| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গল্প: মুক্তি । সোমজা দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

 

 

অফিসের কাজে যেতে হয়েছিল চিত্রকোট। যাওয়া আসার টিকিট অফিস থেকেই কেটে দিয়েছে। ফেরার দিন সকাল সকাল অফিসের কাজ চুকিয়ে গেস্টহাউজে ফিরে এলাম। বিকেলবেলায় কলকাতায় ফেরার ট্রেন। কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী আমি, ফ্লাইটেই যাওয়া আসা করি। এবারে নেহাৎ শেষ মুহূর্তে চিত্রকোট আসার পরিকল্পনা হওয়ায় ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া যায়নি। অগত্যা ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট দেওয়া হয়েছে।   

এবার আমার আসার কথা ছিল না। আমার স্ত্রী অলকা সন্তানসম্ভবা, পূর্ণগর্ভা ; যে কোনও মুহূর্তে আমাদের সন্তান পৃথিবীতে আসতে পারে। এরকম সময়ে অলকাকে ছেড়ে আসতে চাইনি আমি। কিন্তু চাকরির দায় বড় দায়। যে জুনিয়র ছেলেটির আসার কথা ছিল, হঠাৎ তার মাতৃবিয়োগ হওয়ায় কোম্পানি আমায় হুড়কো দিল। যেতেই হবে। চিত্রকোটে আমাদের কোম্পানির একটা নতুন প্ল্যান্ট তৈরি হওয়ার কথাবার্তা চলছে। সেই সংক্রান্ত জরুরি মিটিং। কোনও ট্যাঁ ফোঁ চলবে না। মনটা পড়ে রইল অলকা ও আমার অনাগত সন্তানের কাছে, এবং তারা রইল আমার শ্বশুর শাশুড়ীর জিম্মায়। মা মারা গেছেন দুই বছর আগে। মা আমার সন্তানকে দেখে যেতে পারলেন না। আমি যাকে বলে পুরোপুরি ফ্যামিলিম্যান। অলকা আমার সবকিছু। এই অবস্থায় ওকে ছেড়ে আমায় আসতে হল বাঁধা টিকির টানে, এই চিত্রকোটে। আমার সবকিছু পড়ে রইল কলকাতায়।

স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছি সময়ের আগেই। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে অলকাকে ফোন করতে গিয়ে দেখি ফোনটা কখন চার্জ ফুরিয়ে সুইচ অফ হয়ে আছে। মনে পড়ল, সকালে তাড়াহুড়ো করে অফিস যাওয়ার তাড়ায় ফোন চার্জ করতে ভুলেছি। এখন আর কিছু করার নেই। ফার্স্টক্লাস কম্পার্টমেন্টে নিশ্চয়ই চার্জিং পয়েন্ট থাকবে। ট্রেনে উঠেই ফোন চার্জে বসিয়ে দেওয়া যাবে।

যথাসময়ে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। চম্বল এক্সপ্রেস, ট্রেনের নাম শুনলেই রোমাঞ্চ জাগে। সে যাক গে, আমার কলকাতায় পৌঁছানো নিয়ে কথা। ট্রেনে উঠে সিট নম্বর মিলিয়ে গুছিয়ে বসলাম। ছোট ছোট কূপে চারজন করে যাত্রীর ব্যবস্থা রয়েছে। ট্রেনে উঠে দেখলাম, আমার কূপে আমি একাই চলেছি। বেশ ক’টা স্টেশন পার করেও যখন কোনও সহযাত্রী এল না, মনে মনে আশ্বস্ত হলাম। ফোনটা চার্জে বসিয়েছিলাম। ফার্স্টক্লাস কম্পার্টমেন্টে চার্জিং পয়েন্ট আছে বৈ কি, কিন্তু আমার ভাগ্যই হোক, বা রেলওয়ের গাফিলতি, কোনও একটা কারণে সেটি দেহ রেখেছেন। সুতরাং হাওড়ায় পৌঁছনোর আগে অলকার সাথে কথা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বেচারি না জানি কতটা দুশ্চিন্তা করছে। আমার ট্রেনে ওঠার খবরটুকু পেলেও শান্তি পেত। 

রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ ট্রেন ঢুকল গয়া স্টেশনে। রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় কূপের দরজায় টোকার শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখি বিশাল লম্বা চওড়া চেহারার এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছেন। মনে মনে ভারি বিরক্ত হলাম। সাধু সন্ন্যাসীদের প্রতি কোনকালেই তেমন ভক্তিশ্রদ্ধা নেই আমার, বরং অশ্রদ্ধা আছে পুরোদস্তুর। সন্ন্যাসী নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। টিকিট মিলিয়ে সন্ন্যাসী কূপে ঢুকে এলেন। বুঝলাম, ইনিই আজকের মত আমার সহযাত্রী। সাহিত্যে, পদ্যে, সিনেমায় মধ্যরাতে ট্রেনে কত সুন্দরীর সাথে মোলাকাত হয় নায়কের। হায় রে, আমার কপালে কি না সন্ন্যাসী! সিটের উপর পা তুলে বাবু হয়ে বসলেন তিনি। কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ট্রেন চলতে শুরু করলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে শুদ্ধ হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
বললাম, “কলকাতা।”
“বাঙালি?” জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। খেয়াল করলাম, উত্তর ভারতীয়দের মত ‘বাঙ্গালি’ না বলে তিনি বাঙালি উচ্চারণ করলেন।

“হ্যাঁ”, নমস্কার করে বললাম, “ আমার নাম রাজর্ষি বসু।”   
সন্ন্যাসী এবার হাসলেন। তারপর বিশুদ্ধ বাংলায় স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, “আমার নাম স্বামী রূপেশ্বরানন্দ। ভালোই হল। অনেকদিন পরে একটু বাংলায় কথা বলা যাবে।”
আমি বললাম, “আপনিও বাঙালি বুঝি?”
সন্ন্যাসী জানলার বাইরের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর বললেন, “সন্ন্যাসীদের কোনও জাত হয় না। পূর্বাশ্রমের কথা মনে করাও পাপ।”
এসব কথা যে আমার অজানা, তা নয়। তবে এই নিয়মগুলো মন থেকে মানতে পারি না। লোকটাকে প্রথম দর্শণেই মনে যে বিরক্তির ভাবটা জেগেছিল, সেটা আবার ফিরে এল। কিছুটা তর্কের খাতিরেই বললাম, “কিছু মনে করবেন না। কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, এই যে আপনারা বলেন পূর্বাশ্রমের কথা মনে করা পাপ, জীবনের একটা অংশ কি পুরোপুরি মুছে ফেলা সম্ভব? কেউ পারে? আপনি নিজে পেরেছেন?” 
স্বামীজি রাগ করলেন না। মুখের হাসি ধরে রেখে বললেন, “মুছে কি যায় কখনও? মন তো কোনও স্লেট নয় যে ইচ্ছে হল, আর ভেজা কাপড় দিয়ে ঘষে স্মৃতি মুছে ফেললাম। কিন্তু সেই স্মৃতির গুরুত্ব হারিয়ে যায়।”
রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। মনে পড়ে গেল, আমার শৈশব, সারাটা জীবন ব্যর্থ হয়েছে এরকমই কোনও এক সন্ন্যাসীর জন্য, যেও তার পূর্বাশ্রমের স্মৃতি মুছে ফেলতে চেয়ে তার গর্ভবতী স্ত্রীকে ত্যাগ করে গিয়েছিল। বোধ হয়, গর্ভবতী স্ত্রী ও অনাগত সন্তানের গুরুত্ব হারিয়েছিল তার কাছেও। আমার মা তার যৌবনে সুখের দিনগুলিতে সংসার, শিশুপুত্রকে ঘরে ফেলে তীর্থে তীর্থে ছুটে বেরিয়েছিল সেই ত্যাগ করে যাওয়া লোকটার খোঁজে। সারা জীবনেও সেই খোঁজ শেষ হয়নি তার। খুঁজতে খুঁজতেই বুঝি না বলে কয়ে একদিন হঠাৎই ওপারে পারি দিলেন আমার দুঃখিনী মা।


স্বামীজি বোধ হয় আমার মুখ দেখে আমার ক্ষোভের আঁচ পেলেন। বললেন, “ভুল বুঝো না। গৃহী মানুষের জন্য সংসারই তার ধর্ম, গৃহই সকল তীর্থের মধ্যে সর্বোত্তম। কিন্তু যে মানুষ নিজেকে এই পৃথিবীর প্রতিটি অণু-পরমাণুতে খুঁজে পায়, পরমব্রহ্মের সাথে একাত্ম অনুভব করে, সে কী করে নিজেকে গৃহের ক্ষুদ্র গন্ডীতে বাঁধবে? এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে নিজেকে লীন করে দিতে হলে ঘরের ক্ষুদ্র বাঁধন তো ছিড়তেই হয়।” 

“কেন ছিড়তে হয়?” বিদ্রুপের হাসি হেসে উঠলাম আমি, “এই তো স্বামীজি, নিজেকেই ঠকাচ্ছেন আপনি। ঘরের চার দেওয়াল কি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের বাইরে? পুরোটাই যখন আপনার, তাহলে বন্ধন ছেঁড়ার এত আয়োজনই বা কেন?”

স্বামীজি এবার গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। ঠোঁটের কোনে হাসির ব্যাপ্তি কিছুটা সংকুচিত হল মনে হল। সেটাকে আমি নিজের জিত বলেই মনে করলাম। যারা সংসার, নিজের পরিজনদের ত্যাগ করে মোক্ষের সন্ধানে পথে নামে, একবারও ভাবে না সেই মানুষগুলোর কথা যাদের পেছনে ফেলে এল, সেই সব সাধুসন্ন্যাসীদের আমি স্বার্থপর ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। জন্ম থেকে মায়ের চোখে জল দেখে বড় হওয়া সন্তানের কাছে এই ধরণের ত্যাগের কণামাত্র মূল্য নেই।

উঠে গিয়ে টয়লেটে গেলাম। কূপে ফিরে দেখি সন্ন্যাসীঠাকুর চোখ বুজে ধ্যানাসনে বসে আছেন। আমি তাঁকে বিরক্ত না করে শোওয়ার তোরজোর করতে লাগলাম। স্বামীজি নিবিষ্ট মনে ধ্যান করছেন। এবার আমার একটু খারাপ লাগল। মনে হল নিজের মনের জমা তিক্ততা একজন সদ্যপরিচিত মানুষের উপর এভাবে ঢেলে না দিলেই হত। মনের মধ্যে সূক্ষ্ম অপরাধবোধ কাজ করছে। না জানি কী ভাবলেন উনি আমার সম্পর্কে। মিনিট দশেক পরে চোখ খুলে তাকালেন স্বামীজি। নিজের গ্লানি থেকেই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কোথায় চললেন? কলকাতায়?”

স্বামীজি আমার দিকে চাইলেন। আমার কথার জবাব না দিয়ে বললেন, “অনেক প্রশ্ন জমে আছে তোমার মনে। আজকের রাতটা আমরা সাথী, সহযাত্রী। কাল সকাল থেকে দুইজনের পথ আলাদা হয়ে যাবে। যদি খুব বেশি ঘুমের প্রয়োজন না থাকে, তাহলে একটা গল্প বলি? শুনবে?” 

সারাদিনের দৌড়ঝাপে শরীর ক্লান্ত ছিল যথেষ্টই। অলকাকে নিয়ে মনের মধ্যে অতিরিক্ত চাপ তো ছিলই। তবু কেন জানি না, সন্ন্যাসীকে মানা করতে পারলাম না। বললাম, “বলুন আপনি। শুনি আপনার গল্প।“

সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “আপনার আপত্তি না থাকলে আলোটা নিভিয়ে দিই বরং। জানলা দিয়ে বেশ চাঁদের আলো আসছে আজ।”

মনে পড়ল, আজ পূর্ণিমা। আলোটা নিভিয়ে জানলার ধার ঘেষে সিটের উপরে বসলাম। আধো আলো আঁধারিতে ট্রেনের কূপের ভিতর একটা অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। স্টেশন ছাড়ানোর পর ট্রেন গতি নিয়েছে। বাইরে প্রকৃতি পেছনে ছুটে চলেছে বিপুল বেগে। সেইদিকে তাকিয়ে সন্ন্যাসী বলতে শুরু করলেন।
 
“সময়টা আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে। আমি তখন হরিদ্বারে আমার গুরুদেবের আশ্রমে থেকে ব্রহ্মচর্য পালন করছি। বারো বছর কঠোর ব্রহ্মচর্যযাপনের পর আমার গুরুদেব আমায় ডেকে জানালেন, আমার ব্রহ্মচর্য সমাধা হয়েছে। এখন আমি সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, আমি সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য মন থেকে প্রস্তুত কি না। আমি সম্মতি জানালাম। গুরুদেব বললেন, সম্পূর্ণরূপে সন্ন্যাসজীবনে প্রবেশ করার আগে পূর্বাশ্রমকে বিদায় জানাতে হবে। একবারের জন্য যেন আমি সংসারে ফিরে যাই। নিজের হৃদয়ের পরীক্ষা নিয়ে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে ফিরে এলে আমি সন্ন্যাস গ্রহনের যোগ্য বলে বিবেচিত হব। 

“নির্দিষ্ট দিনে রওনা হলাম। গোয়ালিয়রে আমাদের আশ্রমের একটা শাখা আছে। সেখানে দুদিন থাকতে হল গুরুদেব নির্দেশিত একটা কাজের জন্য। সেই দুইদিনে নিজেকে প্রশ্ন করলাম বারবার, আমি কি সত্যিই ফিরে যেতে চাই? অনুভব করলাম, আমার হৃদয় দ্বিধাবিভক্ত। মনের একটা অংশ আমায় টানছে আমার আপনজনেদের দিকে। আমি তাদের প্রতি আজ বারো বছর পরে দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করছি। আরেকটা অংশ আমায় সাবধান করছে, বাধা দিচ্ছে ফিরে যেতে। মনে বেশ বুঝছি গত বারো বছরের আমার সাধনা মিথ্যে হয়ে যেতে পারে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে। একবার মায়া কাটিয়ে এসেছি। দ্বিতীয়বার যদি ফিরতে না পারি?
কী করব, যাব কি যাব না ভাবনার মধ্যেই নির্দিষ্ট দিনে ট্রেনে উঠে বসলাম আমি।

“সেদিনটাও ছিল আজকেরই মত। ট্রেন এগিয়ে চলেছে হুহু করে। গাছপালা, বাড়ি ঘর, নদী মানুষ তীব্র বেগে ছুটে চলেছে পেছনের দিকে। আমি এগিয়ে চলেছি আমার ফেলে আসা জীবনের দিকে। সে যে কী তীব্র আকর্ষণ, বলে বোঝাতে পারব না তোমায়। একসময় সিদ্ধান্ত নিলাম, আর নয়। অনেক হয়েছে এই ব্রহ্মচর্য, সন্ন্যাস। এবার ফিরে যাব আমার ঘরে, আমার আপনজনেদের কাছে। আমার স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইলে সে কি আমায় ক্ষমা করবে না? আমার সন্তান কি গ্রহন করবে না আমায়। রাত গভীর হল। ট্রেনের ঝাকুনিতেও শান্তির ঘুম ঘুমোলাম বহুদিন পর।    

“মধ্যরাতে তীব্র ঝাকুনি ও ভয়ঙ্কর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। জানলা দিয়ে আগুনের হলকা ছুটে এল ট্রেনের ভিতরে। টের পেলাম, প্রচন্ড ধাক্কায় শূণ্যে উড়ে চলেছি আমি। তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলাম খোলা প্রান্তরে রেললাইনের পাশে শুয়ে আছি আমি। আমার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃত ও অর্ধমৃত অসংখ্য দেহ। গ্রামবাসীরা রেলকর্মী ও পুলিশের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে উদ্ধারকাজে নেমেছে৷ ট্রেনের ভিতরে তখনও আটকে গেছে অসংখ্য জীবিত ও মৃত মানুষ। ট্রেনের ধাতব দেহ কেটে তাদের বার করার চেষ্টা চলছে। রাত ফুরিয়ে এসেছে। আকাশের দিকে চোখ মেলে চাইলাম আমি। পূবাকাশে ছড়িয়ে পড়েছে অপরূপ রক্তিমাভা৷ পাখিরা রোজকার মতন কলতান করে ঘোষণা করছে নতুন দিনে প্রারম্ভ।  

“সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম, জীবন নিয়ত সঞ্চরনশীল। কারও জন্য পৃথিবীর গতি স্তব্দ হয় না। থেমে যায় না কিছুই। আমরা পৃথিবীতে আসি নিজের নিজের ভাগের কর্তব্যটুকু করতে। তারপর নিজেরাই নিজেদের গড়া মোহের নিগড়ে বন্দী হয়ে যাই। চারপাশে পড়ে আছে অসংখ্য দেহ, যাদের আর ফেরা হবে না নিজেদের আপনজনেদের কাছে। কই, তবু তো থামছে না কিছুই? তবু তো সূর্য উঠছে, পাখি ডাকছে। জীবন বয়ে চলেছে নিরবচ্ছিন্ন গতিতে। সেইদিন সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম মুক্তির অর্থ। ফিরে গেলাম গুরুদেবের কাছে। বললাম, আমি প্রস্তুত। সব ছিন্ন করে এসেছি। গুরুদেব হাসলেন। বললেন, সব বাঁধন ছিন্ন করা কি এত সহজ? যাই হোক, তোমাকে সন্ন্যাসে দীক্ষিত করব আমি। কোন অচ্ছেদ্য সুতো এখনো রয়ে গেছে, তা খুঁজে বের করার জন্য সারাটা জীবন তো রইলই।” 

“খুঁজে পেয়েছেন?” জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

সন্ন্যাসী জানলার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “বোধ হয়!”

আর কথা বাড়ালাম না। বিছানা বালিশ পাতাই ছিল। আমার সামনের পর্দাটা টেনে শুয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। হঠাৎ তীব্র বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করলাম। আগুনের হলকা আর তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ কান ধাঁধিয়ে গেল। জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহূর্তে টের পেলাম, দুটি বলিষ্ঠ দৃঢ় বাহু আমায় পরম স্নেহে কোলে তুলে নিয়েছে। কানের কাছে মুখ এনে তিনি নরম স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন, “আজ আমি সেই সুতো খুঁজে পেয়েছি। হৃদয়ের বাঁধন বড় শক্ত, না ছিড়তে পারলে মুক্তি মেলে না। সেই বাঁধনের বড় টান। সেই টানেই মানুষ বারবার ফিরে আসে আপন রক্তের কাছে, ভালবাসার কাছে।” 
 
এরপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরল হাসপাতালের বিছানায়, দুই দিন পরে। খবর পেয়ে আমার শ্বশুরমশাই এসেছেন। তার মুখে শুনলাম, রেল দুর্ঘটনার খবর পেয়ে অলকা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। হঠাৎই শুরু হয়েছিল ওর প্রসব বেদনা। সেই সময় এক সন্ন্যাসী বাড়িতে এসে খবর দেন, আমি নিরাপদ, সুস্থ আছি। আর দাঁড়াননি সন্ন্যাসী। অলকাকে নিয়ে সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সন্ন্যাসীকে নিয়ে আর কেউ ভাবার সময় পাননি। অলকা আমার দুর্ঘটনার রাতেই এক শিশুপুত্রের জন্ম দিয়েছে। মা ও শিশু দুজনেই ভাল আছে। আমি সেই মুহূর্তে মনে মনে হিসেব করলাম এই স্থান থেকে কলকাতার দূরত্ব। স্বামীজি সেদিন রাতে শুধু আমার প্রাণরক্ষাই করেননি। আমার স্ত্রী ও সন্তানকেও বাঁচিয়েছেন সেই একই রাতে, একই সময়ে। আমার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা খেলে গেল। খুব শান্তিতে চোখ বুজলাম আমি। শুধু না জানি কেন, চোখের কোন থেকে গড়িয়ে আসা জলের বিন্দুটাকে আটকাতে পারলাম না, অথবা আটকাতে চাইলাম না। 








error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত