শারদ অর্ঘ্য ভ্রমণ: চেঙ্গী নদীর পাড়ে । জিললুর রহমান
২৯ এপ্রিল ২০২২
শুক্রবার সকাল থেকে অনিশ্চিত, তাই কাউকে কিছুই বলতে পারছিলাম না। দুপুরে কমলের প্রত্যাশিত ফোনটি এলো। তারপর তড়িঘড়ি বাচ্চাদের তৈরি হয়ে নিতে বললাম। রুমি তো আগে থেকেই আমার অস্থিরতা টের পেয়েছে, তাই সে আংশিক প্রস্তুত ছিল। যাই হোক আধঘন্টার মধ্যে সবার পিছে একটি ব্যাকপ্যাক শোভা পাচ্ছিলো। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। না, কমল এবার সঙ্গী নয়, সে কেবল আমাদের রাত্রিযাপনের স্থান নিশ্চিত করেছে। আমরা হাটহাজারী রোড ধরে এগিয়ে যাই নাজিরহাটের দিকে। মাইজভাণ্ডার শরীফের তোরণ বাব-এ-শাহেনশাহ পেরিয়ে সরকার হাট এবং একসময় বিবির হাটও পেরিয়ে যাবার পরে প্রকৃতি ময়ুরের মতো পেখম মেলে ধরলো। পাহাড়ী লাল মাটি, দুই পাশের রাবার বাগান, একটা চা-বাগান — এসব অতিক্রম করতে করতে যাই। মসৃণ সর্পিল রাস্তা তরুণীর দেহভঙ্গির মতো ক্রমশ হেলে দুলে আসতে লাগলো আমাদের দিকে। না, আমরাই আসলে এগিয়ে যেতে লাগলাম এই অদ্ভুত মায়াবী উঁচুনিচু সর্পিল সড়ক শরীরের আকর্ষণে। সবুজের হাতছানি আমাকে এমন অবশ করে রাখছিলো যে, আমার গাড়ির গতি শ্লথ হয়ে যায়। আমি বিকেলের তেজহীন আলোর মায়ায় গাছের উচ্ছ্বলতা দেখতে দেখতে চলি। এদিকে অপেক্ষাকৃত কম গতির বেবিট্যাক্সিগুলো আমারে ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছে একের পর এক। একসময় ভূজপুর পেরিয়ে আমরা পৌঁছতে যাই মানিকছড়িতে। মানিকছড়িতে মণিমানিক্যের ছড়াছড়ির হয়তো একদা ছিলো, এখন তো দেখছি দু’পাশে কেবল বাঙালি নিবাসের চিহ্ন। শুনেছি এখানে একটা রাজবাড়ি রয়েছে, অন্য কোন একদিন সেই রাজবাড়ির সুলুক সন্ধানে বেরোতে হবে। কিছুদূর এগিয়ে যেতে আমরা প্রবেশ করি মাটিরাঙায়। আমাদের অভ্যর্থনা জানালো শতবর্ষী বটবৃক্ষ। মনে পড়ে গেল, ২০০৫ সালে দেবাশীষ দা সহ আমরা এই বটবৃক্ষ তলে খানিক জিরিয়েছিলাম। যতোটুকু মনে পড়ে, অনুভা অদিতা এই গাছের গুঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার প্রয়াস পেয়েছিল। আজও “তিষ্ঠ ক্ষণকাল” হয়ে বটগাছের সাথে কিছুটা জড়িয়ে নিলাম স্মৃতি। দেখা যাচ্ছে, শতবর্ষ আগে যেমন মেলা বসতো, এখনও মেলা জমে এই গাছ ও তার আশপাশের চত্বর ঘিরে। ক’দিন আগেই যে পহেলা বৈশাখের নববর্ষ উদযাপন এখানে হয়েছে তার চিহ্ন পরিষ্কার বিদ্যমান। তবে, বটগাছ এলাকার পরে মাটিরাঙ্গা সদর বেশ ঘিঞ্জি হয়ে পড়েছে। কিছু ভিড়ভাট্টা ঠেলে আমাদের এগুতে হলো। কিন্তু সামান্য এগুনোর পর প্রকৃতি আবারও সেই সবুজ, সেই আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ। মাটি তো মানিকছড়ি থেকেই রাঙা, রাঙামাটির মাটিও রাঙা, কিন্তু এই অঞ্চল বিশেষ কোন কারণে মাটিরাঙ্গা নামে খ্যাত, তা নৃতাত্ত্বিক বা নৃপতিগণ জানবেন, আমি আদার বেপারী, এসব বুঝতে পারি না। মাটিরাঙ্গায় একটা জায়গার নাম তিনটহরী। নামটা রুমির খুব পছন্দ, কিন্তু গতির আনন্দে আর এখানে থামার সুযোগ হলো না। মাটিরাঙ্গা বেশ বড় এলাকা। পথের বাঁকের কৌণিকতা তো আছেই। তবে একসময় সকল পথই অতিক্রান্ত হয়, যেমন জীবনের পথও আমাকে টানতে টানতে প্রৌঢ়ত্বের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আজ আমরাও একসময় মাটিরাঙ্গা পার হয়ে পৌঁছে যাই গুইমারা এলাকায়। অনেকক্ষণ চলতে চলতে অদিতা প্রশ্ন করলো, গুইমারা এতো বড় কেন? আমি মনে মনে ভাবছিলাম, নামটা গুইমারা হলো কেন! অনেক ভাবতে ভাবতে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছি, যে এখানে কোন একটা গুইসাপকে মারা হয়েছিলো নিশ্চয়। অদিতার উত্তরে তাই বললাম, বিশাল গুইসাপ মারা হয়েছিল, তাই। জানি এত বড় গুইসাপ এনিমেশনেও অসম্ভব।তাই আমার এসব খেলো কথায় কন্যারা দু’পয়সার গুরুত্ব দেয় না। তবু আমি বলতে থাকি। শব্দের সাথে মিলিয়ে কিছু একটা ব্যুৎপত্তি খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু এসবের যে তেমন ভিত্তি নেই, তা-ও টের পাই।
