লোকটার উগ্র মেজাজ ছিল। যেটা নরম মনের আনার সঙ্গে যায়নি। তাছাড়া দুজনের মধ্যে পেশাগত দ্বন্দ্ব ছিল।
ডিভোর্স হবার পরে আনার কান্না শুনে জামিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে ছুটে
গিয়েছিল।
আনার মা দেখে শুনে মন্তব্য করেন, ‘বাবা, আমি ওই দিনই বলছিলাম। আমি তো আমার মেয়েকে চিনি। ওর বিয়ের সময় তুমি ছিলে। ডিভোর্সের সময় আবার এসেছ। এটাই ভালোবাসা। বয়স কম ছিল বলে তুমি ভালোবাসা জিনিষটা কি বুঝতে পারনি।’
আনা প্রশ্ন করেছিল-
‘তুমি যে বারবার নিউইয়র্কে আস, তোমার বাবা-মা কোন প্রশ্ন করে না?’
‘ওদের বলি পেশাগত কারণে গেছি। তাছাড়া নিউইয়র্কে তো আমার অনেক বন্ধু বান্ধবও আছে।’
মাসখানেক আগে আনা হঠাৎ একদিন রাতে জামিলকে কল দিয়ে বলে, ‘যদি পার তাহলে নিউইয়র্কে আস। আমি তোমাকে দেখতে চাই।’
জামিল বলল, ‘আমি তো কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি।’
‘তাহলে আমি আসব তোমার ওখানে?’
‘না, না.. তোমার আসার দরকার নাই।’
জামিলকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসে আনা। দীর্ঘ সফরের পর সাধারণত স্টার বাকসে গিয়ে কফি খায় দুজনে। ওরা ড্রাইভ থ্রু থেকে কফি নিচ্ছিল সেদিন। জামালের কাছে খুচরো টাকা ছিল না বলে বকশিস দিতে গিয়ে আনার শরনাপন্ন হয়। আনা ড্রাইভ করতে থাকায় ওর পার্স জামিলের হাতে দেয়। পার্স খুলে জামিল দেখে ওর পুরনো একটা ছবি। প্রথম যেবার কুইন্স মলে দেখা হয়েছিল তখন তোলা!
‘আমার ছবি তোমার ওয়ালেটে?’
‘তাতে কি হয়েছে?’ আনা বলে, ‘আমি তো ছবি তখন থেকেই রেখে দিয়েছি।’
‘আইফোন ফোর যুগে তোলা ছবি!’
প্রস্তরযুগ-নব্যপ্রস্তর যুগের মতো জামিল নিজে নিজে বানিয়েছে আইফোন মডেলের যুগ! আইফোনের নতুন মডেল এলে সেটা কেনা ওর নেশা। নতুন ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে কথা বলা ওর স্বভাব।
ওর কোন সাল মনে থাকে না। কারো সঙ্গে দেখা হলে বলে, ‘তোমার সঙ্গে আইফোন টেন যুগে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল!’ ‘তোমার অফিসে গিয়েছিলাম আইফোন টুয়েলথ যুগে!’
জামিল আনার কাছে জরুরী তলবের কারণ জানতে চায়।
আনা ধীরে ধীরে বলে, ‘আমার তো বয়স প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেছে। আমি তো আর বিয়ে করব না। কিন্তু মা হতে চাই। আমার একটা সন্তান হলে এতো নিঃসঙ্গ লাগবে না।’
‘ভালোই তো।’
‘যেদিন আমি তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, সেদিন থেকে আমি তোমার সন্তানের মা হতে চেয়েছি। আমি জানি খুব ভালো মানুষ। তুমি আমাকে ছেড়ে গেলেও আমি তোমার সঙ্গে সব সময় একটা কানেকশন বোধ করেছি।’
‘তুমি তো আমাকে চিন্তায় ফেলে দিল। আমি এখনই কি বলব। নাকি সময় পাব চিন্তা করার। আগে আমি ভেবে দেখি।’
‘তুমি নিজেও তো বিয়ে করনি! তোমারও একটা সন্তান দরকার। এজন্য ভাবছিলাম, আমরা দুজনে সারোগোসির মাধ্যমে একটা সন্তান নিতে পারি! যে আমাদের দুজনের বন্ধুত্বের স্মারক হয়ে থাকবে। ’
জামিল বুঝতে পারছিল না কি বলবে! বাবার মৃত্যুর পরে জামিল এখন পরিবারের প্রধান। পরিবারের বাধা এখন সেভাবে নেই।
আনাকে কিছু জবাব না দিয়ে ও আটলান্টা ফিরে আসে।
‘হোলা তুই নিউইয়র্ক কিল্লাই গেছত?’
