শারদ অর্ঘ্য প্রবন্ধ: সার্ধ শতবর্ষে ঠাকুর বাড়ির ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণী
জোড়াসাঁকোর ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে ইন্দিরা। তাঁর বাবা বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মধ্যম পুত্র, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভারতের প্রথম আই সি এস। মা , যুগের তুলনায় প্রগতিশীলা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। জোড়াসাঁকোর মেয়ে হয়েও ইন্দিরা বেশি থেকেছেন জোড়াসাঁকোর বাইরে, কলকাতার নানা বাড়িতে। তার শৈশব কেটেছে অভিজাত ঠাকুরবাড়ির বাইরে, বিখ্যাত বাবার সংগে দেশ ভ্রমণে , অথবা জোড়াসাঁকোর বাইরে বাবা- মায়ের পৃথক সংসারে, বিলেতি কায়দায়। তবে পরিণত জীবনে পারিবারিক গন্ডী ছাপিয়ে পরিণত বয়সে নিজের পরিচয় নিজে তৈরি করেছেন । তাঁর লেখার মাধ্যমে বাঙালি পরিচিত হয়েছে এই বিশাল সংষ্কৃতি- মনস্ক পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাস যা বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক বিরাট বিস্ময়কর কালপর্ব সৃষ্টি করে গেছে।
জন্মেছিলেন ১৮৭৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর , বিজাপুর জেলার কালাদগি শহরে। বাবা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শুধু প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান ছিলেন না, ছিলেন , আদি ব্রাহ্ম সমাজের অনুরক্ত ভক্ত, ব্রহ্মসঙ্গীত রচয়িতা, সঙ্গীতজ্ঞ, সংষ্কৃত ভাষায় সুপন্ডিত। মা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, আট বছর বয়সে যার বিয়ে হলেও স্বামীর নির্দেশে, উৎসাহে হয়ে উঠেছিলেন মুক্তমনা, নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সপ্রতিভ নারী।
ইন্দিরা ছিলেন দীর্ঘায়ু (১৮৭৩-১৯৬০)। সাতাশি বছরের জীবন পেয়ে লিখেছেন তাঁর আত্মকথা, অনুবাদ, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, চিঠিপত্র ইত্যাদি, এ সবই বাংলার সংষ্কৃতির উজ্জ্বল সম্পদ। ‘স্মৃতিসম্পুট’ , ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ ‘রবীন্দ্র-সংগীতের ত্রিবেণীসংগম’ প্রভৃতি গ্রন্থের দে মাধ্যমে তিনি আমাদের আরো গভীর, অন্তরংগ ভাবে চিনিয়েছেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি আর রবীন্দ্রনাথকে। ইন্দিরা আর বিয়ের আগে ভাবী স্বামী প্রমথ চৌধুরীকে লেখা চিঠিগুলিও প্রেমের সুরভি মাখা বাঙালির মেয়ের পত্রসাহিত্যের অসামান্য নমুনা।
শৈশবে কিছুকাল কেটেছে বিলাতে। সাহেবী কায়দায় মানুষ হলেও বাঙ্লা শিখেছেন মায়ের উৎসাহে । বিলেত যাবার তিন বছর পর কলকাতায় ফিরে এসে তারা আর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে উঠলেন না। বাবা বদলির চাকরির সুবাদে মুম্বাই প্রদেশে থাকতেন ,আর মা সংসার পাতলেন কলকাতার ইংরেজ পাড়ায় ভাড়াবাড়িতে । কলকাতায় ইন্দিরাকে ভর্তি করা হল লরেটো কনভেন্টে । সময় ১৮৮১ সাল। বাবা সত্যেন্দ্রনাথ উৎসাহ দিতেন ক্লাসিক ইংরেজী বই পড়ার জন্য। আর সাত বছর বয়সেই মা কোলে করে বসিয়ে ভারতী পত্রিকা পড়াতেন। লরেটো কনভেন্ট থেকে ১৮৮৭ সালে এন্ট্রান্স পাশ করার পর সমবয়সী বোন সরলার