অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-১) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।
অনুবাদকের কথা
কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।
এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে ।নমস্কার।
বাসুদেব দাস,কলকাতা
(১)
ব্রহ্মপুত্রের ওপরের আকাশটা দিন দুপুর বেলা বেগুনি রং ধারণ করেছিল। আর বেগুনি আকাশটিতে সবুজ রঙের মেঘগুলি ভেসে বেড়াচ্ছিল। নদীর জল ছিল পাতলা গোলাপি রঙের। তীরের ভাজা পাপড়েরমতোমুচমুচে নীল বালি গুলির ওপর দিয়ে শ্রীমান হেঁটে যাচ্ছিল। অলস ক্লান্ত তার পদক্ষেপ। উদ্দেশ্যহীনভাবে সে পশ্চিম থেকে পূবের দিকে যাচ্ছিল।
তার কোনো কাজ নেই।
ছাই রংয়ের সূর্যটির শীতকালের মৃদু মোলায়েম উষ্ণতা গায়ে নিয়ে উপভোগ করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই।
এই কাজ না থাকাটাও পরম প্রশান্তির কথা হতে পারে যদি–যদি কি? যদি থাকার মতো একটা ঘর থাকে, মাছ মাংস ছাড়া হলেও দুবেলা দু’মুঠো গরম ভাত সামনে ধরে দেবার জন্য খুব বেশি শাসন না করা একজন মা থাকে।
না, শ্রীমানের আজকাল কোনো নেশা নেই। তাই মদ সিগারেটের খরচও তার কিছুই নেই।পকেটে এক পয়সা না থাকলেও সে খুব স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারে দিনটা। যতদিন দুটো পা ঠিক থাকে ততদিন খুব বেশি সমস্যা নেই ।
ধীর পদক্ষেপে পাপড়ের মতো মুচমুচে বালিগুলির ওপর দিয়ে শ্রীমান হেঁটে যেতে লাগল। কতক্ষণ সে এভাবে হাঁটছে বলতে পারেনা। সময়ের হিসাব তার কখনই হারিয়ে গেছে। সবুজ রঙের মেঘগুলি ক্রমশ গাঢ় সবুজ হতে আরম্ভ করেছে এবং বেগুনি আকাশটা কালো হয়ে পড়েছে।
উজান বাজারের ঘাট সে অনেকক্ষণ হয় পার হয়ে এল।
ক্রমে ওয়াটারসাপ্লাই এর পাহাড়টাও পার হল।
অন্য সময় এই জায়গাটা পার হওয়াযায় না,পারের খাড়াই পর্যন্ত জল থাকে। খাড়াই বেয়ে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে রাস্তায় উঠতে হয়। এবার কিন্তু বালির চর পড়েছে। পারের খাড়াই থেকে বহু দূরে সরে গেছে নদীর জল। বালির চর দিয়ে হেঁটে স্বচ্ছন্দে রামচাপাহাড়ের নিচে পর্যন্ত যাওয়া যায়।জল উঠা ডোবাটার আশেপাশেও বালিগুলি মড়মড় করে ভাজা পাপরেরমতোপায়ের নিচে ভেঙ্গে যাচ্ছে।
শ্রীমান এগিয়ে যেতে থাকল।
হ্যাঁ, সে রামচাপাহাড়ের নিচে পৌঁছে গেছে। অতীতে আহোম রাজা নাকি নিয়ে আসা হিন্দুস্তানি সিপাহির সুবেদাররামসিঙের নামে রামচাপাহাড়। কোনো এক সময় কেউ তাকে কথাটা বলেছিল, কে বলেছিল? এখন ভুলে গেছে!
রামচাপাহাড়ের নিচে পড়া বালির বিশাল চর গুলির ওপর দিয়েগুবরে পোকার মতো অনবরত আসা-যাওয়া করতে থাকা ট্রাকগুলি এখন নেই। সারাদিনের জন্য ব্রহ্মপুত্রের বালি টানা শেষ হয়েছে। গুয়াহাটির খাল-ডোবাগুলি ভরাট করে মানুষ ঘর বানিয়েছে আর ভরাট করার জন্য ব্যবহার করছে ব্রহ্মপুত্রের তীরের মড়মড়ে বালি বা পাহাড়কাটা মাটি । বালি খুঁড়েখুঁড়েনিয়ে এক একটি বড়ো গর্ত করে ফেলেছে ট্রাকগুলি । এক একটি বিশাল পুকুরের মতো গর্ত ।
শ্রীমান তীর ধরে যাওয়া একটি গর্তের নিচে কয়েক পা নেমে গেল ।
তার সেখানে কিছুক্ষণ বসতে ইচ্ছা করছে । ক্লান্ত ও লাগছে। কিছুক্ষণ এখানে বসে বিশ্রাম নেবে সে। তারপরে যখন আকাশে নীল রঙের ঝলমলে তারাগুলি ফুটে উঠবে, তখন সে ধীরে ধীরে সেই তারায় ভরা আকাশের নিচে দিয়েসে তার প্রত্যাবর্তন শুরু করবে । এই সন্ধ্যা বেলা দূরে বয়ে যাওয়া শীর্ণকায় ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরের এই বিশাল নির্জনতাটুকু ভালো লাগে। আগেও সে এভাবে এসে কখনও কখনওনদীর তীরে বসেছে। সূর্যাস্তসময়ের পরিবর্তিত রঙের আকাশটা দেখতে তার ভালো লাগে।
শ্রীমান গর্তটির পারে কিছুক্ষণ নিচু হয়ে বসে রইল।
অদ্ভুত একটি দৃশ্য! তার শরীরটা বালির গর্তের ভেতরে, কেবল মাথার উপরের অংশটুকু– ঠিক চোখের সমান, ব্রহ্মপুত্রের বালির পিঠ থেকে ওপর দিকে বেরিয়ে আছে। আর সেই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে চারপাশে দিগন্ত বিস্তৃত ব্রহ্মপুত্রের ধবধবে বালুচর। এভাবে সে কখনও গর্তে ঢুকে ঠিক চোখের সামনে রেখে বালুচরদেখেনি। বড়ো অদ্ভুত দৃশ্য। বালুচরের উঁচু স্তরগুলি ঢেউ খেলানোরমতো ক্রমে চোখের পাশ থেকে দূরে সরে গেছে। বালি খুঁড়ে নিয়ে যাওয়া গর্তগুলি ছায়ারমতো দেখাচ্ছে– যেন কিছু একটা বস্তুর ছায়াটুকু বালির ওপরে পড়েছে।
সন্ধ্যার ক্রমে কমে আসা আলোতে শ্রীমান তন্ময় হয়ে চারপাশে বালুচরগুলির ঘনঘন পরিবর্তিত হয়ে আসা রং গুলি দেখতে লাগল।
রামচাপাহাড়টা ক্রমে ক্রমে অন্ধকার হয়ে এসেছে। পাহাড়ের ঢালু গা কেটে তৈরি করা ঘর গুলির আকার ভালোভাবে আন্দাজ করা যাচ্ছে না, গাছগুলিও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। ব্লটিং পেপার কালি শুষেনেওয়ারমতো অন্ধকার হয়ে আসা পাহাড়েরগায়ে যেন ক্রমশ শুষেনিচ্ছে গাছপালা, ঘরবাড়ি।
পাহাড়ের গায়ে একটা দুটো করে লাইট গুলি জ্বলে উঠছে।
ঠান্ডাটা বেশ ভালোভাবেইজাঁকিয়েপড়েছে। ঘন হয়ে এসেছে নদীর পারের শিশির।এই অভিজ্ঞতা শ্রীমানের পরিচিত। কিছুক্ষণ পরেই মাকড়সার জালের মতো একটি পাতলা ভেজা চাদরের মতো নেমে আসবে রাত। ধীরে ধীরে ভিজে উঠবে তার সোয়েটারের লোমের ডগাগুলি।
হ্যাঁ, উঠে যাবার সময়হয়েছে। অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। সমস্ত আকাশটা ভয়পাইয়ে দেবার মতোবেগুনি রঙের হয়ে উঠেছে।
কিন্তু তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। সেই গর্তটির মাঝখান থেকে তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। এক অদ্ভুত অলস আমেজ যেন তাকে সেই সন্ধ্যার বালুচরেবসিয়ে রেখেছে।
একটা গাড়ি আসার শব্দ হচ্ছে!
এখন? এখন কোথাকার গাড়ি এল? বালি টানা ট্রাকগুলির আসা যাওয়া সেই কখন বন্ধ হয়ে গেছে। খাদানেরলেবাররাও চলে গেছে। কে? কোথাকার গাড়ি আসছে।
হ্যাঁ, একটা গাড়ি বালুচরের উপর দিয়ে এইদিকেই আসছে। ছোটো গাড়ি, হ্যাঁ ,ছোট গাড়ি একটা আসছে। হেডলাইট না জ্বালিয়ে আসছে। বালি টানা ট্রাক গুলির গাড়িটা লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে। ছোটো পার্কিং লাইট দুটো জ্বালিয়ে নিয়ে আসছে।
বালিতে গাড়িটির চাকা শব্দ করছে। বোধ করি চাকা পিছলে যাচ্ছে, না হলে ঢুকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। খাদানের বালি টানা ট্রাকগুলি চলার জন্য ফেলে রাখা খড়, আবর্জনা এবং ফুটো থাকা লোহার প্লেটগুলির ওপর দিয়ে গোঁ গোঁ করে গাড়িটা আসছে।
বালির সমতলে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকা শ্রীমানের এরকম মনে হল যেন একটা প্রকাণ্ড প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ার ক্রমে তার দিকেএগিয়ে আসছে। জ্বলজ্বল করে তার ভয়াবহ ইলেকট্রনিক চোখ দুটি জ্বলছে। এইমাত্র,এইমাত্র যেন চোখ জোড়ার নিচ থেকে স্যাৎ করে সরীসৃপের মতো আধ ফালা জিভ একটা বেরিয়ে আসবে। তারদিকে জিভটা এগিয়ে আসবে। খসখসে, বিজল-বিজল একটা বিষাক্ত জিহ্বা।
তার শরীরটা শির শির করে উঠল।
গাড়িটা তার একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল। গাড়িটারহেডলাইট জ্বালানো হয়নি। হেডলাইটজ্বালিয়ে দিলে তার আলোর ছটায় তার অবস্থান হয়তোগাড়িরআরোহীরা জেনে যাবে। সে যতটা সম্ভব মাথাটা নিচু করে রাখল।কাছিম খোলসের ভেতরে মাথাটা ঢুকিয়েদেওয়ারমতো সেও গলাটা ছোটো করে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল।
গাড়িটা এসে চট করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘ ঘুরিয়ে নে’– কোনো একজনকে সে বলতে শুনল।
পুনরায় ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল। ড্রাইভারবাঁ দিক দিয়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল। এবার গাড়িটা আবার দাঁড়িয়েপড়ল। মারুতি ভ্যান। হ্যাঁ, মারুতি, মারুতি ভ্যান। এখন সে ভালোভাবেগাড়িটাকে বুঝতে পারল। গাড়ির দরজাটা সশব্দে খুলে সন্ধ্যার অন্ধকারে ছায়া মূর্তির মতোতিনজন মানুষ গাড়িটা থেকে নেমে এল।
কী করছে ওরা?
কাউকে মারুতি ভ্যানের পেছনের সিট থেকে ওরা দুজন টেনে নামাচ্ছে। টেনে নামানো মানুষটার পেছন পেছন আরও একজন মানুষ নেমে এল। সে টেনে নামানোমানুষটাকে ঠেলে দিচ্ছে। নড়বড়ে পদক্ষেপে মানুষটা দাঁড়িয়েছে। তার হাত দুটি কি পেছনের দিকে বেঁধে রাখা আছে? হ্যাঁ, হ্যাঁ হাত দুটো বেঁধে রাখা আছে।
হাত বেঁধে রাখা মানুষটাকেতিনজন মানুষ ঠেলা ধাক্কা দিয়েএগিয়েনিয়ে যাচ্ছে। সে যেতে চাইছে না। মানুষটা ছটফট করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।
শ্রীমানের বুক ঠান্ডা হয়ে গেল। পলকের মধ্যে সে বুঝতে পারল কী হতে চলেছে। কিন্তু তার যেন বিশ্বাস হয়নি, চোখের সামনে ঘটতে দেখা ঘটনাটা দেখেও তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। অন্ধকারের মধ্যে সে চোখ জোড়াবড়োবড়ো করে ছায়ামূর্তিগুলি এবং গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল।
বেঁধে নেওয়া মানুষটাকে হঠাৎ কেউ একজন হাঁটুর পেছন দিকে লাথি মেরে বালুতে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দিল। মানুষটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল । কিন্তু লোকগুলি তাকে পড়ে যেতে দিল না। ব্রহ্মপুত্রের পারে বালির ওপরে হাঁটু গেড়ে বসে রইল মানুষটা। মাত্র কয়েক সেকেন্ড । তিন চার সেকেন্ডের বোধহয়বেশি হবে না । হ্যাঁ তিন বা চার সেকেন্ড মাত্র। তারপরে একটা ধাতব শব্দ। বিস্ফোরণ নয়, শ্রীমান শুনবে বলে ভাবা বিস্ফোরণের শব্দ হল না। হল মাত্র একটা তীব্র ধাতব শব্দ; একটা, মাত্র একটা।
হাঁটু গেড়ে বসে থাকা মানুষটা সামনের দিকে ঢলে পড়ে গেল।
ব্রহ্মপুত্রের বালির বুকে তার শরীরটা যেন কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়েপড়েছে বলে মনে হল। কেউ একজন এবার শরীরটাতে লাথি মেরে দিল। লাথি মেরে মেরে শরীরটা একটা গর্তে ফেলে দিল। হ্যাঁ, বালি খুঁড়েনেওয়াখাদানের একটা গর্তে শরীরটা ফেলে দিল ।
মানুষগুলি এবার দৌড়েগাড়িটাতে উঠল। গর্জন তুলে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হল এবং মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটাখাদানের রাস্তাটা দিয়ে সজোরে যেতে লাগল।
শ্রীমান মাথা তুলে একবার গাড়িটা, একবার মানুষটাকে গর্তে ফেলা জায়গাটার দিকে তাকাল। গাড়িটাবালুচর পার হয়ে রাস্তায় উঠে হেডলাইটজ্বালিয়ে দ্রুত গতিতে গুয়াহাটির দিকে চলে গেল।
শ্রীমান লাফ মেরে বসে থাকা থেকে উঠে দাঁড়াল। সে এখন কী করবে? তার বুকের মধ্যে কলজেটার ধপধপ করা শব্দ বুক থেকে বেয়ে এসে তার মাথার ভেতরে জোরে জোরে আঘাত করতে লাগল। কী করবে সে এখন? কী করবে?
আকাশটা এখন অন্ধকার, সন্ধ্যার রঙের লেশ মাত্র আভাস আর নেই। সবুজ মেঘগুলি কালো হয়ে সমগ্র আকাশ থেকে ছড়িয়েপড়ে যেন ঢেকে ফেলেছে। হঠাৎ মেঘের আবরণ এক দুই জায়গায়ফেটে তার মধ্য দিয়ে ভেসে এল কিছুটা স্বচ্ছ জ্যোৎস্না।
বালুচরগুলিজ্যোৎস্নায় সাদা হয়ে পড়ল। আর খাদানের বালি খোঁড়া গর্তগুলি এক একটা ছায়ারমতো দেখা গেল।
পেছনেররামচাপাহাড়টা যেন একটা ধোঁয়ারপাহাড় বলে মনে হতে লাগল শ্রীমানের, অর্ধস্বচ্ছ, অস্পষ্ট।
–কী করবে সে এখন?
উঠে দৌড়মারবে নাকি সে? গর্তটিতে বসে থাকা থেকে উঠে জলের ট্যাংকিটার দিকে দৌড়মারলেই হল। লাফিয়ে উঠে, হাতের বালি ঝেড়ে ফেলে, পা এগিয়েদিলেই হল। কিন্তু কী হল, সে দেখছি উঠতেই পারছে না, শরীরটা উঠছে না, হাত পা চলছে না। সম্পূর্ণ পক্ষাঘাত হওয়ারোগীরমতো সে স্থানু হয়ে পড়েছে।
সে রামচাপাহাড়ের নিচের রাস্তাটা দিয়েভ্যানটা চলে যাওয়ার দিকে তাকাল। নেই, গাড়িটার এখন আর কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। হেডলাইটের আলো আর দেখা যাচ্ছে না।
ছেলেটা কে– যাকে হত্যা করা হল? ছেলে না বয়স্ক মানুষ?
তার একবার সামনে গিয়ে দেখার উদগ্র বাসনা হল।
গর্তের ভেতরে পড়ে যাওয়া শরীরটাকেগিয়ে দেখার বাসনাটা ক্রমে তীব্র হয়ে উঠল। ক্রমে বাসনাটা এত জীবন্ত হয়ে পড়ল যে এটা যেন তার মাথার ভেতরে এলার্ম ঘড়ির মতো সজোরে টক টক শব্দ করতে আরম্ভ করল।
শব্দটা ক্রমে এক তীব্র যন্ত্রণায় রূপান্তরিত হল।
ইসইস! টক টকটক!ইসইস!
সে ঢুকে থাকা গর্তটির পারে দুহাত মেলে দিল। তারপরে প্রসারিত হাত দুটির ওপরে শরীরের ভর দিয়ে সে গর্তটি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল। গর্তের পার কিছুটা খসেপড়ল। সে এবার পারের ভেঙ্গে পড়া খাড়াইবেয়েবেরিয়ে আসার চেষ্টা করল।
সে যেন দাঁড়াতে, হাঁটতে ভুলে গেল।
একটা অপুট, প্রকাণ্ড প্রাগঐতিহাসিক সরীসৃপের মতো এবার সে বেয়ে বেয়ে বালির উপর দিয়েমানুষটাপড়ে থাকা গর্তটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। একটা গুঁই সাপের মতো শ্রীমান বালির উপর দিয়েপেটটাকেছেঁচড়েছেঁচড়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল– একটা গুঁইসাপেরএগিয়ে যাওয়ার মতো। হুমড়িখেয়ে পেট ছেঁচড়ে, বালিতে মাখামাখি হয়ে সে গিয়েগর্তটার সামনে পৌঁছাল।
অন্ধকার! বেশ ভালো অন্ধকার। মেঘের ফাঁক দিয়ে আসা ম্লান জ্যোৎস্নায়গর্তটির পরিসীমা অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে মাত্র। সে গর্তটির পার থেকে নিচের দিকে তাকাল।গর্তটি যথেষ্ট গভীর। নিচটা অন্ধকারে ডুবে আছে। সে অস্পষ্টভাবে নিচে কিছু একটা দেখতে পেল। হ্যাঁ হ্যাঁ সেটাই হবে, ওটাই মানুষের শরীরটা। গর্তের নিচে পড়ে থাকা মানুষটার শরীরটা ওটাই।
সে তখনই বালির খাড়াই দিয়েছেঁচড়ে নিচে নেমে গেল। পড়ে থাকা মানুষটার শরীরের কাছে গিয়েপড়ল সে। বড় অন্ধকার। ভালোভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
একটা টর্চ বা দিয়াশলাই বাক্স যদি পাওয়া যেত! সে নিজে সিগারেট খায় না বলে তার হাতে দিয়াশলাই থাকে না। কী করবে এখন সে? আচ্ছা এই মানুষটা সিগারেট খেয়েছিল নাকি? সে হাতড়ে দেখবে নাকি? মানুষটার পকেটে দিয়াশলাই খুঁজে দেখবে নাকি সে? হাতটা একবার এগিয়েদিয়েপরমুহূর্তে পুনরায় সরিয়ে আনল। তারপরে সে হাত মেলল। মানুষটারগায়ে সে হাত দিল। অন্ধকারের মধ্যে মানুষটার শরীরের হাত পা গুলি সে হাতড়ে দেখতে লাগল। হ্যাঁ, সে মানুষটার হাঁটুতে হাত দিয়েছে। হাতটা সে ক্রমশ উপরের দিকে উজিয়েনিল। এখানে প্যান্টের পকেটটা থাকবে। সে হাতড়ে দেখল। পেয়েছে, সে পকেটটা পেয়েছে। নেই, পকেটে কিছুই নেই। খালি। পাশের পকেটটাও সে একবার হাতড়ে দেখল। কীসব আছে বলে মনে হচ্ছে। হাতড়েহাতড়ে পকেটটা সে দেখতে লাগল। পকেট থেকে একজোড়া চাবি, একটি রুমাল এবং এটা কি? শক্ত শক্ত, ছোট একটা ডিবের মতো। আকৃতিটা তার পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিকই। এটা একটি গ্যাস লাইটার! সাধারণ রঙ্গিন প্লাস্টিকের গ্যাস লাইটার।
শ্রীমন্ত লাইটারটা নিয়েজ্বালিয়ে দিল।
গলা থেকে তার হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকার উঠে এসে ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁট দুটিতে আটকে গেল। গলা দিয়ে শব্দ বের হল না।
মানুষটা চোখ মেলে তার দিকে বড়োবড়ো করে তাকিয়ে রয়েছে।
ভূতগ্রস্থসম্মোহিত মানুষের মতো শ্রীমন্ত মানুষটার দিকে তাকিয়েরইল। কিছুক্ষণ পরে কম্পন এবং বুকের ধপধপানি শব্দের তুফানের মধ্যে দিয়ে সে বুঝতে পারল ওটা মরা মানুষের চোখের ঘোলা হয়ে যাওয়া দৃষ্টি। মানুষটার চোখ মেলে তাকিয়ে থেকেই মৃত্যু হয়েছে।
মানুষটার মুখে ঢুকিয়েদেওয়া আছে একটা তেল মবিল লাগা নোংরা কাপড়। বোধ করি গাড়ি মোছা ফাটা গেঞ্জি। একটা ছেঁড়া নোংরা গামছামুখের উপর দিয়েনিয়েপেছনে গিট মেরে রাখা ছিল। এখন পিছলে খুলে এসে গলায় ঝুলছে। আর তার হাত দুটি পেছনে বাঁধা।
বালির গর্তটিতেমানুষটা দেওয়ালে হেলান দেওয়ার মতো করে পড়ে আছে।কে এই মানুষটা?ঠিক মানুষ নয়,একটা যুবক ছেলে।বয়স খুব বেশি হলে ত্রিশ হবে।শ্রীমান টান মেরে মানুষটার মুখের কাপড়ের ঢিপেটা খুলে দিল।আর সঙ্গে সঙ্গে সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল।ইসমানুষটা কীভাবে তার দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে।গ্যাস লাইটের আলোতে তার মুখের ভেতরের সাদা ঝকঝকে দাঁতগুলি দেখা যাচ্ছে।তার শরীরের সমস্ত লোমগুলি খাড়া হয়ে উঠল।পিঠের মধ্য দিয়ে ঠিক মেরুদণ্ডের উপর দিয়ে যেন বেয়ে গেল একটা শীতের সরীসৃপ।
সে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে পারবে না।ইস,মানুষটার মুখটা এত বীভৎস হয়ে পড়েছে।সেকোনোমতে বেয়েবেয়েগর্তটার খাড়াই থেকে বের হল।
একটা দুর্লঙ্ঘ দেওয়াল পার হয়ে এল বলে মনে হল তার।
টলমল পায়ে সে বালির উপরে এসে দাঁড়াল।তার মাথাটা ঘুরতে লাগল-দুহাতে সে মাথাটা সজোরে চেপে ধরল।
তার চোখের ঝিলমিল কিছু তারা যেন আকাশ থেকে ঝুলে পড়ল।
যত দ্রুত সম্ভব জায়গাটা থেকে সে চলে যেতে চায়।কিন্তু সে দ্রুত হাঁটতে পারছে না।পা দুটি যেন ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে।পাবাড়াতেইনড়বড়লাগছে।তথাপিমদ খাওয়া মাতালেরমতো টলমল পায়ে সে এগিয়ে যেতে লাগল।
সে হঠাৎ একবার রামচা পাহাড়ের দিকে তাকাল।
পাহাড়টা অন্ধকারের বুকে সম্পূর্ণ লুকিয়ে পড়েছে। পাহাড়ের ঘরের লাইটগুলি এক একটি ছোটো প্রদীপের মতোঅন্ধকারে মিটমিট করে জ্বলছে।
ঃরাস্তাটাও বোঝা যাচ্ছে না ।তিনটি গাড়ি একটির পেছনে অপরটি রাস্তা দিয়ে খুব জোরে এগিয়ে আসছে। খারগুলির দিক থেকে গাড়িগুলি আসছে।এত জোরে কোথায় আসছে। গাড়িগুলির হেডলাইটের আলো অন্ধকার রাতের বুকে সৃষ্টি করা দীর্ঘ আলোর রেখাগুলি থরথরকরে কাঁপতে শুরু করেছে।একের পরে অপরটি—পেছনেরটিরহেডলাইটের আলো হঠাৎ ছুঁয়ে পুনরায় মুহূর্তের মধ্যে আগের গাড়িটা থেকে সরে গেছে।কোথা থেকে আসছে? কোথায় আসছেই
শ্রীমান হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।
তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হতে লাগল।
কিন্তু সে দ্রুত হাঁটতে পারছে না। স্বপ্নে কখনও কখনওদৌড়াতেচাইলেদৌড়াতে না পারার মতো অবস্থা হয়, বাস্তবে এখন তার সেরকম হল। লুইতের বালিতে যেন তার পা ধীরেধীরে ঢুকে যাচ্ছে।
অথচ সে সরে আসছে।
খাদানেরগর্তটির কাছ থেকে প্রতিটি মুহূর্তে সে সরে আসছে– যথেষ্ট দ্রুত সে আসছে। অথচ অহরহ তার ধারণা হয়েছে যেন সে সরে আসতে পারছে না– তার পা এগোচ্ছে না, প্রায় এক জায়গাতেই পক্ষাগ্রস্তরোগীরমতো পা ছেঁচড়ে চলেছে।
ইস জলের ট্যাংকিটার কাছে পৌঁছেছে সে। হ্যাঁ, এটাই জলের ট্যাংকি। এটাতো সেই বার্জটি থেকে ব্রহ্মপুত্রের জল তোলা হচ্ছে টেংকিতে।
জায়গাটা অন্ধকার। দূরে অনেক ঘর আছে যদিও, আর ঘরগুলিতে লাইট জ্বলছে যদিও ব্রহ্মপুত্রের বালির উপরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশ অন্ধকার। নদী অন্ধকার। চাঁদের আলো আকাশ থেকে নেমে আসছে না।
সে এবার অনেকখানি সহজ হতে পারল।
নদীটি থেকে এক ঝাঁক ঠান্ডা বাতাস এসে তার গায়ে লাগল। অনেকটা সতেজ মনে হল তার।
আরে, তার হাতে এটা কি? লম্বা শক্ত শক্ত জিনিস? আরে, এটাই তো লাইটারটা,সেই মরা মানুষের লাইটারটা! সে এখন কী করবে? লাইটারটানিয়ে সে কী করবে?
একবার ভাবল ছুড়ে ফেলে দেয়, গায়ের জোরে লাইটারটা নদীর দিকে ছুঁড়ে দেয়। অন্ধকারের মধ্যে কোথাও পড়ে অদৃশ্য হয়ে যাক লাইটারটা । কিন্তু ছুড়ে ফেলে দিতেও তার এক ধরনের সংকোচ হল। অনেক সময় সে লাইটারটা হাতে নিয়েটেপাটিপি করতে থাকল । হঠাৎ তার ধারণা হল তার পেছনপেছন যেন কেউ হেটে আসছে। ব্রহ্মপুত্রের তীরের পাপড়েরমতোমড়মড়ে বালিয়াড়ি ভেঙ্গে কেউ হেটে আসছে । সে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে এরকম হলো যেন আসতে থাকা মানুষটির হাঁটা বন্ধ হয়ে গেল। সে অন্ধকারের মধ্যে চোখ দুটি বড়োবড়ো করে চারপাশে তাকাল। নেই তো, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার আশেপাশে কেউ রয়েছে বলেও তার মনে হচ্ছে না। নেই, কেউ নেই।
সে পুনরায় হাঁটতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ পরে তার পুনরায় ধারণা হল যে কেউ তার সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে আসছে । শুকনো বালিতে পুনরায় মড়মড় করে শব্দ হচ্ছে । তার হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে পা ফেলে কেউ আসছে ।
তার শরীরটা শিউরে উঠল।
গায়েরলোমগুলি একটা একটা করে দাঁড়িয়েপড়ল ।
সে ভয়ার্তভাবে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগল।
সেই নিশ্চিদ্র অন্ধকারের মধ্যে সে কিছুই দেখতে পেল না।
কিন্তু তথাপি তার ধারণা হল যে সে নিঃসঙ্গ হয়ে আসেনি, কেউ একজন সন্তর্পণে কোমল পদক্ষেপে তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। তার খুব কাছে অন্ধকারের মধ্যে সেও হাটছে। সে এগোলেলোকটিওএগোচ্ছে, সে দাঁড়ালেলোকটিওদাঁড়িয়েপড়ছে।
কে?কে? কে আসছে তার সঙ্গে সঙ্গে?
শ্রীমানের এবার ভয় হতে লাগল। তার শরীর কেঁপে উঠল। সে এবার বালির উপর দিয়েপড়িমড়ি করে দৌড়াতে লাগল। কিছু সময় সে তার সঙ্গে কেউ আসার অনুভূতি থেকে অবকাশ পেল । না এখন আর তার সঙ্গে কেউ আসছে না। সামনেই ওই যে পাকা রাস্তা, তার কাছে বস্তি এবং মন্দিরের লাইট। সচিবের অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দূরের সেই আলোটুকু দেখা যাচ্ছে । সে এবার সেই আলোর দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করল।
আর খুব বেশি দূরে নয়। পাকা রাস্তাটা পেতে আর বেশি দূর নেই। কিন্তু পুনরায় সেই অনুভূতিটা হচ্ছে। কেউ যেন তার সঙ্গে সঙ্গেদৌড়ে আসছে। সে সচকিতভাবে তার পেছনপেছন আসছে।
পাকা রাস্তাটার উদ্দেশ্যে শেষ দূরত্বটুকু সে খুব জোরে দৌড়াতে লাগল। হঠাৎ বালির গর্তে হোঁচট খেয়ে সে পড়ে গেল। তখনই উঠে দাঁড়িয়ে সে যেতে শুরু করল। আর দশটা পদক্ষেপ মাত্র। ততটুকু হেঁটে সে ফোঁপাতে লাগল। এখানে ,পাকা রাস্তার উপরে আলো। স্ট্রীটলাইট গুলি রাস্তাটাকে আলোকিত করে রেখেছে। কিন্তু রাস্তাটা থেকে নিচে নেমে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রের বালির খাড়াইটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে আছে।
সে শরীর থেকে বালিগুলি ঝেড়েফেলল।খাড়াইটার নিচে পড়ে যাবার সময় তার শরীরে বালি লেগেছিল। চুল, শার্ট, প্যান্টের পকেট, কাপড়ের ভাঁজ সব জায়গাতেই বালি ঢুকে ছিল। সে স্ট্রীট লাইটের নিচে দাঁড়িয়েঝেড়েঝেড়ে শরীর থেকে বালিগুলি দূর করল। তখন সে অনুভব করল যে তার হাতে লাইটারটা নেই। মরা মানুষটারলাইটারটা তার হাতে আর নেই।বোধহয়পড়ে যাওয়ার সময়লাইটারটা তার হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে।
লাইটারটা নেই। আর তারপরেই সেই পায়ের শব্দ নেই। হ্যাঁ লাইটারটা নাই হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেপায়ের শব্দ ও নাই হয়ে গেছে।
তার শরীরটা পুনরায় একবার শিউরে উঠল।
পুনরায় একবার নদীর বালির দিকে তাকাল।
আকাশের মেঘগুলি বোধহয় ফাঁক হয়ে গেছে। জ্যোৎস্নার আলো পুনরায় নেমে এসেছে নদীর তীরে। সেই জ্যোৎস্নায় এবার অস্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে তীরের বালুচর।না, নদীটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু পারের বালুচর আবছা ভাবে দেখা যায়। সেই ম্লান জ্যোৎস্নায় নদীর তীরটা অত্যন্ত কুহেলিকাময় এলাকা বলে মনে হল তার। সে এবার পথ পরিবর্তন করল। নদীর তীরের পাকা রাস্তাটা দিয়ে সে উজান বাজারের দিকে এগিয়ে গেল। তৃষ্ণায় মুখ, তালু শুকিয়ে গেছে। জিভাটাশুকিয়ে একটা শিরিষ কাগজের মতোখড়খড়ে হয়ে পড়েছে। কোথাও যদি একটু জল পাওয়া যেত।
একটু আগে সে গুমটি ঘর দেখতে পেল।
কেরোসিনের আলো জ্বালিয়েদোকানিসুপুরি কাটছে।
সে একটু খাবার জল চাইল।
তার অবিন্যস্ত চেহারার দিকে, উশকোখুশকোচুল এবং শুকনো মুখের দিকে তাকিয়েদোকানি অবাক হল। তারপর তিনি একটা কলস থেকে গ্লাসে জল ঢেলে দিলেন।শ্রীমান জল টুকু খেয়ে আরেক গ্লাস চাইল। দুই গ্লাস জল খেয়ে সে অনেকটা প্রকৃতিস্থ হল। জিভ দিয়ে ঠোঁট দুটি চেটে সে দোকানির দিকে তাকিয়েজিজ্ঞেস করল।’ তিনটি গাড়ি এ দিক দিয়ে খুব জোরে গিয়েছিল নাকি?’
‘ এদিকে তো সব গাড়িই খুব জোরে যায়। সামনে গভর্নরেরবাংলো আছে, বড়োবড়ো হোটেল আছে। সব গাড়ি এদিক দিয়ে খুব জোরেই যায়।’
শ্রীমান মাথাটা ঝাঁকিয়েনিল।
ইস- তার যেন দিক ভুল হয়ে গেছে।
উজানবাজার থেকে সামনে গিয়েগিয়ে নদীর পারে পারে খারগুলিপেয়েছিল। অন্য সময় এদিক দিয়ে যাওয়া যায় না । এখন খুব বিস্তৃতভাবেবালুরচরপড়েছে বলে হোটেল এবং রাজভবনের নিচ দিয়ে নদীর তীর ধরে গিয়েখারগুলি এবং তারপরেরামচাপাহাড়েপৌঁছানোযায় । সে তো এই রাস্তায়গাড়িদেখেনি। সে গাড়ি দেখেছিল খারগুলি থেকে আগে যাওয়া রাস্তায়।
আঃ কয়েক মাইল হবে, নদীর পার ধরে কয়েক মাইল হবে। এতদুর সে দৌড়ে এসেছে কি? এতদূর!
তার নিজের পথ হারিয়ে গেছে বলে মনে হল । নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো সে এবার বাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করল।

অনুবাদক