শারদ অর্ঘ্য গল্প: ঘন্টাদার কীর্তি । প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ
ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে তখনই বুঝলাম আমরা ভুল রাস্তায় এগোচ্ছি। স্টেশনের নেমপ্লেটে লেখা আছে মেটাল শহর। অর্থাৎ এই পথ যাচ্ছে বোকারোর দিকে। অথচ আমাদের গন্তব্য পুরুলিয়া।
ঝপাং করে প্লাটফর্মে লাফিয়ে নামল ঘন্টাদা। কাঁধে ঝোলাব্যাগ। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। ট্রেন থেকে নেমেই একদফা আড়মোড়া ভেঙে খুব রোয়াবের সঙ্গে চেঁচিয়ে বলল ঘন্টাদা,
—‘নাম নাম, জলদি নাম। আলিস্যি আর কাটে না তোদের। আমাদের তো আবার ট্রেন ধরতে হবে নাকি!’
আসলে আমরা যে ঘন্টাদার জন্যই ভুল রাস্তায় এসেছি সে কথা কিছুতেই মানতে নারাজ ঘন্টাদা। উপরন্তু আমাদের ওপরেই যত হম্বিতম্বি। এমন হাবভাব যেন আমাদের জন্যেই বিপদে পড়েছেন তিনি! যাইহোক, মুখ বেজার করে আমি আর বুবুন নেমে এলাম ট্রেন থেকে।
মেটাল শহরের আগের স্টেশন আদ্রা। সেখানে ট্রেন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে এক অংশ গেছে পুরুলিয়ার দিকে আর অপর অংশের যাত্রাপথ বোকারোমুখী। আমরা সেই দ্বিতীয় অংশের হতভাগা যাত্রীগণ। আদ্রা স্টেশনে গাড়ি যে ইঞ্জিন পাল্টে বগি আলাদা করে ফেলতে পারে সে সম্পর্কে কোনো ধারনাই ছিল না আমাদের। কারণ আমরা এ অঞ্চলে নতুন। কিন্তু যার ধারনা থাকার কথা সে হল আমাদের ঘন্টাদা। কেননা তার বক্তব্য অনুযায়ী ঘন্টাদা এই অঞ্চলটাকে হাতের তালুর মতো চেনে। তার ওপর আজ বিকেলেই পুরুলিয়ার এক সাহিত্যের সেমিনারের প্রধান বক্তা ঘন্টাদা স্বয়ং। সুতরাং তাঁরই আমন্ত্রণে ও ভরসায় আমাদের এই পুরুলিয়া অভিযান। আমরা তিনজন। আমি অর্থাৎ নিমকি, বুবুন আর ঘন্টাদা।
ঘন্টাদা প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ পায়চারি করে এদিক ওদিক ঘুরে বেশ গাম্ভীর্য নিয়েই আমাদের বলল,
—‘বেশ ভালোই হয়েছে বুঝলি, ভুলবশত এদিকে চলে আসায় তোদের এদিকটাও একটু চিনিয়ে দিতে পারছি। তবে তোদের নিয়ে তো যাওয়া নয়, পিঠে যেন একবস্তা বোঝা…।’
ঘন্টাদার এই শেষ কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল বুবুন।
—‘নিজে ভুল করে আমাদের ওপর চোটপাট করছ কেন বলত! আর তুমি বলেছ বলেই তো এসেছি…!’
বুবুন আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে কোনোক্রমে থামিয়ে আমি বললাম,
—‘ও সব বাদ দাও ঘন্টাদা, আমাদের তো আবার ব্যাকে যেতে হবে। এখানে কখন ট্রেন আছে তুমি জানো?’
ঘন্টাদা আমার কথায় কোনো পাত্তা না দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে বলল,
—‘তোদের এত কথা বলতে কে বলেছে? আমি যেদিকে নিয়ে যাব সেদিকে যাবি। এত কথা আমার সহ্য হয় না।’
আমরা দু’জনেই চুপ। তারপর কিছুক্ষণ থেমে ঘন্টাদা নিজেই বলে উঠল,
—‘এ—ই ট্রেন ঢুকল বলে।’
সুতরাং স্টেশনের কাঠের বেঞ্চে আমরা বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম ট্রেনের আশায়। পনের মিনিট থেকে আধঘন্টা, তারপর একঘণ্টা। শূন্য স্টেশন। লোকজন একেবারে নেই বললেই চলে। এদিকে ট্রেনেরও কোনো পাত্তা নেই।
ঘন্টাখানেক কাটতে চলল। সারারাত জার্নির পর এমন হুট করে ভুল পথে চলে আসা মোটেই সুখদায়ক নয়। তবুও একটা ছোট্ট নিঝুম স্টেশনে বসে বসে আমি উপলব্ধি করতে লাগলাম রাঢ় বাংলার সৌন্দর্য, তার নিজস্ব গন্ধ। চারিদিকে সবুজ জঙ্গল। লালমাটির ঢিবি। অদূরে একটা বড় গাছে উড়ে এসে বসেছে অসংখ্য সাদা বক। কী অপরূপ সে দৃশ্য। আমি বিভোর হয়ে দেখছি। হঠাৎ আমার চমক ভাঙল বুবুন আর ঘন্টাদার খিটিমিটিতে। এইমাত্র এক স্থানীয় লোকের কাছ থেকে জানা গেছে এখান থেকে আদ্রা যাবার ট্রেন এখন কেন, চার-পাঁচ ঘন্টার মধ্যেও নেই। অগত্যা প্ল্যাটফর্ম থেকে নিচে নেমে আসলাম আমরা। সামনে চলে গেছে লাল মাটির রাস্তা। দিগন্ত ছুঁয়েছে পলাশ গাছের সারি। চারিদিক শুনশান। কোনো দোকানপাটও তেমন চোখে পড়ল না। সমস্যা হল, এবার কী করব! বিকেলে ঘন্টাদার সেমিনার। তার আগেই পুরুলিয়া পৌঁছতে হবে আমাদের। কিন্তু সঠিক সময় আদ্রার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে না পারলে পুরুলিয়াগামী ট্রেনও হাতছাড়া হবে নিঃসন্দেহে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে রাস্তায় নেমে আসলাম আমরা। দূর থেকে দেখতে পেলাম একটা টোটো স্টেশনের দিকেই আসছে। যাক, কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এমন সময় ঘন্টাদা বলে উঠল,
—‘নো চাপ দোস্তো, ওই যে টোটোটা দেখছিস ওটা চড়েই আমরা আদ্রা যাব।’
কথা শেষ করেই টোটোর দিকে এগিয়ে গেল ঘন্টাদা। টোটোঅলাকে একবার হাঁক দিয়ে ডাকতেই টোটো নিয়ে আমাদেন সামনে এসে দাঁড়ালেন মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক। তারপর ভাড়া নিয়ে বেশ দর কষাকষির পর আমরা চেপে বসলাম টোটোয়। রওনা দিলাম আদ্রার উদ্দেশ্যে।
টোটোতে তো চাপলাম। কিন্তু গণ্ডগোলটা এইবার শুরু হল দ্বিগুন আকারে। আঁকাবাঁকা এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি আমাদের গন্তব্যে। কখনো মাঠের ওপর দিয়ে, কখনো বা সরু জংলা পথ ধরে। আবার কখনো চড়াই উতরাই। মাঝে মাঝেই গাড়ির চাকা ভাঙা গর্তে পড়তেই আমাদের কোমড় খুলে যাবার যোগার হল। ঝনাৎ ঝনাৎ করে ডান্সিং টোটোয় আমাদের সর্বাঙ্গ চলেছে এক্সারসাইজ করতে করতে। তাও একপ্রকার মেনে নেওয়া যায়। অন্তত গন্তব্যে পৌঁছনোর একটা উপায় তো পাওয়া গেছে। এদিকে মহা ফ্যাঁসাদে পড়ল আমাদের ঘন্টাদা। টোটোর প্রবল ঝাঁকুনিতে এইবার শুরু হল তার ঊর্ধ্বচাপ নিন্মচাপের তাড়না। প্রথমে ঘটনার গুরুত্ব না বুঝেই বুবুন একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেও ঘন্টাদার অমন তেজস্ক্রিয় মুখের কাঁচুমাচু চেহারা দেখে আমরাও অসহায় হয়ে পড়লাম। টোটো তখন শ্লথ গতিতে এগিয়ে চলেছে আদ্রার উদ্দেশ্যে। ঘন্টাদা আর থাকতে না পেরে নিরুপায় কণ্ঠে অনুনয় বিনয়ের ভঙ্গিতে বলল,
—‘আর যে পারছি না রে নিমকি। কিছু একটা কর ভাই। কোথাও দাঁড়াতে বল…।’
—‘কিন্তু এখানে– এভাবে– মাঝরাস্তায়– কীভাবে সম্ভব…!’
