ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
মাঝেমাঝে মনে হয় আমি একটা দরজায় দাঁড়িয়ে আছি,যার কপাট খুললেই দুপাশে দুটি পৃথিবী নানা রঙবেরঙের পশরা সাজিয়ে বসে, আমায় ডাকছে।খোলা দরজায় পিছনের দিকে দুপা পেছোই, আবার সামনের দিকে এগিয়ে যাই।
বিকিকিনি
আমাদের ছোটবেলায় মফস্বলের রাস্তায় অনেক ফেরিওয়ালা ঘুরত।হাঁকডাক শুনে আমরা তাদের বাড়িতে ডাকতাম।স্মৃতি খুব আবছা নয়।মুখ হয়ত স্পষ্ট মনে পড়ে না।তবু একটা আদল মনের আয়নায় ভেসে ওঠে।সকালের স্কুলে পড়ি।তার মানে ফাইভের আগের কথা।ফাইভ মানেই তো বেলা।
দু’একজন হিন্দিভাষী বাজারওয়ালির কথা মনে আছে। মাথার ঝাঁকায় বাজার, দুহাতে বড়বড় রূপোর বালা,চুড়ি,নাকে ইয়া মোটা রূপোর নথ।পায়ে মোটা মোটা মল আর কানে টানা দেওয়া রূপোর বড় পাশা বা ঝুমকো।আমরা গয়না দেখতাম মন দিয়ে।তখন রূপোর গয়না পরার চল বাঙালিদের মধ্যে ছিলনা। তাদের বিচিত্র রঙের ছাপা শাড়ি একটু তুলে পরা থাকত, হাঁটাচলার সুবিধার জন্য। তাতে ঝকঝকে লাল হলুদ গোলাপীর ফুল,গায়ে দড়ি বাঁধা ব্লাউজ। বিশাল বপুটিতে আমাদের বেশ আকর্ষণ হত।কপালে ফুটকির আল্পনা দেওয়া টিপ,চিবুকে কালো ফোঁটা।হাতে সবুজ রঙা কল্কা। আর মাথায় কমলা রঙের সিঁদুর।আমাদের মায়েদের কাপড়ের আঁচল পড়ত বাঁ কাঁধে,ওদের নামত ডান কাঁধ দিয়ে।বিয়েবাড়িতে কনের সাজে বা নাচের সময় মেয়েদের দেখতাম ওদের কাপড় পরার ধরণ নকল করতে। মাথায় ঘোমটা দিত তারা। আমরা প্রায় সিনেমার নায়িকা বা গল্পের বইএর ছবির মত তাদের মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতাম।
সবজির ইয়া বড় ঝুড়ি নামিয়ে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে যেটুকু বিকিকিনি হত, সেটুকুর টাকাপয়সা কোমরের গেঁজেতে মানে কাপড়ের তৈরি ব্যাগে ঢুকিয়ে নিত তারা।যাবার সময় মা কাকিমারা তাদের ঝুড়ি তুলতে সাহায্য করতেন। মাথায় বিঁড়ে বসিয়ে ঝুড়িটা তার ওপর চাপাতে চাপাতে একবার বাঁদিকে একবার ডানদিকে হেলত যখন, সেই মোটাসোটা শরীরের ভাঙচুরের ভঙ্গি দেখতে আমরা অপলকে চেয়ে থাকতাম।মাথার ঘোমটা যথাস্থানে রেখে সে মা কাকিমাদের বলত, “মাইজি, নয়া কুছ লেকে ফির আয়েগি।”
মনে আছে তাদের ঝুড়ি নিয়ে আসা আর সবশেষে চলে যাওয়া অবধি আমরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম।মাঝে তাকে বাতাসা বা মুড়কি দিয়ে জল দেওয়া হত। বাইরের লোকেদের জন্য একটা কাঁসার ঘটি আর পেতলের রেকাবি নির্দিষ্ট ছিল। প্রতিবার ওই ঘটিতেই তাকে জল দেওয়া হত ,ওই রেকাবিতেই বাতাসা, মুড়কি বা গুজিয়া। সে আমাদের দিত হাত ভরা টক লাল কুল, বা ছোট শাঁকালু।কখনও বা টক আম দু’একটি। ওরকম টুকরো টাকরা কিছু দিতে তার ভুল হত না কখনও। আমাদের অনন্ত প্রতীক্ষাকে সে কখনও অসম্মান করেনি।তখন মনে হত আমাদের মুঠি এত ছোট কেন?আরেকটু বড় হলে আরো বেশি পাওয়া যেত।
আমরা নেহাত বোকা ছিলাম না। দেনাপাওনার গল্প না থাকলে আমাদের টিকি দেখা যেতনা। যেমন ঠাকুমা বারবার বলতেন,ঘুঁটে ফুরিয়ে যাবে। ঘুঁটেওয়ালি গেলে ডাকিস। আমাদের তাদের ডাকায় কোন উৎসাহ ছিল না।কখনও বকুনির ভয়ে ডেকে দিয়েই হাওয়া।তারাও আসত রঙিন শাড়িতে রূপোর গয়নায় সেজেগুজে।তবে সে সাজের ধার ছিল কম,যা আমাদের চোখেও ধরা পড়েছিল।
দুপুরে আসত চন্দ্রপুলিওলা।তার মাথায় থাকত টিনের রূপো রঙের বাক্স।দুপুরের ঘুম না হওয়া চোখে আমরা তার অপেক্ষা করতাম।রুশদেশের রূপকথার বই পড়ছি, চোখ সেদিকে। মন আর কান বাইরের পথে ফেলে রেখেছি।তার হাঁকডাক কখন শোনা যাবে।সদর দরজা থেকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে অনেকটা পথ পেরোতে হত। ডাক না শুনতে পাওয়ার ভয়ে কতদিন সেই সদর দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। আজও বাড়ির গলিটা,পথের আর বাড়ির মাঝে সেই অধৈর্যের পদচারণার সাক্ষী হয়ে আছে।
একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল ওই চন্দ্রপুলিওলাকে নিয়ে।সে তার চন্দ্রপুলির বাক্স নিয়ে রোজই সুর করে “চন্দ্রপুলি,চাই চন্দ্রপুলি,…” হাঁকতে হাঁকতে যেত। সোমুদের বাড়ি জানলার ধারে, ও চন্দ্রপুলিওলার গলা নকল করে ভ্যাঙাত। জানলা দিয়ে চেঁচিয়ে টুপ করে জানলার নীচে বসে পড়ত। একদিন ওরকম কান্ড করেছে, আর চন্দ্রপুলিওলা চলেও গিয়েছে। ও একতলার সেই খোলা জানলায় হাত ঝুলিয়ে বসে মন দিয়ে বই পড়ছে।চন্দ্রপুলিওলা তাক করেই ছিল।ধাঁ করে ফিরে এসে ওর হাত ধরে ঝুলে পড়েছে।
ও চেঁচালেও ছাড়ছে না।বলছে,“বল,আর কোনদিন ভ্যাঙাবি?”
শেষে সোমু কাঁদোকাঁদো হয়ে ক্ষমা চাইলে চন্দ্রপুলিওলা হাত ছেড়েছিল।না,আর কোনদিন সোমু ওর ডাক নকল করার সাহস দেখায়নি। সব শুনে সোমুর মা বলেছিলেন, “বেশ হয়েছে। যেমন কর্ম তেমনি ফল।”
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।