| 7 অক্টোবর 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা ভ্রমণ: সুইজারল্যান্ডের ডায়েরি । কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

২০১৫–২৪ শে জুন! যতদূর চোখ যায় সুন্দর সাদা নুড়ি বিছানো পথ–সবুজ ঘাস ছোট্ট বাচ্চা রা খেলছে বল নিয়ে।সাদা কাশের ঝোপে লেক জেনিভার হাওয়া মাখা রূপটান।আল্পস এর সাদা চূড়োয় বরফিলা সরতাজ্ সাব ওয়ের টিউবরেলের কাঠের বেঞ্চে দুটি প্রজাপতির খুনসুটি। এসব দৃশ্য পট দেখছিলাম লোসানের সুইসটেক হোটেলের ১২৬ নম্বর রুমে বসে।তিন চারদিন হলো প‍্যারির গ‍্যার দ‍্য লিও থেকে সুপার ফাষ্ট ননস্টপ ট্রেনে প‍্যারি থেকে এখানে এসেছি।১০ দিনের প্রোগ্রাম।প‍্যারি থেকে লোসান আসতে সময় লেগেছে সাত ঘন্টা মতো।সুন্দর খাবার দাবার এর রেস্তোরাঁ–অসাধারণ আরামপ্রদ সীট–শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেনে বসে বিশাল কাঁচের জানালা দিয়ে দেখছিলাম অপূর্ব সবুজ ভুবন,গাঢ় নীল আকাশ–মাঝে মাঝে আঙ্গুরের ভিনিয়ার্ড–কখন যে ফ্রান্স পেরিয়ে সুইজারল্যান্ডের সীমানায় ঢুকে গিয়েছি বুঝতে পারিনি।এখানে সেরকম কোনো সীমান্ত কড়াকড়ি নেই, সেরকম চিহ্ন ও নেই–অবারিত খোলা প্রকৃতি–। ট্রেনের রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবার ও খেয়ে এলাম–আমাদের সাথে ট্রাভেল করছিল আই আই টি দিল্লির দুটি ছেলে–এরকম একাডেমিক ভ্রমণ এ অনেক সময় কিছু বাড়তি আনন্দ পাওয়া যায়–এবারে ও ব‍্যাতিক্রম হলো না–গল্পে গল্পে বেশ কেটে গেলো সময়–কতো যে সুন্দর ঝর্ণা, ঝরঝরে নদী আর আল্পস এর কতো নতুন নতুন রং ঢং দেখতে দেখতে লোসান পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারিনি।লোসান রেল ষ্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বিশ্বজিৎ এর কলিগ শশাঙ্ক বিষ্নৈ এবং কিউবার তরুণ অধ‍্যাপক ফারনান্দো। ফারনান্দো-র সাথে আলাপ বেশ জমে উঠেছিল ক‍্যারাবিয়ান এবং ল‍্যাটিন আমেরিকা নিয়ে। বিখ্যাত লেখক এদোয়ার্দো গালিয়ানোর –open veins of Latin America–বইটি নিয়ে আলোচনা জমে উঠেছিল। ফারনান্দো খুব অবাক হয়েছিলেন বই টি আমার পড়া বলে।আমি বলেছিলাম–“স্প‍্যানিশ ভাষায় পড়তে পারলে আরো ভালো হতো। আমি ইংরেজি এবং বাংলা অনুবাদ পড়েছি। বাংলাভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে জেনে ফারনান্দো সত্যিই অভিভূত। বঙ্গললনা হিসেবে আমি ও গর্বিত হলাম।

এখানে সব কিছুই স্বয়ংচালিত। হোটেলের রুমেও নিজে নিজেই ঢুকতে হবে–তাই শশাঙ্ক আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। সত্যি–এই অভিজ্ঞতা আমেরিকায় ও হয়নি। আসলে ইউরোপে সবকিছুই খুব কষ্টলি। যাই হোক–এখন এই হোটেল রুমে আমি একা–সুইস সময় অনুযায়ী এখন প্রায় সাড়ে বারোটা। একটু আগেই হাউসকিপিং এর স্মাইলিং ফেস সুসান ঘরটি সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে গেছে–খুব মিষ্টি হাসির সাথে “বঁজো”অর্থাৎ গুড মর্নিং বলে। একে অপরের ভাষা বুঝি না- হাসিটুকু।সম্বল।সত‍্যি ! পৃথিবীতে হাসি না থাকলে যে কী হতো!