নিউইয়র্ক থেকে ফেরার পরে জামিল সব সময় চিন্তিত থাকে বলে প্রশ্ন করেন মা আমেনা বেগম।
জামিল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব খুলে বলে।
শুনে মা বলছে,‘তোঁয়ার হথা উনিবের পর আঁর রিদয় টুরো টুরো অয় গেয়িয্। ওডা তুই দুক পাইয়ুস যে না?’
মায়ের কথা শুনে জামিল অনেকদিন পরে হাসে।
মা প্রশ্ন করেন, ‘এরাদ্দো কিল্লাই?’
‘আমি ভুল ভেবে এতোদিন আপনাদের কিছূ বলি নাই। নিজে কষ্ট পেয়েছি, আনা আর ওর পরিবারকে কষ্ট দিয়েছি। সবকিছু আমার বোঝার ভুল ছিল।’
জামিলের অশিক্ষিত মা আমেনা বেগম স্পষ্ট করে বলে দেন, ধর্মীয় কারণে বিয়ে না হওয়ার কোন কারণ দেখেন না তিনি।
জামিল ফোন করে আনাকে সব জানায়। ওদের বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত করতে বলেন মেরি আন্টিকে। ফোনে উনি কেঁদে ফেলেন জামিলের কথা শুনে। আনার বন্ধু হিসেবে নয়, জামিলকে উনি সব সময় নিজের ছেলের মতো দেখেন।
অবশেষে পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয় জামিল। ওর ছোট তিন ভাই এতদিনে বিয়ে করে বাবা হয়ে গেছ। ছোট বোন রওশনও এখন এক কন্যা সন্তানের মা!
স্মোক রুম থেকে বের হয়ে লাউঞ্জে যাওয়ার পথে রওশন, তিন ভাই আর ভাইয়ের স্ত্রীদের হাস্যোজ্জল মুখ দেখতে পায় জামিল। মনে হয় কোন কিছু নিয়ে ওরা মজা করছে। ও কাছে যেতে রওশন বলে ওঠে-
‘বাফেলো চলে যাবার সময় আমি বলছিলাম- ভাইয়ার জন্য একটা মেয়ে কাঁদছে! তোমরা তখন আমার কথা বিশ্বাস কর নাই!’
সবাই খুব মজা পায় রওশনের কথায়! এমনকি জামিলের মা নিজেও। বড় ছেলে যে এতোদিনে বিয়ে করতে চাইছে, এজন্য তার আনন্দের সীমা নাই। ভরা সংসারে এই একটাই অপূর্ণতা ছিল ওনার।
আমেনা বেগমের মনে পড়ে যায় বাফেলো যাবার দিন বাসের সেই কথোপকথন ।
‘হেইটা তো মেলাদিন আগের কতা!’
‘আইফোন ফোর যুগের কথা বলছে রওশন!’
জামিল উত্তর দেয়।
‘তাইলে তো তোগো পরিচয় হইছিল আইফোন ফোর কালে আর বিয়া অইতেছে আইফোন ফোরটিন কালে আই!’
আমেনা বেগমের কথায় সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে। মায়ের আনন্দিত মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয়, কি একটা ভুল ধারণা এতোদিন বয়ে চলছিল ও!
লেখক ও সাংবাদিক।
জন্ম ৯ মার্চ, বরিশালের পিরোজপুরে, নানাবাড়িতে। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের পুরো সময় কেটেছে পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। বিয়ের পরে দীর্ঘদিন থেকেছেন ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডে। দেশান্তরী জীবনে বাস করেছেন শুরুতে নিউইয়র্কর সিটির জ্যাকসন হাইটসে ও বর্তমানে এস্টোরিয়ায়। লেখকের লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে এসব স্থানের স্মৃতি। গেন্ডারিয়া মনিজা রহমান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পরে বেছে নেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার মতো নারীদের জন্য অপ্রচলিত এক পেশা। দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন, দৈনিক জনকণ্ঠ ও দৈনিক মানবজমিনে। নিউইয়র্কে আসার পরেও নিজেকে যুক্ত রেখেছেন লেখালেখির সঙ্গে। প্রথম আলো উত্তরের নকশার বিভাগীয় সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি শিক্ষকতা করছেন এস্টোরিয়ার একটি স্কুলে। গেন্ডারিয়া কিশলয় কচিকাঁচার আসর, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, কণ্ঠশীলন ও বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০০৮ সালে প্রথম বই প্রকাশিত হবার পরে এই পর্যন্ত তাঁর বইয়ের সংখ্যা তেরটি।