মত বেথুন কলেজে বা অন্য কোন কলেজে পড়েন নি ইন্দিরা। প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে এফ এ ও পরে ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে বি. এ. পরীক্ষায় ইনি ইংরেজিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পেলেন পদ্মাবতী পদক। লা মার্টিনিয়ারের এক শিক্ষকের কাছে ফরাসি ভাষায় তালিম নিতেন । ১৮৯২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসী ভাষায় বি এ পাশ করেন । ঠাকুর বংশের মেয়েদের মধ্যে প্রথম বি এ ডিগ্রিধারী ইন্দিরা। “১৮৮২ থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত মাত্র বারোজন মহিলা গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন, ইন্দিরা তেরো নম্বর,” ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’-এ জানাচ্ছেন চিত্রা দেব।
ছোট থেকেই ইন্দিরা স্বচ্ছন্দে গান গাইতে পারতেন । “রবীন্দ্র সঙ্গীতে ত্রিবেণী সঙ্গম “ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন , খুব ছোটবেলায়, বাবা সত্যেন্দ্রনাথ তখন থাকতেন সমুদ্র শহর কারোয়ারে। সেখানে একদল নর্তকীর মুখে শোনা কয়েকটি কানাড়ি গান শিখেছিলেন । রবিকা সেখানে তাঁর বিয়ের আগে বেড়াতে এসে গান গুলি শুনে বিখ্যাত তিনটি গান রচনা করেন । “বড় আশা করে “, “আজি শুভদিনে পিতার ভবনে” আর” সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে”। কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গান-বাজনার চর্চা ছিল। সাহেব পাড়ায় থাকলেও পারিবারিক জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যাতায়াত ছিল। ইন্দিরার মনে ছিল তার আর তার দাদার তেরো চোদ্দ বছর বয়সে, অর্থাৎ ১৮৮৭ সাল নাগাদ বদ্রিদাস সুকুল নামে এক হিন্দুস্থানী ওস্তাদ তাকে ও তার দাদাকে তেতলার ছাদে হিন্দি গান ও সেতার শেখাতে আসতেন । শিখেছিলেন বেহালা বাজাতেও । পারিবারিক অনুষ্ঠান মাঘোৎসবে গান গাওয়ার ডাক পড়ত। বালিকা বয়স থেকেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দু ধরণের সঙ্গীতেই পারদর্শিনী হয়েছিলেন । ইন্দিরার দেবীর নিজের কথায়, “আমার বিলিতি সংগীত-প্রীতি অবশ্য লরেটো কন্ভেন্টের শিক্ষাজনিত। সেখানে সেন্ট, পলস ক্যাথিড্রালের অর্গানিস্ট, মি. শ্লেটারের কাছে পিয়ানো, এবং মান্জাটো নামক এক ইতালীয় বেহালা-শিক্ষকের কাছে বেহালা শেখার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল । তখনকার কালে কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ অফ মিউজিক থেকে গানের উপপত্তিক প্রশ্ন এ দেশে পাঠানো হত । তার ইণ্টারমিডিয়েট পৰ পর্যন্ত আমি পাস করেছিলুম |” আআর স্মরণ করেছেন ,—আমি রবিকাকার কাছে আলাদা ক’রে বসে কখনো গান শিখেছি বলে মনে পড়ে না। কেবল বাড়িময় হাওয়ায় হাওয়ায় যে গান ভেসে বেড়াত তাই শুনে শুনে শিখেছি । পরবতীকালে বরং আমার বালিগঞ্জের কমলালয় বাড়িতে পিয়ানোর কাছে বসে তিনি আমাকে দু-একটা গান শেখাতে চেয়েছেন বলে মনে পড়ে, যেমন, “কে গো অন্তরতর সে” প্রভৃতি । আর, আমার গান শিখতে দেরি হয় বলে মন্তব্য করায় আমি একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছিলুম। দিনু এবং খুকু (অমিত সেন ) যেরকম তাড়াতাড়ি গান শিখত শুনেছি তার তুলনায় আমাদের ষে ঢিমে তেতাল৷ মনে হবে তার আর আশ্চর্য কি” । গান শিখেছেন আরো কত লোকের কাছে । বাড়ির বাইরের এক অনামা ভদ্রলোকের কাছে শেখা হিন্দুস্থানী রাগ সঙ্গীত, “ চাঁচর চিকুর আধো” রবিকা –কে শোনাতে তিনি নির্মাণ করলেন বিখ্যাত গান “বেঁধেছ প্রেমের পাশে” । এমনকি কাশীতে বিখ্যাত সরস্বতী বাইএর কাছেও গান শিখেছেন । রবীন্দ্রস্মৃতি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন তাঁকে গান শিখিয়েছেন স্বয়ং অতুল প্সাদ সেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। দ্বিজেন্দ্রলাল এর “বঙ্গ আমার জননী আমার, আর কেন মা ডাকছ আমায়, পাগলকে যে পাগল ভাবে, একই ঠাঁই , চলেছি ভাই, আমার আমার বলে ডাকি” –। এসব গান নিজে ইন্দিরাকে শিখিয়েছেন । শৈশবে পিয়ানো , সেতার , বেহালা বাজাতে শিখেছিলেন । পিয়ানো বাজানো ইন্দিরা ছাড়েন নি, বুড়ো বয়সেও বাজাতেন ।
গান ছাড়াও খুব ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন । প্রথমে হাত দেন মৌলিক লেখা নয়, অনুবাদ রচনায়। ১২৯২ বঙ্গাব্দে জন রাস্কিন এর লেখা ইংরেজি থেকে বাঙ্লায় অনুবাদ করেছিলেন নিতান্ত অল্প বয়সেই। সে লেখা প্রকাশিত হয় মা জ্ঞানদানন্দিনী সম্পাদিত “ বালক পত্রিকায়। তবে লেখক হিসেবে নাম ছিল শ্রীমতী ইঃ , পুরো নাম প্রকাশিত হয়নি। পরে ফরাসি শিখে কিছু ফরাসী বই এর বাঙ্লা তর্জমা করেছিলেন ।এ তালিকায় ছিল পরিচয় পত্রিকায়, রেনে গ্রুসের ভারতবর্ষ, সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত পিয়ের লোতির গল্প ও ভ্রমণ কাহিনীর অনুবাদ ( কমল কুমারিকাশ্রম এবং মাদাম লেভির ভারতভ্রমণ কাহিনী) ইত্যাদি। তবে তাঁর এই অনুবাদ কর্মের নৈপুণ্য লোকের মনোযোগ দাবি করল যখন তিনি রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা, গল্প , প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদ করলেন । অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের জাপানযাত্রীর ডায়েরি ।দার্জিলিঙে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনীর ইংরেজি অনুবাদ করছেন সত্যেন্দ্রনাথ, “বাবার সঙ্গে আমিও অনুবাদে হাত লাগিয়েছিলুম,” লিখেছেন মেয়ে ইন্দিরা। অনেক মৌলিক লেখাও লিখেছেন । সবুজপত্রে আঁদ্রে জিদ এর রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ফরাসী অনুবাদের গ্রন্থে ভূমিকার ফরাসি লেখাটি বাঙ্লায় অনুবাদ করেন। দিনলিপিতে জানিয়েছেন , জীবনের শেষ ভাগে ফরাসী শিল্পী ও শিল্প সমালোচক আঁদ্রে কার্পেলের লেখা ফরাসি থেকে বাঙ্লায় অনুবাদ করেন । বামাবোধিনী, বঙ্গলক্ষ্মী, সাধনা, পরিচয়, সবুজপত্র প্রভৃতি পত্রিকায় সঙ্গীত ও সাহিত্যবিষয়ে তার অনেক মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয়। বঙ্গনারীর শুভাশুভ বিষয়ে তার মতামত নারীর উক্তি নামক প্রবন্ধটি ছাপানো হয়। দুটি বিশেষ মৌলিক কবিতার উল্লেখ এখানে করা যায়। যে বছর রানী ভিক্টোরিয়া মারা যান , বড় ননদের অনুরোধে বামাবোধিনী পত্রিকায় কাঁচা ভাবলেশহীন প্রবন্ধ লিখেছিলেন । পরে ভারতীতে “মারাঠী পানসুপারি “ নামে নিয়ে লিখেছেন, সরলা দিদির অনুরোধে। তবে এই অনুবাদের কাজে তাকে ছোটবেলা থেকে উৎসাহ যুগিয়েছেন রবিকাকা । প্রায়ই তিনি ইংরেজি থেকে বাংলা তর্জমা করে ছোট্ট মেয়েটিকে শোনাতেন ।
গান , লেখালেখি, অনুবাদের সূত্রে রবিকাকার সঙ্গে কিশোর বেলা থেকেই নিবিড় সখ্য হয় তার রবিকাকার, সে তীব্র সখ্য পরিবারের আর কারোর সঙ্গে হয়নি। রবিকা তাঁকে জন্মদিনে সস্নেহ উপহার দেন একটি দোয়াতদানি, পিয়ানোর মতো গড়ন। সঙ্গে লেখা দু’ছত্র, সেও তাঁর হাতের স্পর্শে উজ্জ্বল: “স্নেহ যদি কাছে রেখে যাওয়া যেত/ চোখে যদি দেখা যেত রে,/ বাজারে-জিনিস কিনে নিয়ে এসে/ বল দেখি দিত কে তোরে।”
চিরকাল তিনি ছিলেন রবীন্দ্র স্নেহধন্যা। রবীন্দ্রনাথ প্রভাত-সঙ্গীত উৎসর্গ করেন তাঁকে। উৎসর্গপত্রে লেখা হয় : ‘শ্রীমতী ইন্দিরাদেবী/ প্রাণাধিকাসু/ রবিকাকা’। রবিকার চোখে প্রাণাধিক হয়ে ওঠার যোগ্যতা ইন্দিরার হয়েছিল, অশেষ গুণবতী হয়েও যা হয়ে উঠতে পয়ারেন নি ভাগ্নী সরলা। কড়ি ও কোমলের একাধিক কবিতায় , ছিন্ন-পত্রাবলীর পত্র সম্পদে তাঁর স্নেহ নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। রবিকা তাঁকে নানা জায়গা থেকে চিঠি লেখেন এমনকি কবিতা-চিঠিও— তিনিও সে সব চিঠি শুধু গুছিয়েই রাখেন না, সংরক্ষণ করেন রীতিমতো, দুটো মোটা খাতায় পরে লিখে রাখেন সেই সব চিঠির বয়ান। সেই তো অমূল্য ‘ছিন্নপত্রাবলী’-র হয়ে ওঠা’র ইতিহাস! ঠাকুর বাড়ির কত প্রতিভাবান যোগ্য মানুষের মাঝে শুধুমাত্র ইন্দিরাকেই লেখেন, “তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যেরকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আর কোনো লেখায় হয়নি।… যদি কোনো লেখকের সব চেয়ে অন্তরের কথা তার চিঠিতে প্রকাশ পাচ্ছে তা হলে এই বুঝতে হবে যে, যাকে চিঠি লেখা হচ্ছে তারও একটি চিঠি লেখাবার ক্ষমতা আছে।”
ইন্দিরার বিবাহ হয় ব্যারিস্টার সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরির সঙ্গে। ইন্দিরা –প্রমথর সংসারে অনটন হাজির হয়েছিল পেশাগত দিকে প্রমথর ক্রমিক অসাফল্যে এবং ইন্দিরার গৃহিণীপনার অভাবে।আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে এসেছিল। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি, দেনা অনেক। নিঃসন্তান এই দম্পতি শেষ জীবনে শান্তিনিকেতনে বসবাস করেন । এই সময় থেকে আমৃত্যু শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী এবং বিশেষ করে ‘সংগীত ভবন’-এর জন্য তিনি অবিশ্রান্ত ভাবে কাজ করে গেছেন । তিনি ছিলেন সঙ্গীত ভবনের প্র-নেত্রী,
বিশ্বভারতী স্বরলিপি সমিতির সদস্য। আটষট্টি বছরে পোঁছে সঙ্গীতভবনে নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষাদান শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুবনমোহিনী পদক পেলেন । বিশ্বভারতীর উপাচার্য প্রবোধচন্দ্র বাগচীর ১৯৫৬ সালে হঠাৎ প্রয়াণের পরে, তিন মাসের জন্য উপাচার্যের কাজ সামলেছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী— ১৯৫৬ সালের ২৮ মার্চ থেকে ৩০ জুন, তিনিই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে বিশ্বভারতী থেকে ডি-লিট উপাধি পেয়েছিলেন , বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম উপাধিও লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে রবীন্দ্র-ভারতী সমিতি থেকে পেলেন রবীন্দ্র-পুরস্কার।
রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল তাঁর প্রাণ, যদিও রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শেখেননি। কিন্তু তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল রবীন্দ্রসুরের শুদ্ধতার যেন যথাযথ ভাবে লালিত হয়, সংরক্ষিত থাকে। তাঁর-ই চেষ্টায় উদ্ধার হয়েছিল ‘ভানুসিংহের পদাবলী’-র (ভানুসিংহের গান সাজিয়ে নাট্যরূপ) পুরনো গীতিনাট্যরূপ, পুরনো ‘ভারতী’ পত্রিকা থেকে ‘কালমৃগয়া’-র গানের লিপ্যন্তর। মায়ার খেলা, ভানুসিংহের পদাবলি এবং কালমৃগয়া সমেত রবীন্দ্রনাথের প্রায় দুশটি গানের স্বরলিপি তিনি করেছিলেন । ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’র বেশ কিছু গানের হারিয়ে যাওয়া সুর স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে স্বরলিপি করেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের শুদ্ধ ধারাটি বহমান রাখার কাজটি অত্যন্ত সুচারু ভাবে সম্পাদন করেছিলেন । একসময় রবীন্দ্রনাথের গানের ‘ভান্ডারি’ হিসাবে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সুপরিচিত। ১৯৩৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সেই বহমান ধারায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে, বিশেষত জীবনের শেষ দুই দশকে বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবন , রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে ভাবনা পরিকল্পনা এবং কাজের ব্যাপ্তি সামলে ইন্দিরা দেবী হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্র গানের সার্থক কাণ্ডারি।
রবিকার লেখার অনুবাদ করা ছাড়াও নিজেও মৌলিক লেখা বেশ কিছু লিখেছেন ।সম্পাদনা করেছেন কিছু গ্রন্থ যেমন বাংলার স্ত্রী-আচার (১৯৫৬)পুরাতনী (১৯৫৭ ) গীতপঞ্চশতী, প্রমথ চোধুরি সহযোগে হিন্দু সঙ্গীত (১৩৫২) লিখেছেন একাধিক ব্রহ্ম-সঙ্গীত, কবিতা। । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুদীর্ঘ কাল যুক্ত থাকার ফসল , “রবীন্দ্রস্মৃতি ( ৫ খন্ড ১৯৫৯) ্র মূল উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-কথন । আর দু খন্ডের “স্মৃতি সম্পূট “এর মারফত বাঙালিকে চিনিয়েছেন তাঁর সমকালকে।
প্রিয় রবিকার জন্ম শতবর্ষ উদযাপন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ তাঁর হয়নি। মাত্র এক বছর আগে ১৯৬০ সালের ১২ই অগাস্ট তিনি প্রয়াত হন । তবে নিজেকে নিঃ শেষ করে প্রিয় কাকার সৃজন সম্ভারে মগ্ন থাকাই ছিল তাঁর জীবন –বেদ। আপামর বাঙালি এ কারণে তাঁর কাছে ঋণী হয়েই আছেন ।
তথ্য সূত্রঃ
১। চিত্রা দেব, ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’
২। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, “রবীন্দ্র সঙ্গীতে ত্রিবেণী সঙ্গম “
৩। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, ‘স্মৃতিসম্পুট’ প্রথম খন্ড
৪। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, ‘স্মৃতিসম্পুট’ দ্বিতীয় খন্ড
৫।ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, রবীন্দ্রস্মৃতি

শিক্ষক,কথাসাহিত্যিক