গুইসাপ মরুক বা না মরুক, বড় হোক বা ছোট হোক, গুইমারা বেশ বড় এলাকা। তবে একসময় আমরা তার সীমানা পেরিয়ে খাগড়াছড়ি জোনে পৌঁছে যাই। খাগড়াছড়ি শহর তখনও বেশ দূরে। সাপের কি ফিতার মতো মসৃণ পিচঢালা পথ ধরে অনেকক্ষণ এগিয়ে চলার পর চেঙ্গী নদীর লাল মাটির ঘোলা পানির ওপর ব্রিজটি নজরে এলো। ব্রিজে ওঠার আগে একপাশে পর্যটনের মোটেল। এখানে ২০১৫/১৬তে একরাত থাকার অভিজ্ঞতা আমাদের মনে পড়ে গেল। অপর পাশে দেখলাম হেরিটেজ পার্ক নামে নতুন ট্যুরিস্ট পয়েন্ট তৈরি হয়েছে। আমাদের চার চাকা চেঙ্গী ব্রিজ অতিক্রম করতেই খাগড়াছড়ি গেইট ঘোষণা দিচ্ছে যে আমরা শহরের উপকন্ঠে উপনীত হই। তখন প্রায় ৬টা বাজে। একপাশে গাড়ি থামিয়ে একটা ঝুপড়ি দোকান থেকে চনা-পেঁয়াজু-বেগুনী-মুড়ি কিনে নিলাম। তারপর পৌঁছে যাই আমাদের রাতের আশ্রয় “অরণ্য বিলাস” হোটেলে। কমল এদিকে এলে এখানেই ওঠে। এই ক’দিন আগেও আমার ট্র্যাকিং টিমের বন্ধুরা বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু শীর্ষক পাহাড়ী নৃগোষ্ঠীর নববর্ষ উদযাপন উপভোগ করার জন্যে এই হোটেলে টানা পাঁচ দিন থেকে গিয়েছে। আমাদের ছুটি ছিল না তাই সেদিন আসা সম্ভব হয়নি। কমলের বন্ধু রানা আমাদের থাকা নিশ্চিত করেছেন। রানার আসল নাম লিটন ভট্টাচার্য, পেশায় সাংবাদিক, এবং তার সাথে ভিডিও এডিটিং সহ নানারকম কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকেন। রাজনীতিতেও তাঁর যথেষ্ট গুরুত্ব ও ব্যস্ততা রয়েছে। তবুও আমাদের থাকার আয়োজন রানাই করে দিয়েছেন। কোনরকমে রুমে উঠতেই ইফতারের সময় হয়ে গেল। কেনা ইফতার তো আছেই, রুমিও চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে সেমাই, স্যান্ডউইচ এবং মিনি পিজা। আমরা সবাই মিলে গোগ্রাসে ইফতার খেলাম। আমাদের এমনিতে কারও তৈরি চনাবিরানী স্বাদ লাগে না। আজ মনে হলো এই চেঙ্গী পাড়ের চনা অমৃতস্বরূপ। ইফতার শেষে রুমের দিকে ভাল করে তাকানোর সুযোগ হলো। রুমটা বেশ বড়সড়ই। দুটো ডাবল বেড অবশ্য পুরো রুমটাকেই ভরিয়ে রেখেছে। একটা সোফা এবং একটা সোফার লম্বা টেবিলও রয়েছে। এসি চালু করায় রুম বেশ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। রুমের সাথে লাগোয়া টয়লেটে আলো আরেকটু বেশি হলে বাচ্চাদের নাক কুঁচকানো হয়তো অনেকটা কমে যেতো। তবে কক্সবাজারের ভাল হোটেলগুলোর সমমর্যাদার না হলেও খাগড়াছড়িতে এরচেয়ে বেশি ভাল হোটেল মনে হয় তেমন একটা নেই। যাই হোক, আমরা মুখ হাত ধুয়ে জামাকাপড় পাল্টে বেরিয়ে পড়লাম রাতের খাগড়াছড়ি শহর দেখতে। সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ি গেইট তেমন লক্ষ করিনি, হয়তো পৌঁছার তাড়ার কারণে। এখন তার বিস্তৃত পরিসর দেখতে পেলাম। আর সাথে সাথে টের পেলাম, সকালে আবার আসতে হবে এখানে। গাড়িতে চড়ে রাতের খাগড়াছড়ি দেখতে দেখতে ঢুকে পড়ি একটা গলিতে। কিছুদূর এগুতে চোখে পড়লো বানৌক গেস্ট হাউস ও রেস্টুরেন্ট। রুমি বললো, এটা আমাদের ডা. মৌমিতার স্বামী ডা. লক্ষীপদের প্রতিষ্ঠান। আমরা দেখলাম, সদর দুয়ার বন্ধ। রুমি নেমে ভেতরে গেল। একটু পরেই কেয়ার টেকার গেইট খুলে দিলে আমি গাড়ি ভেতরে নিয়ে গেলাম। দেখি, অনেক বড় উঠানে শিশু কিশোরদের বিনোদনের ব্যবস্থা তো আছেই, আলোকসজ্জিত চত্বরটি বড়দের হৃদয় হরণ করবে। একপাশে রেস্টুরেন্টে দু’চারজন নৈশভোজে ব্যস্ত। অপর পাশে চারতলা উঁচু দালান জনশূন্য, খাঁ খাঁ করছে। কেয়ারটেকার ছেলেটা