সংঘাতের আবহে সত্যজিৎ । রানা চক্রবর্তী
বাংলা ছবিতে তৈরি হয়েছিল তিনটে ঘরানা৷ একটা সত্যজিৎ, আরেকটা ঋত্বিক ও তিন নম্বর মৃণাল সেন৷ এই তিন পরিচালকের ছবি তৈরির ঘরানার মধ্যে তফাৎ অনেকটাই৷ কেউ পর্দায় বাস্তবকে তুলে নিয়ে আসতেন, সাহিত্যের থেকে ধার করে, নন্দন তত্ত্বের ওপর ভর করে৷ যেখানে ছবি অনেকটাই ম্যাজিকাল৷ কেউ আবার ছবির পর্দায় গল্পের মাধ্যমে অনবরত সমালোচনা করেই চলতেই সমাজের৷ প্রথমটা যদি সত্যজিৎ রায় হন, তাহলে দ্বিতীয়টা অবশ্যই ঋত্বিক ঘটক৷ তবে এই দুই পরিচালকের থেকে অনেকটা দূরে থেকেই সিনেমাকে অন্যভাবে দেখেছেন পরিচালক মৃণাল সেন৷
ঋত্বিক ঘটক – সত্যজিৎ রায় – মৃণাল সেন .. বলা চলে বাংলা চলচ্চিত্রের ব্রহ্মা – বিষ্ণু – মহেশ্বর। একই বৃত্তে কর্মরত ছিলেন তিনজন। ছিল আলোচনা ও সমালোচনা। ছিল বৈরিতা। তা সত্বেও ছিল বন্ধুত্ব।

মৃণাল সেন থেকে দুই বছরের বড় ছিলেন শ্রী সত্যজিৎ রায় (১৯২১ – ১৯৯২), আর ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫ – ১৯৭৬) ছিলেন আড়াই বছরের ছোট। একজনকে সম্মান করতেন, অন্যজন ছিলেন বন্ধু। কিন্তু দুজনের সঙ্গেই ছিলো সম্পর্ক। চলচ্চিত্রের সূত্রে। দুজনের সঙ্গেই চলতো বাহাস। ছবি নিয়ে। ছবির ভাষা নিয়ে। তবে ঋত্বিক বন্ধু বলে ওর সঙ্গে ঝগড়াঝাটিও হতো। আরো হতো রাজনৈতিক আলাপ। পরিকল্পনা হতো কি করে তারা লুকিয়ে কাকদ্বীপে চলে যাবেন; তারপর সেখানে পুলিশের নজর এড়িয়ে, গেরিলা কায়দায় ১৬ মিলিমিটারে চলচ্চিত্র বানাবেন। এরপর তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেই ছবি দেখাবেন। সত্যজিতের সঙ্গে অবশ্য সেসব আলাপ জমতো না। সত্যজিৎ এমনিতেই ছিলেন রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মানুষ।
মৃণাল সেন (১৯২৩-২০১৮) দুজনের কাজেরই প্রশংসা করেছেন, সমালোচনাও করেছেন। রাজনীতি ও চলচ্চিত্রের অঙ্গীকারের প্রতি অবিচল ছিলেন বলেই ঋত্বিকের প্রতি পক্ষপাত যেন একটু বেশিই মৃণালের। অপর দিকে সত্যজিতের সেই অর্থে কোন অঙ্গীকার ছিলো না। ঘটকের মতো সিনেমা ও বিপ্লবকে হাত ধরাধরি করে চলতে দেখেননি রায়। তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করার চাইতে নতুন নতুন কাহিনী বুনতেই বেশি ভালোবাসতেন। তারপরও কি রাজনীতির বাইরে থাকা যায়? ‘হীরক রাজার দেশে’ তো প্রচণ্ডভাবে রাজনৈতিক ছবি।
আবার ছবিতে যে অবধারিতভাবে রাজনীতি সরাসরি থাকতেই হবে বিষয়টি তেমনও নয়। সমকালীনতাকে ধারণ করলেও অনেক ছবি কালকে অতিক্রম করতে পারে। আর একারণেই ‘পথের পাঁচালী’কে যতোটা না, তার চেয়েও বেশি প্রশংসা মৃণাল করেছেন সত্যজিতের ‘অপরাজিত’ ছবিটির। দ্বিতীয় ছবি হলেও এটিকেই সত্যজিতের প্রথম দিককার শ্রেষ্ঠ ছবি বলে মনে করেন মৃণাল:
‘আমার মনে হয় যে ছবিটি সব চাইতে জীবন্ত, সব চাইতে জটিল, সব চাইতে সমকালীন সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য ছবির তুলনায়, তা স্বাভাবিক কারণেই ‘অপরাজিত’। ছবিটি তৈরি হয় ১৯৫৬ সালে— সমকালীনতায় সমৃদ্ধ।’
মৃণাল সেনের পুত্র কুণাল শিকাগো থেকে এক চিঠিতে তার মা গীতাকে লিখেছিলেন যে, তিনি সত্যজিতের ‘অপরাজিত’ দেখতে গিয়েছিলেন শিকাগো ইউনিভার্সিটির ফিল্ম ক্লাবে। তখন মায়ের কথা মনে পড়েছে কুণালের। গীতা এই ছবিটি দেখে কেঁদেছিলেন। মৃণাল এই প্রসঙ্গে আরেক প্রস্থ প্রশংসা করেন ‘অপরাজিত’ ছবিটির।
‘‘অপরাজিত’ আমার কাছে সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়। ছবিটার ভেতরে আমি ‘contemporaneity’ খুঁজে পাই’।
ভিন্ন আরেক জায়গাতেও এই প্রশংসা অব্যহত ছিল মৃণালের। ‘কুড়ির দশকের কাহিনী, লেখা হয়েছিল চল্লিশের দশকে, পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এসে ছবি করলেন মানিকবাবু। অপুর চরিত্রের বদলটা চমৎকার ধরতে পেরেছিলেন, নিজে তিনি আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন বলেই। মা-ছেলের আন্তঃসম্পর্ক, মাকে ছেড়ে নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে অপুর কলকাতায় চলে আসা, এইসব আজও যেন অসম্ভব সমকালীন মনে হয় আমার কাছে। ঘটনার পারম্পর্যে, দৈনন্দিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে নিশ্চিন্দিপুরের সমস্ত শেকড় উপড়ে ফেলতে হয় অপুকে। অবস্থার চাপে পড়েই হোক, কিংবা আবেগতাড়িত হয়েই হোক, কলকাতার কাছে শেষ পর্যন্ত ধরা দেয় অপু। আর এখানেই সত্যজিৎ যেন সরে আসেন বিভূতিভূষণ থেকে। কারণ তাঁর অপরাজিত উপন্যাসের শেষ কথা ছিল:
‘অপু নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া যায় নাই, সে আবার ফিরিয়া আসিয়াছে।’
তবে শুধু প্রশংসা নয়, সমালোচনাও ছিলো। যে ‘পথের পাঁচালী’ ভারতীয় চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে গিয়েছিল, সেটিকে নিয়ে, ‘অপরাজিত’ নিয়েও। মৃণাল মনে করতেন অনেক কিছুই অপ্রয়োজনীয় ছিলো ছবি দুটিতে। যেমন ‘পথের পাঁচালী’ ছবির শুরুতে কারো মাথার টাকে বৃষ্টির ফোঁটা, বা বিড়ালের দৃশ্যটি, ‘ডিটেলের কাজ হিসেবে এসব সিকোয়েন্স নিশ্চয়ই ভালো, কিন্তু কোনো প্রয়োজন ছিল না এই ভিশুয়ালাইজেশনের। যেমন প্রয়োজন ছিল না অপরাজিত-তে হরিহরের মৃত্যুদৃশ্য দেখানো। ঝাঁকঝাঁক পায়রা ওড়ার শট দিয়ে সিকোয়েন্সটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে ঠিকই, কিন্তু মৃত্যুর ঠিক আগে হরিহরের গোঙানি বা সর্বজয়ার ‘কী হল? কী হল?’ সংলাপের খুব প্রয়োজন ছিল কি? আসলে মৃত্যু দেখানোতেই আপত্তি আমার। ফিল্মে তো সবকিছুই দেখানো যায় আর সেটাই সবচেয়ে বড় বিপদ ফিল্মের। ফিজিক্যালিটি পেরিয়া যাওয়াই ধর্ম যে-কোন ফিল্মের, বা শিল্পের। মৃত্যু না দেখালেই বরং তার অভিঘাত জোরালো হয় আরও। তবে অপরাজিত-র সামগ্রিক অভিঘাত এত বড় আমার কাছে যে এ-সমস্তকিছুই গৌণ বা তুচ্ছ হয়ে যায়। অতিকথন এড়িয়ে মানিকবাবুর ইকনমি বা পরিমিতি বোধ এমনভাবে ধরা পড়েছে এ-ছবিতে, বা তাঁর প্রথম দুটি ছবিতে যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না।’
অবশ্য সত্যজিতের পরের ছবিগুলোকে ততোটা বাহবা দিতে নারাজ মৃণাল। বলছেন,
‘অপরাজিত-র পর থেকেই আঁটসাঁট প্লটের মধ্যে আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ল তাঁর ছবি। অপেন এন্ডেড বা বন্ধনমুক্ত সমাপ্তির ছবি না বলেই ওসব ছবি নাপছন্দ মৃণালের। বলেন, ‘এ-ছবি দুটোর (পথের পাঁচালী ও অপরাজিত) পর তাঁর ছবি যেন আস্তে আস্তে স্কিম-এর মধ্যে ঢুকে পড়ল, ঢুকে পড়ল নিটোল কাহিনীবৃত্তে। কাহিনীসূত্র নিশ্চয় থাকবে ছবি করার পিছনে, কিন্তু খোলা হবে গল্পের মুখটা, যাতে যেকোনো দিকেই চলে যেতে পারে ছবিটা। বেশি স্কিম্যাটিক হয়ে গেলে ছবির গতিমুখ বা মুহূর্তকে প্রেডিক্টেবল বা অবভিয়াস লাগতে পারে দর্শকের।’
‘চারুলতা’ অবধি সত্যজিতের ছবিতে বিস্মিত হওয়ার মতো ঐশ্বর্য থাকলেও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তৈরি করা ছবি নিয়ে কথা বলতে একটু ‘অস্বস্তি বোধ’ করেন মৃণাল। যে সত্যজিৎ ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ‘দেবী’ বা ‘মহাপুরুষ’-এর মতো ছবি বানান, তিনিই আবার কি করে জাতিস্মরের মতো ব্যাপারকে প্রাধান্য নিয়ে বানালেন ‘সোনার কেল্লা’, ব্যাপারটা ‘মাথায় ঢোকে না’ মৃণালের।
এছাড়া ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র অতিরিক্ত প্লটের আরোপ, ‘গণশত্রু’ ছবিতে ইবসেন প্রস্তাবিত প্রোটাগনিস্ট তথা একা মানুষের লড়াকু শক্তিকে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান মুখরিত মিছিলের মাধ্যমে মিথ্যে করে দেওয়ারও সমালোচনা করেন মৃণাল। আর্ট ফর্ম হিসেবে সিনেমার সম্ভাবনা নিয়েও সত্যজিতের সঙ্গে মৃণালের তর্ক হয়েছে। সিনেমা ভাষা কি শুধু লিনিয়ারই হবে? নন-লিনিয়ার হলে সমস্যা কোথায়? দুজনের সেই বাহাসের কিছুটা ছাপাও হয়েছিলো ৯৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত ব্রোশিওরে।
সত্যজিতেরও সমালোচনা ছিলো মৃণালের ছবি নিয়ে। মৃণালই সেটির কথা উল্লেখ করেছেন—
‘সত্যজিৎ রায়ের কথায়, ভুবন সোম অন্য স্বাদের ছবি। বেশি দর্শকের দরবারে পৌঁছোতে পারেনি, যতটুকু পেরেছে ওইটুকুই। এবং চালু কনভেনশনের ওপর নির্ভর করে ছবিটি তৈরি হয়েছে। সবই আছে ছবিতে: মিষ্টি মধুর এক নায়িকা, জমজমাট আবহ-সঙ্গীত, কিছু বা রমণীয় দৃশ্য।দৃষ্টিনন্দন এবং সব কিছু ছাপিয়ে ইচ্ছা পূরণের খেলা। সাফল্যের মন্ত্রগুপ্তি। এই সব বলে সত্যজিৎ টেনে আনলেন সাত-শব্দের সংক্ষিপ্তসার: বিগ ব্যাড বুরোক্র্যাট রিফর্মড বাই রাসটিক বেল।’ বাক্যটি সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব কিনা আমার জানা নেই। হলেই ভালো, কিন্তু আমরা শুনেছি যে এক কালে হলিউড গল্প-প্রসঙ্গে ওই কথাটাই নাকি ব্যবহার করত: ‘Big Bad Bureaucrat Reformed by Rustic Belle.’
সত্যজিৎ মৃণাল সম্পর্কে আরো একবার বাঁকা মন্তব্য করেছিলেন লন্ডনে, এক সাংবাদিকের প্রশ্নে জবাবে। মৃণালের জবানীতে, ‘সত্যজিৎ বাবু ওই প্রশ্নোত্তর পর্বের ব্যাপারটাকে সহজভাবে না নিয়ে আমার সম্পর্কে একটি নিষ্ঠুর মন্তব্য করলেন।’ সেটি কি? সত্যজিৎ বলেছিলেন:
‘মৃণাল সেন অলওয়েজ হিটস সেফ টারগেট’,
এটিই শিরোনাম হয়ে ছাপা হয়েছিল ‘সানডে অবজারভার’ পত্রিকায়। মৃণালের তৈরি করা রাজনৈতিক ছবিগুলোর উপর কথা বলতে গিয়েই ‘সম্ভবত’ এমন মন্তব্য করেছিলেন সত্যজিৎ। এই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর পত্রিকার সম্পাদক মৃণালকে ফোন করে বলেছিলেন একটি রিজয়েন্ডার পাঠাতে। পাঠিয়েছিলেন মৃণাল:
‘সত্যজিৎবাবু সবচাইতে নিরাপদ জায়গায় আঘাত হেনেছেন। লোকটি আমি, মৃণাল সেন।’
দুজনের মধ্যে এমন অম্ল সম্পর্ক যেমন ছিল, মুদ্রার উল্টো পিঠের মত, মধুর সম্পর্কও ছিল। সত্যজিতের Our Films, Their Films বইটির সমালোচনা লিখেছেন মৃণাল ‘সানডে’ সাপ্তাহিকে। আবার মৃণালের লেখা ‘চার্লি চ্যাপলিন’ বইটির প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। একটা সুস্থ তর্ক-বিতর্কের সম্পর্ক ছিল তাঁদের মধ্যে। মৃত্যুর আগে ও পরে তাই মৃণাল বরাবরই কাজের সমালোচনার পাশাপাশি শ্রদ্ধা দেখিয়ে এসেছেন সত্যজিতের প্রতি।
সত্যজিৎ শেষের কয়েকটি বছর খুব একটা আউটডোর শুটিং করেননি। অসুস্থ ছিলেন। তাই ইনডোরেই বেশিরভাগ শুট করেছেন। ১৯৮৯ সালে ইবসেনের কাহিনী নিয়ে ‘গণশত্রু’, ১৯৯০ সালে নিজের কাহিনী নিয়ে ‘শাখা প্রশাখা’ ও ১৯৯১ সালে নিজের লেখা গল্প থেকে ‘আগন্তুক’ এই তিনটি ছবিই ছিলো সত্যজিতের শেষ তিন ছবি। এসব ছবি তৈরির সময় স্টুডিওর বাইরে এম্বুলেন্স মজুদ থাকতো। কারণ এর আগে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পরপর দুটো অ্যাটাক। আমেরিকাতে বাইপাস সার্জারি হয়। সেই ধকল কিছুটা কাটিয়ে ওঠার পর ছবিগুলো নির্মাণ করেন। কাজ করার ইচ্ছা শক্তিই তাঁকে দিয়ে আরো তিনটি ছবি করিয়ে নেয়। তো ৯১ সালে মৃণাল এক ফাঁকে নিভৃতে সত্যজিৎকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মাঝে মাঝে একা লাগে না?’ সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘ভয়ংকর একা লাগে। ভীষণভাবে একা লাগে।’
এই আলাপের এক বছর পর, ১৯৯২ সালে মারা যান সত্যজিৎ। মৃণাল তখন স্মরণ করছেন ১৯৮৩ সালের একটি ঘটনা। সে বছর প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয় সত্যজিতের। অ্যাটাকের দুঘন্টা আগে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ বলেছিলেন,
‘কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি, মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই।’
মৃণাল বলছেন,
‘অকপট, অদ্ভুত সাহসী একজন মানুষ!’
শ্রদ্ধার্ঘ্যে সত্যজিৎ সম্পর্কে মৃণাল বলছেন,
‘… যা ঘটে থাকে মহৎ শিল্পীর দীর্ঘকালীন কর্মকাণ্ডের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে— প্রশস্তি এবং তারই পাশাপাশি কখনও সখনও কিছু প্রশ্ন, কিছু বা সংশয়, কিছু বিতর্ক। তারই মধ্যে সোজা দাঁড়িয়ে তিনি নিজের মতো করেই চলতে থাকলেন, চলতে চলতে আবার হঠাৎ, কিছু দিনের জন্য থেমে পড়লেন। শারীরিক কারণেই থামতে হল। আবার চললেন, বললেন, বুঝলেন কাজ, শুধু কাজই তাঁর শরীর ও মনকে তাজা রাখে, তাঁকে চালিয়ে নেয়। এভাবেই চলছিল, অসুস্থতাও বাড়ছিল, তারপর শেষের সেদিন এসে পড়ল অনিবার্যভাবে।’
মহৎ শিল্পীর ক্ষেত্রে প্রশস্তির পাশাপাশি প্রশ্ন থাকা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ঋত্বিক ঘটকের নাম। বিভূতিভূষণের উপন্যাস থেকে সত্যজিতের করা চলচ্চিত্রত্রয়ী নিয়ে প্রশ্ন ছিলো ঋত্বিকেরও। ঋত্বিক নিজেও একজন মহৎ শিল্পী। তিনি চেয়েছিলেন সত্যজিতের অপু বিভূতিভূষণের ছক মেনে গ্রামেই ফিরে যাক, কিন্তু সত্যজিতের অপু গ্রামে ফিরে যায়নি, কলকাতামুখী হয়েছে। মৃণাল এখানে ঋত্বিকের সমালোচনা করেছেন। বলেছেন,
‘ঋত্বিক সম্ভবত সত্যজিতের নাগরিক মননটুকু তেমনভাবে ধরতে পারেননি, পারলে বোধ হয় মানিকবাবুর ছবিতে অপুর বদলটা মেনে নিতে পারতেন।’
এই জায়গায় ঋত্বিকের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, মৃণাল যদি ঋত্বিকের শেকড়ে ফিরে যাওয়ার মননটা ধরতে পারতেন, তাহলে হয় তো ওপরের বাক্যগুলো ভিন্নভাবে বলতেন।
‘নায়ক’। সত্যজিৎ রায় ও মহানায়ক উত্তম কুমারের এক অবিশ্বাস্য যুগলবন্দী। জানা যায়, এই চলচ্চিত্রের বিশেষ রোলটির জন্য সত্যজিৎ রায় উত্তম কুমারকেই বিশেষ করে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে ঘটেছিল একটা বিরূপ ঘটনা। উত্তমকুমার বনাম সত্যজিৎ রায়!!
ছয়ের দশকের শেষ দুটো বছর বড়ই বিতর্কময় ছিল মহানায়কের পক্ষে। বিশেষতঃ ১৯৬৮ বছরটা যে কেরিয়ারের দিক থেকে একেবারেই ভালো কাটেনি উত্তমকুমারের তার প্রমাণ পরিসংখ্যানই দেবে। মাত্র চারটে ছবি রিলিজ। অগ্রদূতের ‘কখনো মেঘ’ ব্যবসার দিক থেকে ‘অ্যাভারেজ’। উত্তম–সুচিত্রা জুটি নিয়ে যে ম্যাজিকটা অগ্রদূত দেখাতেন বোঝা গেছে সেটা এ সময় সুচিত্রা–বিহনে অন্তর্হিত। মঙ্গল চক্রবর্তীর ‘তিন অধ্যায়’–এরও সেই অবস্থা। অজিত লাহিড়ীর ‘গড় নাসিমপুর’ ফ্লপ। একমাত্র স্বান্তনা পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের ‘চৌরঙ্গী’। তবে সে ছবিও বক্স অফিসে ব্লক বাস্টার নয়।
আসলে এই ১৯৬৮ সালটা একেবারেই ভালো ছিল না সামগ্রিকভাবে বাংলা সিনেমার পক্ষেই। গোটা বছরে মাত্র ১৯টি ছবি মুক্তি পেয়েছিল! আর এর কারণ ছিল সিনেমার সঙ্গে যুক্ত নানা ধরনের কলাকুশলীদের ও কর্মীদের ধর্মঘট। যার ফলে শুটিং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হলে ছবি দেখানোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঠিক ৫০ বছর আগের বছরটিতে এক অদ্ভূত অনিশ্চয়তার গর্ভে ঢুকে গিয়েছিল গোটা টালিগঞ্জ।
১৯৬৯–এ উত্তমকুমার ‘ভরত’ পুরস্কার পেলেন। এই পুরস্কার পাবার পেছনে সত্যজিৎবাবুর ছবি ‘নায়ক’এর অবদান অনস্বীকার্য। অথচ এই ৬৯-এই উত্তমের নাম সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেল অনভিপ্রেত বিতর্কে। এবং এখানেও সেই প্রযোজককূলের উপস্থিতি ও ভূমিকা।
‘চলচ্চিত্র সংরক্ষণ সমিতি’র একটা দাবি ছিল সেন্সর–এর তারিখের ভিত্তিতে ছবি মুক্তি পেতে হবে। পরে সেন্সর হওয়া ছবি যেন আগে হল না পেয়ে যায়। তবে ব্যতিক্রম চলছিলই। ইতিমধ্যে তো উত্তম–সৌমিত্র ভাঙন, সংগঠন দু–টুকরো ইত্যাদি ঘটছিলই। আরও একটা ঘটনা ঘটল, আগে চলচ্চিত্র সংরক্ষণ সমিতিতে থাকলেও এইসব ঘটনার পরে সমিতি থেকে বেরিয়ে এলেন সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, অজয় কর, রাজেন তরফদারসহ সাতজন নামী পরিচালক। মৃণাল সেন আগেই বেরিয়ে এসেছিলেন। ১৯৬৯–এর ৮ মে মিনার বিজলী ছবিঘরে মুক্তি পেল ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’। আর এতে চেন আটকে গেল বিকাশ রায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’ আর উত্তমকুমারের ‘মন নিয়ে’–র জন্য। ‘আরোগ্য নিকেতন’ আবার অরোরা ফিল্মস–এর ছবি, তাদের দাবি ছিল তারা ঐ ছবি ‘গুগাবাবা’র আগে সেন্সর করিয়েছে। আবার ‘গুগাবাবা’ প্রযোজক অসীম দত্তদের যুক্তি ছিল এসব রীতি নিয়ম চালু হবার আগে বিজলী কর্তৃপক্ষ–এর সঙ্গে তাঁদের চুক্তি হয়েছে। উত্তমকুমাররা এই মুক্তির বিরোধিতা করলেন। খবর রটে গেল, উত্তমকুমার–বিকাশ রায়রা নাকি শিল্পী সংসদ–এর লোক এনে বন্ধ করে দেবে ‘গুগাবাবা’র প্রদর্শন। সৌমিত্রবাবু–ভানুবাবু–অনুপকুমার, কালী ব্যানার্জিরা ঐ খবরের ভিত্তিতে বিজলীর সামনে পাহারায় বসলেন।
আরও একটা ঘটনা ঘটল। প্রযোজকদের তরফে গোপনে একটি সবুজ হ্যান্ডবিল নাকি ‘সার্কুলেট’ করা হয়েছিল। যাতে ছিল একটি ‘ব্ল্যাকলিস্ট’ আর সৌমিত্র–ভানু–অনুপকে বয়কটের নির্দেশ। তবে সে তো অন্য গল্প। একটি অ্যান্টি–ক্লাইম্যাক্স।
মৃণাল সেনের ‘আকাশ কুসুম’ ছায়াছবি নিয়ে সত্যজিৎ রায় চাছাঁছোলা মন্তব্য করেন। যার জবাবে ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় চিঠি পাল্টা-চিঠিতে শুরু হয় দু’জনের জীবনব্যাপী এক দীর্ঘ দ্বৈরথ।
ফরাসি চিত্রনির্মাতা ফ্রাঁসোয়া ট্রুফোর দ্বারা প্রভাবিত মৃণাল সেন ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে ‘আকাশ কুসুম’ ছায়াছবিটি বানাতে শুরু করেন। অভিনয়ে ছিলেন সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও অপর্ণা সেন। প্রকাশের পর এই ছবির ভাষাভঙ্গি নিয়ে চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মাঝে সাড়া পড়ে যায়। তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে এই ছবির সমালোচকদের একজন ছিলেন সত্যজিৎ রায়।
মৃণাল সেন সে’সময় আশীষ বর্মণের একটা গল্প নিয়ে ছবি বানাচ্ছিলেন। ‘আকাশ কুসুম’ নামের এই ছবির গল্পটা এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির যুবককে নিয়ে, যে যেনতেন উপায়ে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতো। মৃণাল চিত্রনাট্যে গল্পের ভেতর কিছু কিছু জায়গা বদলে দেন। ফলে গল্পের নায়ক অজয়ের চরিত্র হয়ে ওঠে স্বপ্নালু ও ভাবুক, যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধ বাস্তবতার ভেতরে বসেও আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখতো, যার প্রবল বিশ্বাস ছিল যে শুধু স্বপ্নের জোরেই সে একদিন বিরাট ধনী হতে পারবে। শেষ পর্যন্ত সে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়, এবং তার যা সহায়সম্পদ ছিল সেটাও খুইয়ে বসে।
কেন যেন অজয়ের চরিত্রটাকে চলচ্চিত্রের সমালোচকেরা ভালোভাবে নিতে পারলেন না। মৃণাল বেশ উদ্বিগ্নই হলেন। শেষতক ২৫ জুলাই একটা বিজ্ঞাপনেও একটি বাক্য জুড়ে দিলেন, “অজয় কোন ধোঁকাবাজ নয়, সে উচ্চাকাঙ্খী”। এর কিছুদিন আগে ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘স্টেটসম্যান’-এ ছবিটার একটি সমালোচনা ছাপা হয়েছিল। তার প্রতিক্রিয়ায় সেই ২৫ জুলাইয়ে সম্পাদকের কাছে চিঠির পাতায় চিঠি লিখে পাঠালেন পাঠকেরা। প্রতিক্রিয়ার কারণ হলো স্টেটসম্যানের সমালোচক তার লেখায় বলেছিলেন যে এই ছায়াছবির সমাপ্তিটা ডন কিহোতের সমাপ্তির মতো – হাস্যরসে মেশানো করুণ। যে কারণে দর্শকেরা ছবি শেষ করে নায়কের পরিণতিতে সমব্যথী হবে। এর জবাবে গল্পকার আশীষ বর্মণ বলেছিলেন যে গল্পটা মোটেও এভাবে শেষ হয়নি। কারণ ওভাবে শেষ করলে তা শুধু ভুলই হতো না, দর্শকদের কাছেও সেটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো না। বর্মণের মতে, ‘সমসাময়িক’ সময়ের একটি গল্পে এমন শৈল্পিক ধোঁয়াশা রেখে দেয়া প্রায় অসম্ভব।
এই পর্যায়ে সত্যজিৎ ঘটনায় জড়িয়ে গেলেন। যদিও প্রতিক্রিয়া লেখার আগে সত্যজিৎ মৃণালকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন যে তার সমালোচনার লক্ষ্য আশীষ, এবং তার লেখা পড়ে মৃণাল যেন আহত না হয়। কিন্তু তার লেখা প্রকাশ পেলে দেখা গেল যে তিনি পুরো ছবিটার ভিত্তিমূল নিয়েই প্রশ্ন করছেন। এই ছবির সমসাময়িকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন। যা পড়ে মৃণালও ভাবলেন জবাবটা তার দেয়া দরকার। সত্যজিৎ’র লেখার জবাবে একদিকে আশীষ লিখলেন যে, ‘কোন গল্পে মৌলিক মানবিক তাড়না, যেমন প্রেম, ঈর্ষা, ক্ষুধা, আশা কিংবা ভালো জীবনের আকাঙ্ক্ষার কথা বললেই তা সমসাময়িকতা হারায় না’। অন্যদিকে মৃণাল সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে উত্তর দিতে গিয়ে তুলে আনলেন চ্যাপলিনকে। আশীষ বর্মণ আর মৃণাল সেনের জবাবে বারবার সমসাময়িকতার বরাত দেয়াতে সত্যজিৎ বেশ ক্ষিপ্ত হলেন। এর পরের জবাব হলো আরো খাপখোলা তলোয়ারের মতো, কোনোরূপ চটুল রসিকতার আড়াল ছাড়াই, “এই ছবির নায়কের আচরণ আর তার পরিণতির কোন সমসাময়িকতার উপরে পুরো গল্পটা দাঁড়িয়ে আছে তা বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। ‘আকাশ কুসুম’-এর যদি কোন সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা থেকে থাকে, তা শুধুই উপরে উপরে, কিছু ছড়ানো-ছিটানো শহুরে জীবনের বর্ণনা আর ফ্যাশনদুরস্ত বয়ানে। কিন্তু এই গল্পের থিমের সমসাময়িকতা কোথায়? সে ব্যাপারে ছবির নির্মাতাদের বক্তব্য কী?”
পাঠকদের চিঠি আসতে থাকলো। তার বেশিরভাগই সত্যজিৎ’র এমন রূঢ় লেখাকে ভালোভাবে নিলো না। কারো কারো কাছে মনে হলো সত্যজিৎ ‘গোঁড়া এবং অসহিষ্ণু’, কারো চোখে মনে হলো তার লেখায় ‘তলে তলে ছিদ্রান্বেষী মনোভাব সুস্পষ্ট’। এর মধ্যে মৃণালও আবার জবাব দিলেন, তবে তাঁর জবাব সচেতনভাবেই চ্যাপলিন সংক্রান্ত বিষয়ে সীমাবদ্ধ, আকাশ কুসুম নিয়ে তিনি কিছুই বললেন না।
এতসব চিঠি পড়ে রায়সাহেবের মেজাজ ঠাণ্ডা থাকার কথা না। এবার তিনি লিখলেন এক ঝাঁঝালো ব্ল্যাক হিউমার মেশানো সার-সংক্ষেপ, প্যারোডির ঢঙে এক গল্প লিখলেন, যার প্রত্যেক লাইনে জোর করে “সমসাময়িক” শব্দটা ঢুকিয়ে দিলেন। যেমন, নায়ক থাকে এক কুঁড়েঘরে, কিন্তু তার দেহের গড়ন সমসাময়িক সুনজর পেয়ে বেশ দশাসই। এই লেখাটা শেষ হলো তার বিখ্যাত সেই উক্তি দিয়ে, ‘A crow-film is a crow-film is a crow-film’।
কথার লড়াই ততোদিনে মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে অনেকটাই ব্যক্তিগত যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। তাই কদর্যতায় রূপ নেয়ার আগে ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় উদ্যোগী হলো তর্ক-যুদ্ধ অবসানের। তাঁরা মৃণাল এবং আশীষের কাছে একটি শেষ জবাব দেয়ার অনুরোধ করলো। মৃণাল সত্যজিৎকে আক্রমণও করলেন না, তার ছায়াছবির হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনও করলেন না। তিনি সত্যজিৎ’র শেষ গল্পের জবাবে বললেন যে চাইলে হ্যামলেটকেও সংক্ষেপে রাজবাড়ির এক খুন আর ভূত-রহস্য-প্রেম-প্রতারণা-অজাচারের গল্প বলে চালিয়ে দেয়া যায়, যে গল্পের শেষে নায়িকা উন্মাদ হয়ে আত্মহত্যা করে, আর বেশ কয়েকটি খুন ঘটার পর নায়কও আত্মহত্যা করে।
কেন যে সত্যজিৎ অমন আক্রমণাত্মক লেখাটি লিখেছিলেন তা আজও রহস্য। আকাশ কুসুমের থিমের ব্যাপারে তার অ্যালার্জির কারণও বুঝতে বেজায় কষ্ট হয়। কারণ প্রায় কাছাকাছি থিমের একটি ছবি তিনি নিজেও এর সাত বছর আগে বানিয়েছিলেন। তার ‘পরশ পাথর’ ছায়াছবিতে এমনই এক গরীব কেরানি জাদুর পাথরের বদৌলতে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যায়। সে পাথর লোহাকে সোনায় পরিণত করতো, যার সুবাদে সেই কেরানির জীবনেও আমূল পরিবর্তন এসেছিল।
কারণ যাই হোক না কেন, আকাশ কুসুমকে ঘিরে ঘটে যাওয়া এই তর্ক-যুদ্ধে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল। সত্যজিৎ রায় প্রকাশ্যে মৃণাল সেনের সাথে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। ‘পথের পাঁচালী’র সময় থেকেই তিনি বাংলা সিনেমা জগতের অবিসংবাদিত নায়ক। সেই জগতে মৃণাল যে তাঁরই মতন প্রাসঙ্গিক আর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন এটা তিনি নির্ঘাত বুঝতে পেরেছিলেন।
সে বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর দ্য স্টেটসম্যান আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আকাশ কুসুম’ ছায়াছবি নিয়ে তর্কের সমাপ্তি ঘোষণা করে জানায় যে এই বিষয়ের ওপর আর কোনো চিঠি তাঁরা ছাপাবে না। সেদিন সন্ধ্যায় ফিল্ম সোসাইটির একটা প্রদর্শনী ছিল। সেই মিলনায়তনে সত্যজিৎ আর মৃণালের দেখা হলো। সত্যজিৎ হাসতে হাসতেই বললেন, ‘কেমন হুট করে তর্কটা থামিয়ে দিলো! আপনি লেখা বন্ধ করলেন কেন? আমি তো আরো অনেকগুলো চিঠি লিখতে পারতাম!’
‘আমার তো আপনার মতো ভক্তকূলও নেই, লোকবলও নেই’, মৃণাল জবাব দিলেন, ‘তবে একাই আপনার সব চিঠির জবাব দিতে পারতাম!’
এই কথা-পাল্টা-কথাই এই দু’জনের পরবর্তী জীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ালো। হাসি-ঠাট্টার সৌজন্যমূলক আবরণের আড়ালে তাঁরা পরষ্পর দূরে দূরেই থাকলেন। কেউ কাউকে চিনলেন না। সদা-সতর্ক, সদা-উদ্যত। ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলের আড্ডাতেও তারা একে অপরের কাজ নিয়ে কথা বলতে চাইতেন না।
কলকাতার সিনেমাবোদ্ধাদের অনেকে প্রায়ই বলেন যে সত্যজিৎ আর মৃণালের মধ্যে মিল শুধু দৈহিক উচ্চতায় আর গায়ের রঙে। সংবেদনশীল শিল্পী হিসেবে দু’জনেই চারপাশের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা আর হালচালে প্রভাবিত হতেন। যদিও তাঁদের প্রকাশভঙ্গি আর শিল্প ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, যেমন পুনশ্চ আর মহানগর। তাঁদের দীর্ঘ চলচ্চিত্র নির্মাতা জীবনে এমন অনেকবারই ঘটেছে। আধুনিক তারুণ্যের সমস্যা নিয়ে তাঁরা দু’জন বানিয়েছেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ আর ‘ইন্টারভিউ’; ১৯৪৩ এর মন্বন্তর নিয়ে বানিয়েছেন ‘বাইশে শ্রাবণ’ আর ‘অশনি সঙ্কেত’; আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদ হিসেবে বানিয়েছেন ‘কোরাস’ আর ‘হীরক রাজার দেশে’।
আশির দশকে যেন নিজেরাই বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান বদলে ফেললেন দু’জনেই। সঙ্গীতময়, সূক্ষ্ণ আর নিয়ন্ত্রিত সত্যজিৎ ক্রমশ হয়ে উঠলেন উচ্চকিত ও দৃঢ়ভাষী। নিজের দর্শনকে প্রকাশ করার জন্য তিনি তার ছবির ভাষাকেও আগাগোড়া বদলে দিলেন। অন্যদিকে মৃণাল, যিনি বরাবরই ছিলেন কসরতবাজ আর চড়াসুরের বক্তা, তিনি হয়ে উঠলেন অন্তর্মুখী আর শান্ত।
বর্তমান প্রজন্মের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে এককালে এই দু’জন অসম্ভব অন্যরকম শিল্পী পরষ্পরের খুব ভাল বন্ধু ছিলেন। মৃণাল সেনের চ্যাপলিনের ওপর লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। সত্যজিৎ’র লেক টেম্পল রোডের বাসায় মৃণালের নিত্য আসা-যাওয়া ছিল। সেখানে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিনেমা নিয়ে আলাপ করতেন। ‘অপরাজিত’ দেখে মৃণাল মুগ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর কাছে এটাই সত্যজিৎ’র সেরা ছবি। কিন্তু কেন জানি ‘পরশ পাথর’ অতোটা পছন্দ করেননি, সত্যজিৎকে বলেওছিলেন সে’ কথা। ‘বাইশে শ্রাবণ’ দেখে সত্যজিৎ’র তেমন আহামরি কিছু মনে হয়নি। পরে অবশ্য তিনি এই মত পরিবর্তন করেছিলেন, এবং ১৯৬৫ সালের ২য় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জুরি থাকাকালীন সময়ে এই ছবিটার একটি বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন তার বন্ধুদের জন্য।
এমন চমৎকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের পর ‘আকাশ কুসুম’ নিয়ে সত্যজিৎ’র লেখা চিঠিতে মৃণাল যারপরনাই আহত বোধ করেছিলেন। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেননি। আগের উষ্ণতা না থাকলেও মৃণাল বরাবরই সামাজিক সৌজন্য বজায় রেখেছিলেন। তাই তাঁর পরের ছবি ‘মাটির মণীষা’ দেখতে সত্যজিতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ছবি দেখে সত্যজিৎ-ও বলেছিলেন যে তাঁর ভাল লেগেছে। প্রায় দশ বছর পর মৃণালের ‘ওকা উরি কাথা’ দেখেও তিনি একইভাবে প্রশংসা করেছিলেন।
মৃণালও তাঁর ছবি ‘ভুবন সোম’-এর একটি দৃশ্যে বাংলার গৌরব নিয়ে বলার সময় পর্দায় সত্যজিৎ’র আলোকচিত্র দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এই ছবিটা আবার সত্যজিৎ’র ভাল লাগেনি। তাঁর লিখিত বই “Our Films, Their Films”-এ সত্যজিৎ এই বিষয়ে লিখেছেন, “ভুবন সোম উৎরে গেছে কারণ মৃণাল এখনকার সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু কৌশল ব্যবহার করেছেন, যা এই ছবির ভাষার খচখচে জায়গাগুলোকে কিছুটা নরম করে দেয়। এসব কৌশলগুলো হলোঃ সুন্দরী নায়িকা, সুমধুর আবহসঙ্গীত, আর একটি সাধারণ, মন-ভালো-করে দেয়া চিত্রনাট্য ইত্যাদি। সাত শব্দে সারাংশ করলে দাঁড়ায়ঃ “Big Bad Bureaucrat Reformed by Rustic Belle”।
সত্যজিৎ রায়ের বইটা প্রকাশ হবার পর কলকাতার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা মৃণাল সেনের কাছে পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার অনুরোধ করে। প্রথমে কিছুটা টালবাহানার পর মৃণাল লিখতে রাজি হন। ভুবন সোম বিষয়ে সত্যজিতের সমালোচনা নিয়ে তিনি লিখেছেন, “সমালোচকেরা অনুকূল মন্তব্য করেছেন, দর্শক ছবিটা পছন্দ করেছেন, আর উভয়েই ছবিটাকে ব্যতিক্রমী মনে করেছেন। স্বভাবতই আমরা খুশি। যা হোক, অনেকে বলে এর সতেজ আমেজের কারণে ভুবন সোমকে সবাই গ্রহণ করেছে। এটুকুই যথেষ্ট।”
সত্যজিতের সাত শব্দের সারাংশ একটু পাল্টে মৃণাল তাঁর ছবিকে বললেন, “Big Bad Bureaucrat Chastised by a Charmer’s Cheek”। তাঁর এই লেখাটার শিরোনাম ছিল “His Book, My Comments”।
সত্যজিৎ’র জীবনের শেষ দশকে তাঁরা দুইজন বেশ কয়েকটি কমিটিতে একসাথে কাজ করেছেন। বিভিন্ন ফিল্ম সেমিনার ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মেও তাদের কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁদের এই শীতল ও আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের খুব বেশি উন্নতি হয়নি।
শেষদিকে আরো একবার সত্যজিৎ মৃণালের দিকে আক্রমণের তীর ছুঁড়েছিলেন। যদিও অনেকে বলেন তিনি এটা প্রকাশ্যে করতে চাননি। তাঁর পুরনো বন্ধু ও বিখ্যাত চিত্রসমালোচক চিদানন্দ দাসগুপ্তকে লেখা তাঁর এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে তথাকথিত ‘আর্ট ফিল্মের’ নির্মাতারা নিজ দেশে দর্শকদের সাথে মেলবন্ধনের চেয়ে বিদেশি ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী। ‘তাঁরা কেউই গল্প বলার কৌশল জানে না, মৃণালও জানে না’, এই ছিল তাঁর বক্তব্য।
১৯৯১ সালের জুনে বন্ধুকে লেখা এই ব্যক্তিগত চিঠিটি অক্টোবর মাসে একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়ে যায় সত্যজিৎ’র অনুমতি ছাড়াই। ততোদিনে সত্যজিৎ খুবই অসুস্থ এবং বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি মৃত্যুর দিন গুনছেন। মৃণাল স্বভাবতই এই আকস্মিক আঘাতে বিচলিত হয়েছিলেন। তবে তিনি তা প্রকাশ করেননি। অনেকের প্রণোদনা থাকার পরেও পত্রিকাকে একটি অসম্ভব স্থিতধী মন্তব্য জানিয়েছিলেন।
“আমি নন্দনতত্ত্ব আর গল্প বলার শৈল্পিক দিক নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সাথে কোন তর্কে জড়াতে চাই না। তাঁর অসুস্থতায় ওষুধের পাশাপাশি মানসিক শান্তিও প্রয়োজন, এবং আমি তা কোনোভাবেই নষ্ট করতে চাই না।”
সত্যজিৎ রায়ের জবাব জানার আর কোন উপায় ছিল না। কারণ এই বিতর্কিত চিঠিটি প্রকাশের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই ১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সত্যজিৎ রায়ের অসুস্থতার পুরো সময়টায় সেন পরিবারের সবাই তাঁর পরিবারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বজায় রেখেছিলেন। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে নার্সিং হোমে সবার আগে তারাই পৌঁছেছিলেন। শেষকৃত্য শেষ হওয়া পর্যন্ত মৃণাল সেনকে দেখাচ্ছিল উদ্ভ্রান্ত, শূন্য দৃষ্টিতে তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। প্রায় দুই দশক আগে তিনি সত্যজিতকে তার একাকীত্ব নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। সেই একই একাকীত্ব যেন তাকে গ্রাস করেছে। সেই ক্লান্ত গ্রীষ্মের এপ্রিলের বিকেলে সত্যজিৎ’র মরদেহের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। একটু পরেই এই দীর্ঘাঙ্গী সত্যজিৎ’র শেষ চিহ্নটিও চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মৃণালের উপলব্ধি হলো যে এতদিন তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহে, উদ্যমে, ক্ষেপিয়ে সৃজন-উৎকর্ষের সুউচ্চ চূড়াটিতে তুলে দেয়া মানুষটি আর রইলো না।
(তথ্যসূত্র:
১- সত্যজিৎ রায়, বাবলু ভট্টাচার্য, অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্পানি।
২- Portrait of a Director: Satyajit Ray
by Marie Seton, Penguin Books.
৩- সত্যজিৎ রায়: বিশ্বজয়ী প্রতিভার বর্ণময় জীবন, অরূপ মুখোপাধ্যায়, দীপ প্রকাশন।
৪- মৃণাল সেন, আমি ও আমার সিনেমা, বাণীশিল্প (২০১৫)।
৫- মৃণাল সেন, মানিকবাবুর সঙ্গে তর্ক এখনও আমার শেষ হয়নি, ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পাদিত ‘আনন্দলোক’, ২রা মে ১৯৯৮।
৬- আজকাল পত্রিকা, ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৮ সাল।)

কনটেন্ট রাইটার, ইতিহাস নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।