আমতা আমতা করে আর কিছু উপায় না পেয়ে টোটোঅলা কাকুকে সবকিছু খুলে বললাম আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্যার একটা সমাধান পাওয়া গেল। একটা জঙ্গলের পাশে টোটো দাঁড় করাতেই সাঁই করে টোটো থেকে নেমেই ঘন্টাদা ছুট লাগাল সেদিকে। ব্যাস সমস্যা থেকে কিছুটা নিস্কৃতি। কিন্তু সমাধান কী এত সহজে হয়! একেই পেটরোগা মানুষ ঘন্টাদা, তার ওপর গতকাল রাতের রুমালি রুটি আর কষা মাংসের অ্যাকশন তো চলবেই।
টোটো করে কিছুটা যেতেই আবার পেট চেপে বসে ঘন্টাদা। বিবর্ণ মুখে অসহায় ভাবে বলে,
—‘আবার যে মোচড় দিচ্ছে ভাই…’
ঘন্টাদার এই পরিস্থিতিতে বুবুনও এবার অসহায় বোধ করে।
—‘একটু কষ্ট করে বসো ঘন্টাদা। মনে হয় স্টেশন আর বেশিদূর নয়…’
সান্ত্বনা দেয় বুবুন। সত্যিই তাই, মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম আদ্রা স্টেশনে। স্টেশনে উঠেই জানতে পারলাম, পুরুলিয়ার ট্রেনের খবর হয়েছে এইমাত্র। ঘন্টাদা সে সব তোয়াক্কা না করেই বুবুনের হাতে থাকা মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা ছোঁ মেরে নিয়ে ছুট দিল বাথরুমের খোঁজে। যাইহোক অবশেষে আমরাও নিশ্চিন্ত হলাম কিছুটা।
ঘন্টাদা গেছে তো গেছেই। এদিকে পুরুলিয়াগামী ট্রেন প্রায় ঢোকে ঢোকে। স্টেশনে লোকের ভিড়। দূর থেকে হর্ণ শোনা যাচ্ছে ট্রেনের। আমি আর বুবুন ঘন্টাদার বাথরুমের সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে।
—‘কী গো ঘন্টাদা, আর কতক্ষণ? ট্রেন যে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে।’
—‘এই তো হয়ে গেছে।’
এতক্ষণে ভিতর থেকে উত্তর আসল ঘন্টাদার।
টেনশনে নখ কামড়াতে লাগলাম আমি, আর ক্রমাগত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছি দরজায়। পারলে সেই মুহূর্তেই বাথরুমের দরজা ভেদ করে ঢুকে যেতাম আমরা ভেতরে। কিন্তু উপায় নেই। দরজা ভেতর থেকে শক্ত করে বন্ধ।
এরপর ট্রেন এসে থামল প্ল্যাটফর্মে। কিছুক্ষণ সময় অপেক্ষা করে যথারীতি আবার ছেড়ে চলেও গেল। আমাদের সামনে দিয়ে একটা-দুটো-তিনটে করে চলন্ত বগিগুলো আস্তে আস্তে উধাও হতে লাগল। একসময় প্রবল হুঙ্কার তুলে একনিমেশে ভ্যানিস হয়ে গেল আদ্রা স্টেশন থেকে পুরুলিয়াগামী ট্রেন।
![প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2020/03/priyanjali-debnath-150x150.jpg)
কবি, গল্পকার
সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম তরুণ গল্পকার প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ। বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি লিখেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। সুখবর, যুগশঙ্খ, মাসিক কৃত্তিবাস,অবগুণ্ঠন,অন্য একলব্য,উৎসব,আদৃতা,ক্লেদজ কুসুম,আমি অনন্যা,তমসা,পারক,শতানীক -এর মতো অনেক ছোট বড় পত্রিকায় স্থান পেয়েছে কবিতা, গল্প, অণুগল্প ও ভ্রমণকাহিনি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রিয়াঞ্জলি স্নাতকোত্তর বাংলাভাষা ও সাহিত্যে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শব্দের অরণ্যে আরও এক ক্রোশ ‘ ও প্রথম অণুগল্পের বই ‘এবং করোনাসুর বধ’। ভ্রমণপিপাসু মন। রং তুলিতে যাপিত হয় প্রিয়াঞ্জলির অবসর সময়।