জানালো, রোজা উপলক্ষে ব্যবসা বন্ধ, কারণ, এসময়ে টুরিস্ট থাকে না, চালু রাখলে লোকসান টানতে হবে। লক্ষীপদও নেই। বেলী ও কামিনী ফুলের শাদা রং রাত্রির কৃষ্ণ ছায়াকে ম্লান করে উঠোনকে উজ্জ্বল করে তুলেছে, সেই সাথে মৃদুমন্দ সুঘ্রাণও ছড়িয়ে পড়ছে চৌদিকে। কয়েকটা ছবি তুলে রুমি মৌমিতার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে ফোন দিলো। হোয়াটসএপে ছবি দেখতে বললো। একটু পরেই আবার মৌমিতার বিস্ময়াপ্লুত ফোনে প্রশ্ন — কবে গেলেন?! আমরা দোলনায় দুলতে দুলতে ছবি তুললাম। নিজস্ব সময় কাটিয়ে একসময় বেরিয়ে এলাম বানৌক গেস্ট হাউস প্রাঙ্গন থেকে। এর মধ্যে কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জেনে নিলাম, বানৌক হচ্ছে ত্রিপুরা ভাষায় জুমের পাহাড়ে পাহারা দেওয়ার জন্যে তৈরি অস্থায়ী কুটিরের নাম। আমরা ফিরে চলেছি অরণ্য বিলাসের দিকে। একটু পরেই ফোন এলো রানার মোবাইল থেকে। উনি আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন। আমি তাঁকে একটু অপেক্ষা করতে বললাম। দু’মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে দেখি রাস্তায় পায়চারী করছেন ভদ্রলোক। গাড়ি পার্ক করে আলাপ করলাম। অরণ্য বিলাসের রিসেপশনে বসে রানার সাথে আলাপে আড্ডায় অনেক কথা জানা হলো।
এর মধ্যে রুমি খোঁজ নিয়ে এলো পাশের বেম্বু শুট রেঁস্তোরা বন্ধ। অতএব, আমাদের নৈশভোজের জন্যে শাপলা চত্বরের ফেনী হোটেল ছাড়া বিকল্প নেই। রানা আরও বেশ ক’টি রেঁস্তোরার নাম বললেন, তবে অরণ্য বিলাসের রিসেপশনিস্টরা জানালেন, সবগুলোই বন্ধ থাকবে। রানা অবশ্য নাছোড়বান্দা, উনি আমাকে তার মোটর সাইকেলে তুলে নিয়ে বের হলেন পুরো খাগড়াছড়ি শহরের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে সবগুলো রেস্টুরেন্টের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্যে। এরকম যেতে যেতে মহিলা কলেজ এলাকায় স্বপ্নচূড়া রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন তিনি। মালিক এক চাকমা মহিলা। দেখলাম, রানাকে বেশ খাতির ও সমীহ করে এরা। আমাদের জন্যে নিয়ে এলো আমের জুস। আলাপের ফাঁকে ওরা জানিয়ে দিলো, সকালে অর্ডার করলে দুপুরে খাবার পরিবেশন করতে পারবে। কিন্তু তাদের আইটেমগুলো অনেকটা সাধারণ বাঙালি রেসিপির মতো। আমাদের আগ্রহ পাহাড়ি রেসিপির খাবারের দিকে। ওখান থেকে বেরিয়ে আরও কয়েকটা জায়গা ঘুরে আমরা নিউজিল্যান্ড পাড়ায় পৌঁছে অনুধাবন করলাম, এখানকার যে রেস্টুরেন্টে প্রাতরাশ করার পরামর্শ কমল দিয়েছিলো তা’ও সম্ভব নয়। রানা বললেন, এগারটায় পরে গেলে খাবার মিলতে পারে। এরপর আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। রাত তখন সাড়ে নয়টা বেজে গিয়েছে। আমরা মোটর সাইকেলে চড়ে শহরের শীর্ণ গলি পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি। একটি অন্ধকার মতো জায়গায় থেমে রানা উঁকি দিলো একটি রেঁস্তোরা মতো ঘরে। আমিও পেছন থেকে উঁকি দিয়ে টের পাই বেশ ব্যস্ত রেস্টুরেন্ট হবার কথা, কিন্তু জনশূন্য এই মুহূর্তে। কারণ, রাত আটটার পরে বন্ধ হয়ে যায়। পরের দিন দুপুরে খাবার পাওয়া যাবে শুনে আস্বস্ত হলাম। রানা বললেন, এটা সিস্টেম রেস্টুরেন্ট। সিস্টেম রেস্টুরেন্টের কথা অনেক শুনেছি। রুমি অনেকদিন আগে আবদার করেছিলো, একবার সিস্টেম রেস্টুরেন্টে আহার করবে। এটা খাগড়াছড়ির প্রাচীনতম পাহাড়ি রেসিপির রেস্টুরেন্ট। রানা বলে রাখলেন, আমরা দুপুরে এখানে খাবো। যখন অরণ্য বিলাসে পৌঁছালাম তখন রাত দশটা বেজে গিয়েছে। অদিতাকে ফোন করে নেমে আসতে বললাম। সবাই নেমে এলে রানা একটা অটো রিকশা ঠিক করে দিলেন, বললেন শাপলা চত্বরের ফেনী হোটেলের ঠিক সামনে নামিয়ে