| 6 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৭) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 চাপানউতোর

 

প্লেনে করে আজকাল এদেশে কোথাও একটু দূরে বেড়াতে গেলেই রাণীয়ার মন কেঁদে ওঠে নিজের দেশের জন্য। আবার কবে দেশে যাবে সে? সেখানে গেলেও উভয়সংকট। আর যদি ফিরতে না পারে? ভিসার চক্করে পড়ে যায় যদি? কুশলকে ছেড়ে থাকতেও মন চায়না বেশিদিন। কুশল নাহয় এখনই দেশে যেতে পারছে না কিন্তু সে তো যেতেই পারে। নাহ! এত ঝামেলায় কাজ নেই। কুশলের প্রজেক্ট শেষ হলেই একেবারে যাবে তবে। কিন্তু কুশলের ভিসা স্ট্যেটাস দোদুল্যমান। গ্রিন কার্ড হলে তবে নিশ্চিন্ত হবে ওরা, যাওয়া আসায় আর প্রব্লেম হবেনা। ততক্ষণ এই টেনশন চলতেই থাকবে। ওদিকে মা বাবারা বুড়িয়ে যায়। ক্রমশই অক্ষম হয়ে পড়েন। কিন্তু কিছুই করার নেই তাদের। এর নাম আক্ষরিক অর্থেই হেল্পলেস।

কোথাও দু’ চারটে দিন বেড়াতে বেরিয়ে নিজের ডেরায় ফিরতে গিয়েও সেই একই কষ্ট রাণীয়ার। ঘরে ফেরার গান গাইতেও বড় কষ্ট হয়। মা, বাবার জন্য মন কেমন করে ওঠে। তোলপাড় মন। উথালপাথাল যেন। আবার দিন কয়েক পর নিজের প্রিয় ঘরটির মধ্যে ফিরতেও চায় মন।সেঁধিয়ে যায় ঘরের ভেতরে। নিজের আদরের, যত্নের সেই একলা মহল। রান্নার পডকাস্ট এর অডিও রেকর্ডিং, চ্যানেলের ভিডিও শুট এসবের মধ্যেই নিজেকে বন্দী করে ফেলতে হবে রাণীয়া কে। মা বাবা খুব চাইছে এবার তাদের সন্তান আসুক একটা। মিঠি নাহয় বিশাল চাকুরে কিন্তু রাণীয়ারও এইবার একটা ইস্যু হতেই পারে । রাণীয়ার এখুনি ইচ্ছে নেই। সে বলে দিদির এখনও কিছু হলনা, আমি তো ওর চেয়ে ছ’ বছরের ছোটো। আমাদের এখুনি কেন বাচ্চাকাচ্চা নিতে হবে? আর দিদির চাকরীটা বড় কাজ আর আমার কাজটা ছোটো বুঝি?

মা ভাবেন, এই এক হয়েছে এখনকার ছেলেপুলেদের। বিয়েই হোক বা লিভ টুগেদার কেউ বাচ্চাকাচ্চার ঝামেলা নিতে চায়না। বলে বেশ তো আছি। জাপানে দেখ। অত উন্নত দেশ। সেখানে লোকসংখ্যা র‍্যাপিডলি কমে যাচ্ছে। সবাই ব্যস্ত যার যার কেরিয়ার নিয়ে।কারোর সময় নেই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভাবার। আমার জীবন আমারই। যতদিন সময় পাচ্ছি শুধু কাজ আর কাজ। সেইসঙ্গে বিশ্ব দর্শন। কতকিছু করার আছে বাকী! কতকিছু দেখা হয়নি এখনো। এ জীবন চলে গেলে, ও সোনামন… হেসে গান গেয়ে ওঠে রাণীয়া।
অনসূয়া বলেন, কিন্তু লাইফ সাইকেলটা কমপ্লিট হবে কী করে? বাচ্চা না নিলে! আমাদের অবর্তমানে তোদের কে দেখবে? কে থাকবে? রক্তের সম্পর্কের কে থাকবে তখন? একথা ভিডিও কলে মা বললে দুই মেয়েই ঠোঁট ওল্টায়। একটাই তো জীবন মা। লেটস লিভ অ্যান্ড হ্যাভ ফান। রাণীয়া সেদিন বলল, বাচ্ছাকাচ্ছা হলেই যে বাবা মা’কে দেখবে সেটা খুব সত্যি কী মা?
অনসূয়া ভাবে, তা ঠিক তবে আমাদেরও তো ইচ্ছে করে।মিঠি অমনি ঝাঝিয়ে উঠে বলে, তোমাদের ইচ্ছেগুলোকে আমাদের ওপর ইম্পোজ করাটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না মা।
মা ভাবেন সেই এক কথা। রাণীয়ার নাহয় বয়স টা কম কিন্তু মিঠির এটা হাই টাইম টু হ্যাভ আ কিড।
মা বলেন, তারপর বয়সটা বেড়ে গেলে কমপ্লিকেশন হবে। তখন আফসোসের শেষ থাকবেনা কিন্তু। মিঠি বলে, কাম অন মা! হলে দেখা যাবে। এসব নিয়ে ভেবোনা এত।
ছোটোমেয়েটার এমনিতেই চিরকাল পলিসিস্টিক ওভারি। একটা বাচ্চা নিলেই সব সেরে যেত। বলেছিল অনসূয়ার এক গাইনি ডাক্তার বন্ধু। কিন্তু এখুনি মেয়ে নারাজ। দিদির তো আগে হোক। দিদি কে বলো। দুহাত জোড় করে ভিডিও তে বলে সে “আই বেগ অফ ইউ মা”
মায়ের মুড অফ হয়ে যায় এক্কেবারে। ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস।
মা ভাবেন, মেয়েদের হায়ার স্টাডিজ করে এইসব হাল হল। সব মেয়েদের মুখে এক রব। তারপর কোথা না কোথা থেকে একটা বাচ্চা এনে মানুষ করবে। অ্যাডপশনে যে এরা কী মজা পায় জানিনা। মানছি অ্যাডপ্ট করা বিশাল মহৎ এক কাজ। সামাজিক দায়িত্ব। কিন্তু বত্রিশ নাড়ী না ছিঁড়ে সব মেয়েরা ঝামেলা না পুইয়ে কানাইয়ের মা হতে চায় এখন। রক্তের সম্পর্ক কে কেয়ার করে না। ওইজন্য্যেই বলে, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাকায় করে টাশটাশ।
মেয়েদের মুখে যুক্তির ভেলকি! হোয়াট ডু ইউ মিন? রক্তের সম্পর্কই শেষ কথা? মোটেও না। তাহলে ছেলেরা তাদের মা’কে আজ ঘরে ঘরে ওল্ড এজ হোমে রেখে আসত না।
অনসূয়া নিজের মনে ভাবতে থাকেন। তোরা সব বুঝে গেছিস যেন। পরক্ষণেই মনে হয় তাঁর। এমনি হয় বুঝি। তাঁর দুই মেয়ের কেমিস্ট্রি বিয়ের আগে একরকম ছিল। বিয়ের পরেও সবকিছুই ঠিক ছিল। ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে সব। মিঠি আর রাণীয়ার সম্পর্কের মধ্যে কোথাও যেন একটু হলেও শূন্যতা লক্ষ্য করছেন তিনি। হয়ত তাঁর মনের ভুল। তাই যেন হয়। তবে তিনি তো ওদের মা। নিজের পেটে ধরেছেন দুটিকেই। তাঁর কী এতটা ভুল হবে?


আরো পড়ুন: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৬) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


ছোটবেলায় এসব বোঝার সময় ছিলনা। দুজন কে ভালো করে মানুষ করে তুলতে তুলতেই ইস্পাতনগরীর জীবন ছিল কর্মময়তায়। রুটিন লাইফ। সুইস ক্লকের মত প্রিসিশন সেই রোজনামচায়। একদিকে ওদের বাবার ইস্পাত কারখানায় বড় চাকরি আর অন্যদিকে দুইমেয়ে। পড়াশোনা, গান বাজনা, সাঁতার, আবৃত্তির ওয়ার্কশপ। একেবারে থইথই টাইম টেবিল। নিজের জীবন বলতে মাঝেমধ্যে মেয়েদের নিয়ে কলকাতায় শ্বশুরবাড়ি, বাপেরবাড়ি। জামশেদপুরের লেডিজ ক্লাব, আর নামকরা সব ক্লাবের পার্টি…এসব। সেইসঙ্গে ছিল বেড়ানো আর রান্না, ভালো বই পড়া। স্টিল কোম্পানির অফিস লাইব্রেরীতে বাংলা গল্প-উপন্যাসেরও বিস্তর সম্ভার ছিল। ভদ্রলোক নিয়ম করে এনে দিতেন।
ঠিকই বলেছে মেয়েরা। রক্তের সম্পর্কই শেষ কথা নয়। নয়ত মিঠি রাণীয়াকে এখন ঈর্ষা করতে শুরু করে? ছোটবেলায় অবিশ্যি একদিন বোনের প্লেট থেকে বড় মাছ টা তুলে নিয়ে সে বলেছিল, আমায় কেন ছোটোটা দিলে? আমি বড় ওর চেয়ে। বড়টা তো আমিই খাবো। আজ এতদিন বাদে এসব পুরনো কথা মনে পড়ছে তাঁর।
আরেকদিন মেয়েদের বাবা ছোটোমেয়ের জন্মদিনে একটা মস্ত পুতুল আনতে মিঠির সে কী কান্না! তুমি বোন কে বেশী ভালোবাসো… এই বলে। পরদিনেই আবারও বিষ্টুপুর মার্কেট থেকে অমন আইডেন্টিকাল পুতুল এনে দিতে হয়েছিল বাবা কে। মিঠির এত রাগ ছিল তবে? ওদের পড়াশুনোর চাপে এসব থিতিয়ে পড়েছিল। মায়ের বা বাবার কারোর খেয়াল ছিলনা এসব নিয়ে মাথা ঘামানোয়।

এসব ভেবেই অনসূয়া মনে মনে আবারও বিড়বিড় করলেন। রাণীয়ার আমার ছোটো থেকে কোনও চাহিদা ছিলনা। মিঠি পড়াশুনোয় ভালো ছিল বেশী। তাই ওকে সায়েন্স নিতে বলেছিল স্কুল থেকে। আইআইটিতে চান্স পাবার জন্য বেশ দামী টিউশন দিতে বাবা কে অনেক খরচ করতে হয়েছে। তাইজন্যই না আজ সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে আর অত বড় চাকরি করছে। পড়াশুনো, হস্টেল, চাকরী, বিয়ে সবের মধ্যে যেন মিঠি ভুলে গেছে পরম আনন্দে ছোট্ট বোন রাণীয়াকে নিজের হাতে সুজির পায়েস খাইয়ে দেওয়ার দিন। “ও মা আমায় দাও” বলে কেড়ে নিয়েছিল। তারপর থেকে বোনের দাঁত উঠতে বিস্কিট ক্রাশ করে কলা আর মধু মেড়ে দিয়ে মা ধরিয়ে দিত মিঠির হাতে। “নে বোন কে খাইয়ে দে। খুব ধীরে ধীরে…অল্প করে দিবি কিন্তু” মিঠির ভালো লাগতো বোনের পাগলে পাগলে খাওয়াটা।
তবে একদিন মেয়ের হাতে আসত একটা কলা ধরিয়ে দিয়ে তিনি রান্নাঘরে চলে গেছেন। এসে দেখেন রাণীয়া নিজের মনে খেলছে আর মিঠি খাচ্ছে সেই কলা। খুব রেগে গেছিলেন অনসূয়া সেদিন। বোনের থেকে তুই ছ’ বছরের বড়। তুই তো আমাদের সঙ্গে সবকিছু খাচ্ছিস। ওর খাবারটা ওকে খেতে না দিলে বোনের পুষ্টি হবে কোথা থেকে? মিঠি বলেছিল, আমার খিদে পেয়েছিল তো। আর বোন খাচ্ছিল না তাই…
সেদিনই বোঝা উচিত ছিল মায়ের। আসলে মায়েদের মন কখনও খারাপটা ভাবে না। নিজের সন্তানদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে মোটেও কু গায় না তাদের । তারা তখন এসব দেখে ভাবে, ছোটো তো। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে কিছুই ঠিক হয়না। যা হবার তাই হয়। কপালে যা থাকে তাই হয়। ওই যে কথাতেই বলে না? উঠুন্তি মুলো তার পত্তনেই চেনা যায়। মিঠি চিরকালই এমন কুটনি স্বভাবের। রাণীয়া ভোলাভালা। মিঠি এখনও তেমনি। রাণীয়ার কোনও হেলদোল নেই এসবে।

অথচ দিদির টিউশনে বাবা এত খরচা করল, দিদি কে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হল আর রাণীয়ার বেলায় বাবা মায়ের তেমন আর উৎসাহ নেই এসব নিয়ে সে মাথায় ঘামায়নি কখনও। কোলের মেয়ে কাছেই থাকুক, সেই ভেবে মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ার করতে চাননি হয়ত তারা। রাণীয়া একটু ঘরোয়া স্বভাবের চিরকাল। ছোটো থেকেই দিদি কে পড়াশুনো নিয়ে থাকতে দেখে সে দিব্যি নিজের পড়াশুনোটা মন দিয়ে করত। সেই অর্থে দুই মেয়ে নিয়ে অনসূয়ার কোনও জ্বালা ছিল না। রাণীয়া আপসে যেন দিদির দেখাদেখি সব শিখে গেল। মানুষ হয়ে গেল । সায়েন্স পড়েছিল সে ও কিন্তু বাবা কিছুটা ব্রেন ওয়াশ করেছিলেন। একজন মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে। সে দূরে চলে যাবে চাকরী সূত্রে। সেইজন্যই হয়ত রাণীয়া কে জেনারেল স্ট্রীমে পড়তে উৎসাহ দিলেন তিনি। এ অন্তত কাছে থাকবে। তার ফলে যেটা হল সেটা রাণীয়ার পক্ষেই ভালো। মা, দিদিমা, ঠাকুমা কে পেল অনেক গুলো বছর। তৈরী হয়ে গেল সে। কিন্তু এই নিয়ে রাণীয়ার মধ্যে আজ অবধি কোনও আক্ষেপ লক্ষ্য করেন নি অনসূয়া বা তাঁর স্বামী। দিদির জন্যে এত খরচখরচা করে দিদিকে স্পেশ্যাল টিউশন দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছ… এমন কথা কস্মিনকালেও সে মেয়ের মুখ দিয়ে বেরুবে না। অনসূয়া তা জানেন। ছোটোমেয়েটা কে তিনি খুব ভালো চেনেন। তা সে ইঞ্জিনিয়ার বাবা তাঁর ইঞ্জিনিয়ার মেয়ের দিকে যতই ঝোল টেনে কথা বলুন না কেন।
ওই যে আগেই বলেছি রাণীয়ার বুক ফেটে গেলেও মুখ আর ফুটল না… সে পরিস্থিতি আয়ত্ত্বে না থাকলে গুণ গুণ করে গেয়ে ওঠে নিজের মনে। শান্তি পাবে বলে।
অস্তরগ্লানি সংসারভার, পলক ফেলিতে কোথা একাকার / জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার, রাখিবারে যদি পাই…

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত