ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৩০) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
এই সব কিছুর মাঝে এক কিশোরী তার বন্ধুদের নিয়ে পুজো প্যান্ডেলের বাঁধা বাঁশের খাঁচায় দোল খায়, ভিড়ের ফুচকা ঘুঘনির দোকানের সামনে লাইন দেয়, দুর্গা পুজো-র আগে শিউলি তলায় ঘুরেঘুরে ফুল তোলে।মন্ডল বাড়ির ঠাকুরের সিংহ না বাবুর বাড়ির সিংহ,কে বেশি তেজস্বী তাই নিয়ে যুক্তি সাজায়।
অমলিন এমন কত স্মৃতি এই বর্ষার মেঘে শরতের হাতছানি বয়ে আনে।স্মৃতির আকাশে ভেসে ওঠে সেইসব ছিটের কাপড়ের নকশা, জুতোর ফুটকি, কিংবা ধুনুচি নাচিয়ের ছন্দবদ্ধ অবয়ব।কে বলে পুরনো সময়ের সবকিছু হারিয়ে যায়?
“রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।”
আমাদের একটা বড়োসড়ো দল ছিল।যেখানে যেতাম আমরা সকলেই একসঙ্গে যেতাম।আমাদের কিছু লুকোচুরিও থাকত বড়দের সঙ্গে।সেগুলো নিয়ে ভয় ছিল,দ্বিধা ছিল না।নির্দিষ্ট গন্ডি ছাড়িয়ে হয়ত একটু দূরে যাওয়া,কিংবা বারণ সত্বেও সাদা কাঠির আইসক্রিম খাওয়া।এর বেশি কিছু না।তবু সে সবের নিষিদ্ধ আনন্দও বড় কম ছিল না।
মা দুর্গার শাটিন শাড়ির লাল রঙ,টুকটুকে লাল ঠোঁট ,গয়নাগাটি বড় টানত।কিন্তু আমাদের বাড়িতে ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া চলবে না।ভাবতাম ঠাকুরেরা এত সাজেন-গোজেন দোষ হয়না ,আমরা করলেই দোষ?
দুর্গা পুজা-র সপ্তমীর দিন পাড়ার মন্ডলবাড়ি থেকে একটা বিরাট বড় কাঁসার থালায় করে নৈবেদ্য আসত আমাদের বাড়ি।কাঁসার থালা মাথায় করে আসতেন উড়িয়া বামুন ঠাকুর।সেই থালা এতটাই বড় যে তাতে অনায়াসে একটি বাচ্চাকে শোওয়ানো যায়।থালায় মাঝমধ্যিখানে থাকত নিখুঁত চূড়ো করা ভিজে আতপ চাল,চারপাশে সাজানো অনেক আস্ত কলা আর ফলের কুঁচি,চূড়োর মাথায় এবং চালের চারপাশে সাজানো সন্দেশের সারি ,আর একটি রূপোর কয়েন।ঠাকুমা বলতেন ঠাকুর পুজোর শুরু থেকেই এই রেওয়াজ চলে আসছে।বামুন বাড়িতে ওই থালা ভরা নৈবেদ্য পাঠিয়ে সম্মান জানাতেন ওরা।আমরা ছোটবেলায় সপ্তমীর দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম ওই থালার আগমনের।পুজোর গন্ধ ওই থালাতেও যেন মাখামাখি হয়ে থাকত।এখনও বোজা চোখে দেখতে পাই ওই থালা নিয়ে এক লম্বা উড়িয়া ঠাকুর আমাদের সদর দরজা গলে ভেতরবাড়িতে চলেছেন,পেছনে আমাদের মত কুঁচোকাঁচার দল।কৌশলে থালা নামিয়ে তিনি বসেছেন উবু হয়ে,মায়েরা ব্যস্ত হাতে নিপুণভাবে সব প্রসাদসামগ্রী বাড়ির থালা বাটিতে তুলছেন।আর আমরা মনোযোগ দিয়ে সবটাই দেখছি।আহা! সেই দেখায় কত সুখ!
আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-২৯) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
পুজো-র আরেক আনন্দ ছিল সারাদিনের ছুটিতে।সদ্য হাতে পাওয়া পুজোর উপহারের বইতে।সেসব মোটা মোটা শিশুসাথী, আলোর ফুলকি, ইত্যাদি সঙ্কলনে লেখার সঙ্গে সঙ্গে কত ছবি থাকত।আমরা উপুর হয়ে ছবি দেখতাম।চীনা সম্রাটের ঝোলানো গোঁফ, রাজপুত্র ,রাজকন্যার অপরূপ চেহারা,যুদ্ধের ঢালতলোয়ার বা কামান বন্দুকওলা সৈ্ন্যদল, কত রকমারি ছবি।পড়াশুনো না করে প্যান্ডেলে বেলা অবধি খেলা্, পুজোর বই নিয়ে বিছানায় গড়ানো ,সেসবেও ছিল কত স্বর্গসুখ।
আমাদের কোন টিভি ছিলনা,মোবাইলে গেম খেলা ছিল না।পুজোর সময় ছোটখাটো অনুষ্ঠানে কবিতা বলা বা নাচে, গানে, নাটকে অংশ নেওয়ায় ছিল আমাদের আনন্দ।তার জন্য পুজো-র আগে থেকেই শুরু হত রিহার্স্যাল।এছাড়া স্কুলেও পুজোর ছুটি পড়ার দিন আমাদের ক্লাস অনুযায়ী অনুষ্ঠান করতে হত।সেই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিতেও আমরা খুব আনন্দ করতাম,সেটাকেও পুজোর আনন্দের সঙ্গে যোগ করে দেওয়াই যায়।
সেই সময়ের আনন্দের বেশিটাই ছিল সমষ্ঠিগত।পুজোর দিনগুলো যেন স্বপ্নের ঘোরে কাটত। জলসা ,যাত্রা,পাড়ার দাদাদের করা থিয়েটার সব কিছুর মধ্যে যে বড় রকমের অপেশাদার ব্যাপার-স্যাপার কাজ করত তার আঁচ আমাদের গায়ে লাগত না।আমাদের ছোটদের কাছে সবকিছুই বড় মনোরম হয়ে ধরা দিত।এক অপার মুগ্ধতা নিয়ে আমরা সেগুলো দেখতাম আর নিজেদের খেলায় সেগুলোর অনুকরণ করতাম।
এসবের শেষ হত বিজয়াদশমীতে। ঠাকুর বিসর্জনের বাদ্যি বাজলেই চারদিকে যেন আবছা অন্ধকারের মত বিষাদ ঘনাত।মাদুর্গা তার ছেলেমেয়ে মায় বাহন,অসুরসমেত কোন নদী বা বড় জলাশয়ে পড়লেই দেশলাই কাঠির ভিজে যাওয়া বারুদের মত আমরাও নিভে যেতাম একেবারে।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।