দিতে। আমাদের জানালেন ভাড়া জন প্রতি ৫ টাকা। অটোতে উঠার আগ মুহূর্তে হোটেলের সামনে এসে হাজির হলে টিটু, আমাদের পরের দিনের গাইড ও সঙ্গী; রানার খালাত ভাই এবং এসিস্ট্যান্ট। কথা হলো সকাল সাড়ে আটটায় এসে টিটু আমাদের নিয়ে যাবে। এরপর আমরা অটোতে চেপে বসতেই প্রধান সড়ক ধরে সোজা কিছুদূর এগিয়ে যেতেই ঢাকা চট্টগ্রামের বিশাল বিশাল বাসগুলো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। বাস স্টেশন পেরিয়ে গেলে এক কোণে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে এককালের সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের দু’হাত তোলা মুরতি। এতো বছরেও এটা টিকে আছে দেখে কিছুটা বিস্মিতও হলাম। তারপরে একটি ছোট্ট ব্রিজ পেরুতেই সামান্য দূরে অতি চেনা শাপলা চত্বর চোখে পড়লো। ফেনী হোটেলের খাবার বেশ ভাল। টাকি মাছের ভর্তা, বেগুন ভাজি, লাউ চিংড়ি ও গোমাংস দিয়ে তৃপ্তির সাথে নৈশভোজ সেরে নিলাম। তারপর পায়ে হেঁটে ফুটপাথ ধরে ফিরে এলাম হোটেলে। রাতে অদিতা ও অরণির সাথে ৪ দফা উনো খেললাম। বলাই বাহুল্য পরাজয় আমারই ঘটেছে। তারপর একসময় নিদ্রাদেবী দখল করে নেন আমাদের সকল চেতনা।
৩০ এপ্রিল ২০২২
ভোরের একটা ডাক যেন শরীর শুনতে পায়। বায়োলজিক্যাল ক্লক বা দেহঘড়ির কথা আমরা প্রায় শুনি। হয়তো এই দেহঘড়ির ঘন্টাধ্বনি খুব ভোরে আমাকে জাগিয়ে দেয়। জেগে উঠে সকলের ঘুম ভাঙালাম, তারপর সকলে মিলে বেরিয়ে পড়লাম। সরাসরি চলে যাই খাগড়াছড়ি গেইট এলাকায়। গেইটের ওপরের রেইনবো রাতে বুঝতে পারিনি। সকালের কাঁচা রোদে চারপাশের সবুজ গাছপালার মাঝে লাল ইটের গাঁথুনি এই তোরণ খুব মনোমুগ্ধকর। গেইটের ছবি ধারণ করে এগিয়ে যাই চেঙ্গী ব্রিজে। সেখান থেকে পর্যটনের মোটেল ঘুরে ফিরে চলি শহরের দিকে। শাপলা চত্বর এলাকা যেন ঘুমিয়ে রয়েছে। দোকানপাট সব বন্ধ। আমরা সোজা এগিয়ে যাই। একটি ছোট্ট চা দোকানে তন্দুর দেখে থামি। অতএব, আবার সেই নানরুটি প্রাতরাশই আমাদের নিয়ত নিয়তি। প্রাতরাশ সেরে হোটেলে ফিরে আসি, প্রাতকৃত্য তখনও বাকি।
সকাল সাড়ে আটটায় টিটু এসে আমাদের নিয়ে যাবার কথা। কিন্তু তার পৌঁছাতে কিছুটা বিলম্ব হলেও ন’টার আগেই আমরা হোটেল ত্যাগ করে পাহাড়ী পথে বেরিয়ে পড়লাম। আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে যাই গুইমারার দিকে। অল্প সময় পরেই আমরা পৌঁছে যাই বিখ্যাত রিছাং ঝরনায় যাওয়ার রাস্তায়। কিছুদূর এগুলেই একটা ফটক এবং টিকেট কাউন্টার। আমরা টিকেট কেটে গাড়ি সহ ভেতরের পাহাড়ি পথে চলতে থাকি। সিজনে টুরিস্টে গিজগিজ করা এলাকা এখন যেন বিরান ভূমি। আমরা চারজন এবং সঙ্গী টিটু ছাড়া এতদঞ্চলে কাকপক্ষীও নেই। কিছুদূর ওঠার পর বেশ ঢালু ছলিন বিছানো পথ দিয়ে গাড়ি গড়িয়ে দিলাম। কিছুদূর পৌঁছে কিছু বাঁশের তৈরি দোকান বা ঝুপরির সামনে সমতল এলাকায় গাড়ি রেখে চারপাশে তাকিয়ে দেখি, ঝুপরি দোকানে এক চাকমা বুড়ি এবং এক তরুণী বসে আছে। কিছু কলা ডাব লেবু ইত্যাদির পসরা নিয়ে তারা বসেছে। কিন্তু কোন্ ক্রেতার আশায় তা বুঝতে পারলাম না। কারণ, ত্রিসীমানায় আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। হতে পারে, বেলা বাড়ার সাথে সাথে আরও কিছু দর্শনার্থী এসে যাবে। পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে নীচে দূরে আরেক পাহাড়ে ঝরনার চিকন ধারা ঠাহর করার চেষ্টা করলাম। কারণ, শীত মৌসুমে ঝরনা শুকিয়ে যায়, এবং বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এটা শুকনো খটখটে থেকে যায়। কিন্তু ঝরনা যতোটা সহজে দৃশ্যমান হলো, তার কাছে যাওয়া ততোটা সহজ কর্ম নয়। একটু এগুনোর পরেই পাহাড়ের ঢাল প্রায় খাড়াভাবে নীচের দিকে নেমে গিয়েছে। গতি বেড়ে গেলে থামা কঠিন এবং দুর্ঘটনার সমূহ সম্ভাবনা। তবু সতর্ক পদযাত্রায় পাহাড় বেয়ে নামছি তো নামছিই। এর মধ্যে এদিক ওদিক বাঁকও ঘুরতে হলো বার কয়েক। একসময় সিমেন্ট জমানো পাকা সিঁড়ির দেখা পেলাম এবং সিঁড়ি এগিয়ে গিয়েছে একেবারে ঝরনার তলদেশ পর্যন্ত। এই সকাল সাড়ে ন’টা দশটা বাজেও সমস্ত পাহাড় জুড়ে ঝিঁঝিঁ পোকার নিরবচ্ছিন্ন হামিং যেন নিস্তব্ধত ভেদ করে প্রকাণ্ড গর্জন স্বরূপ কানে এসে আছড়ে পড়ছে। একটা ঝিঁঝিঁ পোকা সিঁড়ির রেলিংয়ে বসে আছে দেখে অরণি ছবি তুলতে উদ্যত হয়। বার কয়েক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ক্ষান্ত দিলো সে। কারণ, পোকাটি বারবার স্থান বদল করে অবশেষে দূরে উড়ে যায়। আমরা নীরবে ঝিঁঝির সঙ্গীত শুনতে শুনতে অতিক্রম করে যাই সিঁড়ির ধাপের পর ধাপ। একেবারে নীচের ধাপে পৌঁছে দেখি একটা জলাশয়, তেমন স্রোত নেই – কেবল পাহাড়ের একপাশ দিয়ে প্রবহমান ঝরনার চিকন জলধারাকে গ্রহণ করে চলেছে। সেই জলাশয়ে মৃদু স্রোত থাকলেও তা আমার মতো আনাড়ির চোখে দৃশ্যমান নয়। তবে সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে জমানো স্ল্যাব কার্লভার্টের মতো জলাধারের উপর গিয়ে অতিক্রম করে সামনের পাহাড়ের গায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যেখান থেকে ঝরনার উৎপত্তি। সেখানে আবার বেশ কিছু ধাপ উপরে ওঠারও ব্যবস্থা আছে। তারপর পদার্পন করি পাহাড়ের মসৃণ গায়ে। ঝরনার যুগযুগান্তরের জলধারা পাহাড়ের গা মসৃণ করে তুলেছে। ঢালু এবং মসৃণ পাহাড়ের যে স্থানে এখন হাঁটছি, সেখানে বর্ষা এলে অসম্ভব বেগে জল বয়ে যাবে। এখন অবশ্য শুকনো খটখটে। ভাবতেই শিহরন লাগছে এক খরস্রোতা ঝরনার ঠিক মধ্যিখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। অবশ্য ঠিক দাপিয়ে বেড়ানো বলা যায় না, বরং খুব সতর্কতার সাথে পা টিপে টিপে হাঁটতে হচ্ছে যাতে পিছলে পড়ে না যাই। এখানে পা পিছলে পড়ে গেলে হাড়গোড় তো ভাঙবেই, মৃত্যুও অস্বাভাবিক নয়। মূল ঝরনা জলশূন্য হলেও পাশের লাগোয়া উঁচু পাহাড় থেকে একটি ক্ষীণ জলধারা নেমে এসেছে মূল ঝরনার কিনারায়। এখনও বর্ষা আসেনি তাই, ঝরনার জলধারা চিকন ফিতের মতো। তবে তার প্রবাহের বিশাল কলেবরের চিহ্ন বসে আছে অনাগত জলোচ্ছ্বাসের জন্যে। পরিষ্কার টলটলে শীতল জলধারায় হাত ভেজাতে এগিয়ে গেলেও পিচ্ছিল পথের জন্যে ক্ষান্ত দিলাম। অদিতা ও অরণিসাহস করে পৌঁছে জলে হাত ভেজাতে পারলো। টিটু জানালো, সিজনের সময় প্রতি বছরই এখানে দুর্ঘটনা ঘটে এবং মৃত্যুও। আমার মনে হলো ঝরনার উপরিভাগের চেয়ে নিম্নভাগে পাথর, ঘাস ও বৃক্ষের সৌজন্যে যে অপরূপ সৌন্দর্যের অবতারণা হয়েছে, সেইখানটায় একটু যাই। তাই অরণির হাতটা ধরে একসাথে নেমে এলাম। এখানে যেন একটা ছোট্ট স্বর্গ রচিত হয়েছে। পাথর ও বৃক্ষের নৈসর্গিক ভূমিতে প্রজাপতি উড়ছে, পানির কুলুকুলু ধ্বনি, আর ঝিঁঝির গুঞ্জন সব মিলিয়ে যে ইন্দ্রজাল রচিত হয়েছে তা উপভোগ করতে করতে উদাস হয়ে গেলাম। একটি বাঁশের তৈরি আসন পেয়ে অরণি খুব আয়েশ করে বসে পা দোলাতে লাগলো। আমিও বসলাম বড় এক পাথরের ওপর। আমাদের এই অবস্থান গ্রহণ দূর থেকে নিশ্চয় খুব ভাল দেখাচ্ছিল। অদিতা ছুটে আসতে আসতে ছবি তুললো। রুমিও সহসা নেমে এলো আমাদের হঠাৎ পাওয়া স্বর্গীয় উদ্যানে। আনন্দে আলাপে আমাদের মিষ্টি রোদের সকাল তপ্ত দুপুরের দিকে গড়াতে শুরু করেছে। আমাদের বেয়ে উঠতে হবে অনেক উঁচু সিঁড়ির ধাপ এবং তারপরে আরও আরও উঁচু খাড়া পাহাড়ের চড়াই। এই ভাবনা ভাবতেই পিঠ বেয়ে চিকন ঘামের ধারা নামতে লাগলো। মনে হলো, এও এক জলধারা, যার কোন কলস্বর নেই, আছে কেবল সিক্ততা। আমরা উঠে দাঁড়ালাম এবং সিঁড়ির ধাপগুলো অতিক্রম করতে লাগলাম ধীর গতিতে। সিঁড়ির পরে খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে যখন ঝুপরি দোকানের সামনে এসে পৌঁছালাম, ততক্ষণে গায়ের টি শার্ট ভিজে চুপসে পড়েছে। আমি এবং টিটু গিয়ে ঝুপরি দোকানের বাঁশের টুলে বসলাম। দরদর করে ঘামের ধারা কপোল দিয়ে গড়িয়ে গণ্ডদেশ সিক্ত হয়ে গেল। ঝুলে থাকা কলার কাঁদি থেকে ছিঁড়ে নিয়ে দুটো কলা খেলাম। দোকানী তরুণী জানতে চাইলো লেবুর শরবত খাবো কিনা। ততক্ষণে অন্যরাও এসে আমার পাশে বসে পড়েছে। সবাই সাগ্রহে পান করে অমৃতের স্বাদ পেলাম এই তাৎক্ষণিক বানিয়ে দেওয়া লেবুর শরবতে। একটু ধাতস্থ হয়ে গাড়িতে উঠলাম। আর বেশ কিছুটা পথ পাহাড় ডিঙোতে হবে। অনেক কসরত করে গাড়ি প্রধান সড়কে পা রাখলে আমরা এগিয়ে গেলাম আলুটিলার দিকে। কিন্তু পথিমধ্যে একটা সাইনবোর্ড দেখলাম, লেখা আছে তেরাং— টিটুকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এখান থেকে পুরো খাগড়াছড়ি শহর দেখা যায়, অর্থাৎ বার্ডস আই ভিউ। তেরাং অর্থ কি তাই? জানিনা। টিটুরও জানা নেই। তেরাং-এ হ্যালিপ্যাডও আছে। এটা সেনাবাহিনীর তৈরি। আমরা গাড়ি পার্ক করে এগিয়ে দেখি টিকেটঘর বন্ধ। আশেপাশে জনমনিষ্যি নেই। অগত্যা নিজ দায়িত্বে এগিয়ে যাই পথের একপাশে সেনাবাহিনীর কিছু স্থাপনা এবং অপরপাশে লিচু বাগানে থোকা থোকা লিচু লাল হয়ে ঝুলে আছে। অরণি একটা লিচু পেড়ে নিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করে বুঝলো, এখনও পাকতে ঢের দেরী আছে। আমরা পাহাড় চূড়ায় পৌঁছে হ্যালিপ্যাড এবং একপাশে রেলিং ঘেরা শহর দেখার স্পট চোখে পড়লো। মনে হলো, পুরো খাগড়াছড়ি শহর যেন আলাদিনের দৈত্যের মতো আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। তবে, চোখে সৌন্দর্যে শহরটি দেখতে পেলাম ক্যামেরায় ততোটা পরিষ্কার ধারণ করা সম্ভব হলো না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করলাম এই উচ্চতা ও সবুজের সৌকর্য। তারপর নেমে গেলাম গাড়ির দিকে। এবার তবে আলুটিলা যাওয়া যাক।
আলুটিলার গুহার আঁধারে
রিছাং ঝরনায় যাওয়ার সময় আলুটিলার বিশাল ফটকের সামনে গাড়ি থামিয়েছিলাম টিটুর নির্দেশনায়। তখন সে কেউ একজনকে জানিয়ে রেখেছিলো যে আমরা একটু পরে আসছি। তাই এবার যখন আমাদের গাড়ি আলুটিলা পর্যটন এলাকার তোরণে পৌঁছালো, তখন দারোয়ান প্রধান ফটক খুলে দিলো। সরাসরি গাড়ি নিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। কঙ্কর ও সিমেন্ট দিয়ে জমানো পাকা রাস্তা ধরে অনেক দূর নীচে নেমে গেলাম। দেখি, কয়েকটি ঝুপরি দোকানে পাহাড়ী জামাকাপড়, ডাব কলা সহ অন্যান্য ঠাণ্ডা পানীয় এবং নাস্তাপানির ব্যবস্থা রয়েছে। পাশের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখি জেলা প্রশাসক একটা ব্রিজের মাধ্যমে সংযোগ করে দিয়ে সেখানে দোলনা সহ নানারকম বিনোদন ও বিশ্রামের আয়োজন করে দিয়েছেন। ওখানে ৩/৪ জন টুরিস্টকে ছবি তুলতে ব্যস্ত দেখতে পেলাম। আমাদের লক্ষ্য অবশ্য গুহামুখ তাই ওদিকে না গিয়ে বামে সিঁড়ি বেয়ে নামতে উদ্যত হলাম। সিঁড়ির ডান পাশে পাকা টয়লেটের নাম অরুণিমা টয়লেট। আমাদের অদিতার নামের দ্বিতীয় অংশ অরুণিমা। তাই সে একটু মনক্ষুণ্ন হলেও পরে তার আপুমনিকে দেখানোর জন্যে টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় মগ্ন হলো। তারপর সিঁড়ি ভেঙে নামতে গিয়ে ডানে পাহাড়ে একটি দোলনা দেখে অরণি ও অদিতা রেলিং টপকে সেদিকে ছুটে গেল। অবশ্য দুয়েক দোলার পরেই আবার তারা ফিরে এলো আমাদের কাছে। সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর নামতেই নীচে একটি বটগাছ দৃশ্যমান হলো। বটগাছের চারপাশ খুব পরিচ্ছন্ন উঁচু ডালপালা থেকে অনেক অনেক বটের ঝুরি নেমে এসে মাটি ছোঁয়ার উপক্রম করছে। দূর থেকে দেখেই মন দ্রবীভূত হয়ে গেল। সাধ জাগে, এই বটবৃক্ষ তলে পদ্মাসনে বসে ধ্যানস্থ হই। কিন্তু পেছনে রয়েছে জলজ্যান্ত সংসার, আমার পেছ পেছনই ধেয়ে আসছে। আমি তো আর সিদ্ধার্থ নই! তা’ছাড়া সিদ্ধার্থও রাতের আঁধারে গোপনে গৃহত্যাগ না করলে আমার মতোই স্ত্রীপুত্র নিয়ে প্রমোদভ্রমণ ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। ধ্যানের কথা ভুলে গিয়ে ছবি তোলায় মগ্ন হলাম। বটগাছটির তলা এবং চারপাশ এতো স্নিগ্ধ শীতল যে এই অঞ্চলটা ছেড়ে এগুতে মন চায় না। টিটুর তাগাদায় এগিয়ে যাই সামনের মেঠোপথ ধরে। তারপর আরেকটি ৪/৫ ধাপের ছোট সিঁড়ি পেরুলেই সুড়ঙ্গমুখ। সুড়ঙ্গমুখে পৌঁছতে লক্ষ করলাম তিনজন তরুণ যুবক কিছুটা উদ্বিগ্নতা নিয়ে কি যেন আলাপ করছে। আমাদের টিটুও এগিয়ে গেল। কয়েকটি ঢিল ছুঁড়ল সামনে জমে থাকা জলের দিকে। আমি কাছাকাছি পৌঁছালে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা কি হয়েছে? টিটু নিরাসক্ত ভাষায় জানালো “একটা ব্যাঙ”। আমিও “ওহ্” বলে এগিয়ে যাই অন্ধকার গুহার দিকে। অরণির হাত ধরে এগুচ্ছি, অন্ধকারটা যেন হঠাৎ ঝুপ করে নেমে এলো চলার পথে। মোবাইল হাতে নিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে সামনের দিকে ধরি। ম্লান আলোয় পাথুরে পিচ্ছিল আঁকাবাঁকা পথ আবছা দৃষ্টিগোচর হলে আমরা ধীর গতিতে এগিয়ে যাই। যে তিন যুবা এতক্ষণ গুহামুখে দাঁড়িয়ে শঙ্কার সাথে ইতস্তত করছিল ঢুকবে কি ঢুকবে না, তারাও আমাদের অনুসরণ করলো। তারা অনেকটা আমাদের পায়ে পা লাগিয়ে হাঁটছিল। ২/১ বার আমার জুতো তাদের জুতোর গুতা খেয়ে কুঁচকে গিয়েছে। এদিকে যতোই এগুচ্ছি, অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে সুড়ঙ্গের ছাদও নীচু হয়ে আসতে লাগলো। আমরা কখনও হাঁটুঙাঙা দ হয়ে, আবার কখনও রুকুর ভঙ্গিতে এবং দুয়েক জায়গায় হামাগুড়ি দিয়ে এগুলাম। এদিকে মেঝেতে কোথাও কোথাও জল জমে আছে, যা টর্চের আলোতেও সহজে টের পাওয়া যায় না। অদিতার এক পা অকস্মাৎ জলে ডুবে গেল, ভিজে গেল একপাটি কেডস। তার অস্বস্তি টের পাচ্ছি। আমি তাকে কোন কিছু না ভেবে এগিয়ে যেতে বললাম। এভাবে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরে ক্ষীণ শশাঙ্কের মতো আলোকরশ্মির দর্শন মিললো। আশপাশের পাথরগুলো আবছা দৃশ্যমান হয়ে এলো। আমাদের গতি বাড়তে লাগলো এবং আমরা ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে থাকি। আলো দৃশ্যমান হওয়ার সাথে সাথে প্রতিবেশী তিন যুবক আমাদের কিছুটা ঠেলেঠুলে আমাদের আগেই সুড়ঙ্গ মুখ অতিক্রম করে বেরিয়ে গেল। আমরা এবার বেশ আয়েশ করে তাড়িয়ে তাড়িয়ে এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে লাগলাম। কারণ, এখন এই সুড়ঙ্গে আমরাই একমাত্র অভিযাত্রী দল। তা’ছাড়া, আলো আঁধারি যে অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করলো তা উপভোগ না করে উঠে যাওয়ার কোন মানেই হয় না। অদিতা অরণিও অনেক আগ্রহ নিয়ে ছবির জন্যে পোজ দিল। এদিকে বায়ুপ্রবাহবিহীন প্রায় মধ্যাহ্নের সূর্য ক্রমশ উত্তাপ ছড়িয়ে চলেছে, তার সাথে সুড়ঙ্গ অতিক্রমের ক্লান্তি আমাদের তৃষ্ণার্ত করে তুললো। ঝুপরি দোকানে গিয়ে অরণি চেয়ে নিলো ঠাণ্ডা কোক। অদিতাও তাই। আমরা একটা ঠাণ্ডা মিনারেল পানির বোতল নিয়ে চুমুক দিতে দিতে অপেক্ষা করতে থাকি তেঁতুলের শরবতের জন্যে। এরমধ্যে রুমি দোকানীকে শরবতে বেশি করে পাহাড়ী ধেনো মরিচ মিশিয়ে দিতে অনুরোধ করায়, আমি তাড়াতাড়ি মরিচবিহীন শরবত নিয়ে নিলাম। তারপর তৈরি হলো ভয়াবহ ঝাল ও টকের মিশ্রণ। রুমির যেন বহুদিনের শখ মিটলো এই ঝাল শরবত পান করে। অদিতাকে গাড়ির পেছনে রাখা স্পন্জের স্যান্ডেল পরে আর গাড়ি থেকে বেরোতে চাইল না। অতএব, পাশের পার্কসদৃশ ভ্রমণস্পটে আর যাওয়া হলো না। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে আমরা যখন জেলা পরিষদের তৈরি নতুন হর্টিকালচার পার্কে গেলাম, তখন সবাইকে নামতে হলো। টিটুর কল্যাণে আমাদেরকে বিনা টিকিটে পরিদর্শনের সুযোগ করে দিলেন পার্কের কর্তাব্যক্তি। নানান রকম ফুল ও ফলের গাছ খুব সুন্দরভাবে সাজানো। একটা ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে অপর পাশে জবাফুলের বাগানের মাঝখান দিয়ে নেমে যাওয়া সিঁড়ি যেন কোন স্বর্গীয় উদ্যানের মতো মনে হলো। একটা বিশাল ডুমুর গাছে এক সাথে থোকা থোকা অনেক ডুমুর ধরতে দেখে খুব ভাল লাগলো। এখানে রাত্রিযাপনের জন্যে কটেজও রয়েছে দেখলাম। এর মধ্যে অবশ্য বাচ্চারা ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছে। তাই, কিছুটা তড়িঘড়ি করে পার্ক দেখা শেষ করে আমরা গাড়ি ঘুরালাম টিটু গিয়ে ঝুপরি দোকানের বাঁশের টুলে বসলাম। দরদর করে ঘামের ধারা কপোল দিয়ে গড়িয়ে গণ্ডদেশ সিক্ত হয়ে গেল। ঝুলে থাকা কলার কাঁদি থেকে ছিঁড়ে নিয়ে দুটো কলা খেলাম। দোকানী তরুণী জানতে চাইলো শহরের দিকে। এর মধ্যে ফেসবুকে আমার সুপ্রভাত শীর্ষক পোস্ট দেখে ফোন করলো কবি আলোড়ন খীসা। আলাপে জানা গেল, আলোড়নের বাড়ি অরণ্য বিলাসের পাশেই। আমি তাকে মেইন রোডে আসতে বললাম। আমাদের গাড়ির চাকা এবং আলোড়ন খীসার পা দুটো বরাবর একই সময়ে অরণ্য বিলাসের সামনে এসে দাঁড়ালো। বহু বছর পরে আলোড়নের সাথে দেখা। সাথে তার শিশু পুত্রও আছে। ওকে আমাদের সাথে সিস্টেম রেঁস্তোরায় যাবার আমন্ত্রণ জানালে সে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলো। অগত্যা তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে টিটুর দিক নির্দেশনায় পৌঁছে গেলাম শহরের একটু ভেতর দিকে অবস্থিত বিখ্যাত সিস্টেম রেস্টুরেন্টে। এদের হরেক রকম পাহাড়ী রেসিপির কথা অনেক শুনেছি। আমরা হাত ধুয়ে বসার সাথে সাথেই এসে গেল চিকেন ভর্তা, লাউ-চিংড়ি, চিকেন কারি, বরবটি দিয়ে শোল মাছের ভর্তা, ছুরি শুঁটকির ভর্তা, তিতা করলা ভাজি, লাল মরিচের ভর্তা সহ তোজা, এঁচোড়, ঘন ডাল, লইট্টা মাছ, ঘন ডাল। পাহাড় বেয়ে এসে সকলেই অনেক ক্ষুধার্ত ছিলাম। এমন বুভুক্ষুর মতো সকল খাবার যেন নিমিষে শেষ করে ফেললাম। খাবারের মেনু অনুপাতে বিল তেমন বেশি না, সুস্বাদু তো বটেই। বেরিয়ে এসে রুমি বললো অনেকদিনের একটা সখ মিটলো। সিসটেমে লাঞ্চ শেষ করে হোটেল ছেড়ে দিলাম। তারপর টিটুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শুরু করলাম প্রত্যাবর্তনের যাত্রা। দেখার বাকি রয়ে গেলো অনেক কিছু। টিটুকে বলে রাখলাম, এখানে বারবার আসবো, ও যেন পরবর্তীতে একে একে সব দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখতে সাহায্য করে।
নিবাস: চট্টগ্রাম।
কবিতাই প্রধান বিচরণ।তবে নন্দনতাত্ত্বিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণগদ্য এবং অনুবাদকর্মেলিপ্ত।
কবিতার বই:
অন্যমন্ত্র(লিরিক১৯৯৫),
শাদা অন্ধকার(লিরিক২০১০),
ডায়োজিনিসের হারিকেন(ভিন্নচোখ২০১৮)
দীর্ঘ কবিতার পুস্তিকা:
শতখণ্ড(বাঙময়২০১৭)
আত্মজার প্রতি(বাঙময়২০১৭)
প্রবন্ধ/নিবন্ধ:
উত্তর আধুনিকতা: এ সবুজ করুণ ডাঙায়(লিরিক২০০১, পরিবর্ধিত২য়সংস্করণ: খড়িমাটি২০১৯)
অমৃত কথা(লিরিক২০১০)
অনুবাদ:
আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব: কয়েকটি অনুবাদ(লিরিক২০১০)
নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ(বাতিঘর২০১৮)
এমিলি ডিকিনসনের কবিতা(চৈতন্য২০১৮)