আজ আকাশ রোদ ঝকঝকে। ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর ওপাশে নীলাভ আকাশ,রোদ–ছোট্ট পায়ে চলা নুড়ি বাঁধা পথরেখা চলে গেছে হোটেলের অন‍্য উইং গুলোর দিকে।ছোট ছোটো পাইন গাছ গুলোকে তার দিয়ে টেনে বেঁধে রেখেছে মাটির সাথে–বোধহয় এখানকার মাটি একটু ঝুরো ঝুরো। আজ আর কোথাও বেরুইনি।একাডেমিক কাজকর্ম রয়েছে ওদের।গতকাল সকালে চলে গিয়েছিলাম জেনিভা বা ওদের ভাষায় জেনিভ বেড়াতে। সকাল সাড়ে আটটায় এখান থেকে মেট্রো ধরে ষ্টেশন লোসান গ‍্যার। সুইজারল্যান্ডের হোটেলে চেক ইন করা মাত্র ই ওরা আমাদের কে ফ্রি মেট্রো পাস দিয়ে দিয়েছিলো। স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভার বিহীন মেট্রো।অভ‍্যেস নেই তো–সত্যি বলতে কি একটু ভয় ভয় ও করছিল। মেট্রোতে টিকিট চেকিং কোথাও হয় না–তবে কেউ বিনা টিকেট এ ট্রাভেল ও করে না–সততা হয়তো এভাবেই গড়ে ওঠে। মেট্রো ধরে লোসান গ‍্যার–সেখান থেকে জেনিভার ট্রেন। ননস্টপ  ৪৫ মিনিটের জার্নি। ছোট ছোট ষ্টেশন গুলো পেরিয়ে যাচ্ছিল দুরন্ত গতিতে–ঝকঝকে পরিষ্কার ষ্টেশন চত্বর–নির্ভেজাল জীবন যাত্রা–আপেল আর আঙ্গুরের ভিনিয়ার্ড–মাঝে মাঝে আল্পস পাহাড়ের বাড়ি ছেড়ে মেঘেরা নেমে আসছে–দূষণহীন বৃষ্টি ধারায় ভিজিয়ে দিচ্ছে জনপদ।

জেনিভা পৃথিবীর মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর–এই জেনিভায় কতো চুক্তি নামা লিখিত হয়েছে–ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো দুদিন আগে আমি একাই উসি তে অলিম্পিক মিউজিয়াম দেখে মেট্রো করে হোটেলে ফিরছি–আলাপ হলো একটি শ্রীলংকান তামিল মেয়ের সাথে।মেয়েটি এই সুইস টেকনিক্যাল ইনষ্টিটিউট এই পড়ে–জেনিভা চুক্তি অনুসারে ওর মা বাবা এই দেশে পলিটিক্যাল আ্যসাইলাম পেয়েছেন।ও বলল ও এই দেশকেই নিজের দেশ বলে জানে।–“This is my country! I had never been in Sri Lanka.”বাড়িতে তামিল বলে–ইংরেজি ও ভালো ই বলে–ফরাসি ভাষায় পড়াশোনা করছে।সত্যি–পৃথিবীতে অনবরত মানুষের বাসস্থান পাল্টে যাচ্ছে–কবে কোন সুদূর অতীতে মানুষ অন্ন বস্ত্র বাসস্থান এর খোঁজে বেড়িয়ে পড়েছিল যাযাবর এর মতো–আজ ও এই খোঁজ চলছে। জেনিভ–জেনিভা অসাধারণ সুন্দরী-তন্বী–ছিমছাম। Lac-Leman অর্থাৎ লেক জেনিভা এবং মঁ ব্লো–বা Mount Blanc-এ ঘেরা শহর জেনিভ। পৃথিবীর উচ্চতম ফাউনটেন-Jet du Eau দেখতে ভিড় করেছেন পৃথিবীর সর্বদেশের পর্যটকরা।

আমার ভূপেন হাজারিকার গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটি মনে পড়ে গেলো-
মোরা যাত্রী এক ই তরণী র–চোখ কারো কালো কারো নীল কিংবা পিঙ্গল–

গায়ের রঙ এর বিচিত্র সহাবস্থানে জেনিভার এই টুরিষ্ট ফাউনটেন ক্ষেত্র যেনো মানব সমুদ্র।হেঁটে বেড়াতে  বা দুজনের সীট ওয়ালা সুন্দর ট‍্যুরিষ্ট বাইকে বেড়াতে ভালো ই লাগতো কিন্তু আমাদের সময় কম–তাই ছাদ খোলা দোতালা ট‍্যুরিষ্ট বাসে  ওপেন ট‍্যুরের টিকিট কেটে উঠে পড়লাম।প্রথমেই কয়েকটি পুরোনো ক‍্যাসল–যা দেখে মনে  হচ্ছিল গ্রীমস্ ফেয়ারি টেলস্ এর সেই গথিক প্রাসাদ দেখছি–সেগুলো দেখিয়ে আমাদের নিয়ে গেলো ইনটারন‍্যাশনাল চত্বরে। যিনি ইংরেজি তে পুরো ট‍্যুর টির ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন,তিনি শুরুতেই বলেছিলেন যে সুইজারল্যান্ডের কোনো রাষ্ট্র ভাষা নেই।চারটি অফিসিয়‍্যাল ভাষা রয়েছে।
১–ফরাসি
২–জার্মান
৩–ইটালিনো
৪–রোমানশো
দারুণ ভালো লাগলো শুনে। জেনিভের মানুষ ফরাসি ভাষায় কথা বলেন–জুরিখের পর এটাই সুইজারল্যান্ডের second most city populas city  এবং the most popular city of Romandy–,অর্থাৎ ফরাসি ভাষা আধ‍্যুষিত অংশ।এটা রিপাবলিক আ্যন্ড ক‍্যানটন অব্ জেনিভা র রাজধানী। জেনিভা অবশ্যই একটি গ্লোবাল শহর,অর্থনৈতিক সেন্টার এবং “a worldwide centre for diplomacy due to the presence of numerous international organizations–” এই কথা গুলো ভাবছি আর আমাদের মিনি ট‍্যুরিষ্ট বাসটি ছুটে চলেছে ঐ সব হেডকোয়ার্টার গুলো র দিকে।বাসটি ছুটে চলুক–আল্পসের হাওয়া এর লেক জেনিভের নীল জলজ রূপ দেখতে দেখতে একটু ইতিহাস এর পাতা উল্টে নেওয়া যাক।

খ্রীষ্টপূর্ব ১২১এ যখন রোমান রা জেনিভা অধিকার করে তখন তখন জেনিভা ছিল একটি-“Allobrogian Border “শহর।রোমান দের আগমনের সাথে সাথেই খ্রীষ্ট ধর্মের প্রভাব শুরু হয় এবং পঞ্চম খ্রীষ্টাব্দে জেনিভা পুরোপুরি ভাবে রোমান সাম্রাজ্য এবং-“Bishopric of Vienne” র সাথে যুক্ত হয়।মধ্য যুগে জেনিভা  রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এক কাউন্ট দ্বারা শাসিত ছিল–১৪শো শতকের কাছাকাছি সময় “হাউস অব্ সেভয়”এই শহরটিকে শাসন করতে শুরু করে–।ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে প্রটেষ্টান্ট রিফরমিষ্ট রা শহরে আসতে শুরু করায় জেনিভায় ধর্মীয় সংঘর্ষ বাঁধে–এবং সেভয় শাসকদের হটিয়ে দিয়ে জেনিভা –সুইস কনফেডারেসির সাথে যোগ দেয়।১৫৪১ খ্রীষ্টাব্দে, প্রোটেষ্টান্ট রিফরমার  জন কেলভিন জেনেভা রিপাবলিক এর পত্তন করেন।এরপর আঠারো শো শতাব্দী তে জেনেভা ক‍্যাথলিক।ফ্রান্সের আওতায় চলে আসে।এভাবে চলতে চলতে ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দে নেপোলোনিক যুদ্ধ-শেষে জেনিভা সুইস কনফেডারেশন এ যোগদান করে।ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে জেনেভা আস্তে আস্তে বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা র কেন্দ্র বিন্দু হয়ে ওঠে।

ভাবনার সায়রে ভাসতে ভাসতে ই আমাদের ছাদ খোলা ট‍্যুরিষ্ট বাস পৌঁছে গেলো আন্তর্জাতিক চত্বরে। প্রথমেই দেখলাম হোটেল কনটিনেনটাল–যেখানে ফিদেল কাস্ত্রো, গর্ভাচেভ,বিল ক্লিনটন সহ তা-বড়  তাবড় নেতারা থেকেছেন।দেখলাম WHO এবং UNO সহ আরো অনেক গুলো আন্তর্জাতিক সংস্থা র হেড কোয়ার্টার।রেডক্রস এর পুরোনো এবং নতুন দুটি বিল্ডিং ই ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখলাম।ব্রোকেন চেয়ার মনুমেন্ট চত্বর দেখে খুব মজা পেলাম।

শ্রীলঙ্কার তামিল রিফ‍্যুজি ছাড়াও চোখে পড়লো লেবানন, প‍্যালেষ্টাইন এবং সিরিয়ার আ্য সাইলাম প্রাপ্ত দেশছুট মানুষের মুখ। মনে পড়ে গেলো ওয়ার্ডসওয়ার্থের সেই অসাধারণ উক্তি–‘”What Man has made of man.”এতো সুন্দর জেনিভ লেক-মঁ ব্লো–সুন্দরী নগরীর সুসজ্জ্বিত রাজপথ,–অট্টালিকা–তবু দু দুটো বিধ্বংসী মহাযুদ্ধের পর ও যুযুধান পৃথিবী এখনো আত্মকলহে–জাতিসংঘের প্রাঙ্গণে পৃথিবীর সমস্ত দেশের বহু বর্ণরঞ্জিত পতাকা উড়ছে–তবু মানুষে মানুষে  শান্তি, প্রেমের সম্পর্ক কী এখনো স্থাপিত হয়েছে? এখনো পৃথিবীতে বারুদগন্ধ-এখনো ঘরছাড়া, দেশছাড়া মানুষ মানুষীর ব‍্যাথায় বিষণ্ণ হয়ে ওঠে  এতো সুন্দর পাহাড়, লেক–আকাশ–প্রকৃতি।শান্তির ললিত বাণী আজ ও শোনাইবে ব‍্যার্থ পরিহাস।

মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে উঠলো—রিফ‍্যুজি/ট্রানজিট ক‍্যাম্প গুলো কবে পৃথিবীর অভিধান থেকে বিদায় নেবে?গাড়ি চলছে–Lac lemon এর বিশুদ্ধ হাওয়ায় মুক্ত নীল আকাশে উড়ছে পৃথিবীর সমস্ত দেশ সহ আমার দেশের ও অশোকচক্র শোভিত তিনরঙা পতাকা–যে পতাকা র জন্য কত শত বিপ্লবী, শহীদ হয়েছেন–যুদ্ধ করেছেন আজাদ হিন্দ্ বাহিনী র সেনাগণ বীর সুভাষ এর নেতৃত্বে আমাদের গর্বিত করেছেন–কতো সাধারণ মানুষ –ইংরেজ ভারত ছোড়ো আন্দোলনে সামিল হয়ে প্রাণ দিয়েছেন–কারাবরণ করেছেন–এবং তারপর ও দেশভাগের শিকার হয়ে রিফ‍্যুজি ক‍্যাম্পে, র অন্ধকারে জীবনের শেষ কথা লিখেছেন। তাঁদের সবার উদ‍্যেশ‍্যে রইলো আমার মতো একজন নগণ্য ভারতীয় নারীর বিনম্র প্রণাম।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত