আজ ১ মে কবি, সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক নওশাদ জামিলের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
হৃদয়ের আলপথ
মাঠের ভিতর দিয়ে আমি ছুটে যাব
অনেক অনেক দূরে— সূর্যাস্তের কাছে
জীবনমৃত্যুর মাঝে আবার দাঁড়াবো
আবার হৃদয়ে নেব শূন্যতা, স্তব্ধতা
এমন নীরব হবো যেন কোনোদিন
ছুঁইনি তোমার ঠোঁট, হৃদয়জমিন
এমন স্থবির হবো যেন কোনোদিন
শিখিনি সাঁতার অশ্রুনদীতে, সাগরে!
খরস্রোতা নদীর মতন যেতে যেতে
হারাবো অচেনা নদীমূলে, অন্ধকারে
মায়ার ভিতরে কেউ যদি ডেকে যায়
আকস্মিক তাকাবো পিছনে— তারপর
হৃদয়ের আলপথ দিয়ে ছুটে যাব
অনেক অনেক দূরে— একান্ত নিভৃতে।
প্রত্নলিপি
তোমার ইশারালিপি পাঠ করি ধীরে
মনে হয়— আমরা ছিলাম মুখোমুখি
গুহার ভেতরে, অগ্নিপরিখার ঘরে
একদিন— নিজেরই গলার স্বর শুনে
বুঝি যে চিৎকারে কেঁপে ওঠে শিলাখণ্ড
দুলে ওঠে প্রত্নত্রস্ত পূর্ণাঙ্গ শরীর
এতদিন কী দেখেছি— একে একে বলি
গুমোট, দুঃসহ, ভারি সেই নীরবতা।
অগ্নিপরিখার ঘরে— দাঁড়াই আবার
দেখি আজ হাওয়ায় দুলছে বনলতা
কাঁপছে উদ্ভিন্ন স্তন তীব্র শিহরণে
একদিন— নিজেরই গলার স্বর শুনে
বুঝি যে বিস্ফারে কেউ চলে যায় দূরে
কেউ থেকে যায়— মুখোমুখি গুহাঘরে।
নোঙর
গভীর গহনস্রোতে চোখ রেখে বলি
হাতে হাতখানি ধরো— এসো, ঝাপ দিই
অতল জলের পিঠে ভাসাবো সংসার
পাখায় পাখায় মেলে দেব লীলানাট
হাতটি বাড়াও স্রোতস্বিনী— ভেসে ভেসে
স্বপ্নে-পাওয়া ভেলা নিয়ে যাবে দূরদ্বীপে
হৃদয়বরণ ঘাটে যদি থামে ভেলা
মনে রেখো প্রেম এক রহস্য নোঙর!
হৃদমূলে, রক্তস্রোতে কী এক দহন
হাতটি বাড়াও স্রোতস্বিনী— ঝড়জলে
ভেসে ভেসে পাড়ি দেব প্রলয়পিঞ্জর
কোথায় সে দূরদ্বীপ, জলে ভেজা ঘাস?
প্রেমের প্রবালদ্বীপে চোখ রেখে বলি
জীবন কি শুধু ভেসে যাওয়া, ডুবে যাওয়া?
বৃষ্টি নদী
চোখের কোণে নামল টলোমলো
বৃষ্টি নদী, ভিজল দুইধার
অন্ধকারে কাঁপছে সরোবর
স্তব্ধ হলো হৃদয় পারাবার!
বৃষ্টি মুছে আঙুর মেখে ঠোঁটে
নামল ঝড় তোমার সিঁথিজুড়ে
হঠাৎ করে তীব্র ঢেউ আজ
তুফান বেগে আছড়ে পড়ে দূরে।
বৃষ্টি দেখে জোরসে দাও টান
আয় রে নদী, ভিজুক চারপাশ
আঁধার রাতে কাঁপছে সরোবর
বুকের কাছে ভাসল রাজহাঁস।
অন্ধকারে তোমার ঠোঁটে ঝরে
আর্দ্র মধু, প্রেমের নিরাময়
মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুঁসে জল
ভাসল তরি, নাই রে কোনো ভয়!
ভুলের ভ্রমর
সমস্ত চিন্তার বাঁকে স্পষ্ট মুখ, মেঘ
হঠাৎ আকাশ ভেঙে নামে ঝোড়োবেগ
অন্ধকারে হেসে ওঠে তার এলোচুল
ঢেকে দেয়– বলে, তবু ছিল কিছু ভুল?
প্রেমের পরিধিপ্রস্থ তুমি জানো যদি
গোপনে বাজাও কেন বাঁশি নিরবধি?
ওহে মম রাধা, আমি তোমারই শ্যাম
তুমি বলো স্পর্শখেলা, আমি বলি প্রেম!
নিশিবনে নীরবে ফুটেছে নাভিতল
ডুবুরির বেশে খুঁজি তোমার অতল
চোখের ইশারা দিয়ে ভুলের ভ্রমর
হেসে ওঠে, বলে, প্রেম সত্যিই অমর
হৃদয় আগলে রাখি– কেটে যায় বেলা
আমি বলি প্রেম, তুমি বলো স্পর্শখেলা!
ছায়াযান
আকস্মিক প্রশ্ন করি: তুমি কি কখনো ক্লান্ত হও?
কুয়াশার তন্তুজালে মিশে আছে মুখ-হিম ঘেরা
হিমাঙ্কের অনেক গভীর থেকে মেলে না উত্তর
যখন দেখেছি তাকে– চোখের কোণায় দাগ ছিল
নতমুখে ছিলাম দাঁড়িয়ে–সেদিন বলিনি কিছু
কী খবর? ভালো? স্মিত হেসে চলে গেল ছায়াপিণ্ড
জন্মান্ধের মতো থাকি–হৃদয় উজার করে দিয়ে
ডুবে আছি, মজে আছি–ছিটেফোঁটা ক্লান্তি নেই মনে।
আকস্মিক প্রশ্ন করি: বলো কাকে বলে ভালোবাসা?
স্মিত হেসে উড়ে গেল ছায়াযান–দূর নভোদেশে
রৌদ্রতপ্ত দিন যায়, ঘূর্ণাবর্ত রাত যায় একা
এত দাহ, এত জঞ্জাল–আমি তাকে পাই না তো খুঁজে
কুয়াশার ক্যানভাসে আঁকা দুটি চোখ–তাকে বলি
হৃদয়ে জেগেছে প্রেম–ক্লান্তি আর করে না তো স্পর্শ!
![নওশাদ জামিল](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2020/05/jamil-150x150.jpg)
কবি ও সাংবাদিক নওশাদ জামিলের জন্ম ১৯৮৩ সালের ১ মে, ময়মনসিংহের ভালুকায়। তার শৈশব কেটেছে ভালুকার সিডস্টোর বাজার এলাকায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা সেখানেই। তারপর চলে আসেন ঢাকায়, ভর্তি হন ঢাকা স্টেট কলেজে। উচ্চমাধ্যমিকের পর পড়াশোনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, সরকার ও রাজনীতি বিভাগে। সেখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর।
নওশাদ জামিলের পেশা সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার শুরুতে কাজ করেন দৈনিক প্রথম আলোয়। বর্তমান কাজ করছেন দৈনিক কালের কণ্ঠের বার্তা বিভাগে, সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তীর্থতল’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালের অমর একুশের গ্রন্থমেলায়। বইটির প্রকাশক ঐতিহ্য। একই প্রকাশনী থেকে ২০১৪ সালে বের হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কফিনে কাঠগোলাপ’। ২০১৬ সালের গ্রন্থমেলায় তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ঢেউয়ের ভেতর দাবানল’ প্রকাশ করে প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশ। ২০১৭ সালের গ্রন্থমেলায় ভ্রমণগ্রন্থ ‘লঙ্কাপুরীর দিনরাত্রি’ প্রকাশ করে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স। এ ছাড়াও সম্পাদনা করেছেন ‘কহন কথা: সেলিম আল দীনের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার’ (যৌথ) ও ‘রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি’ (যৌথ) শিরোনামের দুটি বই ও পত্রিকা।
কবিতা ও সাংবাদিকতার জন্য ইতিমধ্যে নওশাদ জামিল অর্জন করেছেন বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। কবিতার জন্য পেয়েছেন কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার, বিশাল বাংলা সাহিত্য পুরস্কার এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গ থেকে পান আদম সম্মাননা পুরস্কার। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য পান ইউনেস্কো-বাংলাদেশ জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী স্মৃতি পুরস্কার। তার স্ত্রী খন্দকার কোহিনুর আখতার পেশায় বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও মানবাধিকারকর্মী।